| 16 এপ্রিল 2024
Categories
লোকসংস্কৃতি

সন্ন্যাসগ্রহণ ও রাঢ় পরিক্রমায় শ্রীচৈতন্যদেব

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

ড.স্বপনকুমার ঠাকুর


নবদ্বীপের বিদ্বোৎসাহী বিদ্রোহী নিমাই পন্ডিত। ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দে কণ্টকনগরে অর্থাৎ কাটোয়ায় গুরু কেশবভারতীর কাছে সন্ন্যাস দীক্ষা নিলেন। পরিচিত হলেন প্রেম-করুণা-দয়ার মূর্ত প্রতীক মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব নামে। দিব্যোন্মাদে ছুটে চললেন বৃন্দাবনের পথে। এই সূত্রে চৈতন্য-চরণ স্পর্শে ধন্য হয়ে ওঠে রাঢ় অঞ্চল। বিশেষ করে  বর্ধমান মুর্শিদাবাদ এবং বীরভূমের  বেশ কিছু জনপদ। রাঢ়ের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে এই চৈতন্য পরিক্রমণের  অসামান্য প্রভাব আজও লক্ষ করা যায়।

মহাপ্রভু কেশবভারতীর কাছে ঠিক কোন তারিখে সন্ন্যাস দীক্ষা নিয়েছিলেন তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। বৃন্দাবন দাস তাঁর চৈতন্যভাগবতে লিখেছেন—

“এই সংক্রমণ উত্তরায়ণ দিবসে।
নিশ্চয় চলিব আমি করিতে সন্ন্যাসে।।     (মধ্যখণ্ড ২৬ অধ্যায়)

এই সূত্রে পৌষসংক্রান্তিকে বা পয়লা মাঘ মহাপ্রভুর সন্ন্যাসগ্রহণদিবস ধরা হয়। কাটোয়ার গৌরাঙ্গবাড়ি-সহ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে আজও পালিত হয় সাড়ম্বরে ১লা মাঘ মহাপ্রভুর সন্ন্যাসগ্রহণ উৎসব। কথিত আছে ২রা মাঘ থেকে ৪ঠা মাঘ এই তিনদিন তিনি রাঢ় অঞ্চল পরিক্রমা করে ৫ই মাঘ গঙ্গাপথ ধরে শান্তিপুরে আসেন। সেখানে কয়েক দিন থাকার পর নীলাচলের পথে রওনা দেন এবং ১৫১১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের গোড়ার দিকে জগন্নাথধামে পৌঁছে যান।

আধুনিক গবেষকদের মধ্যে বিশেষ করে রাধাগোবিন্দ নাথের মতে মহাপ্রভু ১৪৩১ শকে ২৯ শে মাঘ শনিবার সন্ন্যাস দীক্ষা নিয়েছিলেন এবং পরের দিন রবিবারে রাঢ় পরিক্রমা শুরু করেন। অধ্যাপক সুখময় মুখোপাধ্যায় সময়কাল নির্ণয় করেছেন ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারি। বিশিষ্ট গবেষক হিতেশরঞ্জন সান্যালের মতে, তারিখটি ছিল ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে জানুয়ারি এবং তাঁর মতে মহাপ্রভুর রাঢ় ভ্রমণকালের ব্যাপ্তি ছিল ৭-৮ দিন।

মুরারি গুপ্তের কড়চানুসারে মহাপ্রভুর মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রজভূমি অর্থাৎ বৃন্দাবন গমন এবং এই জন্যই তাঁর রাঢ় পরিক্রমা। কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ এই মতের সমর্থন জানিয়ে লিখেছেন –

সন্ন্যাস করি প্রেমাবেশে চলিলা বৃন্দাবন।
রাঢ়দেশে তিনদিন করিলা ভ্রমণ।।

কিন্তু চৈতন্যভাগবত রচয়িতা বৃন্দাবন দাসের মতে প্রগাঢ় ভাবাবেশে মহাপ্রভু রাঢ়ের বক্রেশ্বরের অরণ্যে কৃষ্ণ ভজনার জন্য ধাবিত হয়েছিলেন –

প্রভু বলে বক্রেশ্বর আছেন যে বনে ।
তথায় যাইমু মুঞি থাকিমু নির্জনে।।

বৃন্দাবন দাসের সমর্থনে অবশ্যই যুক্তি দেওয়া যায়। কবি নিত্যানন্দদাসের প্রেমবিলাসকাব্য অনুসারে মাধবেন্দ্রপুরীর শিষ্য ছিলেন কেশবভারতী। কবি কর্ণপুরের গৌরগণোদ্দেশদীপিকায় মাধবেন্দ্রপুরীকে মাধ্ব সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী বলা হয়েছে। সুতরাং প্রাতিষ্ঠানিক দিক থেকে স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেবও এই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। অক্ষয়কুমার দত্তের “ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়” গ্রন্থ থেকে জানা যায়, মাধ্বগোষ্ঠীর সন্ন্যাসীরা বিষ্ণুর সঙ্গে শিবপূজা করতেন। মহাপ্রভু সন্ন্যাসী হিসাবে অত্যন্ত নিয়ম-নিষ্ঠ ছিলেন – এ-কথা চৈতন্যজীবনীকারেরা তাঁদের কাব্যে বারংবার ঘোষণা করেছেন। চৈতন্যভাগবতের অন্ত্যখণ্ডের চতুর্থ অধ্যায়ে অদ্বৈত আচার্যের গৃহে মাধবেন্দ্রপুরীর আরাধনা ও শিবপূজার কথা সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে এবং মহাপ্রভু সপরিকর তাতে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। সুতরাং এই দিক থেকে দেখতে গেলে বৃন্দাবন দাস সঠিক তথ্য দিয়েছেন বলেই মনে হয়।

কাটোয়ায় সন্ন্যাস গ্রহণের পরের দিন মহাপ্রভু সপরিকরে প্রবল ভাবাবেগে ছুটে চললেন অজয় নদীর তীর ধরে, ঝোপ-ঝাড় ভেঙে। অজয়ের বাঁকে প্রাচীন জনপদ রসুই। তখন তাঁর অন্য নাম। এ গ্রামের মাঠের বটতলায় মহাপ্রভু দিলেন আরামের নিদ্রা। এখানেই হলো মধ্যাহ্নের আহারের আয়োজন। ঘুম থেকে উঠে ভোজন সাঙ্গ করে পরিতৃপ্ত মহাপ্রভু বলে উঠলেন – এ গ্রাম রসবতী। তার থেকেই গ্রামনাম পালটে হয়েছে রসুই। জয়ানন্দের  চৈতন্যমঙ্গলের বিজয়খণ্ড থেকে জানা যায় প্রভু নিত্যানন্দ তাঁর সাঙ্গ-পাঙ্গদের নিয়ে বিচিত্র অবধূত বেশে নাম সংকীর্তন প্রচারের উদ্দেশে রাঢ়ের নৈহাটি হাটাই চরখি হয়ে বেলেড়া রসুই জনপদে এসেছিলেন। রসুই গ্রামবাসীরা বিশ্বাস করেন মহাপ্রভু তাদের গ্রামে এসেছিলেন ৪ঠা মাঘ। সেই উপলক্ষে নানাবিধ বৈষ্ণবানুষ্ঠান আজও জাঁকজমকের সঙ্গে  পালিত হয়ে চলেছে।

বাসু  মাধব গোবিন্দ ঘোষ – এই তিন ভাই তথা বিশিষ্ট চৈতন্যপরিকরের জন্মস্থান কাটোয়া মহকুমার কেতুগ্রামের কুলাইগ্রাম। এরই দক্ষিণ দিকে অবস্থিত অজয়তীরবর্তী মহাপ্রভুর স্মৃতিধন্য ন-পাড়া বিশ্রামতলা। এখানেও তিনি সাময়িক ভাবে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। স্থানটি বেশ প্রাচীন। রয়েছে সুপ্রাচীন বটবৃক্ষ। এ সম্পর্কে উনিশ শতকের বিশিষ্ট লেখক ভোলানাথ চন্দ্র তাঁর The Travels Of A Hindoo To Various Parts Of Bengal And Upper India গ্রন্থে মহাপ্রভুর বিশ্রাম সম্পর্কে  লিখেছেন – “….Out of breath, tired and sunburnt, he sat down under the shade of this banian to repose his weary limbs. The spot has thence received the name of Bisramtullah, or resting-place.To appearance, the banian tree looked old and hoary enough to be the identical tree—or it may be, that they preserve a plant to cherish a memory of the spot.” page no 29

এখনও সেই বটতলায় ছড়িয়ে রয়েছে নাম না জানা কত মহান্তদের স্মৃতি স্মারক। ছোট্ট এক মন্দিরে রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহের পাশে নাড়ুগোপাল মূর্তি। দক্ষিণে অজয়ের ধূ ধূ বালুচর। এই মন্দিরে কাটোয়া থেকে আগত গৌর-নিতাইএর দারু বিগ্রহ পূজিত হয় ১৪ ই জ্যৈষ্ঠ থেকে ১৫ই ভাদ্র। ২রা মাঘ হয় মূল উৎসব। এখান থেকে মহাপ্রভু রাজুর খালা প্রভৃতি গ্রাম অতিক্রম করে বীরভূম জেলার বাহিরীগ্রামে উঠেছিলেন।

বোলপুর থানার বাহিরীগ্রামে রয়েছে শ্রীচৈতন্য মঠ। বৃহৎ মন্দিরের প্রাঙ্গণে প্রাচীন বৈষ্ণব সাধকদের অন্তত ২৫টি ‘সমাজ’ লক্ষ করা  যায়। অতি প্রাচীন প্রত্নসমৃদ্ধ জনপদ। গ্রামের দক্ষিণ দিকে মহাপ্রভুর চরণাঙ্কিত স্থানে গড়ে উঠেছে প্রাচীন “বাহিরীশ্রীশ্রী চৈতন্য মঠ”। কাটোয়ার মাধাইতলা থেকে ১লা আশ্বিন গৌর-নিতাই দারুবিগ্রহ বাহিরী আশ্রমে আসেন। সন্ন্যাস উৎসব ছাড়াও রাসপূর্ণিমা ও বৈশাখ মাসে বিশেষ পূজাপাঠ হয়। মহাপ্রভু এই গ্রাম থেকে নাকি মুলুকগ্রাম গিয়েছিলেন। কিন্তু সে সম্পর্কে বিস্তারিত কোন তথ্যাবলী পাওয়া যায় না। কবি বৃন্দাবন দাস লিখেছেনঃ

ক্রোশ চারি সকলে আছেন বক্রেশ্বর ।
সে স্থানে ফিরিলেন শ্রীগৌর সুন্দর।।

বক্রেশ্বর থেকে চার ক্রোশ দূরে কোন এক স্থান থেকে দিব্যোন্মাদ মহাপ্রভুকে পূর্বাভিমুখী করা হয়েছিল। এখন প্রশ্ন হলো সেই স্থানটি কোথায়? সিউড়ি শহরের দুমাইল দক্ষিণে একটি প্রাচীন গ্রাম রয়েছে। তার নাম পান্ডুরি। এখানেও একটি বিশ্রামতলা রয়েছে। গ্রামবাসীদের মতে মহাপ্রভু এখানে বিশ্রাম নেওয়ার পর নিত্যানন্দের তৎপরতায়  শান্তিপুরের দিকে অগ্রসর হন।

 

প্রত্যাবর্তনের পথে তিনি আরও দুটি স্থানে বিশ্রাম করেছিলেন। দুটি স্থানই বর্তমানে মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত এবং কুয়ে নদীর তীরে অবস্থিত। ভরতপুরের দু মাইল উত্তরে বিশ্রামতলা এবং দেড় মাইল উত্তর পূর্বে ধোয়াঘাট। এখানে মহাপ্রভু নাকি কুয়েনদীতে হাত-পা প্রক্ষালন করে সাময়িক বিশ্রাম নিয়েছিলেন। কেউ কেউ বলেছেন ফেরার সময় তিনি নাকি মঙ্গলকোট নতুনহাটে অজয় পার হয়ে এসেছিলেন এবং মাথরুনের সন্নিকটে একটি গ্রামে তাঁর স্মৃতি ফিরে পেয়েছিলেন। তার থেকেই গ্রামনামটি পরিবর্তিত হয়ে চৈতন্যপুর নামকরণ হয়। এ গ্রামটিও বেশ প্রাচীন। এখান থেকে মিলেছে বিরল নিদর্শন বিষ্ণুর এক আভিচারিক মূর্তি। বর্তমানে এটি ভারতীয় যাদুঘরে রয়েছে।

ফেরার পথে মহাপ্রভু বিখ্যাত বৈষ্ণব কবি জ্ঞানদাসের জন্মভূমি কাঁদরা গ্রামে গিয়েছিলেন এবং এক রাত্রি বাস করেছিলেন মঙ্গল ঠাকুরের গৃহে। কাঁদরা গ্রামে মহাপ্রভুর স্মৃতিময় স্থানটি গৌরাঙ্গডাঙ্গা নামে সুপরিচিত। বর্তমানে একটি ছোট মন্দির করা হয়েছে। সম্মুখ দেওয়ালে লেখা আছে “১৪৩১ শকে ৩রা মাঘ সন্ন্যাস গ্রহণের তৃতীয় দিনে মঙ্গল ঠাকুরের গৃহে মহাপ্রভু এক রাত্রি অবস্থান করেন।”

শ্রীচৈতন্যদেব সতীপীঠ কেতুগ্রামের ভৈরবতলার চণ্ডীমন্ডপে বসে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। এখানকার চট্টোপাধ্যায় বংশের জনৈক ব্যাক্তির কাছে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য জল পান করেছিলেন। আগে ভৈরবের স্থানে প্রচুর পশুবলি হতো। মহাপ্রভুর সম্মানার্থে পরে বলিপ্রথা উঠে যায়। কেতুগ্রাম থেকেই নাকি মহাপ্রভুকে ঈশানী নদীপথে উদ্ধারণপুর এবং সেখান থেকে গঙ্গাপথে শান্তিপুর নিয়ে যাওয়া হয়।

এই জনপদগুলি ছাড়াও মহাপ্রভু বিভিন্ন সময়ে অগ্রদ্বীপ শ্রীখণ্ড ভাতার-সেবাগ্রাম দামোদর নদের উত্তরতীরে নতু গ্রামে একরাত্রি বিশ্রাম করেছিলেন। নতু থেকে ছোটবৈনান প্রভৃতি  জনপদে এসেছিলেন বলেও দাবি করা হয়।

 

 

 

কৃতজ্ঞতা: বঙ্গদর্শন

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত