| 29 মার্চ 2024
Categories
গল্প সম্পাদকের পছন্দ সাহিত্য

যুক্তফ্রন্ট

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

তখন ভরদুপুর। খুকি দু-হাতে জানলার গরাদ ধরে, শরীরকে আলগা করে দাঁড়িয়ে। গলিটা খুব সরু। এঁকেবেঁকে একদিকে বড়ো রাস্তায় অন্য দিকে একটা বস্তির মধ্যে পড়েছে। জানলার সামনেই একটা কারখানাবাড়ির টিনের দেয়াল। বস্তুত জানলায় দাঁড়িয়ে খুকি কিছুই দেখতে পায় না যদি না কোনো লোক জানলার সামনে দিয়ে যায়। বস্তির লোকই বেশিরভাগ সময় যাতায়াত করে। তাদের দেখতে খুকির ভালো লাগে না। খুকির স্বাস্থ্য ভালো। দেখতেও মন্দ নয়। পাত্র দেখা হচ্ছে।

মেঝেয় আদুড় গায়ে ওর মা ঘুমোচ্ছে, পাশের ঘরে বউদি বাচ্চা নিয়ে। দুই ছোটোভাই স্কুলে গেছে। বাবা আর দাদা অফিসে। আশেপাশে সমবয়সি মেয়ে নেই যে খুকি দু-দন্ড ঘুরে আসবে। সামনের টিনের দেয়ালে একটা পোস্টারে লেখা–সাম্রাজ্যবাদকে খতম করতে হলে শোধনবাদের সঙ্গে লড়াই করুন। খুকি দেখল গত পনেরো দিনে খতম করতেটা বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে। করুনটা ছেঁড়া। এ ছাড়া গলিতে কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ছে না। একটা সিনেমা পোস্টারও ঢোকে না এমন হতভাগা গলি।

বড়ো রাস্তার দিকে পটকা ফাটার শব্দ হল দুটো। কিছু হইচই শোনা গেল। ওরকম হরদমই শোনা যায়। খুকির তখন কারখানাবাড়ির চালায় চোখ। দুটো পায়রা, নিশ্চয়ই মদ্দা এবং মাদি, বকম-বকম করতে করতে যা করার তাই শুরু করে দিয়েছে। খুকি প্রথমেই পিছনে তাকিয়ে ঘুমন্ত মাকে দেখে নিল। অতঃপর নিশ্চিন্ত হয়ে, গভীর মনোযোগে যখন মুখটি উপরে তুলে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল তখন সে শুনতে পেল না গলি দিয়ে ছুটে আসা পায়ের শব্দ।

তাই বিষম চমকে গেল লোকটিকে একেবারে তার দু-হাতের মধ্যে দেখে। হাতে ক্যাম্বিসের ব্যাগ। ব্যাগটা জানলা গলিয়ে খুকির পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে, এটা রাখুন তো, পরে নিয়ে যাব। বলেই ছুটে চলে গেল।

খুকির তখন রা কাড়ার ক্ষমতা নেই। নড়াচড়ারও। ফ্যালফ্যাল করে সে ব্যাগটার দিকে শুধু তাকিয়ে। অনেকগুলো পায়ের শব্দ আর ডাকাত ডাকাত, পাকড়ো পাকড়ো চিৎকার গলি দিয়ে এগিয়ে আসছে। ভয় পেয়ে খুকি জানলা বন্ধ করে দিল। শুনতে পেল ছুটন্ত লোকগুলো বলছে, ব্যাঙ্কের সামনেই—গাড়িতে ওঠার সময় লুট করেছে। একটা ধরা পড়েছে। অবশেষে পায়রাদের কান্ড এবং এই ব্যাগ, দুয়ের ধাক্কা সামলাতে না পেরে খুকি। মাকে ডেকে তুলল।

মাঝরাতে বাবা-মা দাদা-বউদি ঘরের দরজা-জানলা এঁটে গুনে দেখল দশটি বাণ্ডিলে মোট দশ হাজার টাকা। সকলে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।

ঠিক কী বলেছিল লোকটা, আবার আসব? দাদা ফিসফিস করে বলল।

ওকে দেখলে আর চিনতে পারবে কি? মনে তো হয় না। ফিসফিস করে মা বলল।

তাতে কী আসে-যায়, বাড়িটা তো চিনবে। বউদি চাপা সুরে বলল।

লোকটা ধরা পড়েছে কি না আগে সেই খোঁজ নিতে হবে। বাবা দমবন্ধ করে বলল।

ব্যাগটা এখন কোথায় রাখা হবে?

আমার খাটের তলায় থাক। বউদি পরামর্শ দিল।

ইঁদুর আরশোলার উৎপাত বড়ো। কেটে দেবে। বরং ঠাকুরঘরে থাক। মা প্রতিবাদ করল। রাখা সম্পর্কে কোনো ঐকমত্য না হওয়ায় স্থির হল ভাঁড়ারে আটা রাখার ড্রামে ব্যাগটা ভরে ঢাকনাটা কষে এটে দেওয়া হোক। যদি পুলিশ সার্চ করতে আসে আগেই তো সিন্দুক তোরঙ্গ দেখবে। আটার ড্রাম অনেক নিরাপদ।

পরদিন সকালেই দাদা এবং বাবা খবরের কাগজে হুমড়ি খেয়ে বৃত্তান্তটা খুঁজে খুঁজে পেয়ে গেল। মাইনে দেবার জন্য দশ হাজার টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে এক কারখানার ক্যাশিয়ার গাড়িতে উঠছিল। তখন দুজন দূবৃত্ত বোমা ছুড়ে টাকার থলি ছিনিয়ে চম্পট দেয়। একজন ধরা পড়েছে, থলি নিয়ে অন্যজন পালিয়ে গেছে। ক্যাশিয়ার হাসপাতালের পথেই মারা যায়।

তখন ফিসফিস করে দুজনে বলাবলি করল

আর কেউ জানে বলে তো মনে হচ্ছে না।

কী করে জানবে? ছুটতে ছুটতে গলিতে ঢুকে বোধ হয় ভয় পেয়েই থলিটা তাড়াতাড়ি নামিয়ে দিয়ে গেছে। আনাড়ি মনে হচ্ছে।

নিশ্চয় নিতে আসবে।

আসুক-না, দেখা যাবে ক্ষণ।

যদি ধরা পড়ে তাহলে ভালোই হয়।

মারের চোটে কোথায় থলিটা রয়েছে পুলিশের কাছে তা ফাঁস করেও তো দিতে পারে?

তা বটে। ধরা না পড়াই ভালো।

অবশ্য বলা যায়, থলির কথা আমরা কিছুই জানি না।

তাহলেও পুলিশ সার্চ করতে আসবেই। গুণ্ডাটাকে যখন ভদ্রলোকের মতোই দেখতে, অবশ্য খুকির মতে, তখন পুলিশ কোনো ওজর আপত্তিই শুনবে না। বহু ভদ্রলোকই তো এসব কাজ করে।

তাহলে থলিটা বাড়িতে রাখা ঠিক হবে না। আমার শালার কাছে বরং…

না না, এখন কোনো জিনিস হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোনো ঠিক নয়। পুলিশ নিশ্চয় নজর রাখছে। তা ছাড়া এই গুণ্ডাটা আগে ধরা পড়ুক তবে তো?

গুণ্ডাটা নিশ্চয় একা নয়, দলও আছে। যদি চড়াও হয়?

দুজন ভীষণ ভাবনায় কথা বন্ধ করে ফেলল। তারপর চান-খাওয়া সেরে যে যার অফিসে চলে গেল। দুপুরে খুকির মা আর বউদি রান্নাঘরে খেতে খেতে বলাবলি করল, দরজা জানলাগুলো ভালো করে বন্ধ আছে কি না শোবার আগে আবার দেখতে হবে।

কড়া নাড়লেই যেন দরজা খুলো না। আগে দেখে নিয়ে তারপর।

তার থেকে যদি দাদার ওখানে রাখা যেত তাহলে এত ভয়ের কিছু থাকত না।

দরকার কী আবার লোক জানাজানি করে।

দাদা সেরকম লোকই নয়। তাহলে আর ব্যাবসা করে খেতে হত না। আমার বিয়েতে চার হাজার টাকা ধার করেছিল, কক্ষনো কারুর কাছে তা ভাঙেনি, এমন চাপা।

তোমার দাদা ছেলে ভালো। খুব নম্র, ভদ্র।

ওই জন্যই তো দাদা খালি লোকসান দিচ্ছে। কত বার ওর বন্ধুরা, এমনকী খদ্দেররা পর্যন্ত বলেছে অত সৎ হলে ব্যাবসা করা চলে না। একদম মিথ্যা বলতে পারে না। অথচ কী ভালো ব্যাবসা। কত মাড়োয়ারি টাকা নিয়ে সাধাসাধি করেছে পার্টনার হবার জন্যে। যদি নেয় তাহলে এখনও হেসেখেলে মাসে পাঁচ হাজার লাভ করতে পারে। কিন্তু ওই…

তা নিলেই তো পারে!

বাঙালি ছাড়া নেবে না, এমন গোঁয়ার যে কী বলব। আপনার ছেলেকে তো বললুম দাদার সঙ্গে নেমে পড়ো। চাকরির সাড়ে চারশো টাকায় ছেলেপুলে নিয়ে কি বাঁচা যায়? হাজার সাত-আট দিলেই…

অত চ্যাঁচাচ্ছ কেন। এখন চারিদিকে লোক ঘুরে বেড়াবে। এক বার একটুখানি শুনতে পেলেই এসে পড়বে। খুকি কোথায়? কী করছে?

খুকি তখন ছাদে। পাঁচিলে কনুই রেখে গালে হাত দিয়ে এমনিই দাঁড়িয়ে। এক তলা বাড়ির ছাদ, তিন দিক থেকে চাপা। একটুখানি মাত্র গলির দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। মায়ের ডাকে খুকি নীচে এসে জানলাবন্ধ ঘরের মেঝেয় শুয়ে পড়ল।

রাতে খুকির বাবা-মা চাপা গলায় আলোচনা করার জন্য বহুদিন পরে আজ পাশাপাশি শুল। দুই ছেলে এবং খুকি আঘোরে ঘুমিয়েছে দেখে তবেই খাট থেকে মা নেমে এসেছে।

এই এক ঝামেলা বাপু ছেলে মেয়ে বড়ো হয়ে গেলে।

আর একটা ঘর থাকলেই হয়।

একটা কেন, দুটো দরকার। খুকির বিয়ে হলে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। কিন্তু এদের দুজনকে বিয়ে দিয়ে বউ এনে রাখবে কোথায়?

ছাদে দুটো ঘর অবশ্য তোলা যায়। তবে এদের বিয়ে হতে তো এখনও অনেক দেরি।

ততদিনে পাঁচ টাকার জিনিস পঞ্চাশ টাকায় দাঁড়াবে। এখন করলে তবু ভাড়াটে বসানো যায়। মাস মাস অন্তত একশো টাকা তাহলে আসে।

আমি ভাবছিলুম শ্রীরামপুরে এক বার যাব কি না। ছেলেটার প্রসপেক্ট আছে। দু-বছরের মধ্যেই অফিসার হয়ে যাবে, বংশটাও ভালো।

বড্ড বড়োলোক বাপু এরা, খরচ করতে করতে পরে জেরবার হতে হবে। শুধু বিয়েতে খরচ করলেই তো চলবে না। এই বাড়ির একটা বউ আফিং খেয়েছিল কেন খোঁজ নিয়েছিলে কি? তার থেকে বরং শ্যামপুকুরেরটি ভালো। দোজবরে তো কী হয়েছে। অবস্থাপন্ন, কলকাতায় নিজের বাড়ি, খাঁইও একদম নেই। আমার যা গয়না আছে তাই ভাঙিয়েই হয়ে যাবে।

লোকটার বয়স খুকির দু-গুণ। দুটো ছেলেও আছে।

আছে তো কী হয়েছে? খুকির অত বাছবিচার নেই, যা দেবে আমার সোনামুখ করে নেবে।

পাশের ঘরে খুকির দাদা-বউদি প্রথামতো দাম্পত্য-ক্রিয়া সেরে চিত হয়ে বিশ্রাম করছে। একটা আরশোলা ফরফর করে উড়তে শুরু করল। দুজনে তখন খুব বিরক্ত হয়ে বলতে লাগল, এঁদো ঘরে মানুষ থাকতে পারে?

নোনা লেগে ইটগুলো পর্যন্ত ক্ষয়ে গেছে।

এর থেকে নতুন বাড়িতে ভাড়া থাকাও ভালো।

এরপর তো ঘরে কুলোবে না, তখন কী হবে?

বেরোতে হলে এখনই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু বাড়িভাড়া টানার মতো রোজগার না হলে আলাদা থেকে সংসার চালানো যে কী অসম্ভব ব্যাপার…

আজ বলেছিলুম দাদার সঙ্গে ব্যাবসায় নামার কথাটা। একদম গা করল না। মনে হয় কোনো মতলব আছে ওঁদের।

যে-মতলবই থাক, খরচ করতে গেলেই নজরে পড়বে। তখন ক্যাঁক করে পুলিশ ধরবে, পেলে কোথায়? কী জবাব দেবে তখন? অবস্থা তো সবাই জানে। বাসনমাজার ঝি তো আমার বিয়ের পর রাখা হল।

বুঝিয়ে বলো-না। ড্রামের মধ্যে রেখে তো কোনো লাভ নেই। বরং নিজেদের লোকের সঙ্গে ব্যাবসায় খাটালে কিছু আসবে। মিনমিন করলে কি চলে! এখন নয় একটা ছেলে, তারপর আরও তো হবে, বাবা-মা আর কদ্দিন!

বলার সুযোগ যে পাচ্ছি না!

পরদিন অফিস যাবার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে খুকির দাদা মোড়ে দাঁড়িয়ে রইল। একটু পরে বাবাও অফিসে বেরোল। দুজনে দেখা হতেই কথা শুরু হল –

কাল বড়োশালার সঙ্গে দেখা হল। ব্যাবসাটাকে বড়ো করতে চায়। কিছু টাকা দিয়ে যদি পার্টনার হওয়া যায়—তুমি কী বল?

ভালোই তো, কিন্তু টাকা পাবি কোথায়?

ড্রামের মধ্যে না পচিয়ে কাজে লাগাতে তো হবে।

খুকির বিয়ে দিতে হবে। আবার তোর মা বলছে ছাদে দুটো ঘর তুলতে।

ভালোই তো। কিন্তু খরচ করতে দেখলেই তো কথা হবে হঠাৎ এত টাকা এল কোত্থেকে?

তা বটে। আচ্ছা ভেবে দেখি।

ভেবে দেখতে গিয়ে এক সপ্তাহ কেটে গেল। তার মধ্যে খুকির মা ও বউদির কথা প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে। বাবা ও দাদা অফিস যাবার সময় ট্রামস্টপে প্রতিদিনই তর্ক করে যাচ্ছে। সংসারখরচের টাকা যেভাবে খরচ হওয়া উচিত তা হচ্ছে না, এই যুক্তিতে দাদা চিৎকার করে মা-র সঙ্গে ঝগড়া করল পর পর তিন দিন। দুটো ঘর থেকেই ভাঁড়ারের দরজা দেখা যায়। দুই ঘর থেকে পালা করে সারারাত ভাঁড়ার ঘরের দিকে সন্দেহকুটিল চোখ পাহারা দিতে শুরু করেছে। আর খুকি, দুপুরে ঘরে জানলা বন্ধ থাকে, তাই ছাদে উঠে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। চড়াই বা পায়রা দেখলে শুধু নাকের পাটা ফুলোয়।

কালো কাচের চশমাপরা, টেরিলিন ট্রাউজার্স ও জামা গায়ে ছিপছিপে, শ্যামবর্ণ, মোটামুটি সুদর্শন একটা লোক গলির বাঁকটায় দাঁড়িয়ে তার দিকেই যে তাকিয়ে আছে, খুকি প্রথমে বুঝতে পারেনি। যখন বুঝল, দেহটা কাঁপতে শুরু করল। পাঁচিল থেকে কনুইটা নামাবে সে শক্তিও নেই। লোকটা আস্তে আস্তে বাড়ির সামনে দিয়ে বস্তির দিকে চলে যেতে তখন দেহের উপর নিয়ন্ত্রণক্ষমতা ফিরে পেল খুকি। দুড়দুড়িয়ে সে নীচে নেমে এল।

রাত্রে দালানে এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে থাকতে কথা চলে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছোবার জন্য।

ভুল দেখেনি খুকি?

না না, আমাদের বাড়ির দিকে তাকাতে তাকাতেই তো চলে গেল। লুঙ্গি আর। পাঞ্জাবিপরা,নাকটা থ্যাবড়া, কোমরে কিছু-একটা গোঁজা ছিল বলে ওর মনে হল।

ছাদে কি কত্তে দাঁড়িয়ে থাকে অত বড়ো মেয়ে? তোমরা একটু নজরও রাখ না?

আহাহা, দুখানা ঘরের মধ্যে সারাদিন বন্দি থাকবে নাকি? একদিন থাকো না তুমি, বুঝতে

পারবে।

থাক থাক, এখন এই নিয়ে ঝগড়া করে লাভ নেই। সত্যি যদি সেই গুণ্ডাটাই হয় তাহলে কী করা যায় এখন? নিশ্চয় ফেরত নিতেই এসেছে।

পুলিশে ধরিয়ে দিলেই তো হয়।

না না, তাহলে ফাঁসিয়ে দেবে। নিজে যদি বঞ্চিত হয় তাহলে অন্যকেও পেতে দেবে না, এ তো সহজেই বোঝা যায়।

তাহলে ওকে কিছু দিয়ে দিলেই হয়। থলেটা যদি জানলা গলিয়ে না ফেলত তাহলে ধরা পড়তে পারত। তাহলে টাকাও যেত, প্রচুর মা-র খেত আর ফাঁসি তো হতই। এই বাড়িই ওকে বাঁচিয়েছে বলা যায়। এখন ও কোন মুখে দাবি করতে পারে?

কিন্তু গুণ্ডার কি ধর্মবোধ থাকে? দাবি সে করবেই। এর জন্য একটা মানুষ পর্যন্ত খুন করেছে, সেটা ভুলে যেয়ো না। আমাদেরও খুন করতে পারে।

তাহলে দিয়ে দেওয়াই ভালো।

না না, গুণ্ডার দাবির কাছে মাথা নোয়াতে হবে নাকি? আর দেবারই যদি ইচ্ছে হয়, বেশ তাহলে আমাকেই দাও। আমি বোঝাপড়া করে নেব।

তারপর এ বাড়িতে বোমা ফেলুক, রাস্তায় ছুরি মারুক। তোর জন্যে আমরা মরি আর কি?

টাকাগুলো পেলে কালকেই এ বাড়ির ওপর সব দাবি ছেড়ে চলে যাব। তখন তো আর তোমাদের ভয়ের কিছু থাকবে না।

তা হয় কখনো! হঠাৎ বাড়ি ছাড়লে লোকে বলবে কী?

আরে রেখে দাও তোমার লোক। দু-চার দিন বলাবলি করে তারপর সব ভুলে যাবে।

তাহলেও একটা কারণ না দেখালে কি চলে? জিজ্ঞেস করলে কিছু তো একটা আমাদের বলতে হবে।

মিথ্যে বলার কী দরকার, বলে দেবেন বনিবনা হচ্ছিল না। ঝগড়াঝাঁটি নিত্যিই তো লেগে ছিল, তাই আলাদা হয়ে গেল। ক-দিন নয় লোক জানিয়ে গলা ছাড়া যাবে ক্ষণ।

সবই তো বুঝলুম। কিন্তু গুণ্ডা বুঝবে কী করে যে, টাকা তোমরাই নিয়ে যাচ্ছ, আমাদের কাছে নেই?

এ আর এমন কী শক্ত, গোড়াতেই তো আর ছুরি-বোমা মারবে না। যখন দাবি জানাতে আসবে বলে দেবে।

কিন্তু এ বাড়ির ওপর সব স্বত্ব আগে উকিল দিয়ে লেখাপড়া করে ছাড়তে হবে। মুখের কথায় চলবে না।

সকালেই বাবা এবং দাদা উঁকি লের কাছে গেল। তিনি খুব ব্যস্ত ছিলেন, তাই বলে দিলেন সন্ধ্যায় আসতে, খসড়া তৈরি করে দেবেন, পরদিনই রেজিস্ট্রি হবে। তারপর বাড়িতে তুলকালাম একটা ঝগড়া হবে বলেও ঠিক হয়ে রইল।

খুকির ছছাটো দুই ভাই সেই দিনই স্কুল থেকে ফিরে জানাল, মোটামুটি ভালো দেখতে ছিপছিপে ময়লা রঙের একটা লোক রাস্তায় তাদের কাছে খোঁজ নিচ্ছিল, বাড়িতে কে কে

আছে, বাবা-দাদা কখন আসে, জানলায় যে-মেয়েটি দাঁড়িয়ে থাকে তার নাম কী ইত্যাদি। ওদের চায়ের দোকানে নিয়ে গিয়ে কাটলেট খাওয়াতে চেয়েছিল, তবে ওরা যায়নি।

শুনেই মা ও বউদির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে এল, ছোটো ভাই দুটিকে বিকেলে বেরোতে বারণ করা হল। কিন্তু উপযুক্ত কারণ দর্শাতে না পারায় তারা এই নিষেধাজ্ঞা আগ্রাহ্য করে বেরিয়ে গেল। কিছু-একটা ঘটবে আশঙ্কা নিয়ে মা ও বউদির মধ্যে বলাবলি হল— ব্যাটাছেলেরা কখন থাকে না-থাকে সেটা জেনে নিচ্ছে।

পইপই বলি অফিস থেকে সোজা বাড়ি চলে আসবে, আড্ডায় জমে যেয়ো না। এখন যদি বাড়িতে দল নিয়ে আসে তাহলে?

আজ উঁকি লের কাছে যাবার কথা আছে না? খুব জোরে চেঁচালেই হয়তো পালিয়ে যাবে। দিনের বেলায় অত সাহস হবে না।

বাঃ, দিনের বেলাতেই তো কান্ডটা ঘটিয়েছিল, সেটা ভুলে যাচ্ছেন কেন? ওদের কাছে কিবা দিন কিবা রাত।

তুমি হাতের কাছে কয়লা ভাঙার লোহাটা বরং রাখো।

এই সময় দুজনেরই মনে হল সদরের কড়াটা বোধ হয় কেউ নাড়ল। একটা সচিত্র সিনেমা পত্রিকা হাতে খুকি ছাদে উঠে রয়েছে। বউদি ছুটে রান্নাঘরে গেল। মা পড়িমরি ছাদে উঠে দেখল খুকি পাঁচিলে হেলান দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে। তাকে দেখামাত্র বইটায় মন দিল। কিছু না বলেই মা নেমে এল। বউদি কয়লাভাঙা লোহা হাতে দাঁড়িয়ে।

কেউ না।

কী করে বুঝলেন?

খুকি তো দিব্যি দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখছে, নইলে তো ছুটে নেমে আসত সেদিনের মতো।

আমার শরীর যেন কেমন কচ্ছে। সন্ধে হয়ে এল, বাড়িতে একটা ব্যাটাছেলেও নেই।

খুকিকে বরং ডাকি।

এই সময় ওদের মনে হল আবার যেন কড়া নড়ে উঠল।

আলুওলা নয় তো, বলেছিল বিকেলে দাম নিতে আসবে।

তুমি গিয়ে দ্যাখো-না।

আপনি যান-না। খেয়ে তো আর ফেলবে না।

অবশেষে মা গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বার কয়েক কে কে বলে চ্যাঁচাতে আবার খুট খুট কড়া নড়ে উঠল। খিলটা খোলামাত্র হট করে দরজা ঠেলে একটা লোক ভিতরে ঢুকেই বলল, চ্যাঁচাবেন না। দরজায় খিল দিয়ে বলল, আমার থলি আর টাকা নিতে এসেছি। চটপট দিন। চ্যাঁচালে সবাইকেই খুন করে যাব।

এমন আকস্মিকভাবে ব্যাপারটা হয়ে চলল যে ওরা দুজন এক-পা হটার কথাও ভাবতে পারল না। ছোরার ডগাটার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকল। শেষে বউদিই বলল, টাকা তো আমাদের কাছে নেই। পুলিশে জমা দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বাজে কথা রাখুন। সব খবর রাখি। টাকা এই বাড়িতেই আছে। চটপট বার করুন, জানেন তো এর জন্যে খুন পর্যন্ত হয়ে গেছে। আরও খুন হতে পারে।

টাকা বাপু আমার বড়ছেলে নিয়েছে। আমরা ও-টাকা চাই না।

মিথ্যে কথা। হাত দিয়েও উনি টাকা এখন পর্যন্ত ছাঁননি, আর কিনা ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছেন?

কেন, ও কি টাকার বদলে বাড়ির অংশ ছাড়বে বলেনি? ছাড়ক, তবে তো টাকা পাবে। আগেই বলছেন কেন টাকা নিয়েছে? দশ হাজার টাকার বদলে পনেরো হাজার টাকার বাড়ির অংশ নিচ্ছেন, এত বড়ো জোচ্চুরির পরও কিনা বলছেন আপনার ছেলে টাকা নিয়েছে?

টাকা যে দেওয়া হচ্ছে এই ওর ভাগ্যি। বাড়ি ওর বাপের, সে যদি উইল করে ওকে বঞ্চিত করে তাহলে ও কী করবে শুনি?

করে দেখুন-না। কোর্টে গিয়ে আদায় করব।

তোমার চোদ্দোপুরুষের সাধ্যি নেই আদায় করে।

মুখ সামলে কথা বলবেন বলছি।

চুপ কর হারামজাদি।

এরপর বউদি কয়লা ভাঙার লোহাটা ছুড়ে মারে। মা কপাল চেপে ঘুরে পড়ে বার কয়েক হাত-পা খিঁচিয়েই নিথর হয়ে গেল দেখে গুণ্ডাটা ছুটে এল। নাড়ি টিপে, চোখের পাতা তুলে, বুকে কান রেখে সে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, একেবারে মার্ডার করে দিলেন। যাক চটপট আমার থলেটা বার করে দিন তো, চলে যাই।

আমি এখন কী করব?

আমি কী জানি? আমার থলেটা দিন।

ডাক্তার ডাকব?

বললুম তো জানি না।

পুলিশ?

কী বলবেন ডেকে? খুন করেছি? তাহলে তো আপনার ফাঁসি হবে।

এই সময় ছাদ থেকে খুকি নামল। মাকে রক্তের মধ্যে পড়ে থাকতে দেখে হাউহাউ করে উঠে বলল, ওমা, কে তোমার এমন কান্ড করল?

ওই তো, ওই লোকটা, সেই গুণ্ডাটা!

বউদির আঙুল তোলা দেখে গুণ্ডাটা খুব ঘাবড়ে গেল। তার মানে, এসব কী কথা? বলতে বলতে পিছোতে শুরু করল। খুকি চিৎকার করে ছুটে গিয়ে লোকটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে বউদিও ছুটে গেল।

জানো ঠাকুরঝি, খটাং করে লোহাটা দিয়ে মারল। কীরকম শব্দ যে হল।

খুকিকে এক হাতে আটকে গুণ্ডাটা খিল খুলতে যাচ্ছে, বউদি খিল চেপে ধরে বলল, আবার আমার ঘাড়ে দোষ দেবার চেষ্টা করছে। কী বদমাস দেখেছ!

মা কালীর দিব্যি, আমি করিনি।

না করেনি, পাজি গুণ্ডা কোথাকার। টাকা দিন নইলে খুন করব বলে ওটা ছুড়ে মারলে না?

চিৎকার করতে করতে খুকি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছে। গুণ্ডাটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। খুকির চিৎকারে আশপাশের বাড়ির জানলায় ছাদে উঁকি শুরু হয়ে গেছে। সদর দরজার কাছে কাদের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। গুণ্ডাটা হঠাৎ সংবিৎ পেয়ে এধার-ওধার তাকিয়েই ছাদে যাবার জন্য ছুটল সিঁড়ির দিকে। বউদিও পিছু নিল।

পালাচ্ছ নাকি? কোনো উপায় নেই, ছাদ দিয়ে শুধু রাস্তায় লাফিয়ে পড়া যায়। সেখানে এখন লোক।

তাই যাব। ছুরি দেখিয়ে পালাব। মরিয়া হয়ে গুণ্ডাটা বলল।

আমার কী দোষ! চোদ্দোপুরুষ তুলে গালাগাল দিলে রাগ হবে না? তোমার হত না?

গুণ্ডাটা জবাব না দিয়ে কয়েক ধাপ ওঠা মাত্র বউদি ওর জামা টেনে ধরল। এখন তোমায় আমি যেতে দিতে পারি না। খুনি তোমার হতেই হবে। ফাঁসি অবধারিত তোমার।

তাহলে পুলিশকে বলব লুটের টাকা এ বাড়িতে আছে।

তার আগেই সরিয়ে ফেলব অন্য কোথাও।

এখুনি চেঁচিয়ে সব কথা লোকেদের বলে দিচ্ছি। ফাঁসি যখন হবেই আর পরোয়া কীসের। তবে আপনাদেরও টাকা ভোগ করতে দেব না।

কিন্তু তাই বলে আমি ফাঁসি যেতে রাজি নই, তোমাকেই ফাঁসি যেতে হবে। লোকে সহজেই বিশ্বাস করবে তোমার পক্ষে খুন করা স্বাভাবিক। টাকা আমরা পাব না, কিন্তু তুমি টাকা আর প্রাণ দুটোই হারাচ্ছ, লোকসান তোমারই বেশি।

এই শুনে গুণ্ডা খুবই বিচলিত হয়ে সিঁড়িতে বসে পড়ল। সদরের কড়া নাড়ছে প্রতিবেশীরা। কী হল, কী ব্যাপার? প্রভৃতি ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। খুকির জ্ঞান এখনও ফেরেনি।

এখন আর ভাবনা করার সময় নেই। বরং এক কাজ করা যাক, তোমার প্রাণ বাঁচিয়ে দিচ্ছি, টাকার দাবিটা ছেড়ে দাও। মনে রেখো, বেঁচে থাকলে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করতে পারবে। ঠিক বলেছি কি না?

গুণ্ডাটি এইবার ফিক ফিক করে হেসে মাথা হেলাল। সদরে দুম দুম ঘুসি পড়ছে। বউদি ছুটে দরজা খুলেই চিৎকার করে উঠল, সব্বনাশ হয়ে গেছে, শিগগির ডাক্তার ডেকে আনুন। মা মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন। ব্লাডপ্রেশার ছিল। রকের কানায় মাথাটা ঠকাস করে লাগল, উফ কীরকম শব্দটা যে হল!

এই বলে বউদি উচ্চৈঃস্বরে কাঁদতে লাগল। প্রতিবেশীরা ছুটোছুটি শুরু করে দিল। ডাক্তার এল, অ্যাম্বুলেন্সও। মাকে হাসপাতালে পাঠানো হল। খুকির জ্ঞান ফিরে এসেছে, তাকে ঘরে শোয়ানো হল। জনৈক প্রতিবেশীর প্রশ্নের উত্তরে বউদি জানাল, খুকির বিয়ের সম্বন্ধ এক জায়গায় ঠিকঠাক। এইমাত্র জানিয়েছে মেয়ের মাথা খারাপ আছে বলে তারা না কি খবর পেয়েছে। তাই শুনেই মা…

খুকির আচ্ছন্নতা তখনও কাটেনি। ফ্যালফ্যাল চোখে জানলার দিকে তাকিয়ে, সকলের কথাবার্তা তখন তার কানে কম রকমের মতো মনে হতে লাগল।

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত