| 19 এপ্রিল 2024
Categories
এই দিনে গল্প সাহিত্য

সিন্ধুভৈরবী

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

আজ ২৬ ফেব্রুয়ারি কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও সঙ্গীতশিল্পী মণিকা চক্রবর্তীর শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


 

গ্রীন রোডের সিগন্যালে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে জ্যামে আটকে আছে, মেধা। গন্তব্য কলাবাগান। সিএনজির ড্রাইভারটিও বেশ বিরক্ত। মেধা ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে, বিরক্তিটিকেও উপভোগ করে। এবং সে লাফিং বুদ্ধের ঢঙে একটা হাসিও দেয়। ড্রাইভার সম্ভবত আরও বিরক্ত হয়। কিন্তু প্রচুর মেকআপের কারণে তাকে খুব সুন্দরী দেখাচ্ছে বলে, ড্রাইভার হাসিটি গম্ভীরভাবে মেনে নেয়। মেধা আজকাল চারপাশের বিরক্তিকর যা কিছু, সবকিছুই উপভোগ করে। কারণ, যখন কোনো পরিস্থিতিকে তুমি কোনোভাবেই পাল্টাতে পারবে না, তখন তাকে উপভোগ কর। কথাটা সম্ভবত বার্ট্রান্ড রাসেলের। উনি কথাটিকে অন্যভাবে প্রয়োগ করেছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর য়ুনিভার্সিটিতে তার প্রিয় বিষয় ইকোনোমিক্স পড়বার সময় এই কথাটিকে একটু ভিন্নভাবে তুলে ধরেছিলেন তার প্রিয় শিক্ষক। আজ সারাদিনের নানা অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে এই কথাটিকে সে বেশ কয়েকবার উপলব্ধি করেছে। কথাটি যেন শুধু কথা নয়। চারপাশের যানবাহনের ঠাসাঠাসি অবস্থার ভিতর, নিয়তির চরমতম নিষ্ঠুরতার ভিতর, তার হারানো অতীতের ভিতর থেকে, এই কথাটি যে তাকে আপাত স্বস্তি দিচ্ছে, তাও অল্প পাওয়া নয়। মনে মনে এইটুকু ভেবে দম আটকানো পরিস্থিতির ভিতর একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।

আজকের সারাটা দিনের হিসেব এক অর্থে শূন্য। হাতড়াতে হাতড়াতে গত বাইশ বছরের জীবনের হিসাবটাও শূন্য মনে হয় তার। নিঃসঙ্গ, করুণ। জীবনের অনিবার্য দুঃখের ভিতর অবগাহন। তবু সে স্থির, আরও সংযত, আরও অবিশ্বাস্য রকমের পাথর। বিশেষ করে আজকের যে অভিজ্ঞতা হল, তাতে তার জীবনের সকল হিসেবকেই শূন্য মনে হচ্ছে এখন। যদিও এই একই অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে, প্রবল নৈরাশ্যের ভিতর দিয়েই সবটুকু পথ চলা। তবু কিছু আশা বোধহয় মানুষের ভিতর শেষপর্যন্ত থেকেই যায়। জয়ের আশা। কিন্তু আজকের মতো মৃত শরীরের অনুভব নিয়ে সে কোনদিন বাড়ি ফেরেনি। সে জানে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা আজই বাড়িতে জানাতে হবে। ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকা অবস্থায় প্রবল জ্যামের ভিতর সে আবার তাকায় ঠাসাঠাসি করা ভিড়ের ভিতর। গরম-ক্লান্ত মানুষ, কারো কারো দরদরিয়ে ঘাম পড়ছে শরীর বেয়ে, চোখগুলোতে হতাশা আর ক্লান্তির ছাপ। যেন ঠিক এই মুহূর্তেই গন্তব্যে পৌঁছে গেলে কিছুটা বিনাশ ঠেকানো যাবে। এসব ভিড়ের ভিতর, রাস্তার প্রতিটি ইঞ্চিকে দখল করার প্রতিযোগিতার ভিতর, রাস্তার চারপাশে রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পের নানা রকম বড় বড় গর্ত আর ফাঁকের ভিতর মেধার চোখ আটকে গেল নিমিষে এক ঘোড়ার গাড়ির দিকে। ঝলমলে ঘোড়ার গাড়ি। ঠিক কতক্ষণ ধরে রাস্তায় রয়েছে, মেধা আন্দাজ করতে পারল না। গাড়িটি কি রামপুরা থেকেই এসেছে! কী জানি! বোধহয় পুরান ঢাকা থেকে। তবে কতটা পথ ঘোড়া দুটিকে

পাড়ি দিতে হয়েছে! ছয়-সাত বা আট ঘণ্টা! ঘোড়ার গাড়িটির তুলনায় তার সিএনজির ড্রাইভার অনেকটাই ভাগ্যবান। রামপুরা যাবার সময় তার সময় লেগেছিল আড়াই ঘণ্টা। বসুন্ধরার সামনের জ্যামটি কিছুতেই সর ছিলনা, তারপর সোনারগাঁওয়ের সামনে দীর্ঘক্ষণ। দুপুর আড়াইটায় তার গানের রেকর্ডিংয়ের জন্য পৌঁছানোর কথা ছিল। জ্যাম ছাড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে সে টিভি ভবনে পৌঁছেছিল, ঠিক আড়াইটা বাজার দশ মিনিট আগে। পাস আনতে গিয়ে দেখে, তার নামের বানানে ভুল। ক¤িপউটারে নাম ভুল ও ফোন নাম্বার ভুল। এসব ঠিক করতে করতে সে মনে মনে ভাবছিল, মেকআপটা কখন করবে! দেরি হয়ে যাচ্ছে না তো! কেবলি স্ট্রেস!

ঘোড়ার গাড়িটিকে সে আবার মন দিয়ে দেখে। ঝলমলে, সুন্দর সাজানো। গাড়িটি খালি। রাস্তায় দেখবার মতো আর কিছু নেই। ফুটপাথগুলিতে যেভাবে ইচ্ছে মোটরসাইকেল যাচ্ছে, অসংখ্য লোকের ভিড়ে এক বৃদ্ধ যাচ্ছে, এক ছোট্ট শিশুও যাচ্ছে মায়ের হাত ধরে। এ সবকিছুর মধ্যে ছোট্ট ঠেলাগাড়িতে শাকসবজির যোগানও রেখেছে এক দোকানি। এখন রাত সাড়ে সাতটা। সবজিগুলো আর তাজা নেই। ঘোড়া দুটি তাকাচ্ছে সবজির দিকে। কিন্তু ঠুসি পরানো ঘোড়াদের মুখে। রাস্তার আলো পড়ছে তাদের মুখের উপর। ক্লান্ত চোখগুলো এদিক ওদিক করছে। মাঝে মাঝে সাদা লেজের ঝাড়ন দিচ্ছে, আর তা মাঝে মাঝে ফুলে উঠছে। এইসব যান্ত্রিক জীবনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ঘোড়াটির আতঙ্ক যেন মেধা দেখে ফেলছিল। ওর বুকের ভিতরের ধুকপুক, লেজের ভারী লোমের ঝাড়ন আর নিঃশব্দ প্রতিবাদটি মিলে এমন একটি যুদ্ধের জানান দিচ্ছে, যার স্বর যেন রাস্তায় আটকে পড়া প্রতিটি মানুষ জানে। সন্ধ্যার আলোতে ঘোড়াটির ব্যথা ও জীবনের কেন্দ্রের সকল নৈরাজ্য যেন প্রত্যেককেই বিষণè করছে। তবু সকলেই যেন কী এক অজানা যাদুতে শান্ত। মানুষের অস্তিত্ব কি আছে! এইখানে! এই নৈরাজ্যে! নাকি সবকিছুই পুড়ে যাবার পর ছাই বা ধোঁয়া!

আজ সারাদিনে প্রতিটি তিক্ত অভিজ্ঞতার পর এই প্রশ্নটি তাকে তাড়া করেছে। নিজের ভিতর প্রচ- ভারাক্রান্ত অনুভব নিয়েও সে গান গেয়েছিল, রবীন্দ্রনাথের গান। টিভিতে রেকর্ড করা হল। এক টেকেই রেকর্ডিংটা হয়ে গেল। তবু এইটুকুর জন্য তাকে দিতে হয়েছিল মূল্যবান সারাটি দিনের সময়। রেকর্ড হবার কথা তিনটায়। রেকর্ডিং শুরু হলো সাড়ে পাঁচটায়। মিউজিশিয়ান তৈরি তো লাইটিংয়ের লোক নেই। সেট তৈরি হবার পর দেখা গেল ক্যামেরার লোক আসেননি। তিনি প্রচ- জ্যামে আটকে আছেন। তো কী করা! বসে অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই। দুপুরে তাড়াতাড়ি রওয়ানা হওয়াতে মেধা ভরপেট খেয়েও আসেনি। স্টুডিওতে এত ঠা-া যে, গলাটাও বসে গেছে। অন্য সময় সে ব্যাগ গুছিয়ে মোজা, গরম কাপড় ও চা নিয়ে আসে। আজ সঙ্গে কিছুই নেই। ভেবেছিল, চারটার মধ্যেই শেষ হবে। এক কাপ চায়ের বরাদ্দও নেই শিল্পীদের জন্য। কন্ট্রাক্ট সাইন করার সময় তার মনে হল, এর আগে সাইন করা দুটি বিল সে পায়নি।

এখানে তাকে ডেকেছে ছয় মাস পর। গত তিন মাসে সে প্রাইভেট চ্যানেলেও গান করেছে, তবে সেখানে সম্মান, মর্যাদা ও অর্থ সঙ্গে সঙ্গেই পেয়েছে। গানের সুগন্ধটা যেন ছড়িয়ে ছিল সেখানে। যদি সে একটা সিডির অ্যালবাম বের করতে পারতো, তবে প্রাইভেট চ্যানেলে সে নিজেকে নিয়ে একবার চেষ্টা করত। কিন্তু তা হবার নয়। এতটাই পারিবারিক বাধা। তিন ভাইবোনের মধ্যে তাকে কুৎসিতই বলা চলে। বেঁটে, কালো, চ্যাপ্টা চেহারা। তবু বাবার বড় আদরের। বড় মেয়ে; বাবা আদর করে ডাকত মেধা। অন্য দুই ভাইবোন যেন অন্য কেউ। ফর্সা, লম্বা,  ঝকঝকে চেহারার, ব্রিলিয়ান্ট। ভাইটি কবেই স্কলারশিপ পেয়ে আমেরিকায় পড়তে গেছে, ছোট বোনটিও নেভির অফিসার। শুধু সেই যেন কোথাকার কুড়িয়ে পাওয়া কুৎসিত হাঁসের ছানা। বাবাই তার গলায় তুলে দিয়েছিল সুর। মারা যাবার দুদিন আগেও বলেছিল, তানপুরাটা

নিয়ে একটু বস তো মা। হঠাৎ স্ট্রোক হয়ে এত অল্প বয়সে বাবা মারা যাবে, কেউ ভাবেনি। পুরো পরিবারটাই যেন পড়ে গিয়েছিল অথৈ জলে। আর মায়ের সমস্ত রাগ আর বিদ্বেষের বিষয় হয়ে উঠেছিল তার গানের জগৎ। বিশেষ করে তানপুরাটাকে মা যেন সহ্যই করতে পারতো না। সারাক্ষণ বলতে থাকতো, কলাবাগানের এই ছোট ফ্ল্যাটে এসবের জায়গা হবে না। সারাদিন বিভ্রান্তি নিয়ে বেড়াতো মা। অল্প বয়সে স্বামীহারা। কথায় কথায়- কী দিয়েছে তোমার বাপ? ভাগ্যিস আমি বিএসসি অনার্সটা করেছিলাম। তাই স্কুলে কিছু একটা করতে পারছি। দুরুমের পুরানো ফ্ল্যাটটা না থাকলে বস্তিতে থাকতে হতো আমাদের!

মা, বাবার পেনশনের টাকা কি সব শেষ!- বোকার মত প্রশ্ন করে মেধা! অন্য ভাইবোনেরা সারাদিন-রাত পড়ে। শুধু মেধাকেই গান আঁকড়ে থাকতে হয়। হুম, শেষ হবেনা তো কী! তোমার গানের পিছে খরচ করব! সারাদিন তো আছ গান নিয়ে! কেন যে ছায়ানটে তোমাকে শিখতে বলল! গানে তো ফার্স্টক্লাস পেয়েছ! তাতে লাভ হয়েছে কিছু! যা চেহারা তোমার! ডেকে ডেকে সুন্দর চেহারাদের প্রোগ্রাম দিবে, তোমাকে দিবে না! কেন সময় নষ্ট করছ!

মেধা মাথা নিচু করে থাকে। সে জানে মায়ের কথা সত্যি। আছে তোমার বাপের মুরোদ! টাকার জোর! নিজে তো মরছে! মাইয়ার মাথায় ঢুকাইছে গানের পোক। উনি শিল্পী হবেন! সাধনা করবেন! মায়ের মেজাজ খিঁচড়ে এমন পর্যায়ে যায়, শেষ পর্যন্ত তা বাল-ছাল ও নানারকম অশ্নীল শব্দে দীর্ঘায়িত হতে থাকে। মেধা তবুও মুখ দিয়ে স্বর তোলে না। সে জানে, সে কত সাধনা করে তৈরি করেছে তার কণ্ঠস্বর। কথায় কথায় সেটি উচ্চগ্রামে পৌঁছলে তার কণ্ঠস্বরের কোমলতা নষ্ট হতে পারে। সে যেন হঠাৎ স্থানচ্যুত হয়ে হারিয়ে যেতে চায় ছায়ানটের ক্লাসিক্যাল ক্লাসে। তার চোখে ভাসে সেখানে প্রিয় অসিত স্যারের মুখ, সুরের বিস্তার রাগ ভৈরবীতে। কখনওবা তিনি তানপুরার তারগুলিকে বেঁধে দিচ্ছেন পরম মমতায়। এক অসাধারণ শিক্ষক, যিনি প্রকৃতই অভিভাবকের মতো। মায়ের চিৎকারগুলো যেন কোথায় হারিয়ে যায়। তার কানে বাজে মিতা আপা তন্ময় হয়ে গাইছে- আকাশ আমায় ভরল আলোয়, আকাশ আমি ভরব গানে’। মায়ের চিৎকারের ভিতর তার কুঁকড়ে যাওয়া আত্ম গানের ভিতর আশ্রয় খোঁজে। আবার মায়ের ঘ্যানঘ্যানানি কানে বাজে। মায়ের চিৎকার এবার কান্নায় রূপ নেয়। এ বিল্ডিংয়ে আমি মুখ দেখাতে পারি না। মেয়ে গান গায়- এটা কোনো কথা! মেয়ে জাহাঙ্গীরনগর থেকে অনার্স পাস করছে; হয় বিয়ে দাও, নাইলে চাকরি করুক। দশজনের কথার ঠেলায় আমার মাথা ঠিক থাকে না। আর এই মেয়ে সারাদিন আছে গলা উচাইয়া ভ্যা ভ্যা করার তালে। আরে হারামজাদি, এ বাসাটা নিজের না হইলে তো তোর যন্ত্রণায় বাসাও কেউ ভাড়া দিত না। গান গাওয়া হারাম- ত্ইু জানস না! তোর বাপে জানে না! চেহারা-সুরত ভাল থাকলে নাইলে বিয়া দিয়া আপদ বিদায় করতাম!

আর চুপ থাকতে পারেনি মেধা। আম্মা, আমি খুব তাড়াড়াড়িই এখান থেকে চলে যাব। প্লিজ, মা চুপ কর।

কই যাবি!

আমার শান্তিনিকেতনে স্কলারশিপ হইছে। আমি গান শিখতে যাব। আমার জন্য তোমাকে একটি টাকাও দিতে হবে না। মেধা পাঁচ বছর ওখানেই থাকে। ওখানের জীবন যেন তার আত্মার শিকড়ের সঙ্গে মিলিয়ে আছে। ওখানে কোনো ক্লান্তি নেই। জীবনের বিলাসিতা নেই, আছে আত্মিক প্রশান্তি। ওখানকার সাঁওতাল মেয়েরাও কত খুশি। ওখানে সাইকেলে চড়ে যেতে তীব্র গরমেও ক্লান্তি লাগে না। পুরো জীবনটাই যেন সঙ্গীতের মতো সুন্দর আর সাদা পালকের মতো পাতলা। একা চলবার যে বিপুল স্বাধীনতা সে পেয়েছে সেখানে। সেখানে সাঁওতাল থেকে একজন বড় প্রফেসরও পর¯পর বন্ধু। দুজনেই যেন জীবনবোধের শিক্ষায় ও মাধুর্যে দীপ্ত। কোনো অভিযোগ নেই। ভোগান্তি নেই। ধর্মের দখলদারিত্ব নেই। তার ভালো লাগে বিকেলে হেঁটে বেড়াতে। মাঝে মাঝে কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ মানুষ নিজেদের কথা বলে। তারা হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় ট্রেন লাইনের পাশে।

হয়তো তাদের ছেলেমেয়েরা প্রবাসে, তবুও তাদের আত্মা অসহায়ত্বে একটুও মলিন নয়। মানুষ পর¯পরকে এত ভালবাসে! সময় কাটাবার জন্য রয়েছে শ্রেষ্ঠ লাইব্রেরি, শক্তিশালী ওয়াইফাই, খেলা ও বাগান করার নানা আয়োজন। কোনো ক্লান্তি নেই এখানে। বিদেশিরা কত রকমের গবেষণা করছে! রয়েছে নিসর্গের হাতছানি, গ্রীষ্ফে¥র দাবদাহটুকু খুব বেশি। তবু তখন সোনালু ফুলে ভরে থাকে মাঠ। আরও যে কত ফুল! যেখানে দাঁড়াই, সেখানটাই বিশ্বস্ত- ফুলে-ফলে, শিল্প-সুরে। এখানে কোথাও আপোষ করতে হয় না, প্রাণের আনন্দ ছড়িয়ে থাকে সবখানে। পাঁচ বছর ওখানে কাটাবার পর মেধা গত ছয় মাস আগে ফিরেছিল। ভেবেছিল, পাঁচ বছরে অনেক কিছু পাল্টাবে। অন্তত মায়ের স্বভাবে কিছুটা পরিবর্তন দেখবে। এখন মায়ের টাকার অভাব নেই। ভাই বিয়ে করেছে, আমেরিকা থেকে ডলার পাঠায়। ছোট বোনও বিয়ে করেছে নেভির এক অফিসারকে। সুখী দা¤পত্য।

শুধু মেধার জীবনে কিছুই বদলালো না। সুর থেকে সুরে নিরন্তর। পাঁচ বছরে পাল্টায়নি কিছুই। মায়ের মধ্যে সে এখনও পায়নি কোনো পরিশীলিত বোধ। সে ভেবেছিল, কিছুদিন আমেরিকায় থাকায় কিছুটা বদলেছে আম্মুর জীবনবোধ। না, কিছুই পাল্টেনি। গত ছয় মাসের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল ঘাতকের মতো। মায়ের এখন টাকার অভাব নেই। কোনো কিছুরই অভাব নেই। তবু যে কিসের এত অভাব! চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসার আগে সে আরেকবার মায়ের সাথে কথা বলে। সম্ভবত এই শেষবার। শেষবারের মতো ভাবে, মায়ের প্রতিক্রিয়া ভালোও হতে পারে। চেষ্টা করে দেখা যাক।

আম্মু, তুমি যাবে আমার সাথে!

কোথায়!

শান্তিনিকেতনে!

না।

এখানে একা থাকবে, আমার ভয় করে! ওখানে নিরাপত্তা আছে, আম্মু! ওখানে গ্রামের মতো। তোমার ছোটবেলার গ্রামের মতো। তোমার ভাল লাগবে।  না, আমিও যাব না, তুইও যাবি না। আমি তোকে বিয়ে দেব। এমনেই বহুত পাপ কামাইছ। এখন বিয়া-শাদি কইরা সংসারী হও, পাপ কমাও। গান-টান বাদ। মেধা মুখ বুজে হাসে। মনে মনে বলে, সুরের সাথে যার বিয়ে হয়, সে মানুষের বোঝা টানতে যাবে কেন! তার নিস্তব্ধ আত্মার ছায়া পড়ে তানপুরার উপর। ক্ষমাহীনতার অনুভব নিয়ে সে মায়ের মুখের দিকে তাকায়। শেষ বিশ্বাসটুকু খুঁজে খুঁজে আরেকবার ক্লান্ত হয়। মেধা, কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতনের ট্রেনে যাচ্ছে। শুনছে বাউল গান। একের পর এক। এর আগে যতবার সে ফিরেছে, সে ছিল মৃত গাছের মতো। দুর্ভাগ্য তাকে তাড়া করেছে বারবার। তার স্বপ্নের সামনে হাজারবার এসে দাঁড়িয়েছে জীবনের অসঙ্গতি, সমাজের অসঙ্গতি আর পারিবারিক সীমাবদ্ধতা। আজও রয়েছে সেসব। কিন্তু সে আজ কিছুতেই ভয় পায় না। সুরের কাছে সে অঙ্গীকারবদ্ধ। ভালবাসার কাছেও। পিছনে এক দীর্ঘ বিস্মরণ। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে, বৃষ্টি নামবে এখুনি। বদলে যাবে বোলপুরের রোদের তপ্ত মাঠ। ভালবাসার বৃষ্টি পাবে সে। ভিজে যাবে রেললাইনের কাছে পড়ে থাকা পাথর। আকাশের কোনে রহস্য। আলো আর অন্ধকারের খেলা। সে তার গভীর অঙ্গীকারকে ছড়িয়ে দেয় রহস্যময় আকাশে।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত