একগুচ্ছ কবিতা
আজ ০৩ মে কবি, লেখক মোস্তফা মঈনের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
সাদা ঘোড়ার দৌড়
রাত্রির শিকড়ে আমার ঢুলুঢুলু ঘোর। ঘোর একটা আকর গ্রন্থ। তার চিরল পাতা
পৃষ্ঠায় ছাই। জীবনের কয়লাখনিতে জমা হয় ছাইয়ের স্তুপ। স্তুপে শোয়ে থাকে
চকচকে নক্ষত্র। আমার নক্ষত্র ধোয়া রাত একনিষ্ঠ হই আকর গ্রন্থে।
প্রতিটি আকরিক নক্ষত্র আমার ছেলেবেলার কুড়ানো পাথর। পাথর দিয়ে আমি
আকাশ ছোঁয়া ইমারত বানাই। আকাশচুম্বী ইমারতটা নৈশ আলোক।
আমি আলোর চাতালে এসে দাঁড়াই। পান করি আলো। পাঠ করি জীবন।
এই পানশালায় পানরত সবাই প্রতি মুহূর্তে হয়ে ওঠে এক একটি তেজী ঘোড়া।
চারদিকে দৃপ্ত দাপট। ছড়িয়ে পড়ে আলোক হ্রেষা খুর। জন্ম নেয় অখণ্ড হীরক।
কুণ্ডলী পাকায় হীরক জোছনা।
আমার ঢুলুঢুলু ঘোর। ঘোর একটা সাদা ঘোড়ার দৌড়। দ্যোতিমান ঘোড়ার লেজে
ঝুলে যায় আমার চোখ। ওর রেশমি লেজ ছড়িয়ে দেয় সবুজ শস্য ভরা ধান নদী
দারুচিনি গ্রাম। মসলা ঘ্রাণ সচিত্র পাতা বৃক্ষ সবুজ ডাল। ডালের দিকে ওড়ে যায়
পাখি বনঘুঘু।
গ্রাম বালিকা হাসে। আলোর উৎস মুখে লাল শাড়ি বউ কলসী ডুবায়। আমরা পান
করি আলোর মধু।
গৌরী
প্রতিদিন গৌরীর সাথে জীবন বদল করি। সমস্ত জঙ্গল চষে
আমি যখন গৌরীর ডেরায়।
তার কুলুঙ্গিতেই ঘোর নিদ্রা, নিশিযাপন।
শুনেছি মানুষের প্রেমে শরীর থেকে চিলিক দিয়ে রক্ত উঠে মাথায়।
খুন পর্যন্ত গড়ায় জেনেও
মদ আর মরণের লোভে
চাঙ্গা দেয়া কাঠের টুলবাক্সে বসে
আমি গৌরীকেই প্রশ্ন করি, তুমি গৌরীকে চেনো ?
সে বলে, তোমার মুখেই তো কতো শোনেছি তার নাম।
আমি তখন তার কণ্ঠে ঠোঁট চেপে নিজের জীবন দিতে দিতে বলি,
আমিই সেই গৌরাঙ্গ মোহন
পূর্বজন্মে তুমি যার অগ্নিতে বিসর্জন ছিলে।
স্বপ্নফল
যেদিন জেনে গেছি, একটা স্বপ্নেরই পি-িফল এই আমি
সবুজ পাতায় মোড়া ঝুলে রয়েছি গাছের শাখায়, বাতাসে দোলছি গাঢ় লাল
পাখিরা পাকা ফলে ঠোঁট গলাচ্ছে, ঠোকরে ঠোকরে খাচ্ছে আমারই হৃৎপি- ফল।
আমি সেদিনই জেনেছি, পাখিজন্মে যারা নেচে উঠেছিল আমারই মাতৃজঠরে
আমি তাদেরই ঠোঁটে জীবনরস চুইয়ে পড়েছি অনন্তের ফোঁটা।
জীবন-বৃক্ষ থেকে কারো স্বপ্নফল গলে গলে এই আমি, আমারই জন্ম করেছি সার্থক
তাঁর চাওয়া, তাঁর তৃপ্ত অহং গলে গলে পাখিদের ঠোঁটে।
সরোদ স্বপ্ন
আমার শরীর বেয়ে খোয়া গেছে স্বপ্ন। জীবনের ফাঁক ফোকর ভেদ করে
বাতাসের আলিঙ্গন পাই। স্পর্শ পাই পাতা ও পাথর।
পাতায় দোয়েলের ডিম। উঁকি দেয় জীবন।
আমি হাঁটি। আমার শরীর বেয়ে যেন পোনা মাছের ঝাঁক নামে।
কতবার টেনে তুলে আনি সেই সরোদ স্বপ্ন। কলাপাতা মাছরাঙা
বাঁশপাতা ঘুঙুর বালিকা ঘুঘু।
বর্ষায় বৃষ্টিতে কৈ মাছের স্বপ্ন চড়চড় করে হাঁটে। পুকুরপাড় উলুখাগড়া
ধানখেত বিলপাথারে দৌড়ায় স্বপ্নেরা। মাথায় ছাতা করে কোঁচ হাতে
দৌড়ায় গৌরাঙ্গদা। তার চকচকা চোখ। ডিঙি নৌকায় দোল তোলে স্বপ্ন।
আমি হাঁটি। চরাচরে ভ্রমণ করে চোখ। আকাশের চোখ মেলে ধরে
গভীর নীল দেহের ক্ষুধিত তারা। স্বপ্নের ভেতর স্বপ্নান্তরিত হই আমি।

এবং এখানে বনজঙ্গল ঘিরে চাদরমোড়া দিয়ে আসে
শীতের কুয়াশা
ভোরবেলা সবুজের মাথায় করে
গোল হয়ে আসে লাল সূর্য।
.
জানালার ধারে পাখিরা যখন শিস লাগায়
লাল মোরগ ডাকার আগেই
ধানশিশু হাতে কিষাণেরা দলবেঁধে মাঠে নেমে যায়।
.
সকালবেলা মাঠের মিঠে রোদে জীবন চষে চাষিরা
কাদা কিংবা ঝুরঝুরা মাটির তলায়
বুনে চলে নিজেদের জীবন
ধান গম আলু শিম মটরশুঁটি ভরা ঘন সবুজ মাঠ।
.
এখানে জীবনের খেলা চলছে
পূর্বপুরুষের হাত ধরে এই খেলা আমরা পেয়েছি
আমরা মাঠের লোক
মাঠই আমাদের প্রার্থনার গান।
.
আমরা দুহাত ভরে তুলে আনি সোনালি ফসল
প্রাণের টানে দোল খেয়ে চলি ধানভরা নৌকায়
ভাটিয়ালি সুরে সুরে জীবনের সাথে জীবন মিলাই।
.
আমরা জীবন মিলাই নদীর সাথে
আষাঢ়ের নতুন জল
তার কাঁচা দেহে জোয়ার তোলে
নিয়ে আসে সাদা সাদা রূপালি মাছ!
মাছেরা সংসার পাতে বিলেঝিলে
কলমি কুমারীরা
লতানো অঙ্গে ফোটায় ফুল।
.
টলমলা জলে মাছেদের উদলা শরীর দেখে
আমাদের গায়ে শিহরণ লাগে
মৈথুনরত হাঁসেরা প্যাঁক প্যাঁক করে গলা তোলে
আমরাও সাঁতার কাটতে ঝাঁপ দিই
জলের বৈভবে।
.
ভরা শ্রাবণ
মাথায় নামছে পুরো আকাশের ঢল
পায়ে সাদা রূপার মল পরে পাড়ার কিশোরীরা
নামছে বৃষ্টি
পূর্বাকাশে রামধনু হাসছে!
উঠোনে লাল কামিনীগন্ধা বৌদিরাও বসে নেই
খুশিতে কাদামাটি আর শস্যদানা স্তনে মেখে
নেচে গেয়ে চলেছে ঘুঙুর শাড়ি চুল
ভাসছে
নদী উতলা শ্রাবণ।
.
এই জলে শরীর ভিজলে নারীরা গর্ভবতী হয়
মাটি ফুঁড়ে জেগে ওঠে দুর্বাঘাস
কলতলায় বৌদিদের বমি বমি লাগে
শরীরে চিলিক দিয়ে ওঠে লাল শাড়ি পরা ডিমওলা
বউ বউ পুঁটিমাছ!
.
আমার ডাকাডাকি শুনেই লাল বৌদি লজ্জা রাঙা হাসিতে-
দাঁতে শাড়ির আঁচল কামড়ে খিড়কি খুলে
পাকঘরে ঢুকে যায়
বাড়িতে এখন উঠোনের সাথেই তুলে দিয়েছি
লাউয়ের মাচা।
.
আমরা গাছে গাছে সবুজের পাটায় হৃষ্টপুষ্ট
তরতাজা ফল চাই
গর্ভকামিনী গাছের তলপেটে কান পেতে শুনি
নতুন বার্তা
আমাদের মাথা ও চিবুকের অস্থি ঘিরে
তরতর করে বেয়ে চলেছে লাউয়েরডগা!
.
আমাদের আনন্দের শেষ নেই।


প্রকাশিত বই: ‘কালের সেঁওতি মাপে জল‘ (২০০১), ‘শ্বাস পতনের শব্দ‘ (২০০৩), ‘রক্ত মাংসের শ্লোক‘ (২০০৮), ‘হাড়ের পিয়ানো‘ (২০১৫), ‘গন্ধকুমারী ও পাপচিহ্ন‘ (২০১৭), ‘বাম হাতে সমুদ্র ঠেলছি‘ (২০১৯), রোদ কচলে মাটি করতে চেয়েছি‘ (২০২০)।
লেখালিখির পাশাপাশি তিনি সাহিত্যের ছোট কাগজ ‘ডুমুর’ সম্পাদনা করেন।