Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

ইন্দু বিন্দু (শেষ পর্ব)

Reading Time: 5 minutes

শ্রীচৈতন্যের জীবনী নিয়ে মধ্যযুগেই কয়েকটি গ্রন্থ লেখা হয়েছিল। তবে বাংলা সাহিত্য-আসরে আত্মজীবনী সাহিত্য এসেছিল বেশ চমক দিয়ে। চমক এ জন্য যে, আধুনিক যুগ ইংরেজ এবং ইংরেজি সাহিত্যনির্ভর হয়ে উঠেছিল। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিতরাই সমাজ-সাহিত্য-রাজনীতিতে অবদান রেখেছিলেন। কিন্তু বাংলায় ‘আত্মজীবনী’ লেখার ইতিহাস একেবারেই ভিন্নভাবে এসেছে। কোনো ইংরেজ প্রভাবিত বা কোনো শিক্ষিত লোক আত্মজীবনী লেখেননি। লিখেছেন অজপাড়াগাঁয়ের প্রায় অশিক্ষিত এক মেয়ে। তাঁর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, কেউ তাঁকে পড়তে বা লিখতে শেখাননি। লেখাপড়া অর্জন করেছিলেন তিনি নিজে, সম্পূর্ণ একাকী। তাই সাহিত্যের আঙ্গিনায় তিনি একটি বিস্ময়। তাঁর নাম রাসসুন্দরী। তাঁর বইয়ের নাম ‘আমার জীবন’। তারপরে আত্মজীবনী অনেক পেয়েছে বাংলা সাহিত্য ও বাংলা সাহিত্যের পাঠক।

আরও একটি আত্মজীবনী ইন্দু বিন্দু’র সাক্ষী হতে যাচ্ছেন আপনি। আদরের নৌকা,শব্দের মিছিল-এ বিক্ষিপ্তভাবে নিজের জীবন নিয়ে লিখেছেন, ইরাবতীর পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে নিজের জন্মতিথিতে নিজের আত্মজীবনী লেখা শুরু করলেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়। আজ রইলো আত্মজীবনী ইন্দু বিন্দুর শেষ পর্ব।


 

মধুরেণ সমাপয়েত

আমার মা আদ্যোপান্ত সুগৃহিণী। বিয়েবাড়ির পদ্য লেখা থেকে নতুন নরম ন্যাকড়ায় পিটুলি গোলা ভিজিয়ে অসামান্য আলপনা দেওয়া থেকে নিষ্ঠা ভরে সব বারব্রত এবং স্ত্রী আচার পালনে অনুগতপ্রাণ। মা কে দেখলে মনে হয় মহিলা অর্থাৎ মহলে থাকেন যিনি সেই নাম সার্থক। তিনি বইপোকা। টুকটাক লিখতেনও। রীতিমত কীর্তন পটীয়সী। তবে সংসার তার প্রাণের আরাম। রান্না তার মনের খোরাক। গাছ আর বাগান অনুগত প্রাণ। সে যুগে ১৯৬৪ তে রক্ষণশীল পরিবারে নিজের দিদির দেওর কে বিয়ে করার হিম্মত হয়েছিল মায়ের বাড়ির সবার আপত্তিতে।
আমার বাবা-মায়ের তখনকার দিনের ‘ভাব-ভালোবাসার’  বিয়ে এখনকার ভাষায় দিদি তেরা দেবর দিওয়ানা । আমার মায়ের কথায়,

“আমি তখন ক্লাস সেভেন আর সে তখন সিটি কলেজে ফার্স্ট ইয়ার। আমার দিদির দেওর সে । দিদির ননদের বিয়ের বাসরে রজনীগন্ধা ফুল ছুঁড়েছিল আমার দিকে আর কিছু পরে গান ধরেছিল
“ভাঙা তরী শুধু এ গান, কি আছে আর প্রাণের দান? ব্যাস আমি এখনকার ভাষায় “ফিদা” হয়ে গেলাম ।
আমার ননদ গাইল “প্রেম একবারি এসেছিল নীরবে “
আর আমি এ জীবনে যত ব্যথা পেয়েছি, তুমি যে দিয়েছ সবি ভুলায়ে “কি পাকা ছিলাম বলো আমি ! ক্লাস সেভেনে মান্না দের প্রেমের গান গাইছি আমার প্রথম ডেটে !!!  
পরক্ষণেই তিনি বললেন ” ঐ গানটি আমাকে লিখে দেবে?”
ব্যাস সেই থেকেই শুরু তাঁর সঙ্গে আমার জীবনের ওঠাপড়া” ।

আমরা কেউই ভ্যালেন্টাইনস ডে পালন দেখিনি কারণ বিশ্বায়ন এবং সেই চক্করে ভালোবাসার বিশেষ দিনের পণ্যায়ন হয়নি তখনও। কিন্তু তখনো প্রেমে পড়ত ছেলেমেয়েরা আর বসন্ত এলেই প্রেমের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিত যেমন এখনো দেয় সকলে। পালন করত নিত্য নতুন ভ্যালেন্টাইনস ডে। কখনো হোলি, কখনো সরস্বতী পুজো কে উপলক্ষ করে।
প্রণয়-পারাবার সাঁতারাতে সাঁতরাতে বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীরা? দৈনন্দীন জীবনের একঘেয়েমিতে কেমন পাগল পাগল ভাব নিয়ে তারাও মাঝে মাঝে পালন করত বৈকি ভ্যালেন্টাইন্স ডে। স্বামী তার বিশেষ দিনটিতে স্ত্রীয়ের জন্য ছোটখাট সোনার গয়না কিম্বা ছাপাশাড়ি কিনে উপহার দিতেন। অথবা আচমকা নিয়ে আসতেন বম্বেডাইং এর ফুলকাটা সুন্দর ডাবল বেডশিট। কোনও বার গিন্নীর জন্যে একটা ফুরফুরে পাতলা ডি সি এম এর ভয়েল কিম্বা বেগমপুরী তাঁত। অফিস থেকে ফেরার পথে, জলযোগের মাংসের প্যাটিস কিম্বা ফারপোর ফ্রেশলি বেকড কেক নিয়ে বাড়ি ফিরে বলতেন…
“কি গো চা বসাও ? দেখ আজ কি এনেছি, তোমার জন্যে”
কিম্বা পকেট থেকে বের করতেন বিশ্বরূপা, রঙমহল এর নাটকের সস্তার টিকিট দুটি। আপিস থেকে ফেরার পথে এই বসন্তেই বাবা কে দেখেছিলাম মায়ের জন্য বইমেলা থেকে গল্পের বই কিনে আনতে। ঘরে ঢুকে বইখানিতে নিজে হাতে লিখে দিতেন মায়ের নাম আর নিজের নাম। মা বড় খুশি হতেন এমন সারপ্রাইজ গিফটে।
সদ্য শীতের আলস্য কাটিয়ে তাঁর গৃহিণীটি ঘরের মধ্যে থেকে গা ধুয়ে কিউটিকিউরার ফুলেল গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে নরম ছাপা শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে সলজ্জে যেন হাতে চাঁদ পেতেন। কত অল্পে খুশী ছিলেন এঁরা। এগুলি যেন সংসার করার পার্কস বা উপরি পাওনা, বোনাসের মত। এ সব দেখেছি আমাদের বাবা মায়েদের আমলে।ওদের ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে গোল্ডালাইট কালেকশন ছিলনা। ছিলনা বাইরে গিয়ে ক্যান্ডললাইট ডিনারের মোহ কিন্তু যা ছিল তা অনেক বেশী দামী। কোনও বিশেষ দিন পালন নয় বরং হঠাত দিন, নতুন দিন, আরও একটা অবাক করা দিন এভাবেই মনে ধরে রাখতেন মায়েরা।  
মনে আছে এমনি মধুর নাতিশীতোষ্ণ সময়ে একবার কলকাতার বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনের সারারাত ব্যাপী জলসার টিকিট এনেছিলেন বাবা। হেমন্ত-আরতির গান দুজনেরি খুব পছন্দ। আর তখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় খ্যাতির শীর্ষে আর আরতি মুখোপাধ্যায় নবাগতা। এই সারপ্রাইজে মায়ের মুখের হাসিটুকু বাঁধিয়ে রাখা হয়নি কারণ আমি তখন মাত্র ক্লাস ফোর এ।

আর আমাদের দুই বাড়ির মধ্যে সব কথাবার্তা পাকাপাকি হবার পর ঠিক হল আমরা একদিন বেরুবো । কোথায় যাব তা জানিনা তবে যেতে নাকি হবে কারণ একে অপরকে বুঝে নেবার জন্য । আমি তো খুব নার্ভাস । তাতে আবার তিনি আমেরিকায় তখন ছাত্র । অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে শাঁওলি মিত্রের “নাথবতী অনাথবত” নাটকের টিকিট কাটা ছিল । এস-17 বাসে চেপে দুজনের মধ্যিখানে বিস্তর জায়গা ছেড়ে রেখে বসলাম আর অ্যাকাডেমির কাছে নেমে নাটক দেখলাম । তারপর একথা সেকথা পর রেস্তোরাঁয় ঢুকে সেই প্রথম একা একা কোন ছেলের সঙ্গে লাঞ্চ খাওয়া আমার। মনে আছে সে স্টিমড রাইস আর চিলি ল্যাম্ব অর্ডার দিয়েছিলেন। শেষ পাতে লিচি আইসক্রিম। সে আমাকে ভাত সার্ভ করে দিতে বলেছিল (বৌভাতের আগেই সেই আদেশ)। সেটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় পাওনা ছিল !তারপর ভিক্টোরিয়ার ছবির গ্যালারি তে গিয়ে ছবি দেখতে দেখতে মনে হয়েছিল আমাদের দুজনের মনের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য মোটামুটি কাছাকাছি।
আমার বিয়ের বছর শিবরাত্রি পড়েছিল ৬ইমার্চ । সেদিনই আবার আমাদের ইউএস কনসোলেটের ভিসার ইন্টার্ভিউ । আমায় স্টুডেন্ট এর স্পাউস হিসেবে এপ্লাই করতে হবে। তার আগেই ২৬শে ফেব্রুয়ারী রেজিস্ট্রেশান হয়ে গেছে । সুতরাং আমরা আইনত: স্বামী-স্ত্রী । তাই ছাড়পত্র মিলতে বাধা নেই।
বাড়ি থেকে শিবের মাথায় জল ঢেলে পুজো করে বলে গেলাম “দেখো ভোলাবাবা! আফগারী আপ্যায়ণ ভুলে যেওনা যেন! পঞ্চগব্য অর্থাত কাঁচা দুধ, দৈ, মধু, ডাবের জল, ঘি দিয়ে তোমায় মাসাজ করলাম । তারপর তোমার নেশার সব জিনিসপত্র গুছিয়ে দিলাম একে একে । সিদ্ধি, গাঁজার ছিলিম ( অফিম নেই অবিশ্যি) দিলাম ঢেলে । তারপর চন্দনের ফেসপ্যাক “
গেলাম, ইন্টারভিউ দিলাম । ভিসা পেলাম হাতে ।
ঐ ২৭ বছরের ফোক্কড় স্টুডেন্ট ভিসা হাতে পেয়েই বলে কিনা পার্কস্ট্রীটের ট্রিংকাসে চলো! “আমরা লাঞ্চ করব’
তখন আমি শুধু ট্রিংকাসের নাম জানি ঊষা উথুপের কারণে।
বললাম “আজ শিবরাত্রি পালন করেছি, আমি বাইরে খাব না’
সে অগত্যা মুখ চুন করে দুটো লস্যি অর্ডার দিল ।
সেইদিন জিতে গিয়েই মনে হয়েছিল এখনকার ভাষায় “ইয়েস!” কারণ দিদিমা বলেছিল বিয়ের রাত্তিরেই বেড়াল মারতে।
আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন আমাকে দেখেশুনেই এনেছিলেন বৌ করে। বাড়িতে আমার শ্বশুরমশাই আর শাশুড়ি ছাড়াও ছিলেন নিঃসন্তান জ্যেঠশ্বশুর ও জ্যেঠিশাশুড়ি আর দুজন অবিবাহিত পিসিশাশুড়ি। আর ছিলেন শ্বশ্রুমাতার দিদি মানে আমার মাসীশাশুড়ি আর তাঁদের মা অর্থাত দিদিশাশুড়ি। এঁরা কিছুটা দূর থেকে রিমোট কন্ট্রোল করতেন । আমরা ছিলাম বাড়ির মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ দম্পতি তাই কেন জানিনা আমাদের ওপর সকলেই ছড়ি ঘুরিয়ে অপার আনন্দ পেতেন সেই সময়ে মানে ১৯৮৯-৯০ সালে।  দক্ষিণের খোলা বারান্দায় দুজনে পাশাপাশি দাঁড়ালে সমালোচনা হত। অফিস থেকে তিনি ল্যান্ডলাইনে ফোন করলে প্যারালাল লাইনে কেউ একজন আমাদের ট্যাপ করত। এছাড়া অফিস থেকে তিনি ফিরলে তাঁর সামনে দাঁডানোর জো ছিলনা। আমাকে কেউ সেখানে দেখলেই তুরন্ত রান্নাঘরে খাবার গরম করতে পাঠিয়ে দিতেন। সে অফিস যাবার সময় আমার বাই করার তো কোনো কোশ্চেন নেই! নো ওয়ে!   টিফিনের সুস্বাদু খাবার খেয়ে আমার স্বামী ফোন করলেন একবার দুপুরে। কেউ একজন বললেন ” যত্তসব! আদিখ্যেতা!’  
রবিবারের সকালে তাঁরা একজোট হয়ে মহাভারত দেখছেন। আমরা তখন আমাদের ঘরে গল্পে-আড্ডায় মশগুল। ছুতোয় নাতায় ঘরে ঢুকে  আমাদের অনাবিল শান্তি হরণ করে নিতেন। এমনকি নবদম্পতির ছুটির দুপুরে দিবানিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য ফোন করে অযাচিত অতিথিকে আপ্যায়ণ করতেও  ছাড়তেন না তাঁরা। উদ্দেশ্য একটাই আমাদের অবাধ মেলামেশায় যতিচিহ্ন টেনে দেওয়া।  আমি যেন পরপুরুষের সঙ্গে  গল্প করছি নিজের বেডরুমে বসে। আজ ভাবি তখন কেন whattsapp ছিলনা রে? শত্রুমুখে ছাই উড়িয়ে দেদার প্রেমালাপ করতে পারতি দুজনে!!!
তবে আবারো দিদিমার কথায় “মেয়েদের নিজের সংসারে বুকে বসেই দাড়ি ওপড়াতে হয়’ তাই কোনোকিছুই মেনে নিইনি অত সহজে। আমার এই দিদিমার শাশুড়িই নাকি সে যুগে নিজের ইংরেজী শেখার অদম্য ইচ্ছেকে আমরণ প্রশ্রয় দিয়ে এসেছিলেন। বাড়িতে বাজার সরকারের কাজ করতেন তাঁর কর্তার এক গোমস্তা। তিনি ইংরেজী জানতেন। তাঁকে দিয়ে ফার্স্ট বুক আনিয়ে চুপিচুপি পড়তেন আর বৈঠকখানায় কর্তার বন্ধুবান্ধবদের আড্ডায় আড়ি পাততেন পর্দার আড়াল থেকে। ইংরেজী শব্দ বুঝতে না পারলে কাঠকয়লার টুকরো দিয়ে রান্নাঘরের দেওয়ালে বাংলায় লিখে রাখতেন। পরে গোমস্তাবাবুর কাছে জেনে নিতেন সেই শব্দের অর্থ। একদিন স্বামী স্ত্রীর তুমুল ঝগড়ায় দিদিমার এই শাশুড়িমাকে চুপ করাতে গেছিলেন তাঁর দেওর। বলেছিলেন “শাট আপ!হোয়াট ইজ দিস?” দিদিমার শাশুড়ি সেদিন ঝগড়ায় ইতি টেনে চীৎকার করে বলে উঠেছিলেন” দ্যাট ইজ মাই উইশ!”

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>