| 20 এপ্রিল 2024
Categories
সময়ের ডায়েরি

মুজিব বর্ষে হোক অঙ্গীকার ‘ভোট হবে সবার’

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষ্যে চারদিকে সাজ সাজ রব। এ উপলক্ষ্যে রাজধানী ঢাকা সেজেছে বর্ণিল সাজে। যদিও বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় মুজিব বর্ষের মূল অনুষ্ঠান স্থগিত করা হয়েছে। জনসমাগম এড়িয়ে ঘরোয়া আয়োজন এবং স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘মুজিব বর্ষের’ প্রারম্ভিক অনুষ্ঠান শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। রাজধানীর রাজপথে দেখা যায় মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, সংস্থা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্র বিবেচনায় নানা রকম অঙ্গীকার ঘোষণা করেছে। কোনো সংস্থা বলছে তারা হবে ‘জনতার’ কেউ বলছেন মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে ‘নিরাপদ নিরবিচ্ছিন্ন সড়ক নের্টওয়াক গড়ে তুলবেন’। মুজিব বর্ষ উপলক্ষ্যে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা, অধিদফতর তাঁদের সেবা সহজীকরণ করতে এবং এসব সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌছে দিতে বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে । এগুলো আশা জাগানিয়া সংবাদ। তবে, মুজিব বর্ষ উপলক্ষ্যে যে অঙ্গীকারটি করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো সেই অঙ্গীকারটি করছে না কেউ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পূর্ব বাঙলার সাড়ে সাতকোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। বঙ্গবন্ধু সারাটা জীবন ব্যয় করেছেন মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। এজন্য জেল জুলুমও কম ভোগ করেননি। ৫৪ বছরের জীবনে বঙ্গবন্ধু ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে ছিলেন। যার তাঁর জীবনের এক-চতুর্থাংশ সময়।

১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দল সমূহের সম্মেলনে আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঐতিহাসিক ‘ছয় দফা’ দাবি পেশ করেন। কালক্রমে এই ছয় দফা দাবি বাঙালির ‘মুক্তির সনদ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। পাকিস্তানীরা এবং বঙ্গবন্ধু নিজেও জানতেন স্বায়ত্বশাসনের এই ছয়দফা দাবি আসলে স্বাধীন বাঙলার  রুপরেখা। তাই, একদিকে বাঙালিরা যেমন ছয় দফা দাবি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে তেমন এর বিপরীতে পাকিস্তানীরাও সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে থাকে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রেক্ষিতে ফুঁসে ওঠে সংগ্রামী জনতা। ৬৯ এর গণ অভ্যুথানে প্রবল প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধু ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অনান্য বন্দিদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

১৯৬৯ সালের ২ মার্চ আইয়ুব খান প্রেন্সিডেট পদ থেকে ইস্তফা দেন। ইয়াহিয়া খান ওই পদে আসীন হন। তিনি ২৮ মার্চ এক ঘোষণায় পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। তবে পাকিস্তানে ইতিপূর্বে কোনো সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়ায় এ নির্বাচন নিয়েও নানা আশঙ্কা ছিল। নির্বাচন বিষয়ে কোনো নিয়ম-কানুনও ছিল না। অবশেষে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সর্বপ্রথম ‘এক ব্যক্তির এক ভোটের ভিত্তিতে’ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (ওয়ালী), মুসলিম লীগ (কাইয়ুম), মুসলিম লীগ (কনভেনশন), পাকিস্তান পিপলস পার্টি, ডেমোক্রেটিক পার্টি, জামায়াতে ইসলামী প্রভৃতি দল অংশগ্রহণ করে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে ৬ দফার পক্ষে গণভোট হিসেবে অভিহিত করে। নির্বাচনে ৫ কোটি ৬৪ লাখ ভোটারের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে ছিল ৩ কোটি ২২ লাখ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি আসল লাভ করে। সংরক্ষিত মহিলা আসন সাতটিসহ আওয়ামী লীগ মোট ১৬৭টি আসন লাভ করেন জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আবার পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদের সংরক্ষিত ১০টি মহিলা আসনসহ মোট ৩১০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৯৮টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এ বিজয় ছিল নজিরবিহীন। আওয়ামী লীগ এককভাবে সরকার গঠন ও ৬ দফার পক্ষে গণরায় লাভ করে। এই বিজয়ে ৬ দফা ও ১১ দফার প্রতি জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক বিজয় ঘটে। অন্যদিকে পাকিস্তানের সরকার ও স্বার্থান্বেষী মহলের জন্য এটি ছিল বিরাট পরাজয়।

নির্বাচনে নিরস্কুশ বিজয় লাভের পর পাকিস্তানী সামরিক জান্তা যখন রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহান শুরু করে তখন বাঙালীর স্বাধীনতার দাবী জোরালে হয়ে ওঠে। অসহযোগ আন্দোলনের পথরেখা বেয়ে বাঙালি অবর্তীণ হয় ‘মুক্তির সংগ্রামে’ । ওপরের কথামালা থেকে এতটুকু স্পষ্ট যে বাঙালীর মুক্তির সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার পেছনে একটি সুপষ্ট রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক চেতনা কাজ করেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধু যখন শাসনভার নিলেন তখন এই রাজনৈতিক চেতনাকে মূল ভিত্তি ধরে ‘বাহাত্তরের সংবিধান’ রচিত হয়েছে। যার মধ্যে বাঙালী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার মতো অত্যাবশকীয় মূলনীতি গুলো সংযোজন করা হয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি বিপথগামী খুনীদের হাতে বঙ্গবন্ধুর মহাপ্রয়াণের পর কোনো সরকারই বাহাত্তরের সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে নূন্যতম তৎপরতা দেখায়নি। গণতন্ত্র, মানবাধিকার,ধর্মীয় স্বাধীনতা কিংবা আদিবাসী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অধিকার আজ অবধি প্রাতিষ্ঠানিক রুপ পায়নি।

ভাবতে অবাক  লাগে রাজনৈতিক চেতনার ওপর ভিত্তি করে স্বাধীন হওয়া একটি দেশে নির্বাচন এখন উপহাসে পরিণত হয়েছে। নিয়ম রক্ষার নির্বাচনে মাইকিং করেও ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনা যাচ্ছে না। ভোটারের অভাবে খা খা করছে ভোটকেন্দ্র। জাতীয় থেকে শুরু করে স্থানীয় নির্বাচনে ২৭-২৮ বড়জোর ৩০ শতাংশ ভোট কাস্ট হচ্ছে। অথচ এক সময় ভোট এদেশে উৎসব ছিলো। গণমাধ্যম কর্মীরা পত্র পত্রিকা টেলিভিশনে লিখতেন ‘ভোট উৎসব’। সেই উৎসব আজ কোথায় হারালো?

বিগত কয়েক বছরের কর্মকান্ডে ‘নির্বাচন ব্যবস্থা এবং ভোট’ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে জনগণ। এই বৈরি পরিবেশেও যারা ভোট দিতে গেছেন সরকার দলীয় সমর্থকদের হাতে তাঁদের নানাভাবে হেনস্থা হতে হয়েছে, অপমানিত হতে হয়েছে। যা আমরা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে কয়েকটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দেখেছি। একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন ভোট দিতে না পারা  ‘ভোটারদের ব্যর্থতা’ ভোট দিতে না পারা যদি ভোটারদের ব্যর্থতা হয়, তবে ভোটকেন্দ্রে ভোটদানের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে না পারা নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা।

ইদানিং দেখছি সরকার দলীয় মনোনয়ন পেলেই অভিনন্দন বর্ষণ শুরু হয়ে যায়। নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করার প্রয়োজন পড়ে না। মনোনয়ন পাওয়ার এই অভিনন্দন বার্তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাপিয়ে ছড়িয়ে গেছে পোষ্টার, ব্যানার, ফেস্টুনে। লোকজন ধরেই নিয়েছে সরকার দলীয় মনোনয়ন যিনি পেয়েছেন তিনিই হবেন জনপ্রতিনিধি তাই হয়তো এমন অভিনন্দন বর্ষণের ধারা, স্তুতিপূর্ণ বাক্যমালা প্রবাহিত হয় সর্বত্র। 

এখনকার সময়ে তাই সব কসরত ঘাম ঝরানো দলীয় মনোনয়ন পাওয়াকে ঘিরেই। দলীয় মনোনয়ন পেলেই কেল্লা ফতে। প্রার্থী এবং ভোটারদের মধ্যে এই ধারণা যত গাঢ় হচ্ছে ভোটাররা ততই কেন্দ্র বিমুখ হচ্ছেন। আর অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন বলছে ‘ইয়াং জেনারেশন ঘুম থেকে দেরি করে ওঠে তাই ভোটার কম’। ভোটের দিনে ছুটি ঘোষণারও বিরোধীতা করছেন কেউ কেউ। কিন্তু ভোটার কেন ভোটকেন্দ্র বিমুখ হচ্ছেন, কেন ভোট দিতে উৎসাহী হচ্ছেন না সেই ‘আসল’ কারণটা কেউ খতিয়ে দেখছেন না বা দেখতে চাইছেন না। তাই মুজিববর্ষে কেউ কী এই অঙ্গীকারটি করতে পারেন ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, ভোট হোক সবার’।

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত