| 29 মার্চ 2024
Categories
এই দিনে গল্প সাহিত্য

পুনরুত্থান

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

আজ ৯ এপ্রিল কথাসাহিত্যিক মোজাফফর হোসেনের জন্মদিন। ইরাবতীর পাঠকদের জন্য রইল মোজাফফর হোসেনের গল্প। কথাসাহিত্যিক মোজাফফর হোসেনের প্রতি রইল ইরাবতী পরিবারের পক্ষ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


মধ্যরাতে কবর থেকে উঠে এসেছে রহমান। মৃত্যুর দশ দিন যেতে-না-যেতেই তার এই উত্থান। জানতাম ওর যা হতচ্ছাড়া স্বভাব তাতে বেশিদিন টিকতে পারবে না ওখানে। আমরা বন্ধুরা যেখানে পাল্লা দিয়ে দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে যাচ্ছি, রহমান সেখানে দিব্যি দেশজুড়ে ফেরি করে ফিরছে তার এই হতচ্ছাড়া স্বভাব। আমি আর পশ্চিম পাড়ার সফদার যেদিন কর্মজীবন শেষ করে অবসর নিয়ে ফিরে আসলাম গ্রামে, তার মাস খানেকের মধ্যে রহমান যেন কোথায় থেকে উদয় হল। বহু বছর পর আমাদের সাক্ষাৎ। এতদিন কোথায় কোথায় ছিল সে আলাপে আমরা যায়নি। দ্বিতীয়বার দেখা হওয়ার আগেই মৃত্যুসংবাদটা এলো।

রহমান কবর থেকে উঠে সোজা চলে এসেছে আমার কাছে। মধ্যরাতে ঘুম থেকে তুলে বলে – চা খাবে। কিছুক্ষণ বসে এক কাপ চা খেয়ে বিদায় হল। আমার স্ত্রী অতি বিরক্তির সঙ্গে বানিয়ে দিল।

এ কয়দিনে রহমানের ভিটে-মাটি নিজের স্ত্রী-সন্তান না থাকায় ভাইয়ের ছেলে-মেয়েরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছে। রহমানের স্বভাব ওদেরও অজানা নয়, তাই যত দ্রুত পারে সম্পত্তি দখলের কাজটি সেরে ফেলেছে। যে সকল পাওনাদার রহমানকে বিষণ্ণ মনে মাপ করে দিয়েছিল, তারা আবার ধরনা ধরছে পাওনা প্রাপ্তির জন্যে। রহমান এসে আমার কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা ধার করে গেছে। ধারের টাকায় কিছু ধার শোধ দেবে।

ওদিকে রহমানের উত্থানের খবরে শহরে হৈচৈ পড়ে গেছে। আশেপাশের গ্রাম থেকে ছেলেমেয়েরা এসে রহমানের সঙ্গে সেলফি তুলে ফেসবুকে দিচ্ছে। কবরে মুনকার ও নাকিবের সওয়াল জবাবের বিষয়েও জানতে চাচ্ছে কেউ কেউ। রহমান খালি হাসছে। দলে দলে সাংবাদিক আসতে শুরু করেছেন। দফায় দফায় সাক্ষাৎকার নিচ্ছে গ্রামের লোকজনের। সুবিধাজনক কোন তথ্য বের করতে পারছে না কারো মুখ থেকে। যে যার মতো ছেপে দিচ্ছে খবর। একটা পেপার লিখেছে, ‘দজ্জাল নাকি নেক অলির উত্থান: রহস্যের ঘোর কাটছে না কিছুতেই!!’ আমার স্ত্রী সেই রাতের সামান্য চা বানানোর কাজকে কেচ্ছা বানিয়ে বেশ সেজেগুজে সাক্ষাৎকার দিয়ে বেড়াচ্ছে টেলিভিশনে। একটা সাক্ষাৎকারে ওকে বলতে শুনলাম, রহমান সেদিন রাতে যখন আমাদের বাড়িতে এলো, তখন পুরো বাড়িটা টিউবলাইটের মতো জ্বলে উঠল। রহমানের শরীরে পবিত্র ক্বাবাশরিফের ছায়া পড়েছিল। চা খাওয়া শেষ করে কাপটা টেবিলে রাখা মাত্রই চোখের সামনে উবে গেল। পরদিন দেখলাম রহমান যে সোফায় বসেছিল সেটি চেনা-অচেনা লোকজন দেখার জন্য ভিড় জমালে ও ওজু ছাড়া কাউকে উঠতে দিচ্ছে না ঘরে।

রহমানের কাছ থেকে পানিপড়া নিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসছে হাজার হাজার মানুষ। রহমান পানিতে ফুঁ দেবে না কিছুতেই। মানুষজন বাধ্য হয়ে রহমান উত্থানের পর প্রথম যে পুকুরে গোসল করেছিল সেই পুকুরের পানি এখন পান করছে, নিয়ে যাচ্ছে বোতলে করে। পুকুরের পানির দশা বেহাল দেখে লিটার প্রতি দশ টাকা করে নিচ্ছেন পুকুরের মালিক রহিম মোল্লা। রহিম মোল্লার ছোটভাই রবমোল্লা জনগণকে তার পুকুর দেখিয়ে বলছেন, বাবা হযরত রহমান এই পুকুরেই দ্বিতীয় দিন গোসল করেছেন। সুবান্নাল্লাহ! আসেন লিটার প্রতি মাত্র পাঁচ টাকা! শহর থেকে সরকারি লোক এসেছে ভ্যাট নিশ্চিত করতে।

এরিমধ্যে পানিপড়া নিতে আসা একটি বাস গ্রামের সরু রাস্তা ধরে আসার সময় খাদে পড়ে জনাবিশেক মানুষ ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছে। এদের বেশিরভাগই সুস্থ, মৃত্যুপথযাত্রী আত্মীয়-স্বজনদের জন্যে পানিপড়া নিতে এসেছিল।

গ্রামের উত্তর দিকের ফাঁকা জায়গাটিতে মেলা বসেছে। মেলা স্পন্সর করছে দেশের বৃহৎ একটি মোবাইল কোম্পানি। মেলায় বিক্রি হচ্ছে জিলিপি, পেঁয়াজি, চপ, শিঙ্গাড়া ও হাতপাখা। আর অবশ্যই পানি। মানুষজন প্রথমেই যে জিনিসটি কিনছে তা হল হাতপাখা। এই গরমে এটার গুরুত্ব বেড়ে গেছে বহুগুণে, সঙ্গে দামও। হাতপাখার ব্যবসা করেই জনাকয়েক পরিবার পাকা ঘর তুলে ফেলতে পারবে। যারা দিনে দিনে বাড়ি ফিরে যেতে পারছে না, তারা আশ্রয় নিয়েছে গ্রামের স্কুলের ছাদ ও বারান্দাতে। সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়েছে বিদ্যাপীঠ। এ কয়দিনে হালকা বসতিপূর্ণ প্রান্তিক গ্রামটি জেলা শহরের কোলাহলকেও হার মানিয়েছে যেন!

এমপি এসেছিলেন দলের নেতাকর্মী ও সংবাদকর্মীদের নিয়ে। রহমানকে পাশের চেয়ারে বসিয়ে নিজে লম্বা বক্তৃতা দিলেন। এমপি মহোদয় পেশায় ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। বিশেষ থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেছেন। তিনি বললেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন বিস্ময়কর নজির কেবল তার সরকারের আমলেই দেখা গেল। সরকার দেশে ধর্মীয় যুক্তিবাদ এবং বিজ্ঞানসম্মত ধর্মশিক্ষা নিশ্চিত করেছেন বলেই মহান আল্লাহ রহমানে মাধ্যমে তার খুশি হওয়ার বার্তা পাঠিয়েছেন। তিনি ঘোষণা দিলেন, এক মাসের মধ্যেই গ্রামের রাস্তাঘাট আরও উন্নত করে দেওয়া হবে।

সরকারদলীয় সভা শেষ হওয়ার পরদিনই বিরোধীদলের কয়েকজন নেতা গ্রামে এসেছিলেন কিন্তু প্রশাসন এবং সরকারদলীয় ছাত্রনেতারা গ্রামে তাদের ঢুকতে দেয়নি। পরে শহরে ফিরে গিয়ে তারা বলেছেন, সরকার তার ব্যর্থতা থেকে দেশের জনগণকে মুখ ফেরানোর জন্যেই এই নাটক সাজিয়েছে। সরকারের ব্যর্থতার কথা জনগণের জানা। নকল রহমানকে দিয়ে সরকার আবারও প্রমাণ করল, এদেশে ইসলামের প্রকৃত সেবী তারা নন। তারা ধর্মের নামে কুফরি করে এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের চোখে ধুলো দিতে পারবে না।

আমি বাড়ি বসে ইউটিউবে রহমানকে নিয়ে কয়েকজন মৌলানার ওয়াজ শুনছিলাম। রহমানের পুনরুত্থান ইহুদি নাসারা ও নাস্তিকদের জন্য একটি সতর্কবার্তা হিসেবে ব্যাখ্যা করলেন একজন। অন্য একজন রহমানের উত্থানের আগেই তার সঙ্গে স্বপ্নে কথা হয়েছিল বলে জানালেন। স্বপ্নে রহমান তাকে বলেন, বাংলাদেশের নারীরা তাদের পশ্চিমা টাইটফিটিং পোশাকে এদেশের পুরুষদের গুমরার পথে নিয়ে যাচ্ছে। মানুষকে হেদায়েতের পথে আনতে হলে নারীদের ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ করতে হবে। সহি পোশাকে মাদরাসায় পাঠাতে হবে। আরেক হুজুর তার ওয়াজে বললেন, পৃথিবীর বুকে আল্লাহ গজব নামবে, রহমান আমাদের সতর্ক করতে ফিরে এসেছে। এখনো সময় আছে, পৃথিবীর অমুসলিমদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। নাস্তিকদের বিরুদ্ধে আমাদের জিহাদে যেতে হবে। আল্লাহ রসূলের পক্ষ থেকে হযরত রহমান আমাদের এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিবেন। তিনি ওপর থেকে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা নিয়ে এসেছেন।

ফেসবুকে দেখলাম, কুষ্টিয়ার লালন শাহ মাজার থেকে কয়েকজন বাউল দাবি করেছেন রহমানের বেশে আসলে সাঁইজি উঠে এসেছেন। তারা বলছেন, এই মাজার থেকে সাঁইজি জানিয়েছেন যে তিনি পৃথিবীর মানুষকে জাতধর্ম ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে দাড় করাতে আবার উঠে আসবেন। তিনি পুনরুত্থানের রাতেই তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গেছেন। বলতে বলতে জয় গুরু বলে গেয়ে ওঠে: ত্রিজগতের মূলধার সাঁই/ জন্ম-মৃত্যু তার কিছুই নাই/ সিরাজ সাঁই কয়, লালন রে তাই/ থাক সদায় ঠিক জেনে।।

যাকে নিয়ে এত কথা, এত উৎসব ও আয়োজন, সেই রহমানই হঠাৎ করে গায়েব হয়ে গেল। এলাকা তন্নতন্ন করে কোথাও হদিশ মিলল না তার। মাঝ রাতে কে কোথায় দেখেছে সেই গল্প শোনা যেত প্রতিদিন। কোনদিন হয়ত ফজরের আজান দিতে গিয়ে কেউ মসজিদে দেখেছে বলে জানাল। গনগনে দুপুরে মাঠে স্যালো মেশিনের শীতল পানিতে গোসল করতে দেখল কেউ। কেউ দেখল মধ্যরাতে বাড়ির উপর দিয়ে পাখির মতো উড়ে যাচ্ছে দীর্ঘদেহী রহমান। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এ ধরনের কথা শোনা যাচ্ছিল। রাজধানীতে একজন পকেটমার জানিয়েছে, সে রাতে একজনের পকেটমারতে গেলে রহমান এসে তার পা ভেঙে দিয়ে চলে গেছে। সত্যি সত্যি তার ডান পাটা ভাঙা অবস্থায় পুলিশ তাকে উদ্ধার করেছে। এই ঘটনার পর নাকি দেশের অপরাধ অনেকটাই কমে গেছে।

আমরা যখন রহমানকে আর কোথাও দেখতে পাচ্ছিলাম না, তবে তার সর্বময় উপস্থিতির নানা কাহিনি শুনতে পাচ্ছিলাম বিভিন্ন মাধ্যমে তখনই এক মধ্যরাতে রহমান আমার বাড়িতে হাজির। এবার আমার স্ত্রী বেশ আগ্রহের সঙ্গে চা বানাতে গেল। কানে কানে বলে গেলো টেবিলের পানিভর্তি জগে ফুঁ দিয়ে নিতে। চা আসার আগেই রহমান উঠে গেল। বলল, ক্লান্ত, বিশ্রামের দরকার। কবর পর্যন্ত আমি এগিয়ে দিলাম।

পরদিন জানাজানি হলে রহমানের কবর পাকা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল একটি মহল। রহমান যাতে আর সটকে আসতে না পারে তার জন্যেই এই বন্দোবস্ত এমনটি ভেবে অন্য একটি মহল লাঠিসোটা নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো কবরের চারপাশে।

আমার স্ত্রীর এখন পেটের পীড়া একদম সেরে গেছে। ওকে বলা হয়নি, পানিতে ফুঁ-টা সেদিন আমিই দিয়েছিলাম।

 

 

 

 

 

 

 

One thought on “পুনরুত্থান

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত