Categories
নববর্ষ
আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
পয়লা বৈশাখ। নতুন বছরের আরম্ভ। অথচ নববর্ষের প্রাচীন ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে অগ্রহায়ণ ছিল নববর্ষের মাস। প্রচলিত বিশ্বাস হল, অগ্রহায়ণী বা মৃগশিরা নক্ষত্রের উদয়ে ধান পাকে। তাই পাকা ফসল ঘরে তোলার আনন্দ দিয়েই অগ্রহায়ণ মাসে পালিত হত নতুন বছরের উৎসব। অনেক পরে, আকবরের সময় থেকে বৈশাখ মাসকে নতুন বছরের প্রথম মাস বলে দেখানো শুরু হল, কারণ মোটামুটিভাবে সেই সময় থেকে প্রজারা চৈত্র মাসের শেষ দিনে রাজার বকেয়া খাজনা মেটাতে শুরু করল। অর্থাৎ প্রথমে ছিল প্রজার ঘর পূর্ণ হলে নববর্ষের আনন্দ, তা বদলে গেল রাজার ঘর পূর্ণ হওয়ার আনন্দ পালনে। আবার কথিত আছে গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের রাজ্যাভিষেকের দিন থেকে নতুন বঙ্গাব্দের শুরু। সেক্ষেত্রেও বিষয়টা একই, প্রজার বদলে প্রাধান্য পেল রাজার আনন্দ।
তবে চাষবাস থেকে পয়লা বৈশাখকে কখনোই দূরে সরানো যায় নি। এভাবেও বলা যায় যে পৌষমাসে যেমন নবান্ন, ফসল ঘরে তোলার উৎসব, তেমন পয়লা বৈশাখ নতুন করে কৃষিকাজ শুরু করার উৎসব। একে আমরা প্রাক-ফসলী উৎসবও বলতে পারি। অবিভক্ত বাংলায় এই দিনেই হত পুণ্যাহ উৎসব। প্রজারা যেমন খাজনা দিয়ে জমিদারের সারা বছরের ঋণ শোধ করতেন, তেমন জমিদারেরাও প্রজাদের মিষ্টি বিতরণ করতেন, কোথাও একেবারে পাত পেড়ে খাওয়াতেন, কোথাও প্রজাদের মনোরঞ্জনের জন্য নানা ব্যবস্থা করা হত–মুরগির লড়াই থেকে পুতুল নাচের আসর, কবিগান, যাত্রাপালা। জমিদার রবীন্দ্রনাথও কিন্তু শিলাইদহে এমন সব ব্যবস্থা করতেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম আলোয় খুব সুন্দর বর্ণনা আছে এই পুণ্যাহ উৎসবের।
গ্রামের মানুষের কাছে যা পুণ্যাহ, ব্যবসায়ী আর শহুরে মানুষের জীবনে তাই হালখাতার উৎসব। নববর্ষের এই দিনটিতে সবাই তাদের দেনা পরিশোধ করে আর নতুন করে হালখাতা শুরু হয়। সেই যে মহাভারতে বকরূপী ধর্মকে যুধিষ্ঠির কে সুখী, এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, -যে অঋণী থেকে দিনান্তে শাকান্ন খায়, সেই সুখী- তাই এই দিনটিতে অঋণী হয়ে খুশিতে মেতে উঠে নতুন বছর নতুন করে আরম্ভ করার দিন। এই উৎসব এখনও সমানভাবে হয়, বরং এই দুর্মূল্যের বাজারেও এই দিনে গয়নার দোকানের সামনে ভিড় দেখলে অবাক লাগে! অবশ্য ওই দিন কিছু কিনলেই খাবার প্যাকেট আর ক্যালেন্ডার পাওয়া যায়, এটাও একটা লাভ বটে! পুরোনো খদ্দেরদের তো দোকানদাররা আগে থেকেই বলতে থাকেন, দাদা, বৌদি, মাসিমা, মেশোমশাই, ওই দিন আসবেন কিন্তু! সব ধরণের দোকানেই এই নেমন্তন্ন পান ক্রেতারা।
যাঁরা লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের আবার নববর্ষের দিন দুপুর থেকে শুরু হয় কলেজ স্ট্রিট যাত্রা। ওইদিন সব প্রকাশনায়, সব বইয়ের দোকানে হইহই ব্যাপার। কেউ দুর্দান্ত ফিশফ্রাই খাওয়ান, কেউ বা দারুণ সব মিষ্টি। হাসিতে আদরে আপ্যায়নে এ ওকে পাল্লা দেন।
এবার বাংলাদেশের একটা মেলার কথা বলি। বাংলাদেশে স্বভাবতই নববর্ষের উৎসব আরোও ধুমধাম করে পালিত হয় দেশ জুড়ে, কারণ এই উৎসব তো একান্তভাবেই বাঙালীর। নানা জায়গায় মেলা বসে। তার মধ্যে সোনারগাঁও বলে একটি অঞ্চলে সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পুজো দিতে আসেন মেয়েরা। ওখানে যে মেলাটি বসে, সেটি বউমেলা বলে বিখ্যাত। মূলত মেয়েদের জন্যই এই মেলা। এখানে দেবীর পুজোয় ফল মিষ্টি ছাড়াও ধান দেওয়া হয়। কারণ অনেকের বিশ্বাস, এই দিন ভাগ্য থাকলে বনদেবী দেখা পাওয়া যায়! সেই যে, পথের পাঁচালীতে অপুর কল্পনায় বনদেবী এসে বর দিয়েছিলেন, মনে পড়ে?
তাছাড়াও কত পরিবারে কত রকম নিয়ম চালু আছে এই দিনে। কেউ তুলসীগাছের উপর ঝারি বসিয়ে দেন, যাতে সারা বছর বিন্দু বিন্দু করে জল পেতে থাকে তুলসীগাছ। কোনো বাড়িতে শুনেছি চৈত্র মাসের শেষ দিনে গুঁড়ো সাবু পায়ের তলায় ফেলে আঁশবটি নিয়ে বলতে হয় শত্রু যা শত্রু যা শত্রু যা! মানে সবকটা শত্রুকে নিকেশ করে বন্ধুবান্ধব পরিবৃত হয়ে নতুন বছরে নতুন জীবন শুরু করো!
এই দিনে খাওয়া-দাওয়ারও কত নিয়ম থাকত! এখন না হয় কিছু হলেই সব রেস্টুরেন্টে খেতে যায়! কিন্তু এখনও অনেক বাড়িতেই এই দিন নানা ধরণের তেতো খাওয়া ছিলো আবশ্যিক। সকালে চিরতার জল। তারপরে শিউলি পাতার রস কাঁচা হলুদ দিয়ে। অনেক বাড়িতেই গিমা শাক আর যুক্তি ফুল রান্না হয়। যুক্তি ফুল চেনেন তো? এর জন্য কিন্তু বাজারে একেবারে মাটিতে বসা চাষী-বউদের কাছেই যেতে হবে। ছোট ছোট সাদা সাদা ফুল। সামান্য তেতো। একটু আলুবেগুন দিয়ে ভাজা ভাজা করে রান্না করতে হয়। তোফা খেতে কিন্তু। তাছাড়া নানারকম ভাজা, ঘি-ভাত; ফ্রায়েড রাইস নয় কিন্তু, বাঙালীর ঘি-ভাত অন্য জিনিস। বাণী বসুর অষ্টম গর্ভ পড়ুন, জেনে যাবেন কী দেবদুর্লভ অথচ হালকা একটি রান্না। ভেজাল ঘিয়ের ঠেলায় ইদানীং একটু কোণঠাসা। সঙ্গে ছানার কোপ্তা, পটলের দোলমা। কাঁচা আমের অম্বল। খোসাটি থাকবে। ঝোলটি হবে পাতলা। টোকো গন্ধটি থাকবে, অথচ স্বাদটা হবে মধুর। বাঙালী কিন্তু সোনার পাথরবাটি বানাতে জানে! আর শেষ পাতে পায়েস। এই দিনটি অধিকাংশ বাড়িতেই নিরামিষ হয়। শুরুর দিনটিতে রক্তারক্তি নাই বা হল, এই হল আসল কথা। তবে মাছমাংসের ভক্তরা চিংড়ির মালাইকারি থেকে কষা মাংস বা ওই কচি পাঁঠার পাতলা ঝোল ভাত ছাড়া নতুন বছরে পা ফেলতে দ্বিধা বোধ করে! তেমন বাড়িও আছে বইকী।
ঘরবাড়ি পরিষ্কার করাও নতুন বছরে পা ফেলার আবশ্যিক একটা শর্ত। এখানে একটু নিজের ছোটবেলায় ফিরে যাই? এখনও মনে পড়ে, পয়লা বৈশাখের আগে হইচই পড়ে যেত। পরিষ্কারের কী ধূম। বাবা মইতে চড়ে দেওয়াল থেকে সব ছবি নামাতেন। আমি মুছে আবার বাবার হাতে তুলে দিতাম। তখন বাঙালী বাড়িতে খুব ছবির চল ছিল। মহাপুরুষদের ছবি, ঠাকুরের ছবি, পূর্বপুরুষেদের ছবি। আমাদের একটা বিশেষ ছবি ছিল, এখনও আছে ছবিটা, মা-বাবার স্বপ্নের একটা ছবি; অবিভক্ত ভারতবর্ষের, বর্মাটর্মা শুদ্ধু। সেটা নিয়ে আমরা খুব হাসাহাসি করতাম, মনে আছে। সেইসব পরিষ্কার হত। সব ঘরের ঝুল, ঝুলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বেচারা মাকড়সাগুলো; সমস্তকিছুকে নির্মমভাবে বহিষ্কার করা হত। পর্দা থেকে বিছানার চাদর পাল্টানো হত, নতুন কেনার টাকা মোটেও সব সময় থাকত না, কিন্তু কেচে রাখা পুরোনতুন পর্দা চাদর কাজে লাগানো হত। রান্নাঘরে মশলা রাখার কৌটো থেকে বাসন রাখার তাক- সব ঝকঝক করে হেসে উঠত। যেমন হেসে উঠতাম আমি, পরের দিন নতুন জামাটি পরে। দামটাম নিয়ে মাথাই ঘামাতাম না। ডিজাইন নিয়ে তো নয়ই। সেই ফুলতোলা টেপজামা হত, মনে আছে কি? কয়েকবার সেইটাই পেয়েছিলাম। মা আর কিছু পেরে ওঠে নি। তাতে আনন্দ এতটুকু কমে নি।
আর ছিল শুভ নববর্ষ বলার মজা! এখন তো হাইহ্যালোর যুগ। ঔপনিবেশিকতার চক্করে সেই কবে থেকে হেলেই আছি!!! Happy New Year যত বলি, তার তুলনায় শুভ নববর্ষ টিমটিম করে। Happy বলতে বলতে অভ্যস্ত বাঙালী এখন সবেতেই Happy বলে। Happy দোল, Happy দুর্গাপুজো! কোন দিন না Happy শ্রাদ্ধ বলে বসে!!
আমরা এখনও শুভ নববর্ষ বলতেই বেশি আনন্দ পাই, আন্তরিক ভাবে বলি; আর তখন তো ছোট বড় সবাই তাইই বলতো। আর তখন তো SMS না, সহজে ফোনেও না। সোজা বাড়ি বাড়ি চলে যাওয়া । মায়ের হাত ধরে লাফাতে লাফাতে মামার বাড়ি । সেখানে বাকি মামামাসীরাও চলে আসত। ফলে ভাইবোনেদের গুলতানি। সবাই সবাইকে বারবার শুভ নববর্ষ বলতাম। ওটাই মজা।
বাঙালীকে তো এখনও বাঙালী করে রেখেছে এই দুটো দিন। দুটোই বৈশাখ। পয়লা আর পঁচিশে। আসুন না, আমরা আরো একটু বাঙালী হই আবার। Happy ছেড়ে শুভ হই। Happy থাকুক না পয়লা জানুয়ারির জন্য। কিন্তু বাকি তিনশ চৌষট্টি দিন শুভ হোক। সবাইকে নতুন বছরের অজস্র শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা।
অধ্যাপিকা, শিক্ষা বিজ্ঞান বিভাগ, রামকৃষ্ণ সারদা মিশন বিবেকানন্দ বিদ্যাভবন ।
প্রাচীন ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে আগ্রহী, লেখালেখি করার বদভ্যাস আছে। পৌরোহিত্য করেন, মূলত পুরোনতুন বৈদিক পদ্ধতিতে বিবাহ দেন এবং রবিগান কঠোপনিষদ ও ঋক্ মন্ত্রসহ অন্যরকমভাবে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।