| 16 এপ্রিল 2024
Categories
রাজনীতি

শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি বিজড়িত কলকাতার বেকার হোস্টেল

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

অমিতাভ ভট্টশালী


সালটা ১৯৪৬, ফেব্রুয়ারি মাস। ৭৪ বছর আগের ঘটনা।
 
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের সামনে দিয়ে কয়েকজন ছাত্র বন্ধুর সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছিলেন স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সম্পাদক নীহার রঞ্জন চক্রবর্তী।
 
সেটা ছিল রশিদ আলি দিবস। ক্যাপ্টেন রশিদ আলি ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের সদস্য। তাঁর গ্রেপ্তারী আর কারাদণ্ডের আদেশের বিরুদ্ধে ১১ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় ব্যাপক গণ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল।
 
“রশিদ আলি দিবসে মুজিবকে দেখেছি খুব প্রমিনেন্ট রোল প্লে করতে। আমি নিজেও একদিন লালবাজারে কলকাতা পুলিশের সদর দপ্তরের সামনে বিক্ষোভে লাঠির বাড়ি খেলাম। তারপর একদিন মেডিক্যাল কলেজের সামনে দিয়ে আমরা কয়েকজন হেঁটে ফিরছি। হঠাৎ দেখি মুজিব। এসে বলল, কার্ফু দিয়ে দিয়েছে। এবার চলে যান। ব্যাটারা গুলি করতে পারে। সে অন্য কোথাও চলে গেল, আর আমরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছনে আইন কলেজ হোস্টেলে চলে গেলাম,” বলছিলেন নীহার রঞ্জন চক্রবর্তী।
 
মিস্টার চক্রবর্তীর বয়স এখন ৯৬। অনেক কিছুই আর স্মরণে নেই। কথা বলতে বলতে হঠাৎ মনে পড়ে যাচ্ছিল কোনও ঘটনা। যেভাবে তার মনে পড়ল শেখ মুজিবুর রহমান যে একদিন তাদের সাবধান করে দিয়েছিলেন গুলি চলতে পারে বলে।
 
সম্প্রতি একটি সারাটা দিন মধ্য কলকাতার নানা এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছি, যেসব জায়গা বা ভবন শেখ মুজিবুর রহমানের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, সেখানে।
 
সবশেষে গিয়েছিলাম মি. চক্রবর্তীর বাড়িতে। চারদিকে সব অ্যান্টিক জিনিষপত্র সাজানো। একটা পালঙ্ক, যেটি তৈরি হয়েছিল ১৮৬৫ সালে।
 
একটা ঝাড়বাতি ১৮৩৮ সালে রাণী ভিক্টোরিয়ার অভিষেকের বছরের। ইংল্যান্ডের একটি কোম্পানি সেই অভিষেককে স্মরণীয় করে রাখতে তৈরি করেছিল মাত্র কয়েকটি ওই ঝাড়বাতি।
 
এরকমই একটা ঘরে বসে ছিলেন নীহার রঞ্জন চক্রবর্তী। শেখ মুজিবুর রহমান যখন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র, একই সঙ্গে মুসলিম লীগ আর ছাত্র লীগের সংগঠক, সেই সময়েই ছাত্র রাজনীতি করছেন মি. চক্রবর্তীও।
 
আদতে কুমিল্লার মানুষ। তাই সেখান থেকে আসা ইসলামিয়া কলেজের অনেক ছাত্র আর বেকার হোস্টেলের বোর্ডারদের সঙ্গে পুরনো বন্ধুত্ব তার।
 
তাই মাঝে মাঝেই শেখ মুজিবুর রহমানের হোস্টেলে যাওয়া আসা – চেনা পরিচিতি – আলাপ।
 
“ইলিয়ট হোস্টেল আর বেকার হোস্টেল পাশাপাশি, আমরা ঠাট্টা করে বলতাম ইডিয়ট হোস্টেল”, অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে নিজেই লিখেছেন শেখ মুজিবুর রহমান।
 
“সে যে বছর ইসলামিয়া কলেজের স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সেক্রেটারি, আমিও সেবছরই স্কটিশ চার্চ কলেজের সেক্রেটারি হতে কিছুটা বাধ্য হই দাদাদের কথায়। ওদের কলেজে আমার বন্ধুবান্ধবের কাছে শুনতাম খুব শক্তিশালী সংগঠক ছিল। কলেজ ইউনিয়নটা নাকি খুব ভাল চালাতো,” পুরনো দিনের কথা মনে পড়ছিল নীহার রঞ্জন চক্রবর্তীর।
 
মি. চক্রবর্তীর কথা শোনার আগে সেদিন দুপুরেই গিয়েছিলাম মৌলানা আজাদ কলেজে। ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজের নাম দুবার পাল্টিয়েছে। প্রথমে এটাই ছিল ইসলামিয়া কলেজ, যেখানে শেখ মুজিব পড়তে এসেছিলেন। তারপরে ১৯৪৭ সালে দ্বিতীয়বার নাম পাল্টিয়ে হয় সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজ।
 
 
মৌলানা আজাদ কলেজ। তবে শেখ মুজিবুর রহমান যখন এখানে পড়তে এসেছিলেন, তখন নাম ছিল ইসলামিয়া কলেজ।
১৯৬০ সাল থেকে মৌলানা আজাদ কলেজ। কলকাতার নামকরা সরকারি কলেজগুলির একটি।
 
কলেজের দোতলায় দুটো বোর্ড আছে ছাত্র ইউনিয়নের সম্পাদকদের নাম লেখা। ‘বার্মা টিক’ কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো বোর্ডে রয়েছে সেই প্রথম বছর থেকে কারা ছাত্র ইউনিয়নের সম্পাদক ছিলেন।
 
১৯৪৫-৪৬ সালের পাশে লেখা আছে ‘এম রহমান’।
 
ওই বছরের সম্পাদকের পুরো নামটা যদি লেখা থাকত, তাহলে সেটা হত শেখ মুজিবুর রহমান।
 
বর্তমানে ছাত্র ইউনিয়নের প্রধান মুহম্মদ জীশান। অর্থনীতির ছাত্র।
 
“আমি যখন এই কলেজে ভর্তির সুযোগ পাই, তখনই আমার বড়ভাই বলে যে এখানেই আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুও পড়তেন। আমি যে কলেজে পড়ছি, সেখানেই তিনিও পড়েছেন, এতে যে আমার কতটা গর্ব হয়, বোঝানো কঠিন,” বলছিলেন মৌলানা আজাদ কলেজের বাংলাদেশি ছাত্র নাজমুল হক আবিদ।
 
কলেজে শেখ মুজিবুর রহমানের উত্তরসূরি হিসাবে গর্বিত বর্তমান সময়ের কয়েকজন ছাত্রী আলিয়া সুলতানা, সহেলী দাস বা সরসী দত্ত মজুমদারও।
 
কলেজে পড়লেও খুব একটা বেশি পড়াশোনা করার সময় ছিল না শেখ মুজিবুরের।
 
আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “কলেজে যখন ক্লাস করতে যেতাম প্রফেসর সাহেবরা জানতেন, আর দু’একজন বলতেনও, ‘কি সময় পেয়েছো কলেজে আসতে?’ আমি কোনো উত্তর না দিয়ে নিজেই হাসতাম, সহপাঠীরাও হাসতো। পড়তে চাইলেই কি আর লেখাপড়া করা যায়! ক্যাবিনেট মিশন তখন ভারতবর্ষে। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ তাদের দাবি নিয়ে আলোচনা করছে ক্যাবিনেট মিশনের সাথে। আমরাও পাকিস্তান না মানলে, কোনোকিছু মানব না। মুসলিম লীগ ও মিল্লাত অফিসে রোজ চায়ের কাপে ঝড় উঠত।”
 
বেকার হোস্টেলের তিনতলার ২৪ নম্বর ঘরে থাকতেন শেখ মুজিব। সেটিকে এখন জাদুঘর করা হয়েছে, নাম দেওয়া হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি কক্ষ’। সেখানে রয়েছে নানা স্মৃতিচিহ্ন, বই, ছবি।
কলেজ চত্বরে দাঁড়িয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ছাত্র ইউনিয়নের সম্পাদক হওয়ার কথা আর তার ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা বলতেই লজ্জিত হয়ে মুহম্মদ জীশান বললেন, “কোথায় উনি আর কোথায় আমি! এটা ঠিকই উনি আমাদের কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের প্রধান ছিলেন আর এখন আমি সেই ইউনিয়নের প্রধান, এজন্য গর্ব তো হয়ই। তবে তাঁর সঙ্গে আমার তুলনা হয় নাকি! উনি তো আমার, আমাদের সবার আইডল।”
 
নাজমুল হক আবিদ থাকেন সেই বেকার হোস্টেলে, যেখানে তিনতলার ২৪ নম্বর ঘরে থাকতেন শেখ মুজিব।
 
হোস্টেলের প্রাক্তন এই বোর্ডারের ঘরটিকে সংরক্ষণ করা হয়েছে। নাম দেওয়া হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি কক্ষ’।
 
হোস্টেলের সুপারিন্টেনডেন্ট সৈয়দ শাহ মারহুনুল ইরশাদ আল কাদরি নিয়ে গিয়েছিলেন সেই মিউজিয়ামটা দেখাতে।
 
“উনি থাকতেন ২৪ নম্বর রুমে। কিন্তু ঘরটা এতই ছোট, যে আমরা পাশের ২৩ নম্বরটিকেও সংযোজন করে একটা মিউজিয়াম বানিয়েছি। এখানে যে চেয়ার, পড়ার টেবিল, খাট, আলমারি আছে, এগুলো তাঁরই ব্যবহার করা। এগুলোতে তাঁর ছোঁয়া লেগে আছে। হোস্টেলের সুপার হিসাবে এই ঘরের রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারাটা আমার কাছে ভীষণ গর্বের,” বলছিলেন অধ্যাপক আলকাদরি।
 
স্মৃতি কক্ষে যেমন শেখ মুজিবুর রহমানের একটি আবক্ষ মূর্তি আছে, তেমনই আছে অনেক ছবি আর তাঁকে নিয়ে লেখা বই।
 
চোখে পড়ল ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’টিও সাজানো রয়েছে।
 
অধ্যাপক আলকাদরি বলছিলেন, “কী অদ্ভুত দেখুন। এই ঘরে থাকার সময়কার অভিজ্ঞতা তিনি লিখে গেছেন, আর সেই ঘরেই তাঁর সেই লেখা বই রয়েছে।”
 
ওই হোস্টেলেই মাঝে মাঝে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন নীহার রঞ্জন চক্রবর্তী। দেখা হত শেখ মুজিবুরের সঙ্গেও।
 
“হোস্টেলে কার অসুখ, কার কী সমস্যা, সব ওর জানা থাকত। ওর ব্যবহারটা খুবই ভাল ছিল বলে সকলের সঙ্গেই ভাব জমিয়ে ফেলতে পারত। মুসলিম লীগ করত ঠিকই, কিন্তু খুব লিবারেল ছিল। সোহরাওয়ার্দীকে খুব মান্য করত ও।”
 
মুসলিম লীগের দপ্তরটা সে সময়ে ঠিক কোথায় ছিল, তা আর মনে করতে পারলেন না মি. চক্রবর্তী।
 
একটা ঠিকানা খুঁজে পেয়েছিলাম – ২ আর ৩ নম্বর ওয়েলেসলি ফার্স্ট লেন।
 
ওই ঠিকানাটাই যে সঠিক, সেটা নিশ্চিত করলেন তথ্য চিত্র নির্মাতা সৌমিত্র ঘোষ দস্তিদার।
 
ভারত ভাগ হওয়া নিয়ে একটি তথ্যচিত্র করতে গিয়ে সেই সময়ের মুসলিম লীগ রাজনীতির নানা তথ্য খুঁজে বার করেছেন তিনি।
 
নিজেই নিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে সেখানে।
 
পুরনো ২ নম্বর বাড়িটা ভেঙ্গে সেখানে এখন বহুতল উঠেছে। তবে ৩ নম্বর বাড়িটা আছে সেই পুরনো কলেবরেই।
 
“এই যে ২ আর ৩ নম্বর বাড়ি দুটো – এখান থেকে মুসলিম লীগের সব কাজকর্ম চলত, পত্রিকা বের হত। আর শুধু এই গলি নয়। শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে ছিল এই অঞ্চলের আরও নানা রাস্তায় – যেমন রিপন স্ট্রীট, আলিমুদ্দিন স্ট্রীট। তার সাংগঠনিক ক্ষমতার যে উন্মেষ আমরা পরে দেখেছি, তার শুরুটা কিন্তু এখানেই। তিনি যখন এইসব এলাকায় কাজ করছেন, তখন উত্তাল হয়ে উঠেছে উপমহাদেশের রাজনীতি। ভাবুন, এই রাস্তা দিয়ে পাকিস্তানের দাবী নিয়ে আলোচনা করতে করতে হাঁটছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর তাঁর তরুণ শিষ্য শেখ মুজিব!” বলছিলেন মি. ঘোষ দস্তিদার।
 
১৯৪৬-এর কলকাতার ভয়াবহ দাঙ্গা, যা ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ নামে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছে, সেই সময়েও এই সব অলিতে গলিতে তরুণ শেখ মুজিবুর ছুটে বেরিয়েছেন।
 
কখনও হিন্দু পরিবারকে উদ্ধার করে ব্যবস্থা করছেন হিন্দু এলাকায় পাঠানোর, কখনও মুসলমান ছাত্রদের হোস্টেলে গিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন।
 
অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে সেই দাঙ্গার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, “জিন্নাহ সাহেব ১৬ আগস্ট তারিখে ‘ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে’ ঘোষণা করলেন। … কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার নেতারা এই ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’, তাদের বিরুদ্ধে ঘোষণা করা হয়েছে বলে বিবৃতি দিতে শুরু করলেন।.. সোহরাওয়ার্দী সাহেব তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী। তিনিও বলে দিলেন ‘শান্তিপূর্ণভাবে যেন এই দিনটা পালন করা হয়।”
 
“১৬ আগস্ট কলকাতার গড়ের মাঠে সভা হবে। … কলকাতার মুসলমান ছাত্ররা ইসলামিয়া কলেজে সকাল দশটায় জড়ো হবে। আমার উপর ভার দেওয়া হল ইসলামিয়া কলেজে থাকতে। শুধু সকাল সাতটায় আমরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব মুসলিম লীগের পতাকা উত্তোলন করতে। আমি ও নূরুদ্দিন সাইকেলে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত হলাম। পতাকা উত্তোলন করলাম। কেউই আমাদের বাধা দিল না। আমরা চলে আসার পরে পতাকা নামিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল শুনেছিলাম। আমরা কলেজ স্ট্রিট থেকে বউবাজার হয়ে আবার ইসলামিয়া কলেজে ফিরে এলাম।… আর যদি আধা ঘণ্টা দেরি করে আমরা বউবাজার হয়ে আসতাম তবে আমার ও নূরুদ্দিনের লাশও আর কেউ খুঁজে পেত না,” আত্মজীবনীর ৬৩ নম্বর পাতায় লিখেছেন শেখ মুজিবুর রহমান।
 
কয়েক পাতা পরে তিনি আবার লিখেছেন, “কলকাতা শহরে শুধু মরা মানুষের লাশ বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে। মহল্লার পর মহল্লা আগুনে পুড়ে গিয়েছে। এক ভয়াবহ দৃশ্য। মানুষ মানুষকে এইভাবে হত্যা করতে পারে, চিন্তা করতেও ভয় হয়!”
 
“মুসলিম লীগের নিশ্চয়ই অনেক দোষ ছিল। সাম্প্রদায়িক শক্তি হিসাবে তারা প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল। কিন্তু এটা বললে বোধহয় ঠিক হবে না, ১৯৪০ এর দশক থেকে যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সাধারণ স্তরে জনপ্রিয়তা লাভ করল, সেটা শুধুই মুসলিম লীগের জন্য হয়েছে। মুসলিম লীগ যখন সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করছে, উল্টোদিকে হিন্দু মহাসভাও কিন্তু হিন্দু জাতীয়তাবাদ, হিন্দু সত্তাকে সাধারণের কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আবার আমার গবেষণায় এটাও পেয়েছি যে কংগ্রেসের একটা অংশও কিন্তু হিন্দু মহাসভার সঙ্গে যোগাযোগ রাখত,” বলছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সুরঞ্জন দাস।
 
তার কথায়, “এই প্রেক্ষাপটেই ১৯৪৬-এর দাঙ্গাটাকে দেখতে হবে। ওই দাঙ্গার একটা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল এই দাঙ্গা ছিল অনেকটাই সংগঠিত, যা আগের দাঙ্গাগুলো ছিল না।”
 
দাঙ্গার ক্ষত কিছুটা শুকিয়ে আসতেই দেশভাগের সিদ্ধান্ত হল। যে পাকিস্তানের দাবীতে এতগুলো বছর আন্দোলন করলেন শেখ মুজিবুর রহমান বা শহীদ সোহরাওয়ার্দী, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার সময় এগিয়ে এলো।
 
কলকাতার পাট গুটিয়ে ঢাকা ফিরতে হবে শেখ মুজিবুর রহমানকে।
অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে কলকাতা বাস শেষ করে ঢাকা যাওয়ার প্রসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, “আমাদের পক্ষে কলকাতা থাকা সম্ভবপর না, কারণ অনেককে গ্রেফতার করেছে। জহিরুদ্দিনের বাড়ি তল্লাশি করেছে। আমাদেরও ধরা পড়লে ছাড়বে না। শহীদ সাহেবের কাছে বিদায় নিতে গেলাম। তাঁকে রেখে চলে আসতে আমার মনে খুব কষ্ট হচ্ছিল।… শহীদ সাহেবকে বললাম, “স্যার চলুন পাকিস্তানে, এখানে থেকে কি করবেন? বললেন যেতে তো হবেই, তবে এখন এই হতভাগা মুসলমানদের জন্য কিছু একটা না করে যাই কি করে?… বললাম, “ঢাকা যেতে হবে, শামসুল হক সাহেব খবর দিয়েছেন। রাজনৈতিক কর্মীদের একটা সভা হবে। পরে আবার একবার এসে দেখা করব।” বললেন, ‘এসো।’
 
“সেই উত্তাল সময়ে মুসলিম লীগের রাজনীতি করতেন ঠিকই শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু তাঁর আত্মজীবনীতেই আছে যে পাকিস্তান ভাগ হয়ে যাওয়ার পরে খুব দ্রুতই তাঁর সেই রাজনীতি সম্বন্ধে মোহভঙ্গ হয়েছিল। তিনি ক্রমশ উপলব্ধি করছেন পাকিস্তান সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে বাঙালীর আত্ম উপলব্ধি সম্ভব হচ্ছে না,” বলছিলেন রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সব্যসাচী বসু রায় চৌধুরী।
 
শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় চলে যাওয়ার পরে নীহার রঞ্জন চক্রবর্তীর সঙ্গে আর একবারই তাঁর দেখা হয়েছিল, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে যখন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তিনি কলকাতায় এসেছিলেন।
 
“তিনি আমার কথা জেনে খবর পাঠিয়েছিলেন। অনেক লোক তাঁর চারদিকে। দেখেই বললেন, কী, ভাল আছ? আমি বললাম চিনতে পারছেন আমাকে? জবাবে বললেন, চিনব না? আমি কি অত ভুলোমন নাকি,” মি. চক্রবর্তীকে বলেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
কৃতজ্ঞতা: বিবিসি বাংলা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত