| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ইতিহাস এই দিনে

মণি সিংহ বিপ্লবের অগ্নি পুরুষ

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

আজ ৩১ ডিসেম্বর বিপ্লবের অগ্নি পুরুষ মণি সিংহের প্রয়াণ দিবস। ইরাবতীর বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।


তুচ্ছ করেছ রাজ প্রাসাদের মণিমানিকের শোভা, /তুচ্ছ করেছ বন্ধু স্বজন পরিজন মনোলোভা, /তুচ্ছ করেছ রাজভয় আর শাসন ত্রাসন জ্বালা, /কন্ঠে পরেছ শত শোষিতের জীর্ণ হাড়ের মালা

হ্যাঁ, রাজা রাজ প্রাসাদ ছেড়ে যোগ দিয়েছিলে নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের মিছিলে একে একে পাড়ি দিয়েছিলেন কণ্ঠকাকীর্ণ পথ জীবনের সেই পথ কখনো হয়েছে অগ্নিদগ্ধ, কখনো হয়েছে রক্তাক্ত তবু মানুষের মুক্তির সংগ্রামে ছিলেন অবিচল তিনি গণমাণুষের অবিসংবাদিত নেতা মণি সিংহ সেই প্রিয় নেতাকে উদ্দেশ্য করেই পল্লীকবি জসীম উদ্দীন তাঁরযে দেশে মানুষ বড়বইয়ের উৎসর্গপত্রে পঙ্ক্তি গুলো রচনা করেছিলেন

কমরেড মণি সিংহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অনবদ্য সূর্য সৈনিক যার দীপ্ত পথ চলা সেই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম,বাংলাদেশের গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত তিনি দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে শোষিত কৃষকশ্রমিকের মুক্তির জন্য কমিউনিষ্ট নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন আন্দোলন দেশ বিভাগের পরে পাকিস্তান কমিউনিষ্ট পার্টি পরবর্তীকালে বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টি গঠনে যে অবদান রেখে গেছেন তা চির ভাস্বর হয়ে থাকবে

 

জন্ম পরিচয়: মণি সিংহের পিতাকালী কুমার সিংহ ছিলেন নেত্রকোনার পূর্বধলার জমিদার পরিবারের সন্তান যিনি চাকুরিসূত্রে বসবাস করতেন কলকাতায় তাঁর মা ছিলেন নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুরের জমিদার বংশের ১৯০১ সালের ২৮ জুলাই কলকাতাতেই মণি সিংহের জন্ম মাত্র আড়াই বছর বয়সে তিনি পিতাকে হারান পিতাকে হারিয়ে তাঁর চারভাই, একবোন বিধবা মায়ের সংসার সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়ে অবস্থায় কলকাতা ছাড়তে বাধ্য হন তাঁরা কিছুদিন অবস্থান করেন ঢাকায় মামা ডেপুটি ম্যজিষ্ট্রেট সুরেন সিংহের বাড়িতে পরবর্তীকালে চলে যান নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুরে তাঁর বিধবা মা সুসং জমিদার বংশের মেয়ে সেই সূত্রে তাঁর পরিবার জমিদারদের কাছ থেকে বসতবাড়িসহ কিছু ভূসম্পত্তি, বার্ষিক খোরাকি শরিক হিসেবে মাসোহারা পান সুসং দুর্গাপুরেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হয় 

কৈশোরেই শৃঙ্খল মুক্তির মিছিলে : তাঁর রক্তের ভিতরে ছিল মুক্তির মন্ত্র ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রতি তীব্র ঘৃণা খুব অল্প বয়সেই টগবগ করে উঠেছে তাঁর রক্ত স্রোতে যার বহিঃ প্রকাশ ঘটে কৈশোরেই প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে মাধ্যমিক পড়ান জন্য চলে আসেন কলকাতায় ভারত মাতার মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে ১৯১৪ সালে যোগদেন কংগ্রেসের বিপ্লবী দলঅনুশীলনে দেশাত্ববোধের চরম উৎকর্ষতায় তাঁর বিপ্লবী কর্মকান্ড খুব অল্প সময়েইঅনুশীলনদলে নিজের অবস্থান তৈরী করতে সক্ষম  হন ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলন খেলাফত আন্দোলন তরুন মণি সিংহকে গভীরভাবে আকর্ষণ করে এই সকল গণজাগরণ তাকে ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করে আন্দোলনে সাধারণ জনগণকে আরো সম্পৃক্ত করার উদ্দেশ্যে তিনি তার গ্রাম সুসং দুর্গাপুরের আদিবাসী হাজং কৃষকদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন এই প্রেক্ষাপটে হাজং কৃষকদের সাথে সম্পৃক্ততা তাঁর রাজনৈতিক দুরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়

 

মার্ক্সলেনিনবাদে দীক্ষা গ্রহণ শ্রমিক আন্দোলন :

সুসং দুর্গাপুরে মণি সিংহ যখন হাজং কৃষকদের কংগ্রেসের আন্দোলনে সম্পৃক্ততার জন্য কাজ করছিলেন তখন এখানেই পরিচয় ঘটে রুশ বিপ্লবের প্রত্যক্ষদর্শী এবং এই আদর্শে উদ্বুদ্ধ বিপ্লবী গোপেন চক্রবর্তীর সাথে তাঁর সাথে দীর্ঘ যুক্তিতর্কের পর মণি সিংহ মার্কস লেনিনবাদের দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং ১৯২৮ সালে কমিউনিষ্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হন 

কলকাতায় ফিরে গিয়ে তিনি যুক্ত হন মেটিয়াবুরুজের শ্রমিক আন্দোলনে মেটিয়াবুরুজ একটি শ্রমিক এলাকা কলকাতা থেকে আটমাইল দক্ষিনপশ্চিমে সেখানে কেশোরাম কটন মিলে ১৩ দিন ব্যাপী শ্রমিক ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিয়ে দাবী আদায় করতে সক্ষম হন 

টংক তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব :

১৯৩০ সালে মাষ্টার দ্যা সূর্যসেনের চট্রগ্রামের অস্ত্রাগার লুন্ঠনের ফলে ব্রিটিশ সরকার ব্যাপকভাবে গ্রেপ্তার শুরু করে বিনা বিচারে আটক রাখা হয় অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা কর্মীকে বছরই মে কলকাতায় গ্রেপ্তার হন মণি সিংহ টানা পাঁচ বছর বিভিন্ন জেলে রাখা হয় ১৯৩৫ সালে সুসং দুর্গাপুরে নজরবন্দী রাখা হয় সুসংএ থাকা অবস্থায় তিনি টংক কৃষকদের (বেশিরভাগই হাজং কৃষক) শোষনের চিত্র প্রত্যক্ষ করেন পরবর্তীসময়ে পাট চাষ কমানোর সভায় বক্তব্যের অপরাধে আবার তাঁকে গ্রেফতার করা হয় ১৯৩৭ সালে মুক্তি লাভের পর তিনি সুসং দুর্গাপুরে আসেন তখন  টংকের হার চরম পর্যায়ে উঠে যায় অবস্থায় কৃষকরা আন্দোলনে মণি সিংহের নেতৃত্ব কামনা করলে তিনি কৃষকদের পাশে এসে দাঁড়ান সকল দ্বিধাদ্বন্দ কাটিয়ে টংকের নেতৃত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন ফলশ্রুতিতে জমিদার আত্মীদের বিরাগভাজন হন তবু তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অবিচল থেকে নিজের টংক কৃষকের খাজনা মওকুফ করে দেন ১৯৩৭ থেকে ১৯৪০ টংক  আন্দোলনের ১ম দফা, ১৯৪৬১৯৪৭ দেশ বিভাগের আগ পর্যন্ত টংক আন্দোলনের ২য় দফা এবং ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫০ টংক আন্দোলনের সশস্ত্র সংগ্রাম তাঁর নেতৃত্বে সফলভাবে পরিচালিত হয় যদিও টংক আন্দোলনের সশস্ত্র সংগ্রাম ছিল কমিউনিষ্টদের উগ্র রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ খুব শিগ্রই মণি সিংহ এই বিষয়টি বুঝতে পেরে সশস্ত্র সংগ্রাম প্রত্যাহার করে নেন হাজং কৃষকদের ঐতিহ্যবাহী সংগ্রামকে কাজে লাগিয়ে মণি সিংহের নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রাম পাকিস্তানী শাসকদের ভিত নাড়িয়ে দেয় পাহাড়ী অঞ্চলে টংক আন্দোলনের নেতেৃত্বের পাশাপাশি ১৯৪৬ সাল থেকে তিনি সফলতার সাথে নেত্রকোনায় তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদান করেন 

কমিউনিষ্ট পার্টিতে নেতৃত্ব :

 ১৯২৮ সাল থেকে পার্টির সর্বক্ষনের কর্মী ১৯৪২ সালে ময়মনসিংহ জেলা কমিটির সেক্রেটারি ১৯৪৩ সালে বোম্বে সম্মেলনে ময়মনসিংহ জেলা কমিটির প্রতিনিধিত্ব করেন ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিষ্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ ১৯৮০  সালে কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন

 

মুক্তিযোদ্ধে অবদান :

১৯৭১ সালে জেল থেকে মুক্তি লাভের পর যুক্ত হন মুক্তিযোদ্ধে মুক্তিযোদ্ধের সময় বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টমন্ডলীর সদস্য ছিলেন তিনি তাঁর প্রচেষ্টায় ন্যাপসিপিবিছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনী গড়ে উঠে যুদ্ধে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ঐক্যবদ্ধ আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য নিরলসভাবে কাজ করেছেন তিনি জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ন অবদানের জন্যে তিনি ২০০৪ সালে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন 

পরিবার:  মণি সিংহের স্ত্রী অনিমা সিংহ ছিলেন একজন সংগ্রামী কৃষক নেত্রী ১৯৮০ সালে তিনি সড়ক দূর্ঘটনায় প্রাণ হারান একমাত্র পূত্র দিবালোক সিংহ একজন চিকিৎসক রাজনৈতিক নেতা 

তাঁর আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ : জীবন সংগ্রাম, ঢাকা, ১৯৮৩ 

চিরঞ্জীব প্রাণ : ১৯৮৪ সালে গুরুতর অসুস্থ তিনি শয্যাশায়ী হন ১৯৯০ সালের ৩১ ডিসেম্বর সকাল ১০ টা ৫০ মিনিটে ৯০ বছর বয়সে সমাজতন্ত্রের স্বপ্নদ্রষ্টা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কমরেড মণি সিংহ বাংলাদেশর গণমানুষের নেতা মানব মুক্তির আলোর দিশারী, ত্যাগী  নেতা তার অবদানের জন্য চির অম্লান হয়ে থাকবেন তাঁর কর্মকান্ডের জন্য রাজনৈতিক পরিচয়ের উর্ধ্বে উঠে তিনি সমাজের, দেশের সকল মুক্তিকামী মানুষের নেতাতে পরিণত হয়েছিলেন তাই কবি শামসুর রহমানের সুরে বলতে হয়

‘…………প্রগতির/প্রসিদ্ধ চরন জেগে ওঠো চেয়ে দ্যাখো-/ করোনি শাসন কোনদিন তবু বাংলাদেশ আজ/ তোমাকেই গার্ড অব অনার জানায়

শিশির রাজনের 

[রক্তেভেজা গারো পাহাড় বই থেকে]

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত