“কোনো কথা নয় শুধু সুখ – নির্বাক
চাওয়া চাওয়ি দুজনার চোখে,
জীবনের এক বাঁকে দুটি নদী মোহনা –
পাতা কাঁপা থেমে যাক নিভে যাক চাঁদ
শুধু তুমি আমি কিছুক্ষণ একা-একি নির্বাক
নিশ্চুপ থেকে রবো রাতের বুকে…
“রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ”
কিছু নির্বাক-ধূসর কিন্তু প্রচন্ড আবেগময় অনুভূতির চিত্র…।
সংসার জীবনের কানাগলির স্রোতে তো আমরা সবাই যে যার মত ভেসেই চলেছি। সেই অনাদি অনন্তকাল থেকে কিন্তু প্রতিদিনকার এই রুটিন মাফিক জীবনের কতটুকুই অনুভব করার চেষ্টা করি বা বুঝি?বলছি, পরিচালক আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্তর “আসা যাওয়ার মাঝে” সিনেমার কথা।
আলনার কাপড়, খাটের মশারী, জংধরা পানির পাইপ, আয়নার কোনায় লাগানো টিপ, কাপড় শুকানোর দড়ি, ভিজে পায়ের ছাপ, টিফিনের বাটি, ভেসে আসা সুর, এক চিলতে আলো, অন্ধকারের গান, বারান্দার রেলিং, হাড়ি-পাতিলের ঠোকাঠুকি, আর সর্বোপরি সঙ্গের জীবনসঙ্গী।
প্রতিদিনের সকল জানা জিনিষগুলোর মাঝের না দেখার, না জানার যে জগৎটা আছে সেটাই নিবিড়ভাবে ফুটে উঠেছে আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্তের এই দেড় ঘন্টার “আসা যাওয়ার মাঝে (Labour of Life)” চলচ্চিত্রটিতে।
জীবন সংগ্রামের কঠিন বাস্তবতার মাঝেও যে একটা স্নিগ্ধ, শান্ত, সুন্দর রূপ লুকিয়ে থাকে এবং সময়ে সময়ে সেটা যে তার বিপুল বাহু দিয়ে আমাদের আঁকড়ে ধরেও তা হয়তো জানাই হতো না। জানা হতো না কখনো বোঝাপড়া, অন্তরঙ্গ অনুভবের আকুতি, এই সিনেমা না দেখলে।
একটা তুচ্ছ সেফটিপিন লাগিয়ে দেয়ার মাঝে, একটু আলতো ছোঁয়ায়, একটু চোখের দেখায়, কিছু মুহূর্ত পাশে বসে থাকার মাঝে এত ভালোবাসা, এত গভীর প্রেম থাকতে পারে তা কে জানতো!
ভালোবাসা যে শুধু পাশে থাকা নয়, শুধু একসাথে গান গাওয়া নয়, শুধু শারীরিক কোন কামনা নয়। সেটা যে বিছানার একটা পাশ খালি থাকাও, সেলফোনের রিংটোনের শব্দ, অগোছালো হয়ে পরে থাকা কাপড়ের স্পর্শ, কুয়াশা ঢাকা গলির মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়া একটা আবছা কাঠামো, টিফিনের বাটিতে পরম যত্নে গুছিয়ে দেয়া ভাঁজ করা রুটি, সাদা-কালো কিছু ধূসর অনুভূতি…।
জীবন আর জীবিকার এক অদ্ভুত টানাপোড়েন রয়েছে এখানে। প্রায় প্রতিটি দৃশ্যেই কোন না কোন কাজ দেখানো হয়েছে…। গোসল করা, কাপড় ধোয়া, কাপড় মেলে দেয়া, বাজার করা, রান্না করা, অফিসে যাওয়া, ব্যাগ প্যাকেটিং করা, নম্বর টুকে নেয়া, খাওয়া, বাসনপত্র ধোয়া, কাপড় গুছানো, ঝাড়ু দেয়া, সাইকেল চালানো, খবরের কাগজ ছাপানো, সেগুলো গুছিয়ে রাখা, মেশিন চালানো, বাসায় ফেরা, ঠাকুর পুজো ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রতিটি কাজই শুধু জীবন আর জীবিকার জন্য! একটির সাথে আরেকটি একেবারে অঙ্গা-অঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। আমার যদিও এই দৈনিক কাজের দৃশ্যগুলো খুব একটা আহামরি কিছু মনে হয়নি কিন্তু তারপরেও কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম টান রয়ে আছে এই কাজগুলোর মধ্যে, কোথায় যেন একটা নিবিড় মায়ার বন্ধন জড়িয়ে আছে, একটা গৃহস্থালি সুখের-আবেগের ভাব মিশে আছে এগুলোতে।
খুব বেশী ক্লোজ শট যদিও আমার বিরক্ত লেগেছে তারপরেও সিনেমাটোগ্রাফিটা এক কথায় অসাধারণ। পাতিলের পানি শুকিয়ে যাওয়া, কপালে টিপ লাগানো, টিফিন বাটি আর কাপড় গুছানো, ভেজা কাপড় দড়িতে শুকাতে দেয়া, সূর্যাস্ত, ভেজা পায়ের ছাপ শুকানো, সাইকেলের চেইন আর চাকার ঘুর্ণন, খবরের কাগজ ছাপানো আর বিশেষ করে ভোরের কুয়াশা ঘেরা জঙ্গল, জঙ্গলে পাতা খাট আর আসবাবপত্র, ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ানো, কুয়াশাজড়ানো সকালে গলিপথে হেঁটে যাওয়া আরো কত ছোটছোট দৈনন্দিন কাজের ছবি।
এই সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলো এর শব্দ। হ্যাঁ, আমি শব্দকে এই সিনেমার চরিত্রই বলবো। বিসমিল্লার সানাই, বাজারের গুঞ্জন, ছাপাখানার যান্ত্রিক খটাখট, মাছকাটা, ট্যাপ থেকে পানি পরা, কাপড়কাচা, রিংটোন, সাইকেলের টুংটাং, রান্নার সময় বাস্প উবে যাওয়া, মাছ ভাজা, হাতা খুন্তির ঠোকাঠুকি ভেসে আসা গানের সুর, আরো কত কি! তবে সবচেয়ে শক্তিশালী চরিত্র হলো এর নৈশব্দ। নিরবতার যে এত গভীর রূপ থাকতে পারে তা কে জানতো?
জীবনের কঠিন নিষ্ঠুর এই জীবিকার যাঁতাকলের মাঝে থেকেও এভাবেও কিছু প্রেম বেঁচে থাকে বেঁচে থাকে দুজনের সমঝোতায়, অনুভূতির তীব্রতায়, ভালোলাগার, ঘোরলাগায়, আচ্ছন্নতায়, বিশ্বস্ততায়, একটুখানি যত্ন, হালকা ছোঁয়ার স্পর্শে। এই ভালোলাগার যেন আদি নেই অন্ত নেই, শুধু সুর আছে, শব্দ আছে ভাব আছে, গভীর কিছু অনুভূতি আছে, দেহ আছে, প্রাণ আছে…।
প্রারম্ভিক মুক্তি: ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪
পরিচালক: আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত
অভিনয়ে: ঋত্বিক চক্রবর্তী ও বাসবদত্ত চ্যাটার্জি।
সময়: ১ ঘন্টা ২৪ মিনিট
পুরস্কার: Indira Gandhi Award for Best Debut Film of a Director, আরও বেশি অবদান
প্রযোজক: আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত, জোনাকি ভট্টাচার্য।