| 25 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক সাহিত্য

ইরাবতীর কথা (পর্ব-১০)

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

নারীর নিজের মুক্তির জন্য, নিজের স্বাধীনতার জন্য নিজের উপর নিজেকে আস্থা রাখতে হবে, লড়াইটা নিজেকেই করতে হবে। নারীবাদ বলি কী নারী স্বাধীনতা বা নারী মুক্তি- অর্জন না করলে পাওয়া যাবে না। নরওয়ে নারী-পুরুষের সমতার জন্য একটি পারফেক্ট দেশ বলা চলে। তারপরও এই দেশেও তেমন নারীর সাক্ষাৎ মেলে যে নিজে ডাক্তার হয়েও ডাক্তার স্বামীর ভয়ে তটস্ত থাকে।স্বামী শুধু স্যান্ডউইচ দিয়ে লাঞ্চ করতে চায় না বলে স্ত্রীকে সাথে স্যুপও বানাতে হয়। আর এই স্যুপ বানানোটা ভালোবেসে বানানো না রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে বানানো। এর জন্য নিজের অফিসিয়াল কাজ শেষ কোথাও বসে দু’দণ্ড জিরায় না, পাছে বাসার কাজে দেরী হয়ে যায়। অথচ নরওয়ের সমাজে স্বামী-স্ত্রী সপ্তাহের দিনগুলো ভাগাভাগি করে রান্নাসহ ঘরের যাবতীয় কাজ করার নিয়ম। দেখা যাচ্ছে, আইন থাকলেও সব নারী তা যথাযথ নিতে পারছে না। এমন শিক্ষিত নারীকে কে নারী-স্বাধীনতা এনে দেবে বা তার কাছে নারী স্বাধীনতা বা নারীমুক্তির সংজ্ঞা কী কে জানে! ’ইরাবতীর কথা’ ধারাবাহিকে ইরাবতীকে নারীর অনেক না বলতে পারা কথায় ও রূপে সাজিয়েছেন বিতস্তা ঘোষাল আজ থাকছে ইরাবতীর কথা ধারাবাহিকটির ১০ম পর্ব।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

প্রায় একমাস হলো জোহেনেসবার্গ থেকে ফিরে এসেছে ঐহিক। বেশিরভাগ সময় বাড়িতেই কাটাচ্ছে।কথাবার্তাও বিশেষ বলছে না। হেড অফিস তো নয়ই, স্থানীয় অফিসে যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে। কিছু জানতে চাইলে বলছে, শরীর ঠিক লাগছে না। ওখানে গিয়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভরতি হতে হয়েছিল। এক ভারতীয় ডাক্তার খুব সাহায্য করেছেন।

কী হয়েছিল? ইরাবতী জানতে চায় ।

প্রচন্ড জ্বর, ডাইরিয়া। শরীরের সব জল বেরিয়ে গেছিল। স্যালাইন, অক্সিজেন দিতে হল।

ও।বলে চুপ করে গেল ইরাবতী ।কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটা ভয় কাজ করছিল।

মানুষটার আগেও  অসুফবিসুখ হয়েছে , এমনিতেই  একটু আতুপুতু।সামান্য জ্বর হলেও মাগো বাবাগো বলে চিৎকার জুড়ে দেয়। বিয়ের পর থেকে এ দৃশ্য বহুবার  দেখে এসেছে ইরাবতী। রক্ত পরীক্ষা করতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া , সুচ ফোটানো মাত্র কম্পাউন্ডারকে চড় মারতে যাওয়া। সময়ের সাথে এগুলো এখন সহজে মেনে নিলেও একটুতেই কাবু হয়ে পরাটা বন্ধ হয় নি। কিন্তু কথা বলা কখনোই থেমে থাকে না তার।

অথচ এবার ফেরার পর থেকে কেমন যেন থ মেরে গেছে সে। কিছু জানতে চাইলে বেশ খানিকক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে তারপর ধীরে ধীরে উত্তর দিচ্ছে ।গলায় সেই জোরালো দাপট ম্রিয়মাণ ।

ইরাবতী প্রথমে ভেবেছিল, শরীরের কারণেই বুঝি দূর্বল হয়ে পরেছে। কিন্তু ক্রমশ বুঝতে পারছে, শুধু শরীর নয়, মনের জগতেও একটা সাংঘাতিক কিছু ঘটে গেছে ঐহিকের। সেটা লুকিয়ে রাখতে গিয়ে মনের উপর অত্যধিক চাপ নিয়ে ফেলছে, আর তাতে মানসিক স্থিতিটা টলে গেছে। শাপলা কী তবে সব টাকা পয়সা নিয়ে অন্য কারোর সঙ্গে পালিয়েছে! যতদূর সে জানে ঐহিকের আকাউন্ট সেই সামলাতো। তাই কী! মনটা হঠাৎ আনন্দে ভরে উঠল। তাই যেন হয় ঠাকুর। ঐহিক চরম আঘাত পাক তাকে অপমান করার জন্য।

পরমুহূর্তেই নিজেকে ধিক্কার দিল সে। এত প্রতিশোধ স্পৃহা, ঘেন্না তার মনে জমে আছে কিভাবে! সেতো সব ভুলে যেতে চেয়েছে। তারপরেও এসব ভাবছে! একজন মানুষ যদি অন্য কোনো মানুষের কাছে শান্তি সুখ ভালোবাসা পায় তবে তার পুরো অধিকার আছে সে জীবন উপভোগ করার। সেতো কারোর ক্ষতি চাইতে শেখেনি। তবে! তবে কী হলো তার!

আর ঐহিকই বা এত গুটিয়ে নিচ্ছে কেন নিজেকে? এমন কিছু কী করেছে যাতে কোনো বড় অঘটন ঘটেছে! শুধু শাপলার জন্য ভেঙে পরার মানুষ সে নয়। এর আগেও একাধিক সম্পর্কের মধ্যে দিয়েই গেছে সে। যদিও এতদিন কারোর সঙ্গেই স্থায়ী হয়নি, তবু…।      

এখানেই অবাক লাগছে ইরাবতীর। আজ অবধি যা যা করেছে ঐহিক সবটাই নিজের ইচ্ছেতে। বেহিসাবী জীবন, চরম উৎশৃঙ্খল, সংসার, সন্তান, স্ত্রী কারোর প্রতিই  দায়িত্ব না নিলেও নিজের কাজগুলো মনোযোগ দিয়ে করত।

অর্থও যে ভালোই উপার্জন করত তা তার বিলাসিতা দেখে যথেষ্টই বোঝা যেত। দামি দামি ঘড়ি, নামি ব্রান্ডের পোশাক, জুতো, ব্যাগ, বড় বড় হোটেল ছাড়া তার চলে না। রাজ্যের মধ্যে ঘুরতে হলে সে কখনো ট্রেন বাস চড়ে না।নিজের গাড়িতেই সর্বত্র ।

কতবার ইরাবতী এই নিয়ে বকাঝকা করেছে। কী দরকার অযথা তেল পুড়িয়ে! এসি ট্রেন, বাস আছে , তাতে গেলেই তো হয়! 

বিচ্ছিরিভাবে মুখ খেঁকিয়ে উত্তর এসেছে , আমি যা করি নিজের পয়সায় করি, কারোর বাবার টাকায় নয়।তুমি ভিখারি হয়ে বাঁচতে পারো, আমি নই।

ইরাবতী চিৎকার করে উঠেছে- আমি যদি তোমার মতো জীবন কাটাতাম তাহলে এই দুটো পেটের দায়িত্ব নিতে পারতে কস্মিনকালেও! কখনো জানতে চেয়েছ প্রান্তির স্কুল কলেজের  মাইনে কত? প্রতিদিন আমি কী করে সংসার চালাই? 

কিন্তু শেষ অবধি কিছু না বলে সরে এসেছে । যে মানুষটার সঙ্গে তার মনের জগতের কোনো স্থায়ী সম্পর্ক তৈরি হল না এতগুলো বছরেও, কী হবে তার সঙ্গে ঝগড়া করে? এই তো দুদিনের জীবন। আজ আছি কাল থাকব কিনা অনিশ্চিত। তাহলে মিছে কেন এই অশান্তি ? 

তবু বড় মায়া লোকটির প্রতি। খুব ছোট বয়স থেকে চেনা, জীবনের প্রথম ধাপের বহু চড়াই উতরাই একসঙ্গে , যতই মনে হোক, না থাকলেই বা ক্ষতি কী, তবু একেবারে নেই ভাবলেই কেমন যেন ফাঁকা লাগে সব।

‘জানিস সম্পর্ক হচ্ছে একটা অভ্যাস, প্রতিদিন যেমন খাওয়া, স্নান করা, ঘুমনো, দাঁত মাজার অভ্যাস তৈরি হয়, ঠিক পাশাপাশি বাস করা মানুষদুটোর মধ্যেও একটা অভ্যেস গড়ে ওঠে। কেমন বলতো সেটা? বেদভ্যাস মেয়েকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে আপন মনে হাসে।

এই অভ্যাসটা হল নুন চাল ডাল, ঝগড়া , আবার ভাব ভালোবাসার অভ্যাস। এবং জানবি মানুষের যত অভ্যাস আছে তার মধ্যে এই সম্পর্কের অভ্যাস হচ্ছে সবচেয়ে মারাত্মক। একবার যে জড়িয়েছে , তাকে সারাজীবন এই অভ্যাসের দাসত্ব করে যেতেই  হবে, এর থেকে মুক্তি নেই।

 বেদভ্যাসের কথাটা যে কত দামি আর ভয়ংকর সত্য, ইরাবতী এত বছর পর উপলব্ধি করতে পারে। ঐহিক এখন তার অভ্যাস।  সত্যি তো, সামনে থাকলে অশান্তির শেষ নেই, রোজ কিছু না কিছু নিয়ে ঝামেলা, অশান্তি। কিন্তু দূরে গেলেই মনে হয় কবে ফিরবে! কেমন আছে, কী করছে মানুষটা! ঠিক মতো খাচ্ছে তো! ঘরে ঢুকেছে ? এমন নানা প্রশ্ন মাথায় ভিড় করে আসে। অথচ নিজেও জানে এমন অবান্তর ভাবনার কোনো মানে নেই।

কিন্তু এটাও বোঝে না  যে মানুষটা দূরে ছিল, যার কাছে নুন্যতম মর্যাদাও সে পায় নি, সে হঠাৎ বাড়িতে থাকলে, বারবার তার খোঁজ করলে কেন দমবন্ধ লাগে। মনে হয় সব স্বাধীনতা চলে যাচ্ছে। যে মুক্তির স্বাদ সে এতদিন ভোগ করতে অভ্যস্ত হঠাৎ যেন তাতে কেউ শিখল পরাতে চাইছে ।

ইরাবতীর দিশাহারা লাগে।

প্রান্তিও জিজ্ঞেস করে, মা, বাবা এতদিন বাড়িতে কেন? 

ভালো তো প্রান্তি।এত বছর ধরে তো রোজ আফসোস করেছ, প্রত্যেকের বাবা সব জায়গায় নিয়ে যায়, আড্ডা মারে, কত দায়িত্ব নেয়, আর আমার বাবা . . . । এখন সব ইচ্ছা মিটিয়ে নাও।

মা, তখন আমি ছোট ছিলাম, বাবাকে মিস করতাম। এখন আর মিস করি না। বাবার দূরে থাকাটাই এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। বরং বাড়িতে থাকলেই কেমন একটা হয়।

মেয়ের কথা শুনে ইরাবতী একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সে প্রান্তিকে ধমক দেয়। প্রান্তি, বাবা বাড়িতে থাকবে নাতো কোথায় থাকবে? সারাজীবন কী ভবঘুরে হয়ে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াবে! এবার তো বয়স বাড়ছে বাবার। দেখতে পাচ্ছ তো শরীরও ঠিক নেই।

প্রান্তি বলল, আদিখ্যেতা কোরো না।শরীর খারাপ তো ডাক্তার দেখাতে বলো।যতসব ন্যাকামি তোমার।যখন শরীর খারাপ নিয়ে বিছানায় পরে থাকো কে দেখে তোমায়! আর তিনি কী করেন মনে নেই? ফোনে বলে দেন, ডাক্তার দেখিয়ে নাও, কিংবা বলে আমি কী করব! তুমি ভুলে যেতে পারো মা, আমি ভুলি না। অত পিড়িত আমার আসে না।

প্রান্তির মুখের ভাষা শুনে অবাক হয়ে যায় ইরাবতী। সে ধীর অথচ গম্ভীর গলায় বলল, ভুলে যেও না প্রান্তি, সে তোমার বাবা। আজ যেসব কথাগুলো বলছ, সেগুলো বলার আগে বোঝা উচিত, এই লোকটি তোমাকে এনেছে এই পৃথিবীতে। তাকে অসম্মান করার অধিকার তোমাকে আমি দিইনি।

প্রান্তি হঠাৎ প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো, পৃথিবীতে আমাকে এনে তোমরা মহান কোনো কাজ করোনি মা। জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায় না। হ্যাঁ, স্বীকার করছি আমার জীবনে তোমার অবদান সবটাই। তুমি না থাকলে আমি বাঁচতে পারব না। কিন্তু তোমার বরের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই মা। থাকো পরে তুমি। আমি কালই দাদানের কাছে চলে যাব।

কথাগুলো একনিঃশ্বাসে বলে প্রান্তি ইরাবতীর মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিল।

ইরাবতী মুহূর্ত খানেক কিংকর্তব্যবিমুখ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। তার মনে হয়, এই প্রান্তিকে সে চেনে না। এতবছর ধরে যে মেয়েকে সে একা হাতে বড়ো করেছে , সব মানুষকে- সে যেমনি হোক ক্ষমা করতে শিখিয়েছে, তার এমন আচরণ কী করে হল! তাহলে কী সন্তান মানুষ করতে সে ব্যর্থ নাকি বাবার প্রতি তীব্র আক্রোশ থেকেই এই অকস্মাৎ আক্রমণ! 

ইরাবতী বুঝতে পারল না, তার চোখ দিয়ে শুধু বৃষ্টির ফোঁটার মতো জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত