| 29 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক সাহিত্য

ইরাবতীর কথা (পর্ব-৫)

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

নারীর নিজের মুক্তির জন্য, নিজের স্বাধীনতার জন্য নিজের উপর নিজেকে আস্থা রাখতে হবে, লড়াইটা নিজেকেই করতে হবে। নারীবাদ বলি কী নারী স্বাধীনতা বা নারী মুক্তি- অর্জন না করলে পাওয়া যাবে না। নরওয়ে নারী-পুরুষের সমতার জন্য একটি পারফেক্ট দেশ বলা চলে। তারপরও এই দেশেও তেমন নারীর সাক্ষাৎ মেলে যে নিজে ডাক্তার হয়েও ডাক্তার স্বামীর ভয়ে তটস্ত থাকে।স্বামী শুধু স্যান্ডউইচ দিয়ে লাঞ্চ করতে চায় না বলে স্ত্রীকে সাথে স্যুপও বানাতে হয়। আর এই স্যুপ বানানোটা ভালোবেসে বানানো না রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে বানানো। এর জন্য নিজের অফিসিয়াল কাজ শেষ কোথাও বসে দু’দণ্ড জিরায় না, পাছে বাসার কাজে দেরী হয়ে যায়। অথচ নরওয়ের সমাজে স্বামী-স্ত্রী সপ্তাহের দিনগুলো ভাগাভাগি করে রান্নাসহ ঘরের যাবতীয় কাজ করার নিয়ম। দেখা যাচ্ছে, আইন থাকলেও সব নারী তা যথাযথ নিতে পারছে না। এমন শিক্ষিত নারীকে কে নারী-স্বাধীনতা এনে দেবে বা তার কাছে নারী স্বাধীনতা বা নারীমুক্তির সংজ্ঞা কী কে জানে! ’ইরাবতীর কথা’ ধারাবাহিকে ইরাবতীকে নারীর অনেক না বলতে পারা কথায় ও রূপে সাজিয়েছেন বিতস্তা ঘোষাল আজ থাকছে ইরাবতীর কথা ধারাবাহিকটির ৫ম পর্ব।


সারাটা পথ মনটা ভারী হয়ে রইল ইরাবতীর। কতই বয়স ছেলেগুলোর! এত উৎশৃঙ্খল জীবন যাপন এই প্রজন্মের! শেষ অবধি এই সমাজটা কোথায় যে যাচ্ছে! একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল।

এগারোটা বাজার একটু আগে ঘরে ঐহিকের ফোন এল।

আমি একটা জরুরী মিটিংএ কলকাতা আসছি। রাত হবে। দরজা খোলা রেখ। আর একটাও বাড়তি কথা না বলে ফোন রেখে দিল ঐহিক।

আরো দশ মিনিট বাদে কোলাপ্সেবল গেট, দরজার চাবি খুলে অন্ধকার ঘরে ঢুকল ইরাবতী। প্রান্তি কাল মামমামের সঙ্গে তাদের শান্তিনিকেতনের বাড়ি চলে যাবার পর থেকে একটা একাকীত্ব ঘিরে ধরেছে।      

কেন যে এই চার দেওয়ালের মধ্যে রোজ ফিরে আসতে হয়, কেনই বা এভাবে বেঁচে থাকা ভাবতে ভাবতে আলো জ্বালালো। টেবিলের উপর রাখা বোতল থেকে জল খেল। মোবাইল বাজছে। প্রান্তির ফোন।

মা কী করছ?

এই যে বাড়ি ঢুকলাম। তুমি কী করছ?

আমরা খোয়াই দেখে খেয়ে ফিরলাম। ওঃ মা… মা…

কী হল?

একটা কথা বলব? প্রান্তি কী বলতে পারে ইরাবতী জানে। তবু হেসে বলল, বলে ফেলো-

তোমাকে ছাড়া আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। মামমামও তোমাকে খুব মিস করছে, তোমরা দুইবোনই তো গেছো দাদা না না দিদি ছিলে। প্রান্তি হাসল। মামমাম একা একা গাছে চড়তে চাইছে না, আমাদেরও উঠতে দিচ্ছে না। বলছে, দি’ভাই থাকলে মজা হত।

হুম।

মা কাল চলে আসবে?

কাল তো অফিস,

তোমার রোজই কিছু না কিছু বাহানা। আসতে হবে না।

হুম।

একটা কথা বলব ? আমরা কাল রাতেই ফিরে যাচ্ছি। মেসোবাবাকে পরশু জাপান যেতে হবে।

ও। সাবধানে থেকো, মজা করো। মন খারাপ কোরো না বেশ। মুউউউহা…

লাভ ইউ মা। তুমিও সাবধানে থেকো। রাত জাগবে না। আর খেয়ে নেবে।

তুমিও রাত জেগে পাপজি খেলবে না

আচ্ছা বাই। রাখলাম। প্রান্তি জানে মা এরপর এই খেলা নিয়ে বলেই যাবে। অন লাইনে এই গেম খেলা মা দুচক্ষে দেখতে পারে না। সে আবার বলল, মাম্মি, গুড নাইট, লাভ ইউ। বাই।

ইরাবতীও জানে, প্রান্তি আর কোনো কথা বলবে না। মেয়েটা ক্রমশ নেশাগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে এই খেলায়। কী যে বিরক্তিকর! বাই সোনা, মনে থাকে যেন, বলে ফোন রাখল সে। 

 তারপর ফ্রিজ খুলে সকালের রান্নাগুলো মাইক্রোওভেনের ওপর রেখে স্নানে গেল। ইট দিয়ে বাথরুমের নালির মুখটা বন্ধ করল।

 এমনিতে সে কখনো শাওয়ার চালায় না।  কী ভেবে চালিয়ে দিল। বৃষ্টির মত সেই জলের ধারা তার গা বেয়ে নেমে আসছে।  

ইরাবতীর এখন খুব কান্না পাচ্ছে। ইচ্ছে করছে তীব্র ভাবে কাউকে জড়িয়ে ধরতে। কারোর বুকে মুখ ঘষতে। সে চোখ বন্ধ করল।

 দূরের একটা ঘর থেকে আলোর রেখা এদিকে আসছে। ঘরটা তার ভীষণ চেনা। চেয়ারে বসে বিছানায় পা তুলে সিল্কের লুঙ্গি, খালি গা, এক হাতে সিগারেট নিয়ে ফোনে কথা বলছে এক দিব্য পুরুষ। সারা ঘর জুড়ে চন্দনের আর ধূপের গন্ধ। সে আস্তে করে দরজা খুলে চেয়ারের সামনে গিয়ে মাটিতে বসে পড়ল।

ইশারায় তাকে বসতে বলল সেই পুরুষ। সে নিজের মাথাটা রাখল তার পায়ের উপর।

টেলিফোন রেখে তিনি বললেন, কী হল? মন খারাপ?

তোমাকে ছেড়ে আর থাকতে পারছি না। তুমি কী ঈশ্বর হয়ে গেছ? আজকাল আমি তোমাকে কেন এভাবে দেখি বাবা? আমার ভীষণ একা লাগছে। মনে হচ্ছে চারদিক অন্ধকার। তুমি আমাকে তোমার কাছে নিয়ে নাও।

মাথাটা নিজের বুকে টেনে নিয়ে তিনি বললেন, কোথায় তুই আমায় ছেড়ে? আমি তো এখন তোর মধ্যে বিলীণ হয়ে গেছি একেবারে। দেখলি না, যেই মন খারাপ বলে কাঁদলি, আমি চলে এলাম।

ইরাবতী হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল বাথরুমের মেঝেতে। চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। আমি তোমার কাছে থাকতে চাই বাবা। তোমার মধ্যেই আমি ব্রহ্ম দর্শন করেছি। আমাকে এই জীবন থেকে মুক্তি দাও…  

 এভাবেই কেটে গেল অনেকটা সময়। এখন শুধু জলের শব্দ। একটা স্থির পুকুরের মত জল এখন তার গলা অবধি। ইরাবতীর মনে হল সে, আর একটুখানি অপেক্ষা। তারপরই খালি আলো আর আলো।

 হঠাৎ করে এতক্ষণ জমে থাকা শান্ত অন্ধকার ভেদ করে তীব্র ভাবে কলিংবেল বেজে উঠল। একবার… দু বার… তিনবার…

ইরাবতী… ইরাবতী… ঘুমিয়ে গেলে নাকী! দরজা ভাঙতে হবে দেখছি!

কয়েক মুহূর্ত ইরাবতী সাড়া দিল না। ভাঙো, ভেঙে ফেল সব দরজা। আমি এখন রওনা দিয়ে দিয়েছি শান্তির দেশে। আর তোমাকে আমার প্রয়োজন নেই। ইরাবতী সব কটা কল খুলে দিল। আর তখনি তার পড়ল বেদভ্যাসের কথা। ছিঃ ছিঃ, এভাবে কেউ মরে! ভেবে দেখ তুই মরার পর তোর নগ্ন শরীরটা একদল মানুষ কাটবে, আরো কত কী করবে। বড় বড় সুচ দিয়ে তারপর সেলাই করবে। এত সুন্দর দেহ … কী যে বিভৎস দেখাবে…

বাবার মুখের চোখের সেই অদ্ভুত চাউনি ইরাবতী সেইমুহূর্তে চোখের সামনে দেখতে পেল। তাড়াতাড়ি সে কল বন্ধ করে ইট সরিয়ে চিৎকার করে সাড়া দিল, বাথরুমে আছি। একটু দাঁড়াও।

ঐহিক খেয়েই ফিরেছে। পুরো তিন বছর বাদে বাড়ি ফিরে একটা কথাও না বলে সে নিজের ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়েছে। সেই ঘর থেকে তার নাক ডাকার শব্দ ভেসে আসছে। পর্দা সরিয়ে দরজা ফাঁক করে দেখল গভীর ঘুমে সে । এসি ফুল স্পিডে। ঘরটা এক নিমেষে তার মনে হল মর্গ। বুকটা হঠাৎই অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো তার। সে কাছে গিয়ে নাকের কাছে হাত রাখল।

দূর ! এই তো জোড়ে নাক ডাকার শব্দ পেয়েই এ ঘরে এলাম। নিজের মনেই হেসে ঐহিকের মুখের দিকে তাকালো। 

 তার মুখটা এইমুহূর্তে শান্ত, স্নিগ্ধ, বড় মায়াময়। ঘুমোলে বোধহয় সব মানুষকেই এত সুন্দর দেখায়। ভাবল ইরাবতী। তারপর পাশে পরে থাকা চাদরটা নিয়ে ঐহিকের গায়ে জড়িয়ে দিল।

ভালোবাসা কী এমনই হয়! চূড়ান্ত বিদ্বেষ ভরা মনও কী আসলে নিজেকে কোনো কিছু দিয়ে ভুলিয়ে রাখার একটা মাধ্যম মাত্র! ভেতরে ভেতরে ফল্গু নদীর মতোই সে বয়ে চলে। ঐহিকের প্রতি তাই তার টান ,মায়া, প্রেম কোনোকিছুই একেবারে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যায় না। যতবার তীব্র ঘৃণা আর অভিমান নিয়ে সরে যাবার চেষ্টা করে সে ততবার ফিনিক্স পাখীর মতই ফিরে আসে।

ইরাবতী আলতো ভাবে ঐহিকের কপালে হাত রাখল। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

তখনি চোখ পড়ল মাইক্রোওভেনের উপর রাখা প্লাস্টিকের প্যাকেটের উপর। কাছে গিয়ে গন্ধ পেল। কাবাব। হাসি পেল ইরাবতীর। এত মানসিক দূরত্ব সত্ত্বেও, দীর্ঘদিন বাদে এলেও ইরাবতীর যে কাবাব প্রিয় খাবার, তা ভোলে নি ঐহিক।

প্যাকেট খুলে  কাবাব মুখে নিয়ে তার মনে হল, ভালবাসা হল একটা উপরে ছুঁড়ে দেওয়া পয়সার মত। যার একদিকে প্রেম আর অন্যদিকে ঘৃণা, উপেক্ষা , যন্ত্রণা। দুটোই সমানভাবে অবস্থান করে। কখনো এপীঠ কখনো ও পীঠ। এটা নিয়ে ভাবতে গেলেই সব গোলমাল হয়ে যায়।

ইরাবতী উঁকি মেরে আর একবার ঐহিককে দেখে নিজের বিছানায় ফিরে এল।  

ইরাবতী আমি আজ বিকেলের ফ্লাইটে মুম্বাই যাচ্ছি। সেখান থেকে ভোর সাড়ে -তিনটেয় জোহেনেসবার্গ। একটু গুছিয়ে দাও। ঐহিকের কথাটা কানে যেতেই মাথা গরম হয়ে গেল ইরাবতীর। সে রান্নাঘর থেকেই উত্তর দিল, কী করতে আসো এখানে? বছরে সাতদিনও তো আজকাল থাকো না। অতিথির মতো যখন খুশি আসো, যখন ইচ্ছে যাও। আসার দরকার কী ?

এ কী কথা বলছ তুমি? আমি কী নিজের ইচ্ছেতে মজা করতে যাই? কাজের জন্যই তো যেতে হয়।এর জন্য সরকার আমাকে মাইনে দেয়।

সবই তোমার কাজের জন্য! আর তোমার মাইনেতে আমার কী অধিকার! সেতো তোমার। যাও যেখানে খুশি , আমি তো আছি তোমার সংসার সামলাবার জন্য একাধারে রাঁধুনি, ঝি, বাচ্ছা দেখার মাসি , আবার টাকা সাপ্লাইয়ের যন্ত্র… তোমাকে দরকারই নেই।  ইরাবতী চিৎকার করছিল।

ইরাবতী, সাতসকালে অসভ্যতা শুরু কোরো না। আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি , বাড়ির কোনো দায়িত্ব আমি নিতে পারব না। আমার জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত আমি উপভোগ করতে চাই, সে নিজের টাকায় হোক, কিম্বা অন্যের টাকায়। তুমি যদি আসা মাত্র এমন অশান্তি করো আসবই না আর।

খানিকক্ষণ চুপ থেকে খুব গম্ভীরভাবে ইরাবতী বলল , এতদিন তো আসোনি। তাতে তো আমি বা প্রান্তি মরে যাইনি।  শুনে রাখো তোমার আর না আসাই ভালো। আমি জানব তুমি নেই।

তুমি আমার মৃত্যু কামনা করছ? এত অধঃপতন তোমার? ঐহিক কুৎছিত মুখভঙ্গী করে চিৎকার করে উঠল। আমি এলে বুঝি তোমার নাগরেরা আসতে পারে না!

সে কথার  সরাসরি জবাব না দিয়ে ইরাবতী বলল, আমি আমার সন্তানের নামমাত্র ভূমিকায় অভিনয় করা বাবার মৃত্যু চাই না। কিন্তু মন থেকে চাই তুমি যেন আর এখানে না আসো। ভবিষ্যতে না এলেই আমার ভালো লাগবে।

আমার বাড়িতে তুমি আমাকে আসতে বারন করছ কোন অধিকারে? ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব।

ভুল করছ তুমি। বাড়িটার মালিকানা দুজনেরই। আর বেশিরভাগ টাকা আমার দেওয়া।ইরাবতী জানালো।

তোমার? চেঁচিয়ে উঠল ঐহিক।

না, পুরোটা নয়। প্রাথমিক টাকা বাবার দেওয়া। আমার বাবার। তোমার যেখানে ইচ্ছে সেখানে যেতে পারো। আমাকে ডাকবে না আর। বলে ইরাবতী নিজের ঘরে ঢুকে বিছানার এক কোণে বসল। তার চোখ বেয়ে জল গালে গড়িয়ে পড়ল।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ। ঝড় থেমে যাবার পর থমথমে একটা পরিবেশ সারা বাড়ি জুড়ে। ইরাবতী শুনতে পাচ্ছিল, ঐহিক ফোনে কারোর সঙ্গে কথা বলছে। সে চোখ মুছে উঠে পড়ল। অফিস যেতে হবে। যে যেখানে ইচ্ছে যাক। তাকে নিজের অফিস  যেতেই হবে। একমাত্র সেখানেই সে তার মুক্তি খুঁজে পায়। অফিসের চেয়ার, টেবিল, সামনে রাখা সোফা, বইয়ের তাকে রাখা সারি সারি বইয়ের মধ্যেই তার প্রকৃত আশ্রয়।

আরো কিছু সময় এভাবেই কেটে যাবার পর ঐহিক ইরাবতীর ঘরে এলো। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করতে করতে আড়চোখে দেখল ইরাবতীকে। ইরাবতীর চোখে জল। তার মজা লাগে ইরাবতী কষ্ট পেলে। সে নিজের মনেই বলল, কাঁদ মাগী। এত অহঙ্কার কিসের তোর! বাবা বিখ্যাত, প্রচুর টাকা দেয়, তাই আমাকে পাত্তা দিস না, শোন মূর্খ তোকে আমি কখনোই ভাল বাসিনি। জানতাম বাপের সম্পত্তি আছে, তাই বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু তুই শালা দিন রাত আমাকেই ঠেলে ঠেলে কাজ করতে বাধ্য করলি। এখন দেখ কত টাকা আমি কামাচ্ছি। কিন্তু তোকে দেব না। তোর ভীষণ আত্মসম্মান বোধ তাই না! ভাঙবি তবু মুচকাবি না।

তারপর একবার গলা ঝেড়ে বলল, আচ্ছা শোনো, রাগ পড়লে আমাকে একটু জোহেন্সবার্গের ইতিহাসটা বলে দাও।

পারব না। গুগল সার্চ করে দেখে নাও।

গুগলদা ইতিহাসে ডক্টরেট নয়। লোকে জানলে কি বলবে? ইতিহাসের প্রাক্তন অধ্যাপিকার স্বামী কিনা মূর্খ!

এত রাগের মধ্যেও হেসে ফেলল ইরাবতী। কুঁড়ের বাদশা। নেটে এখন সব পাওয়া যায়। সেটা দেখে নিতে পারছ না?

না, পারব না। আমি তোমার থেকেই জানব, বলে ইরাবতীর হাত ধরে নিজের কাছে টেনে নিল ঐহিক।

যত সব আদিখ্যেতা! সহ্য হয় না। ছাড়ো বলছি। ইরাবতী জানে এসবই ঐহিকের সাময়িক অভিনয়। তবু কখনো কখনো এসব দেখতেও মন চায়। কতদিন হয়ে গেছে তাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। তবু শিহরণ জাগে।  

ঐহিক হাত ধরে রেখেই বলল, আগে বলো তুমি আর রাগ করবে না। এই যে এতদিন বাদে এলাম সেতো তোমার জন্যেই,তাই না? তুমি আর বাবান ছাড়া আর কে আছে আমার? তোমাদের জন্যই তো… কথা দিচ্ছি এবার থেকে নিয়মিত আসব, তোমার ফোন ধরব…

ইরাবতীর খুব বলতে ইচ্ছে করল, আমাদের জন্য তুমি কোথাও কিছু রাখোনি আমি জানি ঐহিক, এমনকি তুমি জানতেও চাও না কখনো আমি কিভাবে সংসার চালাই। প্রাত্যহিক জীবনে আমাদের কোনো অস্তিত্বই তোমার কাছে একেবারেই নেই। তবু মুহূর্তের জন্য মনে হল, ঐহিক কী ফিরতে চাইছে? কিছু কী জানতে চাইবে? কিন্তু

শেষ অবধি কিছুই বলল না সে। একটা শ্বাস নিয়ে বলল,

 দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্বের খুবই প্রাচীন জীবাশ্ম ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখা যায়। জোহেনেসবার্গেও তার প্রমাণ মেলে। এখানে প্রথমে বসতি স্থাপন করে স্যানরা। এরপর আসে খৈ খৈ ও বান্টু ভাষার লোকজন। ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দে কেপ সাগরপথ আবিষ্কারের দেড় শ’ বছর পর হল্যান্ডের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এখানে একটি বিশ্রামকেন্দ্র স্থাপন করে। পরে সেটাকেই কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে কেপটাউন শহর। তখন সেখানে বাস করত স্থায়ী জোনা ও জুলু সম্প্রদায়।

এরপর কেপটাউনে ইউরোপীয়দের আগমন ও বসতি স্থাপন বাড়তে থাকে। অবশেষে ব্রিটিশরা কেপটাউনকে ব্রিটিশ উপনিবেশ করে নেয়। এরা স্বাধীনতা পেয়েছে অনেক পরে। এই সেদিন নেলসন ম্যানডেলার নেতৃত্বে।

আর?

আর আবার কী! তোমার বলার জন্য এইটুকুই যথেষ্ট। বাকিটা হিস্ট্রি অফ জোহেনেসবার্গ সার্চ করে পড়ে নিও। আমি এবার রেডি হই। বলে ইরাবতী উঠে পড়ে বিছানা ছেড়ে।

আজও বেরবে তুমি?

হুম। আর এক কাপ চা খাওয়াতে পারি। খাবে কী?

হ্যাঁ দাও। প্রান্তি ঘুমচ্ছে এখনো?

না, ও শান্তিনিকেতনে।

কবে গেছে? আমি এলাম, আর ও নেই? ওকে না পাঠাতে পারতে। আমি আছি আজ।

আছি বোলো না, বলো খানিকক্ষণ আছি। আর তুমি বলেও আসোনি। তাছাড়া কাল রাতে আমার জানা ছিল না তুমি ঠিক একদিনের জন্য এসেছ। আজই চলে যাবে।

ঐহিক আর কথা বাড়ালো না। ভালোয় ভালোয় দিনটা কেটে গেলেই হলো। কাল থেকে আবার মুক্তির স্বাদ। কোনো দায় দায়িত্ব নেই, কোনো ঝামেলা নেই। এরপর যখন আবার আসব একটা কিছু উপহার নিয়ে এলেই হবে। অবশ্য না আনলেও ক্ষতি নেই। এই মেয়েটার কোনো কিছুর প্রতিই কোনো আকর্ষণ নেই বলেই এত সুবিধা।

ভাগ্যিস ইরাবতী গোছাতে বসেনি। তাহলেই শাপলার জন্য কেনা গাউন চোখে পড়ে যেত। এত করে বললাম নিয়ে নিতে, নিল না। এই মেয়েটাও তেমন! তবে একে হ্যানডেল করা শক্ত। এ ইরাবতীর মত বোকা বা সহজ নয়। তাছাড়া শাপলা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। ওরও ক্রমশ চাহিদা বাড়ছে। আজ ক্ষমতা, টাকা আছে, তাই সঙ্গে আছে। কিন্তু আমার থেকে ভালো খরিদ্দার পেয়ে গেলে সে দু’মুহুর্ত ভাববে না ছেড়ে যেতে। কিছুদিন পর সব মেয়েই শালা এক গোয়ালের হয়ে যায়। খালি এই চাই, সেই চাই। তাছাড়া আমারও বয়স বাড়ছে। তখন তো ইরাবতীর কাছেই ফিরতে হবে। তাই সাবধানে খেলা চালিয়ে যাও ভাই। নিজের মনেই হাসল ঐহিক। তারপর দরকারি দু-একটা জিনিস চেক করে নিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিল।

মা জানো আজ কী হয়েছে? দরজা খুলেই প্রান্তি উত্তেজনাপূর্ণ কন্ঠে বলল। সে শান্তিনিকেতন থেকে ফিরেই কলেজ চলে গেছিল। সেখান থেকেও তাড়াতাড়িই ফিরে গেছে দেখে একটু অবাক হলেও ভাল লাগল ইরাবতীর। মেয়ের দিকে হাসিমুখ নিয়ে তাকিয়ে দেখল তার কানে হেডফোন, হাতে মোবাইল।  সেদিকে একবার দেখে জুতো ছাড়তে ছাড়তে বলল, কী আর হবে! পাবজী খেলায় অলিম্পিকে সোনা পেয়েছ। সব্বাইকে বন্দুক দিয়ে গুলি করে যুদ্ধে জয়ী হয়েছ।

সেতো আমি জিতেছি। খেলাও শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। কিন্তু এটা সেটা নয়।

ও। তাহলে হেডফোন খুলে ফোন রেখে বলো।

এনি গেস?

নতুন কোনো বন্ধু? তারপর কানের সামনে মুখটা নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, ভাল দেখতে কোনো ছেলে?

দূর মা! কিন্তু একজন আমার ক্রাস হয়েছে। রোজ আমাকে কলেজে ফলো করে, আজ দেখলাম আমার ইন্সটাগ্রামও সে দেখে রেগুলার।

তাই? তা কে শুনি। দেখতে ভাল তো ?

মা… লাজুক ভঙ্গীতে প্রান্তি বলল, মা অনিরুদ্ধ।

সেটা আবার কে?

মা তুমি সব ভুলে যাও। তোমাকে এবার দেখছি মেমরি বাড়াবার ওষুধ খাওয়াতে হবে।

সে নয় খেলাম কিন্তু এটা কী সেই খেলোয়ার?

হুম। বাংলার বেস্ট ক্রিকেটার। আমাদের কলেজের।

বুঝলাম।

মা দেখবে? আজ আমাকে মেসেনঞ্জারে হাই করেছে। আমি তো উপর থেকে দেখে নিয়েছি, যাতে আনসিন দেখায়। চেনে নাতো আমায়! আমি হলাম চুপা রুস্তাম।

বুঝলাম। কিন্তু হাই- ইয়ের পর হ্যালো, নাম্বার দেওয়া নেওয়া এগুলো …

না মা, তুমি তো জানো যতক্ষণে আমার পছন্দের কেউ আমাকে পছন্দ করছে, ততক্ষণে আমার আর তার প্রতি কোনো আকর্ষণ থাকে না।

সেতো বুঝলাম। কিন্তু বিয়ের পর? সেখানে তো একজনকে নিয়েই ঘর করতে হবে। তখন কী করবি?

মায়ের কথায় কয়েক মুহূর্ত চুপ রইল প্রান্তি। তারপরে খুব শান্ত অথচ জোরালো কন্ঠস্বরে বলল, প্রথমত আমি বিয়েই করব না। দুনিয়ার সবার বিয়ে দেখে দেখে ঘেন্না ধরে গেছে। বিশেষ করে তোমাকে আর বাবাকে দেখে তো আরোই। আর দ্বিতীয়ত, যদি বাইচান্স বিয়ে করি, তবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, নিজের শর্তে। তোমার মত ছোটো বয়সে বিয়ে করে বাবান আমার কী হবে রে! তোর বাবা আমাকে ছেড়ে চলে গেল, বলে কাঁদতে পারব না মা।

ইরাবতী মিনমিন স্বরে বলার চেষ্টা করল , কিন্তু বিয়ে না করলে তুই কী করে হতিস?

মা, আমি না হলেও ক্ষতি ছিল না। নিজেদের সেক্সের চাহিদা মেটাবার জন্য বিয়ে করেছিলে, তার ফলে আমি। আমাকে মুখ খুলিও না। বাবা আমার কোন দায়িত্বটা নিয়েছে আজ অবধি যে তাকে পুজো করব! আই জাস্ট হেট হিম।

প্রান্তি অনেক হয়েছে। এবার চুপ করো। বলে ইরাবতী বাথরুমে ঢুকে গেল।

আজকাল মেয়েটা অল্পতেই রেগে যায়। কেমন যেন অসহিষ্ণু। কিছু বলতে গেলেই বলবে, আমার জ্বালা তুমি আর কী বুঝবে! দিন রাত তো খেটে যাচ্ছ। চেষ্টা করছ আমাকে সব রকম কমফর্ট দেবার জন্য। কিন্তু বাবা! সেতো নিজেকে নিয়েই মগ্ন। তার কোনো কিছুতে কিছু যায় আসে! 

তারপরেই মেয়েটা কাঁদতে শুরু করে। সব কিছু তোমার জন্য। এই লোকটাকে ডিভোর্স দিলে না। খালি মানিয়ে চলেছ। কেন, তোমার কী নেই! পরমুহূর্তেই জড়িয়ে ধরে বলে, তুমি কোনো চিন্তা করবে না। আমি আছি তোমার। আর কোনো শা… কে দরকার নেই। বুঝতে পেরেছ!

ইরাবতীর অসহায় লাগে। মেয়েটা ক্রমশ সাইকোলজিকাল সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে নাতো! কাউন্সিলিং করানো দরকার। বাবার প্রতি ভালবাসা, সম্মানবোধ সব চলে যাচ্ছে। কী যে করি! নিজের মনেই বিড়বিড় করতে করতে কোনো এক অচেনা শক্তির কাছে সব ভাবনা সমর্পণ করল ইরাবতী। তুমি যা ভালো বুঝবে করো। তবু ভাবনাটা মাথাতে রয়েই গেল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত