| 25 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক সাহিত্য

ইন্দু বিন্দু (পর্ব-৪)

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
শ্রীচৈতন্যের জীবনী নিয়ে মধ্যযুগেই কয়েকটি গ্রন্থ লেখা হয়েছিল। তবে বাংলা সাহিত্য-আসরে আত্মজীবনী সাহিত্য এসেছিল বেশ চমক দিয়ে। চমক এ জন্য যে, আধুনিক যুগ ইংরেজ এবং ইংরেজি সাহিত্যনির্ভর হয়ে উঠেছিল। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিতরাই সমাজ-সাহিত্য-রাজনীতিতে অবদান রেখেছিলেন। কিন্তু বাংলায় ‘আত্মজীবনী’ লেখার ইতিহাস একেবারেই ভিন্নভাবে এসেছে। কোনো ইংরেজ প্রভাবিত বা কোনো শিক্ষিত লোক আত্মজীবনী লেখেননি। লিখেছেন অজপাড়াগাঁয়ের প্রায় অশিক্ষিত এক মেয়ে। তাঁর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, কেউ তাঁকে পড়তে বা লিখতে শেখাননি। লেখাপড়া অর্জন করেছিলেন তিনি নিজে, সম্পূর্ণ একাকী। তাই সাহিত্যের আঙ্গিনায় তিনি একটি বিস্ময়। তাঁর নাম রাসসুন্দরী। তাঁর বইয়ের নাম ‘আমার জীবন’। তারপরে আত্মজীবনী অনেক পেয়েছে বাংলা সাহিত্য ও বাংলা সাহিত্যের পাঠক।

আরও একটি আত্মজীবনী ইন্দু বিন্দু’র সাক্ষী হতে যাচ্ছেন আপনি। আদরের নৌকা,শব্দের মিছিল-এ বিক্ষিপ্তভাবে নিজের জীবন নিয়ে লিখেছেন, ইরাবতীর পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে নিজের জন্মতিথিতে নিজের আত্মজীবনী লেখা শুরু করলেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়। আজ রইলো আত্মজীবনী ইন্দু বিন্দুর চতুর্থ পর্ব।


 

আমার শৈশবের ফেরিওয়ালারা   

ছুটির দিনে বাবার সেই ঘুম পাড়ানো? কোথায় যেন হারিয়ে গেল বাংলার লালাবাই গানের সম্ভার। কোনদিন বাবা আমার মাথায় হাত রেখে ঘুমিয়ে পড়ত আর আমি চুপিচুপি পাশ থেকে উঠে গিয়ে পুতুল খেলতে বসে যেতাম দুপুরবেলায়।

ঘু-ঘু-ঘু-ঘু মতি সই, পুত কোথায়?
হাটে গেছে, কি মাছ আনতে ?
সরল পুঁটি, কি দিয়ে কুটী ?
বোঁচা বঁটি, কি দিয়ে রাঁধি
গোল মরিচ, পাবে কোথায় ?
বেনের দোকানে, দেবে কেন?
এক-কড়া কড়ি দিয়ে গুণে নেবে,
তালগাছাটন, বাঁশের বাটন, গৌরী বাটন ঝি!
তোর কপালে বুড়ো বর তা আমি করব কি?
আঙ্কা ভেঙে শাঙ্কা দেব পানের বদল কড়ি,
আর তোর বিয়েতে দেখতে যাব বুড়ো চাপ-দাড়ি !

এইসব ঘুমপাড়ানি গান শুনতে শুনতে আমার  বড় হয়ে ওঠাটা একটু অন্যরকমের। মফস্বলের গঙ্গার হাওয়া গায়ে মেখে, একতলার বারান্দা সর্বস্ব ফ্যান্টাসীময়তায় । যেখানে গ্রিলের সিফুলের মধ্যে চিবুক ছুঁইয়ে পুবের আলো মাখতে মাখতে আমি শুনতাম  
“ঝ্যাঁটার কাঠি লাগবে এ এ এ…ঝ্যাঁটার কাঠি?” আধময়লা মাসীটার পানখাওয়া দাঁতে ফিক করে  আমার দিকে চেয়ে একবারটি হাসা?  মায়ের যখন লাগে মা তাকে থামাতে বলে। খেঁজুর পাতা ছাড়িয়ে মাসীটা রোজ রোজ আসে এ পাড়ায়।  
পোষমাসের অন্ধকার ভোরে বিছানার লেপের ওমে মা’কে জড়িয়ে শুনতে পেতাম ” চাই-র-অ-অ-স্‌-স, খেঁজুরের রস” …

ভাবতাম খেঁজুরবুড়োর যদি ঐ শীতে ঘুম ভেঙে গিয়ে থাকে তবে আমার বিছানা ছাড়া উচিত তখুনি।
মা বলত , “এখন বাইরে যাবেনা,  নতুন ঠান্ডা, চট করে লেগে যাবে” আমি বলতাম ওদের বুঝি ঠান্ডা লাগেনা মা? তারপর বেলা বাড়তে না বাড়তেই রোববারের লুচি-তরকারির ভোর পেরিয়ে আসত  সেই চন্দনের ফোঁটা কাঁটা বোষ্টমীটা, খঞ্জনীর সুরে বারান্দায় আটকে পড়ে যেতাম অমনি  … চেনা চেনা রোদ্দুরে, চেনা সুরের  মায়াটানে।

রাধে রাধে বল, গোবিন্দ বল… কিম্বা সেই গানটা যেটা ছাত পিটুনিরাও গাইত সমবেত কণ্ঠে?
একবার বলরে, মধুমাখা হরিনাম বলরে…

আমার পয়সা দেওয়া আর বোষ্টমীর আশীর্বাদ পাওয়া ছিল রোববারের রোজ নামচা।  
তারপর আসত  বুড়ো মানিক পীর। মাথায় ছোঁয়াত বিশাল গোলাকার ময়ূরের পালকের পাখা। বুড়ো তার লম্বা সাদা দাড়ির কাছ থেকে মুখ উঁচিয়ে আমার সব্বাঙ্গে থু, থু, থু করে কীসব ঝাড়ফুঁক করে জলপড়া  দিত। আমার রোগব্যাধি এক্কেবারে যেন নিমেষেই ঝেড়ে উড়িয়ে দিত।  
তারা নাকি মানুষের সব মুশকিল আসানের জন্য বাড়ি বাড়ি ঘোরে। রোগ ভালো করে দেয়। আর আমিও ছিলাম ছোট থেকেই প্রচন্ড রুগ্ন।  তাই মা ওদের ডাক শুনতে পেলেই আমায় পয়সা দিয়ে পাঠাত সেই ফকিরের কাছে।
বাবা বেশ আপত্তি করত এসবে। বলত যতসব কুসংস্কার তোমাদের!
 
যেদিন স্কুলের ছুটি থাকত  সেদিন বেলা বাড়তেই শুনতে পেতাম  “অচল ঘড়ি বিক্রি করবে ঘড়িওলা?”  মাকে বলতাম, মা “অচল ঘড়ি” কাদের থাকে? মা বলত, যে ঘড়ি আর চলবেনা কোনোদিন তাকে অচল ঘড়ি বলে।

আর সবচেয়ে ভাল্লাগত বর্ষার রেনিডেতে বাড়ি ফিরে ইয়া মোটা, মিশমিশে কালো, দশাশয়ী চেহারার হিন্দুস্তানী বুড়োর ধবধবে পোষাকে “হিলিস মাছ গোঙ্গা” বলে চিল চীত্কার। কুচকুচে কালো বুড়োর দুকানে সোনার চকচকে মাকড়ি । বাড়ির সামনে এলেই মাকে ধরে এনে ইলিশমাছ কিনিয়েই ছাড়বে সে। সেই হিন্দুস্তানী মাছ ওলা আবার শীতকালে সন্ধ্যের ঝুলে গান ধরত, ” বাদাম ভাজা খাইও… ভুখে গুণ গাইও। ইয়ে ঝাল বানারস ওয়ালা, জিসমে নমক পড়ায়ে গা। গরম মুমফালি-ই-ই-ই “
তখন বুঝতামনা শীতকালে বাদাম আর বর্ষায় ইলিশের কেমিস্ট্রিটা । মা বলেছিল, শীতে ইলিশ পাওয়া যায়না তাই পেট চালানোর জন্যে বাদাম ভাজতে হয় তাকে।  

নিয়ম করে প্রতি সন্ধ্যেয় মা তিনবার শাঁখে ফুঁ দিলেই খেলা ফেলে বাড়িতে ফিরতেই হত।  বন্ধুরা যে যার মত বাড়ি চলে যেত হাত নেড়ে । কোনোদিন পর্দার আড়াল থেকে বাইরের ঝুপসি অন্ধকারে গরম পাউরুটিওলার জন্য মন কেমন করে উঠত। একটা বাঁশী বাজায় লোকটা আর তারপরেই বলত, “টাকায় চার, চাই রুটি” টিনের বাক্স থেকে বেরিয়ে আসে গরম পাঁউরুটি। এক পাউন্ড  মানে চারটে কোয়ার্টার নিলে তবেই সে দেবে একটাকায়। লোকাল বেকারীর তৈরী টাটকা  গরম ব্রেড। বায়না করে পড়তে পড়তে বলতাম, ও মা, আজ হাতরুটির ছুটি থাক, আমরা গরম পাঁউরুটি খাব…মা আদর করে বারান্দায় গিয়ে রুটি নিয়ে নিত ।  

একদিন গরমকালের দুপুরে একটা কান্ড ঘটল বাড়িতে। বাড়ির কাছ দিয়ে প্রায়ই যেত একজন ধূপ বিক্রেতা।  সে নিজে ধূপ বানিয়ে বিক্রি করে। আগরবাতি বলে ধূপকে। পুপুল মায়ের কাছ থেকে জেনেছিল। সে বিশাল ব্যাগের মধ্যে নানান সুগন্ধের ধূপ নিয়ে বাড়ি বাড়ি যেত আর সুর করে বলত
“আসুন মায়েরা, সুগন্ধি ধূপকাঠি আছে। আসতে পারেন, দেখতে পারেন, ভালো কি মন্দ, আশা তো করি, মায়েদের কাছে খারাপ কি আর দিতে পারি, আগরবাতি! ”  সেদিন দুপুরে বাড়ির সামনে লোক জড়ো হয়ে দেখল গরমের তাতে হিটস্ট্রোকের মত হয়ে গেছে ছেলেটার। বাবা সেদিন ঘরে ছিল। তাড়াতাড়ি জল এনে ছেলেটার চোখে মুখে ছিটিয়ে সে যাত্রায় তার জ্ঞান ফেরাল। তারপর ঘরে এনে ফ্যানের হাওয়ায় তাকে বিশ্রাম নিতে বলল। তারপর কিছু খাবার দাবার খাইয়ে বলল, তোমার ধূপের ব্যাগটা আমাকে দেবে। আমি সব কটা প্যাকেট রাখব। বলে দাম মেটালো। সেই ধূপ ওলা তো আনন্দে আত্মহারা তখন। এমন ঘটনা তার জীবনে কখনো ঘটেনি। সেদিন বাবাকে আমার জীবনের প্রথম হিরো মনে হয়েছিল।

গরমের ছুটির দুপুরবেলায় “শিল কাটাও” বলে যে লোকটা আমাদের উঠোনে বসে তাদের শিলটা সুন্দর করে কেটে নকশা এঁকে দিত সেই শিল্প কর্মটা ভীষণ উপভোগ করতাম । প্রতিবছর গরমে সে লোকটা আসবেই আর বাইরে থেকে হাঁক দেবেই” শিল কাটানেওয়ালা, মা শিল কাটাইয়ে” …..
সব শেষে শিলের মধ্যে লম্বা একটা মাছ এঁকে দেবে মানুষটা। কত সূক্ষ্ম রুচিশীলতা ! তারিফ না করেও উপায় থাকেনা। এই একটা কারণে স্কুলে যেতে ভাল্লাগত না । বাড়িতে থাকলে এইসব ফিরিওয়ালার ডাকগুলো শোনা যায়। কত জিনিষ কেনা যায়। কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়। কিন্তু স্কুলে তো সব বাঁধাধরা। 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত