কবীর সুমন
গেল শতকের ন’এর দশকে অনেকেই আধুনিক বাংলা গান রচনা শুরু করেন। এঁদের অনেককেই তার আগে কেউ চিনত না। তোমাকে চাই এলবামটি বেরনোর পর কেউ কেউ হঠাৎ বলতে থাকেন আরো কারুর কারুর নাম যাঁরা গিটার বাজিয়ে নতুন গান গেয়েছেন, মায় রেকর্ডও করেছেন। তাঁরা কিন্তু ভুলে যান (অনেকে জানেনও না, জানতে চানও না) ছ’ এর দশকেই আধুনিক বাংলা গানের রেকর্ড বিক্রিতে এমন ভাঁটা পড়ে যে গ্রামোফোন কম্পানি অফ ইন্ডিয়া নতুন প্রজন্মকে ধরার জন্য “বাংলা পপ সং” নাম দিয়ে গ্রামোফোন ডিস্ক বের করেন। গান গেয়েছিলেন শ্রাবন্তী মজুমদার ও রাণু মুখোপাধ্যায়। অনুরোধের আসরে বেজেছে সেইসব গান, কিন্তু বিক্রি হয়নি তেমন।
পপ সং বলতে যতটা সম্ভব ইংরিজি পপ গানের মতো করে বাংলা গান তৈরি ও গাওয়া। আধুনিক বাংলা গানের মেজাজ সেখানে নেই বা খুব কম। মজার কথা এটা যদি কোনও কৃতিত্ব হয় তাহলে বাল্মিকী প্রতিভার প্রথম গান ” এনেছি মোরা” সেই কৃতিত্বে অধিকারী তারও আগের শতকে। রবীন্দ্রনাথ গিটার বাজাননি বা ঐ গান গিটার সহযোগে হাজির করাননি এটা কোনও যুক্তি নয়। গিটার কোনও কিছুর মাপকাঠি নয়। বীটলস দল গিটার আর ড্রামস বাজিয়ে গেয়ে ব্যাপক নাম করেন অতএব তাঁদের গানে গিটার অপরিহার্য এটা যুক্তির ধোপে টেঁকে না। তোল্লাই দিতে দিতে এমন সময় এসেছিল যখন বড় ফিলহার্মনিক অর্কেস্ট্রা তাঁদের সঙ্গে বাজিয়েছিলেন। সেখানে গিটারের প্রাধান্য ছিল না।
বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড এই অধমকে অনুমতি দিয়েছিলেন শুধুমাত্র একটি নাইলন স্ট্রিং গিটার বাজিয়ে কয়েকটি রবীন্দ্রগান রেকর্ড করার। ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাসে সেই প্রথম অমন ঘটনা ঘটল। শুধু গিটার বাজিয়ে রবি ঠাকুরের গান রেকর্ড করলাম, বিশ্বভারতীর অনুমোদনে এলবাম বেরোল – তাহলে রবি ঠাকুরের গান কি পপ সং বা সাহেবী ফোক সং?
১৯৪৩ সালে যশোদা দুলাল মণ্ডল গ্রামোফোন রেকর্ড করেছিলেন “ক্যালকাটা নাইনটিনফর্টিথ্রি অক্টোবর”। একেবারে চলতি কথার আধুনিক বাংলা গান। তাহলে তাঁর নাম করে না কেন লোকে।
মহীনের ঘোড়াগুলির গান ভারতী রেকর্ড কম্পানি সম্ভবত বের করেছিলেন। তাঁদের গায়কিতে বীটলসদের প্রভাব ছিল, গিটার বাজিয়ে গান, রীতিমত নতুন ধরণের। গানের মূল ব্যাপার তো লিরিক ও সুরতালছন্দলয়। খালি গলায় বা মীরাবাই এর একতারাতেও গাওয়া যায়। বীটলসদের গান বা ব্লুজও। তাই যদি হয় তাহলে শুধুমাত্র গিটারসর্বস্বতার কারণে ঐ আঙ্গিককে পথিকৃত বলা যায় কিনা তর্কসাপেক্ষ। বস্তুত, এইচ এম ভির বের করা বাংলা পপ সং যা এর অনেক আগে বেরিয়েছে তা বেশ ইংরিজি গান ঘেঁষা, বেশ শহুরেশহুরে,বেশ পার্কস্ট্রিটপার্কস্ট্রিট, বেশ হাইহ্যালোধরণের, বেশ রিকসাকে রিকি বলা গোছের, তাহলে সেগুলোই তো নাগরিক আধুনিক গানের হোমো ইরেকটুস, নেয়ানডারথাল।
যশোদা দুলালের দস্তুরমত গ্রামোফোন রেকর্ড করা ” ক্যালকাটা নাইন্টিন ফর্টিথ্রি অক্টোবর”ও হোমো ইরেকটুস দলেরই। আমাদের Homo Sapiens দের চেয়ে অনে——-ক পুরোন। আর বাল্মিকী প্রতিভার প্রথম গান “এনেছি মোরা”! সেটা তো ” He is a jolly good fellow” থেকে নেওয়া,ইচ্ছে করলে শুধু গিটার আর ড্রামস বাজিয়ে গেয়ে দেওয়া যায়, লোকে আনন্দ করে শুনবে, যদি না সেটি চলতি বঙ্গকেতায় অতিধীর লয়ে শম্বুকগীতিতে পরিণত না হয়।
তাহলে এগুলোই বা বাংলা পপ নয় কেন। লিরিক ও সুরতালের প্রচলিত চনমনে যোবনযোবন চাল তো নিশ্চিতভাবে আয় লো অলি নয় কোয়েলিয়া গান নয় – একেবারে সরাসরি পায়াপ্পা পায়াপ্পা… হুপ্লালাল্লাহ হ্যাল্লালাল্লাহ… হাই রিকি,শ্যাল উই টেক আ রাইড ম্যান… মানে পপ পপ পপ…. তাহলে তো আবার সেই রবীন্দ্রনাথ!!!! কী জ্বালাতন!!!!!!
শুধু টেলিফোন এয়ারোড্রোম গোছের হাল আমলের ইংরিজি কথা থাকলেই যদি হয় তাহলেও কিন্তু যশোদা দুলাল মণ্ডলই উদগাতা। ” ক্যালকাটা নাইনটিন ফর্টিথ্রি অক্টোবর/ সি আর পি মিলিটারি/ পথে পথে ভিকিরি/সব জিনিসের বাড়ল দর…” (লিরিক উদ্ধৃতিতে সামান্য হেরফের হয়ে থাকতে পারে – ক্ষমা!)। ইংরিজি কথাই যদি বলেন তাহলে এই তো, এই তো…।
যৌবনের কথা, যৌবনের ব্যথা বিদ্রোহ, স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন? গেল শতকের ছ’এর দশকে গ্রামোফোন রেকর্ডে সুবীর সেনের একাধিক গান – “নগরজীবন ছবির মতন”, ” এ যেন সেই চোখ”, ” যখন হাত বাড়ালেই আকাশ”, বিশ্বজিতের গাওয়া “এই ঝড়…”, প্রেমেন্দ্র মিত্রর কবিতা ” সাগর থেকে ফেরা”য় সুধীন দাশগুপ্তর সুর, জটিলেশ্বরের গাওয়া সলিলের “পাগল হাওয়া”… এগুলিতে কি সমকাল, আধুনিক নাগরিক বাঙালি, কথাসুরতালের নতুনত্বর কিছুই নেই? বিমল ঘোষের কবিতা ” উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা”য় সলিলের সুর সন্ধ্যার গাওয়া? শুধু গিটারে গাওয়া হয়নি বলে পপ পদবাচ্য নয়!!!!!
কেন খামোখা নিজের ইতিহাসটাকে অমন হিপ পকেটে নিয়ে ঘোরা। কান আর মনের দৃষ্টিটা আরও প্রসারিত করলে কেমন হয়।
মোহিনের গান আসলে কার লেখা কার সুর তা নিয়ে মামলা মকোদ্দমাও হয়ে গেছে। জানা গেছে – “তপসে,যা ভাবছিলি তা নয়।”
খেয়াল করেছি তোমাকে চাই বেরনোর পর এবং কেউ কেউ আমার গান শুনতে শুরু করার পর কান্নাকাটি চ্যাঁচামেচি এবং আমাকে হেয় করা শুরু হয় আমার আগে কারা ছিলেন সেই পুরান ঘেঁটে। এর পেছনেও আবার সেই রাজনীতি। ১৯৯২ সালের আগে এত কথার কিছুই হয়নি। মজার কথা আমি কিন্তু কোনো দাবিই করিনি।
আমি সঙ্গীতে formal প্রশিক্ষণ পাওয়া, ১৯৬৬/৬৭ সাল থেকে বেতারে আধুনিক রবিগীতি গাওয়া, অপরের লিরিকে সুর করে বেতার অনুষ্ঠান করা একজন পেশাদার মিউজিশিয়ান। বিপ্লবী বা বীটলসভজা বা পপ-পপ- পপার্ত-পপ্পোময়-পপমুখর কেউ না। আমি আধুনিক বাঙলা গানের লোক। গিটার শিখতে শুরু করি ৩৭ বছর বয়সে – তার আগে কয়েক দশক খেয়াল শেখার পর, ভজন রাগপ্রধান গীত রবিগীতি হিমাংশুগীতি আধুনিক শেখার পর, টানা ৮ বছর আকাশবাণী কলকাতা থেকে আধুনিক ও রবিগীতি গাওয়ার পর, ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে দুটি রবিগীতির গ্রামোফোন ডিস্ক প্রকাশ করার পর। আমি গিটার ধরেছিলাম কারণ এতে সুর আর ছন্দ দুটোই পাওয়া যায় – কর্ডস বাজানো যায়। এর সঙ্গে হাইম্যান-হোয়াট-বাগার- লেট্স টাইক আ রিকি টু ফ্রিস্কুলস্ট্রিটের কোনও সম্পর্ক নেই। আমি গিটার বাজিয়ে ললিত রাগে বাংলা খেয়াল বন্দিশও রেকর্ড করেছি।
আমি আধুনিক বাংলা গানের সনাতন ধারার লোক। স্থায়ি অন্তরা সঞ্চারি বানাতে জানি। আমি চিনি আর একটিমাত্র পশ্চিমবাঙালি মিউজিশিয়ানকে যিনি আধুনিক বাংলা গান রচনা করে তাতে ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রাণুষঙ্গ তৈরি করে সিরিয়াসলি গাইতে পারেন। একমাত্র তাঁকে দেখেছি সঞ্চারি বানাতে। তিনি পারেন। তিনি জানেন। তাঁর নাম কাজি কামাল নাসের।
স্বল্পভাষী, সভ্য, শিক্ষিত, পরিশীলিত এই বাঙালি মিউজিশিয়ান আমায় নিয়ে গান বানিয়ে তেইশে এপ্রিল আমায় লজ্জায় ফেলেছেন। ভালবাসলে কখনও কখনও কিরকম একটা সরম আসে না? ভাল লাগে, শরীরমন আনচান করে ওঠে…. সকলকে ডেকে ডেকে বলতে ইচ্ছে করে; আবার সরমও আসে। সেইরকম।
আমার সময়ের একমাত্র সিরিয়াস আধুনিক বাংলা গানের, কালকের খোকাগিটারায়িত নয় বাংলা মতে সনাতন আধুনিক বাংলা গানের স্রষ্টা কাজি কামাল নাসেরকে অভিবাদন জানাচ্ছি। সকলকে বলছি – তাঁর সৃষ্টি শুনুন – জানুন আধুনিক বাংলা গান আজও বেঁচে আছে,কারণ কাজি কামাল নাসের বেঁচে আছেন এই শহরে। তিনি এক সম্পূর্ণ মিউজিশিয়ান।