| 14 ডিসেম্বর 2024
Categories
ধারাবাহিক সাহিত্য

ইরাবতীর কথা (পর্ব-৭)

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

নারীর নিজের মুক্তির জন্য, নিজের স্বাধীনতার জন্য নিজের উপর নিজেকে আস্থা রাখতে হবে, লড়াইটা নিজেকেই করতে হবে। নারীবাদ বলি কী নারী স্বাধীনতা বা নারী মুক্তি- অর্জন না করলে পাওয়া যাবে না। নরওয়ে নারী-পুরুষের সমতার জন্য একটি পারফেক্ট দেশ বলা চলে। তারপরও এই দেশেও তেমন নারীর সাক্ষাৎ মেলে যে নিজে ডাক্তার হয়েও ডাক্তার স্বামীর ভয়ে তটস্ত থাকে।স্বামী শুধু স্যান্ডউইচ দিয়ে লাঞ্চ করতে চায় না বলে স্ত্রীকে সাথে স্যুপও বানাতে হয়। আর এই স্যুপ বানানোটা ভালোবেসে বানানো না রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে বানানো। এর জন্য নিজের অফিসিয়াল কাজ শেষ কোথাও বসে দু’দণ্ড জিরায় না, পাছে বাসার কাজে দেরী হয়ে যায়। অথচ নরওয়ের সমাজে স্বামী-স্ত্রী সপ্তাহের দিনগুলো ভাগাভাগি করে রান্নাসহ ঘরের যাবতীয় কাজ করার নিয়ম। দেখা যাচ্ছে, আইন থাকলেও সব নারী তা যথাযথ নিতে পারছে না। এমন শিক্ষিত নারীকে কে নারী-স্বাধীনতা এনে দেবে বা তার কাছে নারী স্বাধীনতা বা নারীমুক্তির সংজ্ঞা কী কে জানে! ’ইরাবতীর কথা’ ধারাবাহিকে ইরাবতীকে নারীর অনেক না বলতে পারা কথায় ও রূপে সাজিয়েছেন বিতস্তা ঘোষাল আজ থাকছে ইরাবতীর কথা ধারাবাহিকটির ৭ম পর্ব।


অফিসের টেবিলে বসে কম্পিউটারে ফেসবুক চেক করছিল নীল। এখন সেভাবে কোনো কাজ নেই হাতে। মিটিং যা ছিল দুপুরের মধ্যেই শেষ করে ফেলেছে। ইচ্ছে করলে এখনি সে অফিস থেকে বেড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু বাইরে আর কোথায় যাবে! তাছাড়া আজকাল সে যেখানেই যায়, যাদের সঙ্গেই মেশে, তাদের নিয়ে মুখোরোচক খবর তৈরি হয়ে যায়। একেই বলে ইয়লো জার্নালিজিম।

এসব কথা ভাবতে ভাবতে ফেসবুকের বিভিন্ন পোস্ট স্ক্রল করছিল।

 বিভিন্ন পোস্টগুলো দেখতে দেখতে চোখ আটকে গেল ইরাবতীর পোষ্টে। একটা ছবি পোস্ট করেছে। লাল শাড়ি পরা। এলো চুল। নগ্ন দুটো হাত। কানে ভারি দুল। সে অনেকক্ষণ ধরে ছবিটা দেখল।

খুঁটিয়ে দেখলে নিখুঁত সুন্দরী বলা যাবে না। গায়ের রঙ যে ফ্যাটফ্যা্টে  ফর্সা তাও নয়। সাজ-গোজও পরিমিত। তবু কী যেন আছে চেহারাটার মধ্যে। চোখদুটো টানা টানা না হলেও একটা মাদকতা আছে।

নীল তাকিয়ে রইল আরো বেশ কিছুক্ষণ। প্রথম কথা বলে ইরাবতীকে যেমন মনে হয়েছিল, সামনাসামনি দেখা হবার পর দেখেছিল এতটুকু মিল নেই। স্বভাবে গম্ভীর বললে ভুল, কিন্তু অতিরিক্ত কথা বলে না। একটা স্ট্রং ব্যক্তিত্ব তার সঙ্গে বুদ্ধির মেল বন্ধনে সেই মুহূর্তে নীল মুগ্ধ হয়ে গেছিল। সে তৎক্ষণাৎ প্রেম করার প্রস্তাব দিয়েছিল।

ইরাবতী খুব জোরে হেসে উঠেছিল। পাগল নাকী?

দেখো, পাগল হবার অনেক কারণ আছে। তুমি যথেষ্ট সুন্দরী, বিদূষী, বুদ্ধিমতী এবং অনুভূতিপ্রবণ। নীল বলেছিল।

প্রথমের তিনটে আমি জানি। কিন্তু অনুভূতির ব্যাপারটা বুঝলাম না। ইরাবতী হাসল।

নীলের সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল ঠোঁট দুটো কামড়ে ধরে চুমু খেতে। ইরাবতী কী বুঝে গেল! সে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল- মিস্টার নীল, আমি আদৌ যতটা আপনি আমাকে সহজ সরল আর অনুভূতিপ্রবণ ভাবছেন নই। কেউ তখনি আমার হাত ধরতে পারে যখন আমি তার হাত ধরি। চুমু খাওয়া তো অনেকদূরের কথা।

নীল অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল। এতদিন তার কাছে যেসব মহিলা এসেছেন, সহজেই ধরা দিয়েছে। সে না চাইলেও নিজের কাজ উদ্ধারের জন্যেও তারা নিজে থেকেই এগিয়ে এসেছে। আর এই মেয়ে বলে কী! সে বিব্রত গলায় বলল- ম্যাডাম , আমি ভাবছিলাম তোমার ছবি তুলব আমার ক্যামেরায়।

আপনার মনের ক্যামেরায় বুঝি! ইরাবতী আবার হাসল।

নিজেকে খানিকটা সামলে নিল নীল। আরে না। আমি পুলিশের কাজ করতে পারি, কিন্তু ছবি তোলা আমার প্যাশন। প্রচুর ছবি তুলি আমি। তুমি আমার প্রোফাইলে গেলে দেখতে পাবে। বলেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিয়ে বলল- পাঠালাম। একসেপ্ট করলে খুশি হব।

বেশ। দেখে নেব।

প্রথম আলাপের সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ল নীলের। একটা কালো জিন্স আর সাদা লঙ কুর্তি, হাতে মুক্তোর ব্রেসলেট ,কানেও মুক্তোর দুল।

আসতে পারি?- বলে যখন ভিতরে ঢুকলো, নীল- হ্যাঁ আসুন- বলে সামনে বসার অনুরোধ জানিয়ে আবার ফাইলে ব্যস্ত হয়ে গেছিল।

কিছুক্ষণ বাদে মুখ তুলে দেখা মাত্র বুকের মধ্যে একটা কী যেন হলো। অথচ ইরাবতী ততক্ষণে সামনে রাখা একটা ম্যাগাজিন তুলে পড়তে শুরু করে দিয়েছে।

নীল খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে দু একবার ইচ্ছে করে কেশে বলল- হ্যাঁ বলুন।

ইরাবতী ম্যাগাজিন রেখে অল্প হেসে বলল – তুমি কাজ করছিলে, তাই … সরি, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য। আসলে সেদিন তো বলেছিলাম, আমি একটা এন জিও চালাই। বলেই ব্যাগ থেকে ব্রোসিওর বার করে তাকে দিয়েছিল। তারপর বলেছিল- পড়ে দেখবেন। যদি ভালো লাগে তবে পরে এই নিয়ে আবার কথা বলব।

নীল সেইমুহূর্তে বলল- তুমিটা রাখা যেতে পারে। আমি তোমাকে তুমিই বলব।

ইরাবতী শব্দ করে হাসল। হাসলে ইরাবতীর সামনের গজ দাঁত দেখা যায়। ইরাবতী হাসতে হাসতেই বলল- বাঁচালে। আমি বেশিক্ষণ আপনি বলতে পারি না।

আরো কিছু মামুলি কথা বলে ইরাবতী উঠে গেছিল সেদিন। কিন্তু নীলের মনে দোলা লাগিয়ে দিয়েছিল। সে দু’দিন বাদেই ফোন করে অন্য কোথাও বসে আড্ডা দেবার কথা বলেছিল। এবং ‘না’ শুনেছিল। এরপরেও সে প্রায় জোর করেই ইরাবতীর অফিসে গিয়ে দেখা করেছিল। আর প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল।

শেষ পর্যন্ত প্রেমটা হয়নি। কিন্তু বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। তাও প্রায় বছর পাঁচ হয়ে গেল।

ফেসবুকে ছবিটা দেখে- মেয়েটার সঙ্গে অনেকদিন কথা হয়নি ভেবে ইরাবতীকে মেসেজ করল। মেসেজ ডেলিভার্ট হল না। মানে নেট অফ। ফোন করব কী ভাবতে ভাবতে নীল আবার অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল।

মোবাইল ব্লিঙ্ক করছে। মেসেজ আলার্ট। ফ্রি আছ? কল করব? ইরাবতীর মেসেজ।

নীল উত্তর দেবার আগেই ইরাবতীর ফোন এল।

কী খবর তোমার? পাত্তাই নেই! নীল ফোন ধরতেই ইরাবতী অভিযোগের সুরে বলল।

আমার পাত্তা নেই নাকি তোমার? আমিই তো মেসেজ করলাম। তাই বুঝি দয়া হল আমার প্রতি! নীল হাসল।

আরে না। ক’দিন ধরেই ভাবছিলাম তোমার কথা। কিন্তু জানিতো তুমি কাজের চাপে তুমি নাজেহাল। ইরাবতী বলল।

এটা কে বলল তোমায়?

সংবাদপত্র। টিভি। কাগজে রোজ পড়ছি, ছবি দেখছি…

থাক। আর বলতে হবে না। বলো কেমন আছ?

দারুণ নীল। একদম বিন্দাস। বলে ইরাবতী হাসল।

ইরাবতীর এই কারণে-অকারণে হাসিটা নীলের বেশ ভালো লাগে। এমন নির্ভেজাল বিশুদ্ধ হাসি আজকাল দেখাই যায় না। সে মজা করে বলল- সুইট হার্ট এমন করে হেসো না। প্রেম তো করলে না আমার সঙ্গে, হেসে মাতাল কোর না।

ইস! কী যে বলে! দিন-রাত বিখ্যাত নায়িকাদের সঙ্গে, নেতৃদের সঙ্গে প্রেম করে বেরাচ্ছে, তাদের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি আপলোড করছে, আর সে কিনা আমার সঙ্গে প্রেম করবে বলছে! ইরাবতী হাসল।

ইরাবতী দূর থেকে যা সুন্দর মনে হয়, সামনে তার রূপ এক নয়। আর নায়িকা বা নেতৃর সঙ্গে প্রেম- ভালবাসার সম্পর্ক হবার চেয়ে … নীল কথাটা শেষ করল না।

এই তুমি রেগে গেলে! আমি মজা করছিলাম।

না, বলো। কোথায় আছ?

বাড়ি ফিরছি গো।

এই লাল শাড়িটা পরে কোথায় গেছিলে?

কোন লাল শাড়ি?

এফ বিতে দেখলাম।

কবে দেখলে? আজ তো কোনো পোস্ট দিইনি।

আমি আজ দেখলাম। কবে দিয়েছ সেটা দেখিনি।

ও। কে জানে মনে পড়ছে না।

এসব ছবি পোস্ট কোরো না। লোকেদের রাতের ঘুম উড়িয়ে দিয়ে কী লাভ বলো!  মাড়ামাড়ি কাড়াকাড়ি শুরু হলে আমাকে আবার বেকার দৌড় ঝাপ করতে হবে।

যত সব ভুলভাল কথা! কোনো কাজ নেই আজ?

ছিল তো! কিন্তু ভুল করে এফ বি খুলেই মরলাম।

এফ বিতে আবার কী হল? ইরাবতী জিজ্ঞেস করল।

 এক মহিলা দারুণ সেক্সি শাড়ি পরে ছবি পোস্ট করেছে। ব্যাস, মাথাটা গন্ডোগোল হয়ে গেল।

দূর বাবা! এত দিনেও তোমার স্বভাব বদলালো না।

স্বভাব কী আর সহজে বদলায়! আর নিজে মাতাল করা ছবি দিয়ে আমাকে স্বভাব বদলাতে বলছ?

উফ নীল! তুমি কী করে পুলিস হলে কে জানে!

কেন ম্যাডাম! পুলিসরা কী খালি চোর ডাকাতের পিছনে লাঠি হাতে ছুটবে! তাদের কী ভালো লাগা মন্দ লাগা নেই!

নীলের কথা শুনে জোরে হেসে উঠল ইরাবতী। শোনো আমি কী দেখলাম বলোতো এক্ষুনি?

এক্ষুনি আবার কী দেখলে! ফোনে কথা বলতে বাইরে তাকিয়ে আছ?

আরে না। আমি কল্পনায় দেখলাম, তুমি লাঠি নিয়ে একটা মোটাসোটা চোরের পিছনে দৌড়চ্ছ। বলেই ইরাবতী আবার হা হা করে হেসে উঠল।

 ও। তা বেশ। কল্পনায় রাস্তার গরু গাছেও চড়ে। তার থেকে সময় হলে বোলো। একদিন আড্ডা মারব। অনেকদিন দেখাও তো হয়নি।

সিওর নীল। ও হ্যাঁ, তোমার ভুঁড়িটা একটু বেড়ে গেছে, জিমে যাচ্ছ না বুঝি!

কে বলল? কোথায় দেখলে?

কাগজে দেখলাম। মনে হল মোটা হয়েছ।

হুঁ। তা হয়েছি বলে নিজের ভুঁড়িটায় একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে নীল আবার বলল- কী করব বলো! আজকাল আর নিজের জন্য সময় নেই। আজ এই তো কাল সেই অনুষ্ঠান। সর্বত্র গাড়িতে দৌড়ে বেরাচ্ছি। কাজ তো নেই খালি বসে থাকা ছাড়া।

তাহলে বলছ এদেশে আর চুরি ডাকাতি খুন নেই! চোর ডাকাত খুনী ধরতে হচ্ছে না! ইরাবতী মজা করে বলল।

সব আছে ইরাবতী। কিন্তু সনাক্ত করার লোকটাই নেই। আসলে এখন কে চোর কে ডাকাত আর কেই বা খুনি বোঝা গেলেও ধরা যায় না। নীলের গলার স্বর হঠাৎই গম্ভীর হয়ে উঠল।

কেন?

কারণ…। বাদ দাও। চলো একদিন মজা করি, আড্ডা দিই। জমিয়ে খানাপিনা করি। অবশ্য তুমি তো আবার সেসব ক্ষেত্রেও বিরতি টেনে রেখেছ।

নীল আমি বিরতি টানিনি। যে জিনিস আমি পছন্দই করি না তার শুরু বা বিরতি কোনোটাই নেই। আচ্ছা চলো নীল,বাই। আবার পরে কথা হবে। আর কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই ইরাবতী লাইন কেটে দিল। নীলের কী মন ভালো নেই! মনে হলো শেষের দিকের কথাগুলো একটু গম্ভীর শোনালো। সেকী বিরক্ত এই চাকরীতে! কে জানে! ভাবতে ভাবতে ইরাবতী আবার নিজের ভাবনায় ডুবে গেল।

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত