পাখির দেশ প্যাংগট
পাহাড়ে বেড়াতে ভালবাসেন? চান প্রকৃতির কোলে এক নিবিড় শান্তির খোঁজ? জঙ্গলও চাই? ভিড়ভাট্টা বাদ পড়লেই ভাল? তবে ঘুরে আসুন প্যাংগট। উপরি পাওনা হিসেবে পাবেন রকমারি, রংবাহারী পাখি। কুমায়ূনের বিখ্যাত শহরগুলির মধ্যে নৈনিতালের খুব কাছেই, মাত্র ১৫ কিমি দূরত্বে। লিখছেন পুজা সেনগুপ্ত দে।
পাহাড়ে বেড়াতে ভালবাসেন? চান প্রকৃতির কোলে এক নিবিড় শান্তির খোঁজ? জঙ্গলও চাই? ভিড়ভাট্টা বাদ পড়লেই ভাল? তবে ঘুরে আসুন প্যাংগট। উপড়ি পাওনা হিসেবে পাবেন রকমারি, রংবাহারী পাখি। কুমায়ূনের বিখ্যাত শহরগুলির মধ্যে নৈনিতালের খুব কাছেই, মাত্র ১৫ কিমি দূরত্বে। লিখছেন পুজা সেনগুপ্ত দে।
অক্টোবর মাসে পুজোর ছুটিতে বাঙালি পর্যটক যখন নৈনিতালের অলিগলি ভরিয়ে ফেলেছেন, আমরা তখন রওনা দিলাম প্যাংগটের পথে। নৈনিতাল থেকে চলার পথটি চিনা পিক রেঞ্জের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। ঘন জঙ্গল, ওক, পাইন ও রডোডেনড্রন গাছে ছাওয়া। বেশ নির্জন পথ। গাড়ির সমাগম নেই। এই জঙ্গলে কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণীর বসবাস থাকলেও প্রধানত পাখি দেখার জন্য পর্যটকরা এই পথে এসে থাকেন। সম্পূর্ণ চড়াই রাস্তাটি ধরে বেশ কিছুদূর যাওয়া হল। হঠাত্ করে পথের ডানদিক জুড়ে শ্বেতশুভ্র হিমালয় পর্বতশ্রেণীর আবির্ভাব। বিখ্যাত সব শৃঙ্গনন্দাদেবী, ত্রিশূল, পঞ্চচুল্লী দৃশ্যমান। গাড়ি থেকে নেমে প্রথম সূর্যালোকের প্রতিফলনে তাঁদের স্নিগ্ধ রূপ দেখেই কেটে যায় কিছুক্ষণ। আবার চলার শুরু। শেষের পথটুকু যাওয়ার সময়ই আমরা বেশ বুঝতে পারছিলাম যে পাখিদের রাজ্যে এসে পড়েছি। গাছের ডালে-ডালে তাদের কিচিরমিচির ডাক গাড়ির শব্দকে ছাপিয়ে কানে আসছিল। কিন্তু দেখা মিলছিল না। স্বভাব ভীরু পাখিদের দেখা পেতে যতটা নিস্তব্ধতা প্রয়োজন গাড়িতে চলতে-চলতে সেটা পাওয়া সম্ভব নয়। আর কিছুদূর এগোতেই মাইলফলক জানিয়ে দিল যে আমরা প্যাংগট পৌঁছে গেছি।
প্যাংগট একেবারেই ছোট একটি গ্রাম। গুটিকয়েক গ্রাম্য বাড়ি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। বাড়িগুলি নিচু, তাদের টিনের ছাদ, মেটে রং। চোখে পড়ার মতো কিছু নেই। গ্রামের মাঝ বরাবর একটা মাত্র রাস্তা এঁকেবেঁকে গিয়েছে, যার ওপর পিচের প্রলেপটুকু চোখে পড়ল না। গ্রামের মধ্যে একটাই চায়ের দোকান। তারপাশে পঞ্চায়েত অফিস দেখতে পেলাম। উলটোদিকে ডাকঘর। ডাকঘরেরই একদিকে আবার মুদিখানা। ছোট্ট গ্রামখানি আকাশ ছোঁয়া পাইন রডোডেনড্রন গাছে ঘেরাঠিক যেন ছবি। এমন জায়গায় পাখি দেখতে পাবেন না তো কোথায় দেখবেন! প্যাংগটে ইতি উতি ঘুরবেন আর তখনই আপনার আশেপাশে দেখতে পেয়ে যাবেন ম্যাগপাই, ব্ল্যাক হেডেড জে, লার্জ বিলড ক্রো।
প্যাংগটে থাকার জায়গা খুব বেশি নেই। এদের মধ্যে ‘জাঙ্গল লোর’ রিসর্টটিতে থাকার সুযোগ পেলে অবশ্যই থাকুন। এই রিসর্টটি যেন পাখি দেখার জন্যই তৈরি। এখানকার কটেজগুলিকে জঙ্গলের ভিতরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে প্রকৃতির সঙ্গে যোগাযোগটুকু ছিন্ন না হয়। ফলে প্রচুর গাছগাছালির মাঝে পাখিদের আনাগোনা অব্যাহত। এখানে গাছে-গাছে পাখিদের জন্য উপযোগী খাদ্য ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করা আছে। ফলে আপনি আপনার কটেজের বারান্দায় বসে বসেই দেখে নিতে পারবেন গ্রে বুসচ্যাট, ব্লু হুইসলিং থ্রাস বা ইউরেশিয়ান জে’দের ওড়াউড়ি। বাইনোকুলারে চোখ লাগিয়ে দেখে নিন ব্লু থ্রোটেড ফ্লাইক্যাচারের পোকা ধরা।
‘জাঙ্গল লোর’-এ থাকলে সারাদিন নাম না জানা পাখিদের সঙ্গে আপনার মোলাকাত হতেই থাকবে। ওখানকার কর্মচারীদের জিজ্ঞেস করুন, তাঁরাও আপনাকে চিনিয়ে দেবেন পাখিদের। নাগাল্যান্ডের মেয়ে, কলকাতায় পড়াশোনা করা অ্যালেম এই রিসর্টটির ম্যানেজার। অতিথিদের দেখাশোনা, যত্ন, হিসেব-নিকেশসব দক্ষ হাতে সামলানোর পরও হাসিমুখে আড্ডা দিতে বসে পড়তে পারেন তিনি। কলকাতা থেকে এসেছি শুনলে জানতে চান ফেলে যাওয়া কলেজ, শহরের কথা।
পাখি দেখতে হলে সূর্য ওঠার ঘণ্টাখানেক আগে আপনাকে দিন শুরু করতে হবে। স্থানীয় গাইড পাবেন যাঁরা আপনাকে সঙ্গে করে জঙ্গলের ভিতরে নিয়ে যাবেন পাখি দেখাতে। গ্রামে গিয়ে আপনি নিজেও গাইড ঠিক করতে পারেন অথবা হোটেল থেকেও গাইডের বন্দোবস্ত করে দেওয়া হয়। গাইডের সঙ্গে জঙ্গলের ভিতরে হাঁটতে হাঁটতে হয়তো আপনি দেখে ফেলবেন রকমারী ফেজান্ট চির, কেকলাস বা কালিজ। নাম না জানা নানা বাহারী পাখি দেখতে-দেখতে, তাদের আশ্চর্য মধুর ডাক শুনতে-শুনতে হাঁটতে থাকুন। উপভোগ করুন পাহাড়ের নিস্তব্ধতা। ভাগ্যে থাকলে এক আধটা বার্কি ডিয়ার বা সম্ভব চোখে পড়তে পারে। লেপার্ড তো হিমালয়ে আছেই। তবে তাকে দেখার আশা না করাই ভাল। ক্লান্ত হয়ে হোটেলে ফিরে জমিয়ে ব্রেকফাস্ট করুন তারপর নিজের মতো বাকি সময়টা কাটান। সূর্যাস্তের আগে পাখিদের নীড়ে ফেরার সময় যদি তাদের দেখা চান, গাইড আবার আসবেন দ্বিতীয়বার আপনাকে জঙ্গলের কাছে নিয়ে যেতে। আর তা যদি না চান তো দুপুরের রোদ গায়ে মেখে গ্রামের একমাত্র চায়ের দোকানটিতে গিয়ে বসে পড়ুন। গল্প করুন স্থানীয় গ্রামবাসীদের সঙ্গে শুনুন কত সামান্য ব্যবস্থায় এই পাহাড়ি মানুষগুলি তাঁদের জীবন অতিবাহিত করেন। মন ছুঁয়ে যাবে এঁদের সারল্য।
সব সুন্দরের মধ্যে একটিই অসুন্দর বা বলা ভাল আশঙ্কা মনকে পীড়া দেয়। এখানে সেখানে নির্মীয়মান কয়েকটি বহুতল হোটেল। উচ্চকিত পর্যটন অচিরেই ছাপ ফেলতে চলেছে পাখিদের রাজত্বে। পর্যটনের আধিক্য বেড়ে গেলে পাখিরা কি আর এমন কলকাকলিতে ভরিয়ে রাখবে প্যাংগটের? একরাশ আশঙ্কা নিয়ে প্যাংগট ছেড়ে এলাম এবারের মতো।
কীভাবে যাবেন
দিল্লি বিমানবন্দর থেকে ৩১.৬ কিমি (৭ ঘণ্টার মতো মোটর পথ)। নিকটতম রেলস্টেশন কাঠগোদাম, ৫০ কিমি দূরত্বে। যাওয়া আসার জন্য গাড়ি বুক করুন।
কোথায় থাকবেন
জাঙ্গল লোর, বডিং লজ: অনলাইন বুক করুন www.pangot.com
দ্য নেস্ট কটেজেস: www.thenestcottages.com
অশোকাস নৈনি শ্যালে: www.ashokasnainichalet.com
যাওয়ার সেরা সময়
অক্টোবর থেকে মার্চ। প্রচণ্ড শীতে বরফে ঢেকে যায়।
সঙ্গে রাখুন
মশা ও পোকা মাকড়ের কাপড় থেকে বাঁচার ক্রিম, টর্চ, ভাল ক্যামেরা।
কৃতজ্ঞতাঃ সানন্দা
