| 20 এপ্রিল 2024
Categories
এই দিনে কবিতা সাহিত্য

ইন্দ্রনীল ঘোষের কবিতাগুচ্ছ

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

আজ ২৮ জানুয়ারী কবি ইন্দ্রনীল ঘোষের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


দীর্ঘই

মীড় মাহিয়ার রেটিনা-কাটা ধান
তার অঘ্রাণ
এরোপ্লেন বানাতে বাধ্য করলো
যখন সব ক’টা কাগজে যাত্রী উড়ছে
তোমরা কবিতাকে চেনো
ওই যে প্রাচীন ফুসফুসের লম্বা ছায়া পড়েছিলো
তোমরা সেই দীর্ঘই-এর ভাঁজ করা বুদ্ধকে চেনো
তার আঁখির হোঁচট হচ্ছে পিলসুজ

জ্বালিয়ে দাও জ্বালিয়ে দাও
যা কিছু দেখলাম এ’ জীবনে
পুতুল
পুতুলে বৃষ্টি হচ্ছে
তার মাটির চোখে পিঁপড়ে
পৃথিবীর ইতিহাসে এই একটা মাত্র উঠোন…
ফাঁকা বিসমিল্লায় একখানা টিউবওয়েল লাগানো
এখানেই জলের লাইন –
সানাইয়ের ছবিতে
তোমার অবিকল হাত জল ভরছে

সেই প্রথম দিনে কোনো ভাষা ছিল না
তার বদলে
আমরা পুতুল ভিজতে দিয়েছিলাম বৃষ্টিতে

 

এক পর্নোগ্রাফির খসড়া

পর্ন বানানোর জন্য প্রাথমিকভাবে যা যা দরকার – একটি উলঙ্গ মানুষ, একখানা ফাঁকা ঘর, আলো আর কিছু সরঞ্জাম। প্রথম দৃশ্যে লোকটা এগিয়ে যাবে। দ্বিতীয় দৃশ্যে হঠাৎ থেমে ভাববে – খামোখাই, এই এগিয়ে আসার কারণ। শেষ দৃশ্যে, ভাবতে ভাবতে লোকটা বুঝতেও পারবে না কখন ডুবে গেছে ঘরের মধ্যে। তাকে আর আলাদা ক’রে চিনতে পারছে না নতুন পর্নওয়ালারা। তারই ওপর দাঁড়িয়ে লিঙ্গ হাতে নতুন মানুষের দল।

শুটিং-এর জন্য একখানা সন্ধে বাছলাম। একটা ঠিকঠাক সন্ধে – যখন আঁচড়ের রঙ নীল, দূরত্বের আওয়াজ তীক্ষ্ণ। যখন গোলপোস্টের সামনে ফাঁকা বল হাতে বাচ্চাটা বেড়েই চলেছে বেড়েই চলেছে। হাজার হাজার বাচ্চা টুকরো হয়ে লাখ লাখ হলো। অভিনেতার সারা গায়ে ক্ষুরের দাগগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
ক্যামেরা বলল – লোকটা একা কেন?
আমি বললাম – ওর পার্টনার জল আনতে গেছে।
– তবে ও সেক্স করবে কার সঙ্গে?
– দেখছ না, ওর গায়ের ওই দাগগুলোয় জল জ’মে আছে। কাল বালতি ছলকে পড়েছিল ওর সঙ্গীর হাত থেকে।
ক্যামেরা বলল – আমি তবে চোখেমুখে একটু জল দিয়ে আসি?

দূরে, বিদেশী পাহাড় থেকে নাকি মৃত্যু গড়িয়ে আসছে। সেই দেখতে ভিড় জমেছে আজ। সকালে খবরে শুনছিলাম। এমন দিনে বড় নিরালার অভাব। শুটিং-এর সময় বন্ধ করব, তেমন জানলাই বা কোথায়! আমাদের অভিনেতা শেষবারের মতো লিঙ্গ প’রে তৈরি হয়ে নিচ্ছে। আমরা সবাই তৈরি হচ্ছি একটা পর্ন শুটের জন্য। মৃত্যু দেখতে আসা মানুষেরা উঁকি মারছে লিঙ্গের দিকে। জানতে চাইছে, তার উচ্চতা ও বংশপরিচয়।
– এটা এক সাম্রাজ্যের দালানে ছিল, জানেন। শুনেছিলাম, সম্রাট নানাবিধ লিঙ্গ জমাতেন। ঠিক যেমন চিঠি পাওয়া মাত্রই ডাকটিকিট খুলে রাখে বুবুন। ওনার সংগ্রহে বেশ কিছু স্তন ছিল, কিছু যোনি আর কয়েকটা প্রজাপতি।

লিঙ্গ দেখতে আসা মানুষেরা এবার উঁকি মারে মৃত্যুর দিকে – দূরে, বিদেশী পাহাড়ে।

এই ফাঁকে আমরা সরঞ্জাম গুছিয়ে নিই। আলোগুলো গুছিয়ে নিই। অসুখ থেকে একখানা আলো এসেছে, শীতের রুটিতে। আর তাতে ক’রে কুয়াশা তৈরি হচ্ছে সিনেমায়।

সবাই এখন শুটিং-এর জন্য প্রস্তুত।

শুধু খেলা ভোলা সম্রাট ঘুমিয়ে পড়েছে। ছড়িয়ে আছে খেলার লিঙ্গ, খেলার স্তন… যোনি…
চিরকালের মতোই, সে’ ঘুম থেকে, ডাকটিকিট তুলে রাখল বুবুন।

 

ঘড়ি

মহুলকে জড়িয়ে আছে সুকান্ত
এই দুটো নামপদ, আমার চাই

কাঠুরিয়া টোনের বাড়ি
ঠুকরোচ্ছে পাখি
তার পালক নেমে আসছে সন্ধেতে

মহুলকে জড়িয়ে আছে সুকান্ত
এই দুটো নামপদ
আমি পৃথিবীকে দিয়ে যেতে চাই

 

 

স্যালাইন

বমি করতে করতে ওর পাকস্থলী উপড়ে গেছে। 
এক ফিনফিনে শিরার মায়ায় – এ’ বিশ্বে – ছিটিয়ে দেওয়া বমির দানা। 
সকড়ি জিভ এঁটো গ্রামোফোন চাটতে থাকে। চাটতেই থাকে। গান হয় না।
কোনোকিছুই হয় না।
ভুষো সারেঙ্গী জ্বলে নিঃশ্বাসে…

লোকটা খোলশ হয়ে যায়

ওর ফাঁকায় বৃষ্টি ভ’রে চালান করি আমরা
রোদ ভ’রে  
চালান করি ইস্তাম্বুল তিউনেশিয়া খুঁড়ে খুঁড়ে, খিদের ভাস্কর্য্য… ভাস্কর্য্যের উড়ন্ত খুদ… 
চালান করি বরফ জ’মে যাওয়া ক্যালেন্ডারে জমে থাকা লাশটির আঙুলের রঙে।

শুধু রঙই তো শিখতে চেয়েছিলাম
দেখতে চেয়েছিলাম কীভাবে চোখের মধ্যে চোখ-পোকা ন’ড়ে ওঠে 
তেষ্টাকে চিনতাম না। তার ভুলভুলাইয়া জড়িয়ে যেত শরীরে। আলতো ব্লেডের রূপকথা — ফোঁটা ফোঁটা ইলেকট্রিক পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা পাগলে… 

লোকটা খালি হয়ে গেল
তার পাকস্থলী উপড়ে, ছড়িয়ে পড়ল পাকস্থলীর পাতা… 
লালা জড়ানো এক ভিখিরি কিলবিল জনপদে
এই আলোর ধর্মঘট
এই একনাগাড় স্যালাইনের ভোঁ
ডাকটিকিট থেকে পোস্টমর্টেম টেবিল অব্দি… এক ব্রহ্ম ঝিঁ-ঝিঁ ধ’রে আছে।

 

 

বারোমাস্যা

 

আমি তাকিয়ে আছি —
ম্যাজিক থেকে…
ম্যাজিকের ব্রণ খুঁটতে খুঁটতে
একদিন রক্ত,
সে রক্তের সমীক্ষা থেকে
আমি তাকিয়ে আছি —
রেটিনাগুলো থিতিয়ে পড়ছে দৃশ্যে
শান্ত… ধীর…
যেন ফ্রিজে ঠাণ্ডা করা এক অসুখ গড়াচ্ছে

গ্রামকে গ্রাম শালিখে চড়ুইয়ে শুধু কিচির অসুখ আর মিচির অসুখ। আমাদের কার্ণিশ বারান্দা ভ’রে যায়। রোগা হতে হতে শেষমেশ ডাক হয়ে যায় সবকিছু।
একটা মানচিত্র >> শুকনো কণ্ঠনালী ধরে ট্রাপিজ খেলছে ফাঁকা ডাকগুলো। ছেঁড়া সার্কাসের ছবির টুকরো, মাংসের মত ছুঁড়ে দিচ্ছে শূন্যে। যেন এক্ষুনি কেউ জল চেয়ে উঠবে, আর ইন্দ্রনীলকে বিশ্বাস হবে ক্রিয়াপদ ব’লে।
একটা মানচিত্র >> রঙ থেকে ভেঙচি কাটছে আলোর অজুহাত। খুব ঠাণ্ডা এক আলোর অজুহাত… যাকে গরম করার জন্য দেশলাই পাওয়া যাচ্ছে না।

ওপাশে তাকানো-ভাঙা ছবি। এদিকে চোখের গোয়েন্দা। চোখ ঘ’ষে ঘ’ষে… চোখ ঘ’ষে ঘ’ষে যখন রাহাজানির কেসটা বার হলো, রাহাজানি তখন বোবা। তার আবহাওয়াতুতো ভাই,
বোবাদের ভাষা দিয়ে সার বানাচ্ছে ধানক্ষেতের। অত কি সহজ ছিল? ধান চাষ এয়োস্ত্রী ছিলো না তো। হেমন্তের চিড়-এ তার গোপন বিধবা লেগেছিল। সেই যে সফেদ হিম,
তাঁতে বোনা হয়… সারারাত শব্দ ওঠে… মিইয়ে যায় দরজা জানলাগুলো।

অথৈ সার্কাসে আমি আগাগোড়া পাত্তি খেলোয়াড়। নিজেকে ডবল দিই। শীত দিই। ভয়ানক শীত। আগুনেরা কুঁকড়ে ব’সে থাকে। সারা শরীর রাস্তা হয় খুব। রাস্তাগুলো একা একা হাঁটে।
একে অন্যে ধাক্কা মারে। হোই হো… হোই হো… ম্যাজিকের খুঁত লেগে মানুষ যে ভেস্তে গিয়েছে। হোই হো… মানুষের বডি দেখি শীতে ফাঁসে বসন্তেও ফাঁসে। দেখতে দেখতে সমস্তই,
মুখস্ত জীবন সহ সবকিছু শ্বাসের আড়ত। মানুষের নিঃশ্বাসে খুব ঠাণ্ডা পড়ে।

আমি সেই দিনটাকে ঝাঁকাই, যেদিন বরফ-জমা লাশ থেকে বেরিয়ে আসে ফুল-মৃত্যুর নকশা। রেশমেরা কথা বলে ছোঁয়াচে হরফে। কথারা উপচে পড়ে।
সমস্ত ঋতুর নার্ভে ফিসফিস হতে থাকে ম্যাজিকের জীবাণু।

এখানে অসুখ ফিসফিসে

এখানে শরীর ফাঁসাফাঁসা

অতল বসতি ভেঙে বারোমাস হয়ে যাচ্ছে আলো…

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত