Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

রেনেসাঁর জন্ম প্লেগ মহামারীর পরই আর করোনার পরে কি

Reading Time: 3 minutes

ইতালিতেও শুরু হতে চলেছে দ্বিতীয় দফার লকডাউন। কতটা শিথিল করা হবে বিধিনিষেধ, তা নিয়ে সারা দেশ দ্বিধাবিভক্ত, বিতর্কে সরগরম। জানালেন নিকোলো রোকো। আলাপে নীলাঞ্জন বসু



শুধু আমার দেশের ভুল নিয়ে বলাটা একটু কঠিন। যা-ই হোক না কেন, ইতালি বিশ্বের বিজ্ঞান মহল ও পশ্চিমি দেশগুলোর কাছে একটা মডেল হয়ে উঠেছে। আমার দেশের করোনাভাইরাস ম্যানেজমেন্ট দিশা দিয়েছে পশ্চিমের দেশগুলোকে। যদিও এটা বলতেই হবে, প্রথম দিকে ভাইরাসটিকে সে ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। দুর্ভাগ্যজনক হল, গোড়ায় চিন থেকে অপরিষ্কার টুকরোটাকরা তথ্য আসছিল। তাই ইতালির মতো তৈরি ছিল না সমগ্র ইউরোপ। ইতালি, বিশেষ করে উত্তর ইতালি অনুকূল পরিবেশে ভাইরাস বৃদ্ধির আগে দু’সপ্তাহ বেশি সময় পেয়েছিল অন্য দেশগুলোর থেকে। কিন্তু ঘটনার গতিপ্রকৃতি মূল্যায়ন করা কঠিন ছিল। কারণ ভাইরাসের প্রভাব বদলাচ্ছিল দ্রুত। ‘হু’-ও একাধিক বার এর মধ্যে অবস্থান বদল করেছে। তবে এর মধ্যেও একটা মৌলিক ভূমিকা নিয়েছে আমার দেশ। ইতালিই প্রথম কোনও পাশ্চাত্যভূমি, যেখানে স্কুল-কলেজ-সহ সব বন্ধ করে চালু হয় লকডাউন।

শিল্পাঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্ক

উত্তর ইতালির শিল্পাঞ্চলে সংকট যে ভয়ানক হয়ে উঠেছে, তা সত্যি। কারণ ইতালির এই অংশের সঙ্গেই প্রচুর বিদেশি রাষ্ট্রের সম্পর্ক রয়েছে। দেশের এই অঞ্চলে জনবসতি অনেক ঘন। কলকারখানা অধ্যুষিত। যখন দেশের সরকার এই সব কারখানায় উৎপাদন বন্ধ করে দেয়, তখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য তৈরির প্রবাহ যাতে ভেঙে না-পড়ে, সে দিকে খেয়াল রাখতে হয়েছে। খাবারদাবার, স্বাস্থ্য বা শক্তি সংক্রান্ত সব পণ্যকেন্দ্র এমন একটা জায়গায়, যেখানে কোভিড-১৯-এর প্রকোপ সাংঘাতিক।

সংক্রমণ ও দক্ষিণ

যাঁরা আন্তোনিও গ্রামসি পড়েছেন, তাঁরা জানেন দক্ষিণ ইতালির ‘গ্রাম্য’ চরিত্রটা। তাঁর পর্যবেক্ষণ অবশ্য অনেক আগের। তবে এখনও সেখানে জনঘনত্ব কম। শিল্পায়নও উত্তরের তুলনায় নগণ্য। এটাই দক্ষিণ ইতালির কাছে শাপে বর হয়েছে। তবু ইতালির কেন্দ্রীয় সরকার দেশের জন্য অভিন্ন একটা ‘কন্টেনমেন্ট’ নীতি চালু করে। এতে এই এলাকায় অনেকটা রুখে দেওয়া গিয়েছে করোনাভাইরাসের মার্চ। এখানে সময়টাও হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ। একই সময়ে দক্ষিণ ইতালিতে অভিন্ন পদক্ষেপ না-হলে লাফ দিয়ে বেড়ে যেতে পারত আক্রান্তের সংখ্যা।

আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষের ভূমিকা

বাস্তবে গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। কখনও আঞ্চলিক সরকারের অবস্থানের বিপক্ষে গিয়ে। স্থানীয় স্তরে পদক্ষেপগুলো কঠিন-কঠোর মনে করা সত্ত্বেও। কিছু কিছু জরুরি পদক্ষেপ করে শুধু উপদেষ্টার ভূমিকা নিয়েছে স্থানীয় সরকার। বা আরও কিছু খুঁটিনাটি বিষয় জুড়ে দিয়েছে বিশেষ উদ্যোগের সঙ্গে। খুব বড় ভূমিকা নিয়েছেন বিভিন্ন শহরের মেয়ররা। তাঁরা শহরবাসীকে বুঝিয়েছেন লকডাউন ও ঘরবন্দি থাকার তাৎপর্য।

কেন বেহাল হাসপাতাল

সত্যি বলতে আমাদের ‘হেল্‌থ কেয়ার সিস্টেম’ও এত বড় মহামারী সামলানোর জন্য প্রস্তুত ছিল না। আসলে গত দু’দশকে হাসপাতালে (ইন-পেশেন্ট) শয্যার সংখ্যা কমেছে দু’টি ধারণার ভিত্তিতে। একটা হল প্রযুক্তি। তার প্রয়োগ ও সময়োচিত হস্তক্ষেপে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসার ধাঁচা বদলে দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশে প্রবীণের সংখ্যা বেশি। কয়েকটি ‘ক্রনিক ডিজিজ’-এর ক্ষেত্রে এই বয়সের রোগীকে বাড়িতে রেখে সম্ভব হয়েছে রোগ নিরাময়। প্রক্রিয়াটি ইতিবাচক মনে হচ্ছিল। তবে এটাও ঠিক, কোভিড-১৯-এর ব্যাপক সংক্রমণের ফলে এমন বিপুল সংখ্যক রোগীকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসার অভিজ্ঞতা এতে হয়নি। ফলে প্রথমেই দেড়শো কোটি ইউরো বরাদ্দ করে সরকার। যাতে ‘ইনটেন্সিভ কেয়ার’ বেডের সংখ্যা ও স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা দ্বিগুণ করা যায়।

লড়াই ও সহমর্মিতা

সংকট যে গভীর, তাতে তো কোনও সংশয় নেই। কিন্তু এই আঁধারেও আলোর রেখা হয়ে উঠেছে অসংখ্য মানুষের সাহস ও সহানুভূতি। কত কত কাহিনি তার। অবসর ভেঙে কাজে ফিরেছেন বহু ডাক্তার। যে সাবাশি তাঁরা পাচ্ছেন, তাতেই প্রথম মেলে ‘স্টে অ্যাট হোম’-কে দেশবাসীর মান্যতার প্রমাণ। অজস্র ডাক্তার হাসপাতালে হাসপাতালে করোনা-রোগীর চিকিৎসায় নিজেদের জীবন বিপন্ন করছেন। অনেককেই জীবন দিয়ে আত্মত্যাগ করতে হচ্ছে।

ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে

প্রথম দিকে পাগলপারা ঝড়টা গিয়েছে ইতালির উপর দিয়েই। ফলে গোটা বিশ্বের নজর ছিল প্রাচীন এই সভ্যতার দিকে। তাকিয়ে ছিল বিজ্ঞান মহলও। ইতালিতে যে সাইক্লোন উঠেছে তা থেকে কিছুটা শিক্ষা নিতে পেরেছে গোটা ইউরোপ। সঙ্গে আমেরিকা ও ক্যানাডা। অতীতের সব বড় বড় সংকট তৈরি করেছে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক মুহূর্ত। চতুর্দশ শতাব্দীর গোড়ায় সেই ভয়ানক প্লেগের পর ইতালিতে জন্ম নিয়েছে মানববাদ ও রেনেসাঁর। আবার সপ্তদশ শতাব্দীর প্লেগের পর আমরা পেয়েছি নতুন আলোকপ্রাপ্তির যুগ ও শিল্প বিপ্লবকে। ইতালির চলতি সংকটে পেলাম ডিজিট্যাল বিপ্লব আরও উস্কে দেওয়ার আগুন। তবে দুটো চ্যালেঞ্জও রয়ে গেল- এক দিকে মনুষ্যজাতি, অন্য দিকে পরিবেশ রক্ষা। দ্বিতীয়টি হল অসাম্য, ভেদাভেদ দূর করার।

এটিও সাম্প্রতিক ইতিহাসের শিক্ষা বইকি!

সেকেন্ড ফেজ

সংক্রমণের গতি একটু থমকানোয় ‘দ্বিতীয় পর্যায়’-এর কথা ঘোষণা করে দিয়েছে রোম সরকার। ৪ মে, সোমবার তার শুরু। প্রায় দু’মাসের সর্বাত্মক লকডাউনের পর এই পদক্ষেপ নিয়ে আশা-আশঙ্কা সর্বত্র। তবে সতর্ক সরকার। নিয়ন্ত্রিত পদক্ষেপের কথাই বলছে তারা।

কী হবে ৪ মে থেকে? খুলবে বিভিন্ন সংস্থা, হাইপার মার্কেট। দূরে আটকে পড়া প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ সম্ভব হবে। দূর হবে মা-ছেলে, স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকার নিঃসঙ্গতা। আবার ১৮ মে থেকে আঞ্চলিক সরকারগুলো নিজস্ব উপায়ে পদক্ষেপ করতে পারবে। উত্তর ইতালির লোম্বার্ডির মিলানের করুণ অবস্থা আমরা দেখেছি। দক্ষিণ ইতালির কোনও শহরের সঙ্গে মিলান ও তার আশপাশের অঞ্চলের কোনও তুলনাই চলে না। তাই কতটা কী খোলা হবে, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে প্রাদেশিক সরকার। তবে ধীরে ধীরে বার-রেস্তোরাঁ, চুলকাটার দোকান খুলে দেওয়ার কথাও ভাবছে সরকার। সব নিয়েই গরম বিতর্ক চলছে। এক দল বলছে সরকার ঠিক, আর এক দলের কথা, সর্বনাশ হয়ে যাবে। দ্বিতীয় দলটিতে আছেন ডাক্তার, বিজ্ঞানী, গবেষকরা। তাঁদের মতে, এক বারে সব কিছু খুলে দিলে আবার লাফিয়ে বাড়বে সংক্রমিতের সংখ্যা। তবে মূলত অর্থনৈতিক মহলের অনেকেই ব্যবসার চাকাটা যত দ্রুত সম্ভব গড়ানোর পক্ষপাতী। না হলে জীবন-জীবিকার আকাশে যে ঘন মেঘ, তা থেকে অঝোর ধারা বন্যার মতো সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। তার পরও বেশির ভাগ ইতালিয়ান সতর্ক ভাবে পা ফেলতে আগ্রহী। কারণ মৃত্যুমিছিল আর চান না তাঁরা। স্বাস্থ্যই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এঁদের কাছে।

বলা হচ্ছে, এই তথাকথিত ‘সেকেন্ড ফেজ’-এ থেমে থাকবে না কোভিড-১৯ টেস্ট। বরং আরও বাড়বে। ব্যবহার করা হবে একটি অ্যাপ। আক্রান্তদের খবরাখবর দিয়ে সংক্রমণে রাশ টানতে সাহায্য করবে সেই অ্যাপ। এতে আবার আর একটি জ্বলন্ত সমস্যা মাথাচাড়া দেব। গোপনীয়তা বরবাদ বা ব্যক্তির জীবনে রাষ্ট্রের নাক গলানো কে আর মেনে নিতে চাইবে? এখানে সরকারের কাছে ইতিবাচক প্রতিশ্রুতিই চাইবে জনতা।

নিকোলো রোকো ভেনিসের রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও জনসংযোগ বিশেষজ্ঞ।

কৃৃতজ্ঞতা: এইসময়

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>