[কয়েক দিন আগে উইকিপিডিয়ায় দেখলাম এক মার্কিন তরুণীর মন্তব্য। তিনি বলছেন—কমিউনিস্টদের আমি ঘৃণা করি। কিন্তু মাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসটি বার বার না পড়ে থাকতে পারি না।
তখন নিজেকেই প্রশ্ন করতে ইচ্ছা হয়েছিল—এমন কী আছে ‘মা’ উপন্যাসটিতে, যা এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় বিষয় এবং কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলো প্রতি ঘৃণা থাকা সত্ত্বেও একজন ভোগবাদী মার্কিন তরুণীকে বাধ্য করে উপন্যাসটি বার বার পাঠ করতে? সেই উত্তর খুঁজতে গিয়েই এই রচনা।]
কোনো কোনো জরিপে, পৃথিবীর সর্বাধিক পঠিত ও বিক্রীত উপন্যাসের নাম ‘মা’। পৃথিবীর সকল দেশে, সকল ভাষাভাষীর মধ্যে, সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘পাভেল’ নাম্নী যুবকের সন্ধান পাওয়া যাবে। অনেকেরই ধারণা নেই যে, এটি ‘মা’ উপন্যাসের অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র পাভেলের নামানুসারে রাখা হয়ে থাকে। ‘মা’ উপন্যাসের পৃথিবীব্যাপী বিস্তৃত প্রভাবের এটি একটি দিক। সারা পৃথিবীর কোটি কোটি শোষিত, বঞ্চিত মানুষের মুক্তির লড়াইতে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে ‘মা’ উপন্যাস। এখনো এই চিন্তাধারা বহমান। পাশাপাশি শৈল্পিক বিবেচনাতেও এই উপন্যাসকে পাঠ করতে হয় রুশ তথা সারা পৃথিবীর সাহিত্যপ্রেমীদের। সাহিত্যিক মতাদর্শ হিসেবে একসময় আবির্ভূত হয়েছিল ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাবাদ’। সেই মতাদর্শের পরিপূর্ণ ধারক সাহিত্যিক-মডেল হিসেবে বিবেচনা করা হয় ১৯০৬-০৭ সালে রচিত এই উপন্যাসটিকে।
উপন্যাসের আলোচনায় প্রবেশের আগে লেখক মাক্সিম গোর্কি প্রসঙ্গে কিছুটা আলোকপাত করা প্রয়োজন।
মাক্সিম গোর্কির জন্ম মধ্যরাশিয়ার ভোলগা নদীতীরবর্তী নিজনি নোভ্গরদ শহরে। ১৮৬৮ সালের ১৬ মার্চ। তারিখটি বর্তমান ক্যালেন্ডারের হিসাবে দাঁড়াবে ১৬ মার্চ। (সেকালে রুশ দেশে ব্যবহৃত জুলিয়ান পঞ্জিকা বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকা থেকে ১২ দিন পিছিয়ে ছিল)। তাঁর নাম রাখা হয়েছিল আলেক্সিয়েই মাক্সিমোভিচ পেশকভ। মাক্সিম গোর্কি তাঁর নিজের গ্রহণ করা ছদ্মনাম। লেখক জীবনের শুরু থেকেই তিনি এই নাম ব্যবহার করেছেন। ফলে বিশ্ববাসী তাঁকে এই নামেই চেনে। পিতা মাক্সিম সাভ্ভাতেভিচ পেশকভ ছিলেন আস্ত্রাখান শহরের স্টিমশিপ কারখানার ছুতারমিস্ত্রি। মা ভারভারা ভাসিলিয়েভনা পেশকভা। লেখকের চার বছর বয়সের সময় কলেরায় আক্রান্ত হয়ে পিতার মৃত্যু ঘটে। সহায়সম্বলহীন মা তাঁদের দুই ভাইকে সঙ্গে নিয়ে নিজ পিত্রালয়ে চলে আসতে বাধ্য হন। পথের মধ্যে স্টিমারে মৃত্যু ঘটে ছোট ভাইটির। একমাত্র জীবিত সন্তান গোর্কিকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর মা আশ্রয় নেন পিতা-ভ্রাতাদের কাছে। গোর্কির কৈশোরের একটি পর্যায় কেটেছে নানাবাড়িতে। অন্ধকারময় একটি কৈশোর। এখানে কিশোরের জন্য একমাত্র মানসিক আশ্রয় ও শান্তির জায়গা ছিলেন তার দিদিমা। কুরুশ-কাঁটায় সুতার কাজে খুবই দক্ষ ছিলেন দিদিমা। সেইসঙ্গে রুশ লোককথা, লোককাহিনী, রূপকথা আর লোকসংগীতের এক অফুরন্ত স্মৃতিভাণ্ডার ছিলেন তিনি। কুরুশ বুনতে বুনতেই তিনি কিশোর নাতিকে শোনাতেন সেইসব লোকজ গল্পগাথা-সংগীত। দিদিমার মুখে শোনা ছড়া, লোককথা, রূপকথা, লোককাহিনীর কারণেই সম্ভবত গোর্কির সাহিত্যের এক বিরাট অংশ জুড়ে রূপকথা ও লৌকিক উপাদানের এত প্রাচুর্য।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন গোর্কি। কিন্তু স্কুলে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। প্রথম কারণ, তাঁর নানা কোনো খরচ দিতে রাজি হননি। দ্বিতীয় কারণ, নানার বাড়িতে পড়াশোনার কোনো পরিবেশই ছিল না বা পড়াশোনার প্রয়োজনীয়তার কথা কেউ ভাবত না। আর তৃতীয় কারণ হচ্ছে, মামারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ নিয়ে এমন নারকীয় পরিবেশ তৈরি করে রেখেছিলেন যে কিশোর গোর্কির পক্ষে বাড়িতে তিষ্টানো ছিল খুব কঠিন। ফলে তিনি বখাটেদের সঙ্গে মিশে ঘুরে বেড়ানোর পথটাকেই বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু স্কুলের বাঁধন ছিন্ন হলেও কোনো এক অজ্ঞেয় কারণে বইয়ের প্রতি তাঁর আসক্তি তৈরি হয় এবং তিনি নিজে নিজেই লেখাপড়া করতে থাকেন। সম্পূর্ণই স্বশিক্ষিত এক মানুষ বলা যায় গোর্কিকে। আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথ বা কাজী নজরুলকে যে অর্থে স্বশিক্ষিত বলা হয়ে থাকে, গোর্কির ক্ষেত্রে সেই অর্থটি খাটে না। তিনি কোনোদিন কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী বা বিদ্যোৎসাহীর কাছ থেকে কোনো অনুপ্রেরণা পাননি। তৎকালীন রাশিয়ার যে ধরনের নিম্নবিত্ত শিক্ষাবিমুখ পরিবারে গোর্কির বেড়ে ওঠা, সেই পরিবেশের বৈশিষ্ট্য ছিল চরম উচ্ছৃঙ্খলা, দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার, নিগ্রহ, অনাচার, মাতলামি, নিষ্ঠুরতা। এককথায় বলা চলে, তাঁর হওয়ার কথা ছিল আকাট মূর্খ, নীতিজ্ঞানহীন, মদ্যপ, গুণ্ডা কিসিমের কোনো যুবক। কিন্তু তার পরিবর্তে তিনি হয়ে উঠলেন প্রাতঃস্মরণীয় একজন লেখক।
এক্ষেত্রে তাঁর একমাত্র পাথেয় ছিল অপরিসীম জ্ঞানতৃষ্ণা। বেঁচে থাকার জন্য সেই কিশোর বয়স থেকে কোন কাজটি করেননি তিনি! কাজ করেছেন মুচির দোকানে, রুটির দোকানে ও কারখানায়, বিস্কুট ফ্যাক্টরিতে, চাকরি করেছেন মুদি দোকানের বাঁধা মজুর হিসেবে, মানুষের বাগানে কাজ করেছেন মালি হিসেবে, স্টিমারের হেঁসেলে করেছেন বয়-বেয়ারাগিরি, জেলেদের মাছের আড়তে পাহারাদার, তাদের নৌকায় গুনটানার কাজ, রেলস্টেশনে দারোয়ানগিরি। অনেক পরে, যখন তিনি লেখক হিসেবে খ্যাতির তুঙ্গে, সেই সময় আন্তন চেখভকে এক চিঠিতে গোর্কি লিখেছিলেন—‘দশ বছর বয়স থেকে আমাকে নিজের রাস্তা বেছে নিয়ে চলতে হয়েছে। লেখাপড়া যে শিখব, তার জন্য কোনো পয়সাকড়ি ছিল না। আমি কেবল জীবন আর কাজ গলাধঃকরণ করেছি। এর বাইরে আর কিছুই করতে পারিনি, আর জীবন তার কিল-চড়-ঘুষি মেরে আমাকে তাতিয়ে রেখেছে।’ এমন অমানুষিক পরিশ্রম এবং অমানবিক জীবনযাপনের মধ্যেও নিজেকে ভেঙে পড়তে দেননি তিনি। এসবের মধ্যেই চালিয়ে গেছেন পড়ার কাজ। তাঁর প্রতিদিনের কাজের সময় ছিল অনেক দীর্ঘ। যেমন স্টিমারের রান্নাঘরে তাঁকে কাজ করতে হতো সকাল ছয়টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। কিন্তু এখানেও তাঁর বই পড়ার বিরাম ঘটেনি। সৌভাগ্যক্রমে সেই স্টিমারের বাবুর্চি নিজেও ছিল গ্রন্থপ্রেমী। গোর্কির কাজ ছিল তাকে বই পড়ে শোনানো। অবশ্য বই পড়াতে তাঁর কোনো বাছবিচার ছিল না। বেশিরভাগই ছিল বটতলার গ্রন্থ। কিন্তু তাতেও গোর্কির কোনো অনীহা ছিল না। বই পড়তে পেলেই হলো।
কাজের সূত্রেই তিনি কাজান শহরে এলেন ১৮৮৪ সালের শেষদিকে। এই শহরেই তিনি জীবনে প্রথম এমন কিছু মানুষের সঙ্গ লাভ করেন, যাঁরা তাঁর লেখাপড়ার জন্য কিছুটা আনুকূল্য দান করেছিলেন। কাজান শহরে তিনি চার বছর অবস্থান করেছিলেন। এই সময়টাতেই তিনি পাঠ করার সুযোগ পান রুশ ধ্রুপদী লেখকদের রচনা। পড়েছিলেন সৃজনশীল সাহিত্য, সাহিত্যালোচনা, দর্শন, চিন্তাবিদদের বিতর্ক ইত্যাদি। এই সময়েই তিনি মার্কস ও অ্যাঙ্গেলস-এর রচনার সঙ্গে পরিচিত হন। মার্ক্স-অ্যাঙ্গেলস-এর পৃথিবী বদলে দেওয়া যৌথ ইশতেহার ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’ পাঠ করার সুযোগও প্রথম পেয়েছিলেন এ সময়েই।
১৮৮৮ থেকে ১৮৯২ সাল পর্যন্ত মাক্সিম গোর্কি ঘুরে বেড়ান রাশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। শৌখিন ভ্রমণ নয়। পায়ে হেঁটে ঘোরা। কাজ করেছেন আর ঘুরে বেড়িয়েছেন। এই ভ্রমণের ফলে ভলগা ও দন নদীর অববাহিকাজুড়ে বিশাল এলাকার মানুষজন, সমাজ, আর্থসামাজিক অবস্থা, আচরণ ও অভ্যাস সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। সবই পরে কাজে লেগেছিল সাহিত্যসৃষ্টিতে। অনেক বছর পরে সমসাময়িক কথাসাহিত্যিক লিওনিদ লিওনভকে তিনি একটি চিঠিতে লিখেছিলেন— ‘আমি দেখতে ভালোবাসি মানুষের বেড়ে ওঠা।’ সেই মানুষের বেড়ে ওঠা দেখার সবচেয়ে ভালো সময় ছিল এই ভ্রমণকাল।
১৮৯২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর শনিবার জর্জিয়ার রাজধানী তিবলিসের দৈনিক কাফ্কাজ (ককেশাস) পত্রিকায় ছাপা হলো ‘মাকার চুদ্রা’ নামে একটি গল্প। লেখকের নাম মাক্সিম গোর্কি। এই দিনটিকে গোর্কি তাঁর সাহিত্যযাত্রার সূচনাবিন্দুরূপে গণ্য করতেন। আলেক্সিয়েই মাক্সিমোভিচ পেশকভকে বিদায় দিয়ে এই দিনেই আবির্ভূত হলেন মাক্সিম গোর্কি। গোর্কি শব্দের অর্থ ‘তিক্ত’ বা ‘কটূস্বাদ’। এই নাম গ্রহণের পেছনে নিশ্চয়ই নিজের বঞ্চিত ও দুঃখী জীবন কাজ করেছিল। পত্রিকার দপ্তরে বসেই তিনি উদ্ভাবন করেছিলেন নিজের ছদ্মনাম। আর প্রথম লেখার অনুপ্রেরণাদানকারী হিসেবে তিনি জর্জিয়ার একজন গৃহবন্দি বিপ্লবীর নাম উল্লেখ করেছিলেন। তিনি ছিলেন আলেকজান্ডার কালিউজনি। গোর্কির জীবনের বর্ণিল ও কষ্টকর জীবনের গল্প শুনতে শুনতে এই বিপ্লবীই তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন সেই সব অভিজ্ঞতা লিখে ফেলতে।
তারপর প্রকাশিত হতে থাকে একের পর এক লেখা। ১৮৯৫ সালে লিখলেন ‘শিকারী পাখির গান’। এই কাব্যিক গদ্য রচনাটি তাঁকে প্রায় রাতারাতি বিখ্যাত করে তোলে। বহু পূর্বে আলেকজান্ডার পুশকিনের লেখার ক্ষেত্রে যেটি ঘটত, গোর্কির এই রচনাটির ভাগ্যেও সেই অসাধারণ ঘটনাটি ঘটেছিল—হাতে কপি করে লোকেরা নিজেদের মধ্যে বিলি করেছে ‘শিকারী পাখির গান’। একই ঘটনা ঘটেছে ১৯০১ সালে লেখা ‘ঝড়ের পাখির গান’ রচনাটির ক্ষেত্রেও। এর মধ্যে ১৮৯৬ সালে রচিত ও প্রকাশিত ‘চেলকাশ’ গল্পটি ছিল রুশসাহিত্য তথা বিশ্বসাহিত্যে এক অসাধারণ সংযোজন।
১৮৯৯ সালে রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গে প্রথম আবির্ভাব ঘটে গোর্কির। রাজধানীবাসী লেখকদের সঙ্গেও তাঁর প্রথম পরিচয়ের সুযোগ ঘটে সেখানেই। রাজধানীর নগর পরিষদের হলঘরে অনুষ্ঠিত সাহিত্য ও সংগীতসন্ধ্যায় তিনি পাঠ করেন ‘শিকারী পাখির গান’। বিপুলভাবে অভিনন্দিত হলেন সেদিন।
১৮৯৮ সালে প্রকাশিত হলো প্রথম পুস্তক। দুই খণ্ডের গল্প সংকলন ‘রেখাচিত্র ও গল্পাবলি’। প্রতিখণ্ডে ১০টি করে গল্প। তাঁর লেখা নাটক ‘পেটি বুর্জোয়া’ প্রথম অভিনীত হয় রাজধানী শহরের থিয়েটার সেন্টারে ১৯০২ সালের ১৯ মে তারিখে। নাট্যজগতের কিংবদন্তি স্তানিস্লাভস্কি স্বয়ং অংশ নিয়েছিলেন অভিনয়ে। ব্যাপক সাড়া তুলেছিল এই নাটক। নাটকের সহকারী পরিচালক দানচিয়েন্ক এবং স্তানিস্লাভস্কি এ প্রসঙ্গে বলেছেন—‘আমরা নাট্যামোদী শৌখিন নাগরিকদের অকল্পনীয় দ্রুততায় অবহিত করেছিলাম। এবং দূতাবাস ও সরকারি উচ্চপদস্থ আমলাদের পরিবার থেকে সব রকমের আসন সংরক্ষণের জন্য যে-পরিমাণ অনুরোধ পেয়েছিলাম, তাতে আমরা হতবাক। নাটকটি দেখতে বিশিষ্ট, নামীদামি ব্যক্তি ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী যে ধরনের দর্শক আমরা পেয়েছিলাম, তা ইউরোপের কোনো সম্মেলনে ঘটে ওঠাই স্বাভাবিক ছিল।’
প্রথম লেখা প্রকাশের ১০ বছরের মধ্যেই মাক্সিম গোর্কি রাশিয়ার সাহিত্যজগতে সুপ্রতিষ্ঠিত হন। লেভ তলস্তয় ও আন্তন চেখভের মতোই তাঁর খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা হয়ে দাঁড়ায় আকাশছোঁয়া। এমনকি গোর্কি তখন যে পোশাক পরতেন, সেই পোশাকটিও সমাজের অনেক স্তরের স্টাইলিস্ট মানুষের কাছে অনুকরণীয় হয়ে ওঠে। তিনি পরতেন নীল রঙের গলাবন্ধ কোর্তা, বোতাম-আঁটা হাতা, চাষাভূষাদের কানাততোলা বুটজুতা। সেই পোশাক হয়ে ওঠে ব্যক্তিত্বের প্রতীক। অথচ তখনো তিনি ‘মা’ উপন্যাস রচনা করেননি।
১৯০৬ সালে জার সরকারের গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কারণে তিনি প্রথমে রাশিয়া ছেড়ে ফিনল্যান্ডে চলে যান। পরে সুইজারল্যান্ড হয়ে আমেরিকায়। সেখানেই রচিত হয় অবিস্মরণীয় ‘মা’ উপন্যাসটি।
বস্তুত রুশ সাহিত্য পৃথিবীকে উপহার দিয়েছে প্রতিভার মিছিল। তারপরও রাশিয়ার সাহিত্যজগতে মাক্সিম গোর্কির স্থান অনেক উঁচুতে। সাধারণ মানুষ যেমন তাঁর রচনা পাঠ করেছে গভীর সহমর্মিতার সঙ্গে, তেমনই বিদগ্ধ সমালোচকরাও তাঁকে স্থান দিয়েছেন অনেক উঁচুতে। রুশসাহিত্যের প্রথম লেখক হিসেবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ইভান বুনিন। সেই বুনিনের চাইতে সমকালীন গোর্কিকে অনেক ওপরের স্তরের লেখক বলে দাবি করতেন রুশবাসী। এই প্রসঙ্গে নন্দনতাত্ত্বিক মারিয়া তস্ভেতায়েভা তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন—‘নোবেল পুরস্কার। ২৬ তারিখে অনুষ্ঠান। উপস্থিত থাকব বুনিনের সম্মানে। প্রতিবাদের দায় এড়িয়ে যেতে হচ্ছে। প্রতিবাদ আমি করছি না। আমি শুধু বলতে চাই যে আমি একমত নই। কেননা বুনিনের চাইতে নিঃসন্দেহে বড় তো বটেই—অনেক বড়, অনেক মানবিক, অনেক বেশি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয়ও বটে—গোর্কি। গোর্কি একটি যুগ, বুনিন একটি যুগের অবসান। কিন্তু যেহেতু এটা রাজনীতি, যেহেতু সুইডেনের রাজা কমিউনিস্ট গোর্কির গলায় পদক ঝোলাতে পারেন না, অগত্যা…’
নোবেল পুরস্কার পাননি মাক্সিম গোর্কি। তার চাইতে বড় পুরস্কার পেয়েছেন। সে পুরস্কার হচ্ছে বিশ্ব মানবতার মুক্তিযাত্রার সহযোদ্ধার স্বীকৃতি।
‘মা’ উপন্যাসের পটভূমি : মাক্সিম গোর্কির রাজনৈতিক জীবন
দুনিয়া কাঁপানো অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পূর্বেকার উত্তাল রাশিয়ার জনজীবন হচ্ছে এই উপন্যাসের পটভূমি। জার সরকারের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সকল স্তরের মানুষের বিক্ষুব্ধ আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন মাক্সিম গোর্কির মতো সমাজসচেতন লেখক-বুদ্ধিজীবীরাও। এই আন্দোলনের পটভূমিতেই গোর্কি সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর অন্যতম মহৎ উপন্যাস ‘মা’।
জারশাসিত রাশিয়ায় সাধারণ মানুষের কোনো অধিকারই ছিল না। ১৮৬১ সালে আইনগতভাবে ভূমিদাস প্রথার বিলুপ্তি ঘটলেও তা কৃষককে জমিদারের নাগপাশ থেকে প্রকৃত মুক্তিদান করতে পারেনি। জমিদারের কাছ থেকে ‘নিষ্কৃতি’র জন্য কৃষককে গুনতে হতো চড়া মূল্য। অনেক কৃষকেরই সামর্থ্য ছিল না নিজের ও জমির ‘নিষ্কৃতিমূল্য’ প্রদানের। ফলে তারা রয়ে গেল জমিদারের আজ্ঞাবহ। তাদের বেগার দিতে হতো জমিদারের হুকুমমাফিক। খাজনা নির্ধারিত হতো জমিদারের ইচ্ছামতোই। দিনের পর দিন এই রকম শোষণের ফলে গ্রাম উজাড় হয়ে শহরে-বন্দরে ভিড় বাড়তে থাকে মানুষের। সেখানেও দুঃসহ বেকারত্ব। বেঁচে থাকার জন্য মানুষে মানুষে হানাহানি। এই সময়ে রাশিয়া যুদ্ধে লিপ্ত হলো জাপানের সঙ্গে। যুদ্ধে পরাজয় তার অর্থনৈতিক অবস্থায় পুরোপুরি বিপর্যয় এনে দিয়েছিল। সেইসঙ্গে বেড়ে চলল মানুষের ভোগান্তি।
এ পরিস্থিতিতে শুরু হয় ১৯০৫ সালের ব্যাপক গণঅভ্যুত্থান। তার আগেই বাকুর তেলশ্রমিকরা ধর্মঘটে নামে। রাজধানীর সবচেয়ে বড় কারখানা পুতিলভ ওয়ার্কস-এ ধর্মঘট শুরু হয় জানুয়ারি মাসে। কারখানার ধর্মঘট অচিরেই সারা শহরে সাধারণ ধর্মঘটে পরিণত হয়। ৯ জানুয়ারি ফাদার পিগন নামক একজন পাদ্রির নেতৃত্বে দেড় লক্ষ শ্রমিকের একটি বিশাল সমাবেশ জারের কাছে আবেদনপত্র নিয়ে শীত প্রাসাদের অভিমুখে শোভাযাত্রা নিয়ে এগোতে থাকে। এটি ছিল সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রা। শ্রমিকদের হাতে ছিল জারের ছবি ও গির্জার পতাকা। শোভাযাত্রাকারীরা গাইছিলেন ধর্মীয় সংগীত। সেই মিছিলে গুলিবর্ষণের নির্দেশ এলো জারের প্রাসাদ থেকে। নিহত হলো এক হাজারেরও বেশি শ্রমিক। সেদিন ছিল রোববার। এই দিনটি এখনো রাশিয়ার ইতিহাসে ‘রক্তাক্ত রোববার’ নামে পরিচিত। এই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে সারা রাশিয়া উত্তাল হয়ে ওঠে। সব বড় শহর এবং শিল্পকেন্দ্রে ধর্মঘট শুরু হয়ে যায়। লডজ শহরের শ্রমিকরা রাস্তায় ব্যারিকেড বানিয়ে তিন দিন ধরে জারের সৈন্যদের বিপক্ষে সশস্ত্র লড়াই চালিয়ে যায়। ইভানোভা-ভয়নেসেন্সক শিল্পকেন্দ্রে ধর্মঘট চলে একনাগাড়ে আড়াই মাস ধরে।
এই উত্তাল জনবিদ্রোহের ঝাপটা এসে পড়ে গ্রামাঞ্চলেও। কৃষকরা আক্রমণ করে জমিদারদের বাড়ি, প্রাসাদ ও খামার। তারা জমিদারের প্রাসাদ পুড়িয়ে দিতে থাকে, গোলা দখল করে ক্ষুধার্ত কৃষকের মধ্যে শস্য বিলিয়ে দিতে থাকে, জমিদারের জমি দখল করে, বনের গাছ কাটতে থাকে। তবে কোনো জমিদারকে হত্যা করেনি কৃষকরা। সরাতফ প্রদেশের প্রায় সকল কৃষক অংশ নিয়েছিল এই আন্দোলনে। সারা রাশিয়ায় কৃষকদের ক্ষোভের আগুনে ভস্মীভূত হয়েছিল প্রায় দুই হাজার জমিদারবাড়ি। তার মধ্যে সরাতফ প্রদেশেই সংখ্যা ছিল ২৭২টি।
জুন মাসে বিদ্রোহ দেখা দেয় নৌবাহিনীর মধ্যে। কৃষ্ণসাগরে অবস্থানরত যুদ্ধজাহাজ ‘পোটেমকিন’-এর নাবিকরা প্রথম বিদ্রোহের সূচনা করেন। এই বিদ্রোহ নিয়ে পরে ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ নামের অবিস্মরণীয় চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন আইজেনস্টাইন।
শেষ পর্যন্ত কঠোর হাতে বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হয় জারের অনুগত বাহিনী। মূলত নেতৃত্বের অভাব, মস্কোর বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যে সমন্বয়হীনতা পরাজয় ডেকে আনে বিদ্রোহীদের। তারপর শুরু হয় প্রচণ্ড দমননীতি। গ্রামে গ্রামে সামরিক আদালত বসিয়ে ফাঁসিতে ঝোলানো শুরু হয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্তালিপিন-এর নেতৃত্বে। এক বছরের মধ্যেই শুধু একটি প্রদেশে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল ৬৮৩ জন কৃষককে। শহরে এই সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। সেনাছাউনিতে ফায়ারিং স্কোয়াড এবং ফাঁসির সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। সেই সময় ফাঁসির আরেক নাম হয়ে যায় ‘স্তালিপিন টাই’। পুলিশ, সেনাবাহিনী, গুপ্তপুলিশের পাশাপাশি সরকারি ব্যবস্থাপনায় সংগঠিত করা হয় পেশাদার গুণ্ডাবাহিনী।
এই পটভূমিতেই লেখা হয় উপন্যাস—‘মা’।
মাক্সিম গোর্কি নিজেও জড়িত ছিলেন এই বিদ্রোহের সঙ্গে। তারুণ্যের শুরুতেই তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন বিপ্লবী গ্রুপের সঙ্গে। তাই জারের পুলিশ এবং সরকারি গোয়েন্দাদের খাতায় তাঁর নাম সবসময়ই বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত হয়ে থাকত। ১৮৮৯ সালে পুলিশের খাতায় প্রথম নাম ওঠে তাঁর। এই সময় ‘আত্মবিকাশ’ নামক একটি বেআইনি গোষ্ঠীর সংস্পর্শে আসেন তিনি। ১৯০১ সালে ‘ঝড়ের পাখির গান’ রচনাটি পাঠকদের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি সেন্সর এবং গোয়েন্দাদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি গোয়েন্দাদের কাছেও ঝড়ের পাখি নামেই অভিহিত হতে থাকেন। ১৯০১ সালেই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। কিন্তু জেলখানায় স্বাস্থ্যের নিদারুণ অবনতি হওয়ায়, উপযুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে এবং সর্বোপরি, দেশ-বিদেশের লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের চাপে সরকার তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু বিপ্লবী কার্যকলাপ থেকে একমুহূর্তের জন্যও দূরে থাকেননি গোর্কি। তাঁর রচনায় বিপ্লবের সুর ছিল সবসময়ই অত্যন্ত চড়া। সেইসঙ্গে ছিল বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সরাসরি সম্পৃক্তি। তখন রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির নাম ছিল বলশেভিক পার্টি। সেই পার্টির মুখপত্র প্রকাশে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন গোর্কি। তাঁর উদ্যোগে মস্কো থেকে ‘নবজীবন’ এবং পিটার্সবার্গ থেকে ‘সংগ্রাম’ পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে।
‘রক্তাক্ত রোববারে’র দুই দিন পরেই রিগা শহরে তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। বন্দি রাখা হয় পিটার্সবার্গের কুখ্যাত পিটার পল কারাদুর্গে। ইতোমধ্যে তাঁর ঘরে চলেছে একাধিকবার খানাতল্লাশি, বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সম্পাদিত পত্রিকা ‘সংগ্রাম’। তাঁর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ আসতে থাকে দেশ-বিদেশ থেকে। ফ্রান্সের মহান লেখক আনাতোল ফ্রাঁস গোর্কিকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানিয়ে কড়া বিবৃতি প্রদান করেন। তিনি লিখেছিলেন—‘গোর্কির মতো প্রতিভা সাড়া পৃথিবীর সম্পদ। সারা বিশ্ব তাঁর মুক্তি দাবি করে। জার সরকার বাধ্য হয় ১৪ ফেব্রুয়ারি তাঁকে জামিনে মুক্তি দিতে। জামিনে মুক্তির পরে বিভিন্ন দেশ ঘুরে আমেরিকাতে চলে যান গোর্কি। সেখানে বিভিন্ন শহরে, বিশেষত, নিউইয়র্কে অসংখ্য সভা-সমিতিতে তিনি রাশিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে বক্তৃতা করেন, মার্কিন বুদ্ধিজীবী এবং জনগণকে রাশিয়ার মুক্তি আন্দোলনে সংহতি প্রকাশের আহ্বান জানান। সেই সময়, অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে তিনি পুঁজিবাদবিরোধী বেশকিছু স্কেচ ও পুস্তক প্রণয়ন করেন। সেগুলির মধ্যে দুটি গ্রন্থ বিশ্ববাসীর কাছে অক্ষয় সম্পদরূপে বিবেচিত হয়ে থাকে। একটি হচ্ছে নাটক—‘দুশমন’। অপরটি আমাদের আলোচ্য মহৎ উপন্যাস—‘মা’।
উপন্যাসের কথাবস্তু
মাক্সিম গোর্কি তাঁর স্মৃতিচারণে লিখেছিলেন—‘বীর—এই কথাটি মিথ্যে ও বানোয়াট; যা আছে তা হলো সাধারণ মানুষজন। মানুষ। এর বাইরে কিছু নেই।’
প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, সমাজ বা পৃথিবীর যত পরিবর্তন সাধিত হয়, তার নেতৃত্ব দান করেন অগ্রসর চিন্তা ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী কিছু মানুষ। এরাই ইতিহাসের বীর। ইতিহাসে এই মানুষগুলোই বীর বা নায়ক হিসেবে পূজিত হয়ে থাকেন। গোর্কি এই ধারণার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন যে বীর বলে আলাদা কিছু নেই। সাধারণ মানুষই ইতিহাস নির্মাণ করে এবং সাধারণ মানুষরাই ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তন করে। বিশেষ পরিস্থিতি এবং প্রয়োজনের কারণে মানবসমাজে যে রূপান্তর সাধিত হয়, সেই রূপান্তরের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষই পরিবর্তিত হয়ে যায় অসাধারণ মানুষে। যেমন, ‘মা’ উপন্যাসের মা ও তার ছেলে পাভেল। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মা-কে বিপ্লবী মা হয়ে ওঠার জন্য আলাদা কোনো পরিপ্রেক্ষিত নির্মাণের প্রয়োজন হয়নি। সাধারণ একজন মা-ই হয়ে উঠেছিলেন অসাধারণ।
উপন্যাসে মা-এর একটি নাম আছে। পেলাগেয়া নিলভ্না। কিন্তু সেই নামটি উচ্চারিত হয়েছে পুরো উপন্যাসে মাত্র দুবার। বাকি সময় তিনি শুধু ‘মা’। নিতান্তই সাধারণ একজন গৃহিণী ছিলেন তিনি। স্বামী বেঁচে থাকতে সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতেন। কারণ তার সঙ্গে কোনোদিনই মানবিক ব্যবহার করেনি স্বামী। ইচ্ছামতো মারধর করেছে, গালমন্দ করেছে। সেই জীবনকেই স্বাভাবিক জীবন হিসেবে ধরে নিয়ে তিনিও তদানীন্তন কোটি কোটি রুশ রমণীর মতো নিজের জীবনকে কাটিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে অন্য রকম হয়ে উঠতে হলো। হলো ছেলে পাভেলের কারণে, আসন্ন রুশ বিপ্লবের অগ্নিগর্ভ সময়ের কারণে। সাধারণ একজন মা থেকে বিশ্ববিপ্লবের মা হয়ে ওঠার যে বিবর্তন-চিহ্ন, সেই বিবর্তনই আসলে এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু।
কেমন ছিলেন মা? কেমন ছিল মায়ের চেহারা? কোন ধারণাটি ফুটে উঠত মায়ের মুখের দিকে একবার মনোযোগের সঙ্গে তাকালে? ছেলে পাভেল যেদিন প্রথম পরিপূর্ণভাবে মায়ের দিকে দৃষ্টি দিয়েছিল, সেই বর্ণনাতেই পুরোপুরি ধরা পড়ে মায়ের অবয়ব এবং সকল বৈশিষ্ট্যই। পাভেলের মনে পড়ল ‘বাবা বেঁচে থাকতে সারা বাড়ির মধ্যে মাকে যেন কোথাও দেখাই যেত না। মুখে একটিও কথা ছিল না, স্বামীর মারের ভয়ে সর্বক্ষণ যেন কাঁটা হয়ে থাকত।’ মায়ের দিকে পরিপূর্ণ মমতার সঙ্গে তাকিয়ে পাভেলের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠেছিল। কারণ সে মায়ের মধ্যে দেখতে পেয়েছিল একটা করুণ অসহায় প্রতিমূর্তি। ‘লম্বা দেহটা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে খানিকটা; হাড়ভাঙা খাটুনি আর স্বামীর ঠ্যাঙানিতে শরীরটা গেছে ভেঙে। একেবারে নিঃশব্দে চলাফেরা নড়াচড়া করে একপাশে একটু কাত হয়ে, যেন সর্বদাই কিসের সঙ্গে ধাক্কা খাবে এমন একটা ভয়। চওড়া লম্বাটে ফোলা ফোলা কোঁচকানো মুখ। তাতে জ্বলজ্বল করছে একজোড়া ঘন ভীরু আর্ত চোখ, বস্তির আর দশটা মেয়ের মতোই। ডান ভুরুর ওপর দিকে একটা গভীর কাটা দাগ থাকায় ভুরুটা একটু ওপর দিকে টানা। মনে হয় ডান কানটাও বাঁ কান থেকে কিছু ওপরে। এর ফলে সর্বদাই যেন উদ্বেগের সঙ্গে কানখাড়া করে আছে এমনই একটা ভাব মুখে।’
সেই মা-এর বদল শুরু হয়। ছেলে পাভেলের বদলের সঙ্গে সঙ্গে। কারখানা বস্তির অন্য সব তরুণের মতো শুরুর দিকে পাভেলও একই রকম জীবনযাপনে অগ্রসর হয়। এমনকি রোববার রাতে ভদকা খেয়ে মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরাও বাদ যায় না। কিন্তু যেকোনোভাবেই হোক, বিপ্লবী গোপন রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগের ফলে আমূল বদলে যায় পাভেলের জীবনযাপন। পরিবর্তিত হয়ে যায় তার মুখের ভাষাও। কারখানা বস্তিতে নিজেদের মাকে সম্মান দিয়ে কথা বলে না কোনো যুবক। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়ে ওঠে পাভেল। মায়ের সঙ্গে কথা বলে বিনম্র ভাষায়। এমনকি বস্তির কেউ যা কল্পনাও করতে পারে না, সেই ঘটনাও ঘটে এই ঘরে। ছেলে কারখানার কাজ সেরে এসে ঘরের কাজে মাকে সাহায্যের জন্য হাত লাগায়। নিজেই ঘর ঝাঁট দেয়, নিজের বিছানা নিজেই গুছিয়ে রাখে। আর কাজের পরে বাইরে না বেরিয়ে ঘরে বসে বসে বই পড়ে। মা সব পরিবর্তনই খেয়াল করে। খেয়াল করে যে ‘ছেলের মুখখানা দিনে দিনে ধারালো হয়ে উঠছে, চোখ দুটির গাম্ভীর্য বাড়ছে, আর ঠোঁট দুটি যেন একটি কঠিন রেখায় আশ্চর্য সংবদ্ধ।’
ছেলে যে অন্যদের চেয়ে অন্যরকম, তা নিয়ে মায়ের খুশি এবং কৃতজ্ঞতার সীমা-পরিসীমা নেই। কিন্তু ছেলে যে অন্যরকম কিছু কাজকর্মের সঙ্গে জড়িত, এটা জানার পরে মা ভয় পেয়ে যায়। সেই ভয় চরমে ওঠে যখন জানতে পারে যে ছেলে যেসব বই পড়ে সেগুলো নিষিদ্ধ বই, যাদের সঙ্গে ওঠাবসা করে তারা সবাই পুলিশের চোখে সন্দেহভাজন ও বিপজ্জনক, যে গোপন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত সেই সংগঠনকে উচ্ছেদ করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে রেখেছে জারের পুলিশবাহিনী। সব মা-ই এই সময় যা করে, ছেলেকে এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা, এই উপন্যাসের মা সেই কাজটি করেননি। কারণ, মনে হয়েছিল, মনে হওয়ার পেছনে যথেষ্ট বাস্তব কারণও ছিল, যে—তার ছেলে কোনো খারাপ কাজ করতে পারে না।
ছেলের কাজ দেখতে দেখতে একসময় মা নিজের অজান্তেই ছেলের কাজের সহযোগী হয়ে দাঁড়ায়। তার সম্পৃক্তির সূত্রপাতও ঘটে খুব সাধারণভাবে। তাদের বাড়িতে একদিন বৈঠকে বসে পাভেল ও তার সহযোদ্ধারা। সেই প্রথম মা দেখা ও চেনার সুযোগ পায় পাভেলের সহযোগীদের। আন্দ্রেই ও নাতাশা বাইরের শহর থেকে আসে। আর অন্যরা মায়ের আগে থেকেই চেনা। দাগি চোর দানিলার ছেলে নিকলাই, কারখানার পুরোনো কর্মী সিজভ-এর ভাইপো ফিওদর এবং কারখানার আরো দুজন পরিচিত শ্রমিক। তারপরে একের পর এক বৈঠক হতে থাকে তাদের ঘরে। আসতে থাকে সাশা, ইয়াকফ সোমভ, মাজিন, ইভান বুকিন, রীবিন, আরো অনেকে। তাদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে মা। চেষ্টা করে তাদের আলোচনার বিষয়বস্তুগুলো ভালোভাবে অনুধাবন করতে। তারপর স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে এরা খারাপ কোনো কিছু করছে না। এদের আলোচনা থেকে সাধারণ মানুষের যে অবস্থার কথা বেরিয়ে আসে, নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই সেগুলোকে সত্যি বলে বুঝতে পারে মা। এটাও বুঝতে পারে যে এই অবস্থা পাল্টানোর জন্য ওরা যে সংগ্রামের পথ ধরছে, সেই সংগ্রামেরও কোনো বিকল্প নেই।
কোনো কোনো বিষয়ে একটু দ্বিমতও যে তার তৈরি হয় না, তা নয়। যেমন ধর্ম এবং ভগবান প্রসঙ্গে। যখন ওদের আলোচনা থেকে এমন মতামত বেরিয়ে আসে যে ‘ধর্মটর্ম মিথ্যে’, তখন মা কথা না বলে পারে না। দৃঢ়তার সঙ্গেই প্রতিবাদ করে—‘দ্যাখো ভগবান নিয়ে ও কথাগুলো একটু রয়েসয়ে বলো তোমরা… তোমাদের মনে যা খুশি থাক, কিন্তু আমার কথা ভেবো একবার। আমি বুড়োমানুষ। আমার দুঃখের মধ্যে ওইটুকুই তো ভরসা। ভগবানকে তোমরা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিলে কোথায় দাঁড়াব আমি বলো তো?’ মায়ের এই অনুভূতিকে কেউ হেসে উড়িয়ে দেয়নি। বরং পাভেল আশ্বস্ত করেছে তাকে এই বলে যে, ‘তুমি যে দয়ালু ভগবানে বিশ্বাস করো তার কথা বলিনি আমি। বলেছি আমাদের ধর্মের পাণ্ডা-পুরুতরা যে রাক্ষুসে ভগবানকে খাড়া করেছে তার কথা। সে তো ভগবান নয়, জুজু।’ তাতেও বিচলিতভাব কাটেনি মায়ের। বলেছে—‘ওসব শোনার মতো শক্তি আমার নেই।’
এই নিয়ে আর কথা চালাতে না চাইলেও ধীরস্থির গম্ভীর রীবিন পাঠচক্রের অন্যদের মনে করিয়ে দিয়েছে যে, ‘পবিত্র স্থান কখনো শূন্য থাকে না। ভগবানের যেখানে আসন, সেই জায়গাটা ক্ষতবিক্ষত। মানুষের হৃদয়ে ওটা ভারি ব্যথার জায়গা। ভগবানকে যদি বিলকুল বার করে দাও, তবে দগদগে ঘা হয়ে থাকবে ওখানটায়।’ এই বিষয়ের নিষ্পত্তি হয়নি। কারণ—নিষ্পত্তি সম্ভবও নয়। কিন্তু তারপরেও মা অনুভব করেন যে, ওরা যে কাজটি করছে সেই কাজটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়ার মানুষকে বাঁচাতে হলে, মুক্তি দিতে হলে এই পথের কোনো বিকল্প নেই। আর এই বিপ্লবীদের নিয়ে চিন্তা করতে বসে তাদের মহত্ত্বে অভিভূত হয়ে পড়েন মা। নিজেকে বিশ্লেষণ করে মা বুঝতে পারেন যে, ‘আমরা শুধু ভালোবাসি নিজেদের যতটুকু দরকার, তার ওপরে যেতে পারিনে।… যেসব ছেলে জেলে পচছে, সাইবেরিয়ায় যাচ্ছে, কেন? না, দুনিয়ার মানুষের জন্য… জান দিচ্ছে সব। কচি কচি মেয়েগুলো হিমের রাত্তিরে জল-কাদা-বরফ ভেঙে ক্রোশের পর ক্রোশ একলা হেঁটে শহর থেকে এখানে আসছে… কেন? কেন এত কষ্ট সয় ওরা? কে এসব করায় ওদের? না, ওদের বুকের ভেতর আছে খাঁটি ভালোবাসা।’ নিজেকে তাদের তুলনায় নিতান্ত ক্ষুদ্র মনে হয় তার। তুচ্ছ মনে হয়। কিন্তু আন্দ্রেই তাকে মনে করিয়ে দেয় যে, মা যে ভূমিকা পালন করছেন সেটিও গুরুত্বপূর্ণ, সেটিও প্রয়োজনীয়। কারণ, তার ভাষায়—‘আমরা সবাই বৃষ্টির মতো। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা ফসল ফলাবার কাজে লাগে’।
যথারীতি তাদের বাড়িতে পুলিশের হামলা হয়। খানাতল্লাশি চলে গভীর রাতে। গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় আন্দ্রেইকে। যে মায়ের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। তারপর একের পর এক ঘটতে থাকে ঘটনা। পাভেলও গ্রেপ্তার হয় একপর্যায়ে। সে সময় ছেলের কিছু কিছু কাজের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয় মা। তার মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে পুলিশবাহিনীর রক্তচক্ষু এড়িয়ে নিষিদ্ধ পত্রিকা কারখানার মধ্যে নিয়ে শ্রমিকদের মাঝে বিলি করা। আর এসব করতে করতে নিজের অজান্তে, দলের সকলেরই অজান্তে মা শুধু আর মা থাকেন না, হয়ে ওঠেন কমরেড।
পাভেল দীর্ঘমেয়াদে জেলে চলে যাওয়ায় সংগঠনের সিদ্ধান্ত অনুসারে মা এসে ওঠেন শহরে নিকলাই ইভানভিচের বাড়িতে। নিকলাই ইভানভিচের প্রতিও মায়ের স্নেহ এবং মুগ্ধতা পরিচয়ের প্রথম দিন থেকেই। মা আগেই খেয়াল করেছিলেন যে, ‘সব দিক থেকে ওর জুড়ি নেই। কখনো বড় কিছু নিয়ে কথা কয় না। বাড়িঘর, বাচ্চাকাচ্চা, রুটি-মাংসের দর, ব্যবসা-বাণিজ্য, থানা-পুলিশ— এইসব অর্থাৎ আটপৌরে জীবনের বেসাতি ওর বিষয়বস্তু। কিন্তু ওর কথায় লোকের কৃত্রিমতা, গলদ, স্থূলতা, মাঝেমধ্যে তাদের হাস্যাস্পদতা, আর সবকিছুতে তাদের ত্রুটি পরিষ্কার হয়ে যায়।’ নিকলাই পাভেল বা আন্দ্রেইয়ের মতো শ্রমিক শ্রেণির মানুষ নয়। আবার রীবিনের মতো চাষিও নয়। সে শিক্ষিত বড় ঘরের সন্তান। সরকারি চাকুরে। তবু সে এই বিপ্লবের কাজে যোগ দিয়েছে কেন? কারণ খুঁজতে গিয়ে মায়ের মনে হয়েছে যে নিকলাই ইভানভিচ ‘যেন বহুদূরের একটা আলাদা জগতের মানুষ। সেখানে সবাই সাচ্চা মানুষ; সাচ্চা সহজ তাদের জীবন। এখানকার সবকিছুই যেন ওর কাছে নতুন। না পারছে এখানকার জীবনকে মেনে নিতে, না পারছে তার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে। ওর রুচিতে বাধছে। আর বাধছে বলেই এই অবস্থাটা বদলানোর জন্য ওর এই একনিষ্ঠ চাঞ্চল্যহীন শান্ত গভীর পণ।’
নিকলাইয়ের বাড়িতে আসার পরে মা সার্বক্ষণিক সংগঠনের কর্মী হয়ে যান। নিজের অজান্তেই মানসিক বিবর্তনের চূড়ান্ত ধাপে গিয়ে পৌঁছায়। প্রধান কাজ তার বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে চাষি-মজুরদের কাছে সংগঠনের পত্রিকা পৌঁছে দিয়ে আসা। নিষিদ্ধ পত্রিকা। তাতে সত্য কথা লেখা থাকে বলেই তা নিষিদ্ধ। খুবই বিপজ্জনক কাজ। কিন্তু মা সেই কাজ করে চলেন দ্বিধাহীন সাহসিকতার সঙ্গে।
খুবই ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে। ‘মাসের মধ্যে বারকয় বেশ বদলে, কখনো সন্ন্যাসিনী, কখনো লেস আর কাটা কাপড়ের ফিরিওয়ালি, কখনো সংগতিসম্পন্ন নাগরিকা বা মুসাফির সেজে, ঝোলাকাঁধে নয়তো স্যুটকেস হাতে, প্রদেশটা চক্কর দিয়ে আসে। ট্রেনে, জাহাজে, হোটেলে, সরাইখানায় যেখানেই যাক, সেই শান্ত-শিষ্ট সহজ-সরল মিশুক মানুষটি।’
এইভাবে কাজ করতে করতে নিজের চোখও বেশি করে খুলতে থাকে তার। এইভাবে ঘুরে বেড়ানো আর আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে ‘মানুষের ব্যস্তসমস্ত উদ্বিগ্ন জীবন ক্রমশ বিস্তারিত বিচিত্র রূপে উদ্ঘাটিত হতে লাগল তার সামনে। সর্বত্র পরিষ্কারভাবে দেখতে লাগল মানুষকে বোকা বানিয়ে রাখা, লুট করা, লাভের জন্য তার যা-কিছু সম্ভব শুষে নেওয়া, তার রক্ত পান করার রূঢ় অনাবৃত নির্লজ্জ লিপ্সা। মা দ্যাখে সংসারে কিছুর অভাব নেই, তবু দুনিয়ার অজস্র ধনসম্ভারের সামনে জনগণ অনশনে ধুঁকে ধুঁকে জীবন কাটায়। শহরের গির্জায় গির্জায় কী অঢেল ঐশ্বর্য! সোনা রুপো দুহাতে ছড়ানো—তার এককণারও দরকার নেই ভগবানের, অথচ সেই গির্জারই দরজায় অর্ধ-উলঙ্গ ভিখারির দল অবহেলায় ছুড়ে দেওয়া একটা ছোট্ট তামার পয়সার জন্য শীতে কাঁপতে কাঁপতে হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকে।… যিশুখ্রিস্ট দীনদুখিরই বন্ধু। অতি সাধারণ বেশ তিনি পরতেন। কিন্তু গির্জায় গির্জায় সেই খ্রিস্টেরই মূর্তি সোনা-জহরত সিল্ক-সাটিনে মোড়া। শান্তির আশায় ভিক্ষুকের দল সেই দেবতার দুয়ারে যখন এসে দাঁড়ায়, সেই সিল্ক ঘৃণাভরে খসখস করে। আপনা থেকেই রীবিনের কথা মনে পড়ে—দেবতার নামেও ব্যাটারা আমাদের ঠকিয়েছে!’
মা খুশির সঙ্গে লক্ষ করেন, মানুষ এখন প্রশ্ন করতে শুরু করেছে। একেবারে মৌলিক সব প্রশ্ন। চারদিকে এত অঢেল খাবার, তবু কোটি কোটি মানুষ খেতে পায় না কেন? চারদিকে এত বুদ্ধির দীপ্তি, তবে কেন ওরা এত মূর্খ? মা অনুভব করতে পারেন যে এই প্রশ্নই মানুষকে এনে দেবে তার কাঙ্ক্ষিত মুক্তি।
উপন্যাসের শেষ অংশে বাস্তবের সঙ্গে সংগতি রাখার জন্য অনিবার্যভাবেই পুলিশের হাতে ধরা পড়তে হয় মাকেও। কিন্তু এই মা তো ততদিনে অন্য মানুষ। ধরা পড়তে পড়তেও নিজের আরদ্ধ কাজ শেষ করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বিন্দুমাত্র ভীত নয় পুলিশের চোখরাঙানিতে। কারণ ততদিনে তিনি জেনে গেছেন যে ‘যে আত্মার নতুন করে জন্ম হয়েছে’, তাকে মারতে পারবে না কেউ-ই।
উপন্যাসের মা চরিত্র লেখকের এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। সাধারণ এক নারী থেকে মা-এর এই অনন্য উত্তরণ বা বিবর্তন পাঠকের কাছে মোটেই অবিশ্বাস্য মনে হয় না। তার কারণ মা-এর বুকভর্তি ভালোবাসার পরিচয় পাঠক ক্ষণে ক্ষণেই উপলব্ধি করতে পারেন। সেই ভালোবাসাই মাকে রক্ত-মাংসের জীবন্ত চরিত্র রূপে পাঠকের সামনে হাজির করে। সেই ভালোবাসা প্রথমে কেন্দ্রীভূত ছেলে পাভেলের প্রতি, তারপরে সেটি পরিব্যাপ্ত হয় পাভেলের সঙ্গী-সহযোদ্ধাদের প্রতি, তারপর তাদের সংগঠনের প্রতি এবং সবশেষে দেশের প্রতিটি নির্যাতিত মানুষের প্রতি। এমন ভালোবাসাময়ী মায়ের সঙ্গে বাঙালি পাঠকসমাজও পরিচিত বলেই তাদের কাছে এই চরিত্রটি বিশ্বাসযোগ্য বলে সবসময়ই প্রতীয়মান হয়েছে এবং একই সঙ্গে হয়েছে বিনাতর্কে গ্রহণযোগ্য।
মা চরিত্রের পাশাপাশি উপন্যাসের অন্য উজ্জ্বল চরিত্রের মধ্যে রয়েছে পাভেল। উপন্যাসে তার প্রত্যক্ষ উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু ব্যাপ্তি সেই তুলনায় অনেক বেশি। সে কারান্তরালে যাওয়ার সময় যেন নিজেকে সরিয়ে নিয়ে যায় উপন্যাসের পাতা থেকে। কিন্তু পুরো উপন্যাস আবর্তিত হয় তাকে ঘিরেই। তাই যখন আবির্ভূত হয়, তখন সেই পূর্ণ জ্যোতি-বিচ্ছুরিত চরিত্র নিয়েই আবির্ভূত হয়। দরিদ্র-কারখানা মজুরের ছেলে পাভেল, যার জীবন হওয়ার কথা ছিল কারখানা-বস্তির অন্য তরুণদের মতোই। তাদের বস্তিতে ‘রোকবারগুলোয় ছোকরারা অনেক রাত্তিরে বাড়ি ফেরে ছেঁড়া কাপড়ে, সর্বাঙ্গে ধুলো-কাদা মাখা, কালশিটে-পড়া চোখ, জখমি নাক; কখনো আবার বন্ধুদের ঠেঙিয়ে এসে বিদ্বেষের সঙ্গে আস্ফালন করে, আর নয়তো গুঁতোনি খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে আসে’।
বাপ মারা যাওয়ার দুই সপ্তাহ পরে পাভেলও সেই রকম ভোদকা খেয়ে পুরোপুরি মাতাল অবস্থায় বাড়িতে আসে, মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। তারপরেও কিছুদিন যাবত পাভেলের চালচলনও অন্য অল্পবয়সী ছোকরাদের মতোই থাকে। বেতনের টাকা পেয়ে একটা অ্যাকর্ডিয়ন কিনে এনেছে, এনেছে কড়া ইস্ত্রির খড়খড়ে শার্ট, জমকালো টাই, গালস, ছড়ি—ফুলবাবু সাজার সব উপকরণ। মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেনে নিয়েছিল নিজের ভবিতব্য। এখানে সব পুরুষ যেমন অমানবিক হয়ে ওঠে, তার ছেলেও তেমনই হবে, এ আর নতুন কী! কিন্তু সেই অবিশ্বাস্য নতুন ঘটনাটাই ঘটে পাভেলের জীবনে। কোনো এক সোনার কাঠির স্পর্শে আমূল বদলে যেতে থাকে পাভেল। ফুলবাবু সাজার খরচ কমতে থাকে, বাড়তে থাকে ঘরের তাকে বইয়ের সংখ্যা। বাদবাকি মাইনের টাকা পুরোটাই তুলে দেয় মায়ের হাতে। মায়ের সঙ্গে কথা বলার ভাষাও বদলে গেছে আমূল। এমন সম্মান এবং ভালোবাসা মিশিয়ে মায়ের সঙ্গে কথা বলে না কারখানা-বস্তির কোনো ছেলে। মায়ের অতীত জীবনের দুঃখের প্রতি সহানুভূতি জানায় না কোনো ছেলে। একা পাভেলই সেটা করে।
এইভাবে আমূল বদলে যায় পাভেল, কারণ তার সে শুনতে পেয়েছে বিপ্লবের ডাক। সে দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলতে পারে—‘শুধু একপেট খেতে পাওয়াটাই আমাদের সব নয়। যারা আমাদের ঘাড়ের ওপর চেপে বসে আছে, আমাদের চোখে ঠুলি এঁটে রেখেছে, তাদের দেখাতে হবে আমরা সব দেখতে পাচ্ছি।’ তাই পাভেলের কাছে সবচাইতে বড় হয়ে ওঠে পার্টি এবং বিপ্লব। সেই বিপ্লবী কাজে ব্যাঘাত ঘটবে বলে সে এমনকি সাশার প্রেমকেও গ্রহণ করতে রাজি নয়। জেলে যেতে হয় তাকে। সহযোদ্ধারা তার জেল-পালানোর সম্পূর্ণ বন্দোবস্ত করলেও সে তাতে রাজি হয় না। কারণ তার কাছে মনে হয়েছে যে জেল পালানোর চাইতে বিচারের আদালতে হাজির হয়ে নিজের বক্তব্য তুলে ধরলে তা মানুষের কাছে পৌঁছুবে বেশি করে, তাতে বরং বিপ্লবের প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষিত হবে বেশি। ফলে সে বিচার নামের প্রহসনের সম্মুখীন হয়, এবং অনিবার্যভাবেই তাকে সাইবেরিয়ায় যেতে হয় নির্বাসনের দণ্ড মাথায় নিয়ে। আদর্শের উজ্জ্বলতায় ঝলমলে চরিত্র পাভেলের। কিন্তু যতটা আইডিয়ালিস্টিত, ততটা যেন রক্ত-মাংসের নয়। তারপরেও পাভেল চরিত্রটি বিপ্লবের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়েছে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি তরুণের বুকে।
অল্প পরিসর পেলেও আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না নাতাশাকে, শাসাকে, সোফিয়াকে, লুদমিলাকে, রীবিনকে, আন্দ্রেইকে। প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা চরিত্র। প্রত্যেকেই স্বকীয়তায় ভাস্বর। কিন্তু সকলের লক্ষ্য এক। মন-প্রাণ দিয়ে সকলেই একই লক্ষ্য অর্জনের জন্য নিজেদের জীবন বাজি রেখেছে। উপন্যাসের মাধ্যমে লেখক এই সত্যটিকেও প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে সমাজের বিভিন্ন স্তরের আলাদা আলাদা সত্তাবিশিষ্ট মানুষের একত্র হওয়া ছাড়া বিপ্লব সংঘটিত হতে পারে না।
শেষকথা
রাশিয়ার আরেক দিকপাল লেখক আন্তন চেখভ লিখেছিলেন—‘আমি শুধু খোলাখুলিভাবে অকপটে মানুষকে বলতে চেয়েছিলাম—নিজেদের দিকে একবার দেখুন, দেখুন-না কী বিশ্রী আর বিরস জীবনযাপন করছেন আপনারা! সবচেয়ে বড় কথা, লোকে যেন বুঝতে পারে, আর বুঝতে যখন পারবে তখন অবশ্যই তারা নিজেদের জন্য গড়ে তুলবে আর-এক জীবন, আরো ভালো এক জীবন। আমি তা দেখতে পাব না, কিন্তু আমি জানি তা হবে সম্পূর্ণ অন্যরকম—যেমন আছে তার মতো নয়। আপাতত তা যখন নেই, তখন আমি মানুষকে বলব, একবার বোঝার চেষ্টা করুন, কী বিশ্রী আর বিরস জীবনযাপন করছেন আপনারা।’
আন্তন চেখভ যেখানে শেষ করেছিলেন, সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল মাক্সিম গোর্কির ‘মা’-এর পথচলা। নিজেদের বিশ্রী জীবন বদলানোর সর্বাত্মক যুদ্ধে শরিক হয়েছে এই উপন্যাসের পাত্রপাত্রীরা। ‘মা’ উপন্যাসের মাধ্যমে বিশ্বের উপন্যাসসাহিত্যে আর একটি নতুন ধারার সংযোজন হয়েছে। মাক্সিম গোর্কিই পৃথিবীতে প্রথম লেখক, যিনি সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিপ্লবী শ্রমিকদের সংগ্রামের চিত্র অঙ্কন করেছেন। আর এই চিত্র ধারণ করে, পৃথিবীতে এই ধারার প্রথম উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে ‘মা’।
কবি ও কথাসাহিত্যিক। জন্ম ৭ আগস্ট, উত্তরবঙ্গের কোচবিহারে। স্কুল জীবন থেকেই লেখালেখির সূত্রপাত। সম্পাদনা করেছেন বেশ কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকা এবং ওয়েবজিন। বর্তমানে ইরাবতী ডেইলি ওয়েবজিনের সাথে যুক্ত। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : জল ভাঙে জলের ভেতর [২০১১], ঠোঁটে দাও জ্যোৎস্নার বিষ [২০১২], ডুব সাঁতার [২০১৭], নিরুদ্দেশ গাছে সন্ন্যাসীর মুখ [২০১৭]। গল্পগ্রন্থ : কারুময় খামে অচেনা প্রেম [২০১২]। উপন্যাস: ইতি খন্ডিত জীবন [২০২২]। প্রবন্ধ সংকলন: মাটির গন্ধ [২০২২]। সম্পাদনা গ্রন্থ: দুই বাংলার সাম্প্রতিক গল্প [২০২২] ।
শখ বইপড়া, লেখালেখি, ছবিতোলা, গান শোনা ও ভ্রমণ। বেশ কিছু গানও লিখেছেন তিনি।