রুমনের সাথে কথা হচ্ছিলো লিটিলম্যাগ নিয়ে। লিটিলম্যাগের ইতিহাস কি? মনোজ জানতে চাইলো।কি বলা যায় ভাবতে গিয়ে বললাম-লিটল ম্যাগাজিন শিল্পসাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞান বিষয়ে চলমান ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তাধারা ও মতামত ব্যক্ত করার মুদ্রিত বাহনকে বলা হয় লিটল ম্যাগাজিন। এ ম্যাগাজিন অনেকটা অনিয়মিত এবং অবাণিজ্যিক। লিটল ম্যাগাজিন প্রতিনিধিত্ব করে একটি ছোট সমমনা নব্য গোষ্ঠীর যার চিন্তা-ভাবনা-দর্শন চলমান ধারা থেকে ভিন্ন এবং অভূতপূর্ব। ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধ থেকে ইউরোপ-আমেরিকায় লিটল ম্যাগাজিনের যাত্রা শুরু।
ইংরেজি সমালোচনা সাহিত্যের ইতিহাস মতে লিটল ম্যাগাজিনের অভিযাত্রা শুরু হয় Ralph Waldo Emerson ও Margaret Fuller সম্পাদিত The Dial (Boston, 1840-1844)-এর মাধ্যমে। ইমার্সনের নতুন দর্শন Transendentalism-এ যারা সমর্থক তাঁরাই শুধু Dial ম্যাগাজিনে লিখতেন। লিটল ম্যাগাজিনের আরেক প্রভাবশালী পত্রিকা ছিল ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত Savoy। ভিক্টোরীয়ান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার উদারপন্থী ও সাম্যবাদী লেখকদের প্রধান বাহন ছিল এটি। সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশ শতকের গোড়ার দিকে সবচেয়ে নামী লিটল ম্যাগাজিন ছিল Poetry: A Magazine of Verse (Chicago 1912)। এর সম্পাদক ছিলেন হেরিয়েট মনরো ও এজরা পাউন্ড।
পাশ্চাত্যের আদলে বঙ্গদেশে প্রথম লিটল ম্যাগাজিন প্রবর্তন করে প্রমথ চৌধুরী। তাঁর সম্পাদিত সবুজপত্র (১৯১৪)-কে আধুনিক লিটল ম্যাগাজিনের আদিরূপ বলে গণ্য করা হয়। অবশ্য অনেকে মনে করেন যে, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত বঙ্গদর্শন (১৮৭২) বাংলা ভাষায় প্রথম লিটল ম্যাগাজিন।
মিমি, বললো তা কেন হবে? ১৮৭২-এর অনেক আগেই তো বাংলা ভাষার লিটিলম্যাগ ছিলো, যেমন: ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত সংবাদ প্রভাকর (১৮৩১), অক্ষয়কুমার দত্ত সম্পাদিত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা (১৮৪৩), প্যারীচাঁদ মিত্র ও রাধানাথ শিকদার সম্পাদিত মাসিক (১৮৫৪),আর যদি ১৯১৪এর আগে বলো তবে, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত ভারতী (১৮৭৭), সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত সাধনা (১৮৯১), রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত প্রবাসী (১৯০১), জলধর সেন ও অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত ভারতবর্ষ (১৯১৩) প্রভৃতি পত্রিকা। এসব পত্রিকা ছিল প্রতিষ্ঠিত মতাদর্শের বাহক, যদিও পাশাপাশি অভিনবত্বেরও ছাপ ছিল এগুলিতে। তবে সনাতন চিন্তাধারার প্রাধান্য ছিল এগুলিতে।
যথার্থ অর্থে বাংলায় লিটল ম্যাগাজিনের আবির্ভাব ঘটে প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত সবুজপত্র (১৯১৪) পত্রিকার মাধ্যমে। পরবর্তীকালে কল্লোল (১৯২৩), শনিবারের চিঠি (১৯২৪), কালিকলম (১৯২৭), প্রগতি (১৯২৭), পূর্বাশা (১৯৩২) পত্রিকা লিটল ম্যাগাজিন প্রবাহকে বেগবান করে।
-এসব পত্রিকার লেখকগণের উদ্দেশ্য ছিল রবীন্দ্র-প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে নতুন সাহিত্য সৃষ্টি করা। এ লক্ষ্যে তাঁরা ইউরোপীয় আদর্শে বাস্তবজীবন, মনস্তত্ত্বের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রসঙ্গকে তাঁদের রচনার প্রধান উপাত্ত করেন। লিটল ম্যাগাজিন-এর উন্মেষকালে রবীন্দ্রনাথের অনেক কালজয়ী রচনা প্রকাশিত হলেও লিটল ম্যাগাজিনের প্রভাবই বেশি লক্ষ করা যায়, বিশেষত বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কবিতা (১৯৩৫) পত্রিকার মাধ্যমে।
-তুমি বলতে চাইছো লিটল ম্যাগাজিন নবচেতনা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে এবং লেখক ও পাঠকদের মধ্যে সে নবচেতনাকে সঞ্চারিত করে দেওয়ার জন্যে আন্দোলনে যায়। যারা সাহিত্য, দর্শন ও শিল্প-চেতনায় গতানুগতিক ধারার বিরোধী, তারা তাঁদের চিন্তাচেতনার প্রকাশ ঘটান নিজেদের সংঘটিত মুখপত্রের মাধ্যমে, কেননা সাধারণের নিকট তাঁরা অপ্রিয়, বাণিজ্যিক কারণে বাজারের পত্রিকার পরিচালকেরা তাঁদের পরিহার করে চলেন। অতএব নবধারার নবযুগের শিল্পী সাহিত্যিকেরা তাঁদের মতবাদ প্রচারের জন্য লিটল ম্যাগাজিনের আশ্রয় নেন। লিটল ম্যাগাজিন থেকে বেরিয়ে আসেন তখনই যখন তাঁদের মতামত সমাজ মোটামুটি গ্রহণ করে থাকে। তবে এটাও তো ঠিক লিটিলম্যাগ আমাদের সাহিত্যকে অনেক দিয়েছে এবং আগামী দিনগুলোতেও লিটিলম্যাগ সমানভাবে গ্রহণীয়।আমরা যারা লিখছি তারাও লিটিলম্যাগ প্রোডাকশন, আগামীতে যারা আসবে তারাও লিটিলম্যাগের ফসল। রুমনের কথার সাথে গলা মেলালো মিমি, মনোজ আর চন্দ্রানী।
লিটিলম্যাগ চত্বরে আড্ডাটা বেশ জমে উঠেছে।অলকানন্দা কিছুতেই মিমিদের কথার সাথে একমত নয়। তার মতে লিটিলম্যাগের দিন ফুরিয়েছে।একসময় কোনকালে লিটলম্যাগ প্রকাশনা শুরু হয়েছিল প্রতিষ্ঠান ও প্রাতিষ্ঠানিক যাবতীয় মানসিকতার বিরুদ্ধে স্ট্যান্ড নিতে। সেকালে সে তার ডিউটি ভালোভাবেই পালন করেছে। যার ফলে প্রতিষ্ঠানের বারোটা বেজেছে কি বাজেনি তা না-জানলেও ওভারওল সাহিত্যের বেশ পুষ্টিঋদ্ধি হয়েছিল জানা যায়। এই বাংলায়, ওই বাংলায়, এবং গোটা দুনিয়ায়। খুশিফুর্তির লেখা ছাপাবার জায়গার অভাব ছিল না, বানানো ব্যথা-বেদনার লেখা ছাপাবার জায়গা তো সুলভ অধিক, কিন্তু কোথাও বুঝিবা স্বাধীন ও নতুন লেখা মার খাচ্ছিল। হচ্ছিল না ঠিকঠাক। রবীন্দ্রনাথ জন্মালেন, তো দলে দলে রবীন্দ্রপোষকবৃন্দ, নবাগত জীবনানন্দের মুখ দেখাবার আর জো নাই। তখন দরকার পড়ল ‘কবিতা’ পত্রিকার, এইভাবে এরপরে একে একে অন্যান্য। অন্তত কেউ কেউ মনে করছিল যে তেমন কিছু হচ্ছে না, বা যা হচ্ছে তা ঠিক হচ্ছে না, জায়গা চাই নতুন। জন্মোতিহাস তো, ছোটকাগজের, এ-ই ইন-শর্ট। পরবর্তীকালে, একদম সম্প্রতি তেমন পরিস্থিতি তিরোহিত যখন, ছোটকাগজ প্রকাশের খোল ও নলচে নিয়া ভাবার জরুরৎ অতএব অনেক বেশি। কিংবা ভাবার চেয়েও বেশি দরকার সিদ্ধান্ত নেবার, যত নিষ্ঠুর ও নির্মম সিদ্ধান্তই হোক, রাজার হাতি পালনের ডেকোরেশন্যাল কনভেনশন চালু রাখা আদৌ মর্যাদার কি না।
মিমি বেশ উত্তেজিত হয়েই উঠে পড়লো, এটা মানা যায় না নন্দা। তোর কথা একমুখী। তুই লিটিল ম্যাগে লিখিস না তাই এমন বলছিস কিন্তু ভেবে দেখ: লিটিলম্যাগের একটা সংজ্ঞা আছে। লিটিলম্যাগ ছোট পত্রিকা। তার মানে, সব সময় যে এর কলেবর ছোট হবে তা নয়। তবে সাধারণত এ ছোট হয়। অনেক সময় বড়ও হতে পারে। ছোট হওয়ার কারণ হচ্ছে, এই পত্রিকা যারা বের করে তারা সাহিত্যে নতুন পা রাখতে যাচ্ছে। তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি নেই, সামর্থ নেই, কিন্তু পিপাসা আছে। একটা বড় সাহিত্যের স্বপ্ন তাদের চোখের সামনে। একটা উচ্চতর সাহিত্য যুগের জন্য তারা সংগ্রাম করছে।সেজন্য একটি অসীম দারিদ্রের মধ্য দিয়ে লিটিল ম্যাগাজিন বেঁচে থাকে, এগোয়। কিন্তু আপোষহীন-অপরাজিত স্বপ্ন আর শক্তি নিয়ে তারা এ কাজটা করে।
এই ধরনের সব পত্রিকার একজন দুজন মানুষই মূল নিয়ন্ত্রক। তারা একই সঙ্গে সব কাজ করে। তারা লেখা সংগ্রহ করে। নিজেরা লেখে। লেখকদের সংঘবদ্ধ করে। তারা বিভিন্নজনের কাছ থেকে লেখা আনে। তাহলে লিটিল ম্যাগাজিনের অবদান কী? এই পত্রিকার স্বপ্ন কী? দেখা যায়, বড় পত্রিকার চেয়ে লিটিল ম্যাগাজিনের অবদান অনেক বেশি। অন্তত সাহিত্যের অঙ্গনে। লিটিল ম্যাগাজিনের মাধ্যমে সাহিত্যের নতুন চিন্তা, নতুন সাহিত্যের দল, নতুন সাহিত্যের ধারা সাহিত্যের ক্ষেত্রে জন্ম নেয়। বড় পত্রিকা এটা পারে না। দৈনিক বা সাপ্তাহিক পত্রিকা তো পারেই না। সাহিত্যের নতুন বাঁক পরিবর্তন, নতুনদিকে যাত্রা, গতানুগতিকতা থেকে বেরিয়ে, প্রতিষ্ঠানকে অস্বীকার করে, নতুন পথে সাহসে সঙ্গে যে যাত্রা সেটা হচ্ছে লিটিল ম্যাগাজিনের যাত্রা। এর মধ্যে একটা প্রথা বিরোধিতা আছে, একটা দুঃসাহস আছে, বিদ্রোহ আছে। নতুন অনিশ্চিত পথে সাহিত্যের পদপাত, নিত্য নতুন পালাবদল লিটিল ম্যাগাজিনই ঘটায়।
উদয়ন মোবাইলে একটা ওয়েব পড়ছিলো। মোবাইল থেকে চোখ না ফিরিয়েই সে বললো কবি জয়দেব বসু এক ঘরোয়া আলোচনায় বলেছিলেন ‘আমি তিনটি লিটল ম্যাগাজিন ক্রসেড, রক্তমাংস, কবিতাকথা এদের বাদ দিয়ে বলছি। আমি লিটল ম্যাগের কেউ নই। লিটল ম্যাগ আমার কেউ নয়। আমরা কেউ কাউকে বানাই নি। আমি তাদের দেখি দূর প্রতিবেশীর মতো। আমি তাকে ডিস্টার্ব করতে চাই না। উল্টোটাও চাই।’
ছোটকাগজের প্রকাশনা আজ আর কতটা আবশ্যক, যখন অনেকগুণ শক্তিশালী সৃজনকর্ম প্রকাশ হচ্ছে সোশ্যাল সাইটগুলোতে, অলকানন্দার প্রশ্নটা ফেলে দেয়ার মতো নয় একেবারে। এত হুঙ্কারের প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা, যা নিয়ে লিটিল ম্যাগওয়ালারা প্রায় অবসেসড্ ছিলেন এতকাল, আজ আর বিড়াল কণ্ঠেও শোনা যায় না। আজকের সামাজিক ভাব বিনিময়ের মাধ্যমগুলোতে কম্পারেটিভলি অনেক বেশি স্পষ্ট ও বোধগম্য বরং প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা বা অ্যান্টি-এস্টাব্লিশমেন্ট সংক্রান্ত সচেতন তৎপরতা। তাহলে নেসেসিটি অফ এডিটিং অ্যান্ড পাব্লিশিং লিটিলম্যাগ তো অদ্য অনুপস্থিত। তবু কেন ছোটকাগজ ছাপছি আমরা, লিখছি এবং পড়ছিও কেউ কেউ? শৌখিনতা, নাম্বার ওয়ান কারণ। পরের কারণ, সম্ভবত, পুরনোকে পুরোপুরি ছাড়তে না-পারার সংস্কার। তাছাড়া বিশেষ বাঁধাই ও বিশেষভাবে কাটা মাপজোখের কাগজে লেখক নিজের লেখাটা দেখে একপ্রকার বিমলানন্দ বোধ করেন। তবে কি লিটিল ম্যাগাজিন ছাপব না আমরা আর? এর এককথায় প্রকাশযোগ্য কোনো উত্তর দেয়া যাবে কি?
চন্দ্রা, মিমি আর সৌরভ বেশ রেগেই গেলো।সৌরভের বেশ নাক উঁচু ওয়েব ম্যাগাজিন কে সে সাহিত্যের নতুন দিক মানতে নারাজ তাই পড়েও না।জনসমক্ষে অন্তত তাই বলে বেড়ায় সে। তুই কি বলতে চাইছিস লিটিল ম্যাগ আজ আর নতুন কোন অবদান বা দাবী রাখছে না? চন্দ্রা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।
উদয়ন মোবাইলটা পকেটে রেখে মুচকি হাসে। চিনুয়া আচেবে একবার একটা প্রবন্ধে এই ধরনের সংকট নিয়ে ভেবেছিলেন, যখন মুদ্রিত বইয়ের মৃত্যু সম্পর্কে সবাই নিশ্চিত হয়ে যাচ্ছিলেন এবং ভিশ্যুয়াল মিডিয়ার জয়গাথা গাইছিলেন। সমাধান হিশেবে একটা কাল্পনিক পরিস্থিতি উপস্থাপন করে তিনি বলেন, ‘‘ধরা যাক একজন গুণী গায়ক বিরাট প্রেক্ষাগৃহে গান গাইবার জন্য দাঁড়ালেন এবং শেষ মুহূর্তে জানতে পারলেন যে এই প্রেক্ষাগৃহের চারভাগের তিনভাগ দর্শকই সম্পূর্ণ বধির। তার প্রযোজকরা তখন তাকে প্রস্তাব করলেন তিনি গান না-গেয়ে বরং সবাইকে নাচ দেখান। বধিররা গায়কের গান শুনতে না-পেলেও নাচ তো দেখতে পারে। এই গায়কের কণ্ঠ দেবদূতের মতো কিন্তু পা পাথরের মতো ভারী। তাহলে এখন এই গায়ক কি করবেন? তিনি কি প্রেক্ষাগৃহের মাত্র এক-চতুর্থাংশ দর্শকের জন্য চমৎকার গান গেয়ে শোনাবেন নাকি প্রেক্ষাগৃহের সব দর্শককে বিশ্রীভাবে নাচ দেখাবেন?” পরিষ্কার ইঙ্গিত। ছোটকাগজের লেখক-সম্পাদক বুঝবেন সন্দেহ নেই। সঙ্কট রয়েছে, থাকবেই, যেন হুঁশ না হারাই। সীমাবদ্ধতা আছে বলে বেহুঁশ পত্রিকা করে যাওয়ারও কোনো দরকার নেই।
রুকসানা কফি নিয়ে দাঁড়িয়ে চুপচাপ শুনছিলো উদয়নের কথা।এবার সে মুখ খুললো তুমি কথাটা ঠিক বললে না। লিটিল ম্যাগ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী মাধ্যম ও পাঠক নন্দিত।জেলায় জেলায় নয় কিছু কিছু গ্রামেও এখন লিটিলম্যাগ মেলা হয় নতুন মুখ নতুন লেখক,কবি উঠে আসছে।
উদয়ন বলতেই যাচ্ছিলো পুরাণ তাকে থামালো, যোগাযোগের সীমাবদ্ধতাটা সবচেয়ে বড় অন্তরায়। মুখ্য সঙ্কট সংযোগের। অবাক কাণ্ড! তথ্য প্রযুক্তি বিপ্লবের এই যুগে এটা আদৌ যুক্তির কথা হলো! লক্ষ করে দেখুন, কেমন করে একটা আগ্রাসী বিচ্ছিন্নতা আমাদের আমুণ্ডু গিলে ফেলছে। একদিকে গোলকায়িত হচ্ছে বটে নগর-গেরামগাও, ওই গোলকায়নের চাক্ষুষ ফল তো কেবল মুঠোফোন কোম্প্যানি গুলোর একচেটিয়া মুনাফা, আবার একটা মানুষ থেকে আরেকটা মানুষের দূরত্ব দিনে দিনে অথৈ অন্যদিকে। এক মানুষ থেকে আরেক মানুষ সরে যেতে যেতে আলোকবর্ষ দূর চলে গেছে যেন। অসম্ভব অসহ অ্যালিয়েনেশন, সর্বত্র, সবখানে। এইসবের ভেতরেই আমাদের সমাজ, সভ্যতা, সাধের লাউ সংসার আর শিল্পসংস্কৃতি। অ্যালিয়েনেশনের শিকার আমাদের বাংলা কবিতা, কবি ও কবিতাপাঠক।
জন্ম-ও-স্বভাবসূত্রে কবিরা অ্যালিয়েন, বেশিরভাগ বিভোর কবিতাপাঠকের ক্ষেত্রেও ওই বিবৃতি প্রযোজ্য, সর্বকালেই। ওই স্বভাব সৃজনানুকূল বলে বিবেচিত হয়ে এসেছে এতদিন। সহনীয় মাত্রায় অ্যালিয়েনেশন কবিতা ও অন্যান্য শিল্পের বেড়ে-ওঠা ও পরিশীলনে উপকারী ছিল বটে। এখন যখন অ্যালিয়েনেশনই সময়ের শীর্ষপরিচয়, ভুবন জুড়ে সর্বজনের ভূষা, যা ছিল এতকাল কবিস্বভাবীদের ললাটে রাজটিকা, সঙ্কট পূর্বাপেক্ষা অনেক বেশি তীব্রতর। কবির সনে দেখা নাই কবির, পাঠকের সনে তো সোমালিয়ার চেয়েও দূর নয়নের দেখা, আর সম্পাদকের সঙ্গে যেন পাকাপাকি বিচ্ছেদ ঘটে গেছে কবি ও পাঠক উভয় গোত্রের। যে কেবল কথা কয় জলের মতো ঘুরে-ঘুরে সম্পাদক বেচারার সঙ্গে, সে কেউ নয় আর, পাওনাদার মুদ্রণদোকান তথা প্রেস মালিক।
অথচ সম্পাদক তো সাঁকো হবেন, লেখক ও পাঠকের মাঝখানে। কেন তবে এই যোগাযোগহীন যাতনা? আজকাল পাঠক, লেখক ও সম্পাদক একেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। দেখা হয় কদাচিৎ, কালেভদ্রে, এক-দেড়বার বছরে এই বার্ষিক দেখা সাক্ষাতানুষ্ঠান। ফলে কতিপয়ের সঙ্গে কতিপয়ের কচলাকচলি কেবল, বছরভর, করুণ কলরব করে চলেছি সবাই মিলে। এহেন পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে, এই প্রশ্ন অবান্তর। বরং প্রতিবেদিত ওই পরিস্থিতি বিরাজমান, এই সত্য সবাই স্বীকার করি কি না সেটাই জিজ্ঞাসা। এবং স্বীকার যদি করি, তাহলে এহেন শ্বাসরোধী বিরক্ত পরিস্থিতির পবনে প্রবাহিত থাকবো নাকি মোকাবেলার পথ ও পন্থা খুঁজব, সিদ্ধান্ত দরকার।
সেলফোন-ফেসবুক-ব্লগ-ওয়েবজিন ইত্যাদির মারকাটারি দিনে কেন ও কোন আক্কেলে যোগাযোগের অভাব বোধ করছি এবং শীর্ষসমস্যা বলে এইটেকে প্রচার করছি, বিশদে বলা চাই। দেখুন, আমাদের মতো কবিতা-করিয়েরা পত্রিকা ছাপি তিনশ বা পাঁচশ বা সাতশ বা হাজার কেউ কেউ। কে পড়ে এগুলো? উত্তর, পাঠক। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, সাহিত্যের বা কবিতার প্রাণপণ পাঠক। জিজ্ঞাসা আসে, কয়জন? জবাব সংখ্যায় না-দিয়ে একটু অ্যানালিটিক্যাল চিত্র হাজির করা যাক। এই পত্রিকাগুলো কোথায় পাওয়া যায়, মানে এগুলোর প্রাপ্তিস্থান কোথায়, একবার ঢুঁ মেরে আসি। সম্পাদকের বাড়িতে, কলেজ স্ট্রীটের হাতে গোনা একটি বা দুটি দোকানে, হাসবেন না, বাদ দিলে কয়টা জেলায় যায় এগুলোর দু-চারটা নমুনা কপি? দুই বা তিন, নাকি এক-দেড়টা বাদ গেল ক্যালকুলেশন থেকে? হালে অবশ্য জেলা-কাভারেজ কিঞ্চিৎ বেড়েছে। উন্নতি, বাংলা সাহিত্যের,কবিতার, মন্দ নয়।
ভেবে দেখুন, কোথায় আমরা, আমাদের বড়াই। কতদূর রিচ করতে পেরেছি আমরা, পরিসংখ্যানের পুনরুল্লেখ দরকার আছে? কেউ কেউ কৌতূহলী হয়ে ফের জিজ্ঞেস করতে পারেন, জেলার কার কাছে বা ঠিক কোন জায়গাটায় যেয়ে পেতে পারি জিনিসগুলো? হকার ছেলেটার কাছে চেয়ে দেখব? না, আপনি এই ভীষণমুখী বিশেষ পত্রিকাগুলো যত্রতত্র পাবেন না, পাবেন বইয়ের দোকান বা বুকশপ গুলোতে। যেন তেন বই দোকান না, আমাদেরকে পাওয়া যায় নির্দিষ্ট ধরণ কিছু বুকশপে, সেগুলোর ডাকনাম ‘সম্ভ্রান্ত লেখক ও মননশীল পাঠকের বইয়ের দোকান’। সে-রকম দুয়েকটায় উঁকি দিয়ে যদি না-পান আমাদের দেখা, জানবেন তবে, জেলার সর্বত্র সুলভ নই আমরা। খুঁজেপেতে জেলাশহরের একটা বা দুইটা বুকস্টোরে পেয়ে যদি যান, তবে আপনার সাতজন্ম সফল হলো। আমাদের একটা স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান রয়েছে, এটা আপনাকে বুঝতে হবে, এলেবেলে ব্যাটলফিল্ড এড়িয়ে চলি আমরা। আমরাই নেভিগেইট করে থাকি সাহিত্য সংস্কৃতির গতিপথ, হ্যাঁ, আমরা। মাইন্ড ইট, ইয়ার, সামহাল-ক্যে!
এদিকে, এত গর্জনের পর বর্ষণের মাত্রা মাপতে যেয়ে মাথায় বাজ। কথিত ছোটকাগজান্দোলনের চালশে বয়স, অথচ এদ্দিনে ন্যূন-পর্যায়ের একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পারি নি। বিপণনের একটা মিনিমাম কাঠামো, একটা কার্যকর কম্যুনিকেশন, হলো না আজও। হয়েছে বটে, মেলা, আহা মরি মরি লিটলম্যাগাজিন শোভাযাত্রা! কাছা যায় খুলে, সেদিকে খেয়াল নেই, আছে আত্মম্ভরী পায়রা ওড়ানোর বাবুবিলাস। সর্বসাকুল্যে সাতখানা সতেল-সগর্ব মুখের শোভাঢ্য পদযাত্রা, সাত পা আগায়েই ডিক্লেয়ার্ড সাফল্য মণ্ডিত লিটলম্যাগ ম্যুভমেন্ট, স্থিরচিত্রার্পিত কবিতাসাহিত্যের কলম্বাসবৃন্দ। মিশন অ্যাকমপ্লিশড্। রাত্তিরে ঘরে ফিরে ফেসবুকে আপলোড করলেই কেল্লা ফতে।
কে ভাববে এদের কথা, যে-ছেলেটি যে-মেয়েটি লন্ঠনের লুকোচুরির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খেলে চলেছে হাঁটু ও হৃদয় জখম করে শব্দে নৈঃশব্দ্য ধরার খেলা? তার সঙ্গে, তাদের সঙ্গে, কে পাতাবে সখ্য? নতুন কবিতা, নতুন কবি, কিভাবে জন্ম নেবে? সেতুটা কোথায়, সংযোগের? সেতু আছে, অবশ্য,পরম্পরার। যেমন নায়কের ছেলেমেয়ে নায়ক-নায়িকা, যেমন ডিরেক্টরের শালা-সমুন্দি ডিরেক্টর, যেমন রানীর তনয় রাজা, যেমন মন্ত্রীর ভাগ্নে-ভাইস্তা মন্ত্রী, তেমনি কবি হবে কবিদেরই ভাই-বেরাদর। বেশ, বহুৎ খুব, অল ইজ ওয়েল!
এভাবে, আর যা-ই-হোক, অভাবিতের দেখা পাওয়া যাবে না কখনো। এভাবে, আর যা-ই-হোক, অনাস্বাদিতের স্বাদ চাখা যাবে না কখনো। এভাবে, আর-যা-ই-হোক, অভূতপূর্বের উদ্ভাসন হবে না কখনো। এভাবে, আর-যা-ই-হোক, অজানারে বাহুডোরে পাবে না কখনো। এইভাবে, আর-যা-ই-হোক, বাংলা কবিতার বাঁকবদল হবে না কখনো। হবে; বাকবাকুম হবে, পায়রা উড়বে, মাথায় টায়রাও জুটবে। সেইসঙ্গে লেপ্টে রইবে আমাদের পিঠে বাংলা কবিতা পাঠকের ভেংচি ও বুড়ো-আঙুল।
সময়ের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা, আমাদেরই আত্মজ অথবা সহোদর, লিটলম্যাগের কথা শুনে ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে রয়। বুঝতে পারে না, সদ্য প্রবর্তিত মাইনর বা মেজর হয়তো, ভাবে। সে দেখেই নাই কোনোদিন জিনিশটার রূপ। লিটিল ম্যাগাজিন মামুজির মুখখানাই সে দেখেনি ইহজন্মে। আমরা তার সামনে সেটা নিয়ে যেতে পারিনি। কিসের এত বড়াই আমাদের? শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্ত, সংস্কৃত ও সমঝদার, লিটলম্যাগের লম্বাচওড়া গালগল্প শুনে বাতচিতকারীর কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব নিশ্চিত করেন। তার দোষ নেই। তিনি হপ্তান্তে একটা সাপ্তাহিক রাজনীতি বিশ্লেষণী, পক্ষান্তে একটা পাক্ষিক পাঁচমিশালী আর মাসান্তে একটা মাসিক সাহিত্যপত্রিকা রেগুলার সাবস্ক্রাইব করেন। তদুপরি দৈনিকের নানাবাহারী ম্যাগাজিন তো রয়েছেই। কিন্তু অমৃতসমান লিটিল ম্যাগাজিনের কথা তিনি এই প্রথম শুনলেন, এর আগে দেখা দূর শোনেও নি। কিসের জোরে এত এত বাতেলা আমাদের? এত ফালাফালি-লাফালাফি?আমরা পত্রিকা করি, পিঁপড়াও পুঁছে না। আমরা কবিতা লিখি, কীটেও কাটে না। আমরা নিজেরাই ছাপি, নিজেরাই পড়ি, নিজেরাই নিজেদেরে বাহবা দেই, নিজেদেরে নিজেরাই গালিগালাজ করি। কিন্তু তবু ভুলেও পাঠকের মুখোমুখি হই না আমরা, পাঠক এড়িয়ে চলি, পাঠক-সাধারণকে আমরা গ্রাহ্যেই নেই না। আমরা এতটাই নার্সিসাস! ফলে এহেন জনবিচ্ছিন্ন, পাঠকবিচ্ছিন্ন, অবধারিতভাবেই অবক্ষয়িত আমাদের ছোট কাগজবাহিত লেখালেখি ও ছাপাছাপি ও পড়াপড়ির জগৎ। ফলে একটা সময়ে এসে, ন্যাচারাল কারণেই, একেবারে তেজহীন ও স্তিমিত হয়ে এসেছে একদল মানুষের বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সাংস্কৃতিক তৎপরতা। আজ, সারা বছরে, সাতটাও ছোটকাগজ বের হয় কি না গুনতে হবে।
এটা একদিনের ঘটনাব্যাপার নয় মাসিমা, ওভার্নাইট অমন অচলাবস্থা তৈয়ার হয়নি মেসোমশাই! ডোর-লকড্ লিটিল ম্যাগাজিনের চর্চা আমাদেরকে এ-নোম্যান্সল্যান্ডে নিয়ে এসেছে। এখনো অবশ্য সময় আছে, যেতে যদি চাই ফের লোকালয়ে ফিরে।
কস্তুরী আর ঋষি এগিয়ে এলো। ঋষি বেশ উৎসাহিত হয়ে বললো তবে কি তোরা বলতে চাইছিস সেকালের লিটিল ম্যাগাজিন এই সময়ে দিশাহীন?নাকি,বলতে চাইছিস এইসময়ে দাঁড়িয়ে লিটিলম্যাগাজিন হয়ে উঠবে আধুনিক সহজপাঠ্য এবং সহজলভ্য ই-জিন, ব্লগজিন?
উদয়ন সৌরভের দিকে তাকায়,চোখ ফিরিয়ে ঋষির চোখে চোখ রাখে।আমি বা অলকানন্দা কিন্তু বলছি বিপ্লব পথ হারিয়েছে,সময় বদলেছে তাই অন্তত নিজের এবং বাংলা সাহিত্যের নিউট্রিশনের প্রয়োজনে একটা উপায়ই আছে। আপাতত খুলে দাও দ্বার, গাহ বন্দনাগান অজানার; আপাতত দ্বার খুলে দাও, অচেনারে আহ্বান জানাও; আপাতত দ্বার দাও খুলে।আপাতত, অসূয্যম্পশ্যা-অবরোধবাসী সক্কলে সদলবলে হোক স্বাগত। শত জল ঝর্ণা হোক আবার ধ্বনিত, শত হস্তে বাংলাকাব্য হোক মুখরিত। ওই যে-মেয়েটি যে-ছেলেটি ভিড়ের বাইরে চুপচাপ, শোনো তাকে, বলতে দাও ওর বলার কথাটি। ওকে ভাষা দাও, ভাষার উঠোনে ওকে সাদরে নাও টেনে। আমাদের প্রকাশনাসমূহ সম্মানিত হোক বক্ষে ধারণ করে ওদের সংবেদনারাশি। ওই অচেনার ওই অজগেঁয়ের রাশি-রাশি ভারা-ভারা গান বাজুক সারা বছর। আবারও নিধুয়া হাওর থেকে, হরিজনপল্লি থেকে, ধীবর জনপদ থেকে, পর্বতগ্রাম থেকে, সমুদ্রকূল থেকে, দুনিয়ার উত্তর ও দক্ষিণ সমস্ত মেরু থেকে উড়ে আসবে বাংলা গলার স্বর, বাংলা অক্ষর। পত্রিকায় অংশগ্রহণ করবেন পাঠক-লেখক-সমালোচক সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে, কখনো শব্দে কখনো নিশব্দে শরিক হবেন পত্রিকার সঙ্গে, কেননা ছোটপত্রিকা চালিয়ে যাওয়ার কাজ সম্পাদকের একার নয়। ছোটপত্রিকা প্রকাশ ও পরিচালনা একটি সমবায়ী শিল্প। অতএব, হে কিশোর কবি হে তরুণ ভাবুক হে চঞ্চল আলোচক হে স্থিতধী পাঠক হে প্রাজ্ঞ পরামর্শক, ছোটপত্রিকা সকলেরই লেখার ও পড়ার পত্রিকা। আবারও সংযোগ রচিত হোক, লেখক-পাঠক-সম্পাদক, তিন পাগলে মেলা হোক পত্রিকা পাতায়। তা সে ই-জিনে হোক বা লিটিল ম্যাগাজিনে।
কবি ও কথাসাহিত্যিক। জন্ম ৭ আগস্ট, উত্তরবঙ্গের কোচবিহারে। স্কুল জীবন থেকেই লেখালেখির সূত্রপাত। সম্পাদনা করেছেন বেশ কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকা এবং ওয়েবজিন। বর্তমানে ইরাবতী ডেইলি ওয়েবজিনের সাথে যুক্ত। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : জল ভাঙে জলের ভেতর [২০১১], ঠোঁটে দাও জ্যোৎস্নার বিষ [২০১২], ডুব সাঁতার [২০১৭], নিরুদ্দেশ গাছে সন্ন্যাসীর মুখ [২০১৭]। গল্পগ্রন্থ : কারুময় খামে অচেনা প্রেম [২০১২]। উপন্যাস: ইতি খন্ডিত জীবন [২০২২]। প্রবন্ধ সংকলন: মাটির গন্ধ [২০২২]। সম্পাদনা গ্রন্থ: দুই বাংলার সাম্প্রতিক গল্প [২০২২] ।
শখ বইপড়া, লেখালেখি, ছবিতোলা, গান শোনা ও ভ্রমণ। বেশ কিছু গানও লিখেছেন তিনি।