প্রিয় কবিতা
প্রিয় কবিতা বলে যেসব কবিতা দেয়া হয়, আদতে তা সবার প্রিয় না ও হতে পারে। ইরাবতী চায় পাঠকদের কবি ও তার কবিতার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। তাই পড়ার একটা তাগিদ তৈরির প্রচেষ্টা এই প্রিয় কবিতা।
ভাবনার কোলাজ । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
একটা মেল ট্রেনের হঠাৎ ড্রাগন সাজার ইচ্ছে হয়েছিল
আগুন নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে সে যখন শূন্যে লাফ দিতে উদ্যত
পাহাড়ের চুড়া থেকে এক জাদকর বললো, দাস্ ফার, এন্ড নো ফারদার!
একটু দূরে মুচকি হেসেছিল সমুদ্র।
একটি রমণীকে উপহার দিতে গেলাম গুঞ্জাফুলের মালা
সে বললো, আমি টিশিয়ানকে ভালোবাসি, আমায়
মুখ ফেরাতে বলো না!
শিল্পের নারীরা কখনো মুখ ফেরায় না
মাটির প্রতিমাই শুধু গলে গলে যায়
শিল্পের নারীরা পতঙ্গভুকের মত শিল্পীকেও খেয়ে
হজম করে ফেলে
তার বুক ছেঁড়া জামাও কেউ চেয়ে দেখে না
এত অন্ধকার, চাঁদের ওপিঠের মতন চির অন্ধকার
তার জঠরে
বাসি ফুল আর বেলপাতায় দাপাদাপি করে ধেড়ে ধেড়ে ইঁদুর
শব্দে গাঁথা মালাটা কচমচিয়ে খেয়ে যায় ছাগলে…
এবার সমুদ্রের পালা
সে মেল ট্রেনকে বললো, ভাঙো, ভাঙো, ব্রিজটা ভেঙে
ঝাঁপ দাও খাড়িতে
ওসব জাদুকর ফাদুকর, রাজা-গজা আমি ঢের দেখেছি
ওদের কারুকে দেখেছো তোমার ছন্দপতন নিয়ে চোখের
জল ফেলতে
যে চোখের জলকে ওরা বলে কবিতা!
নিঃসঙ্গতা । আবুল হাসান
অতটুকু চায়নি বালিকা!
অত শোভা, অত স্বাধীনতা!
চেয়েছিল আরো কিছু কম,
আয়নার দাঁড়ে দেহ মেলে দিয়ে
বসে থাকা সবটা দুপুর, চেয়েছিল
মা বকুক, বাবা তার বেদনা দেখুক!
অতটুকু চায়নি বালিকা!
অত হৈ রৈ লোক, অত ভীড়, অত সমাগম!
চেয়েছিল আরো কিছু কম!
একটি জলের খনি
তাকে দিক তৃষ্ণা এখনি, চেয়েছিল
একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী!
ভ্রমণ বিষয়ক লেখা। শ্রীজাত
শার্সিতে তার ঝাপটায় অভিমান
দুপুর, তাতে খিদে পাওয়ার রং
বৃষ্টিধোয়ায় ঝাপসানো এক সীমা…
রেলিং তাতে স্বপ্নে দেখা জং
বয়েস কেবল লুকনো বর্ষতি
স্যান্ডউইচে নিঝুম সেলোফেন
মেঘে কামড়, নিকিয়ে সস চাটি
টেবিল, তাতে দুপুরবাঁধা চেন
দুরে কোথাও জাহাজ থামার ডক
জল পেরনো খামার তারও দুরে
ভবঘুরের মুখোশে তার শখ
এক জন্ম । তারাপদ রায়
রাষ্ট্রপ্রধান কি মেনে নেবেন? । শহীদ কাদরী
চেয়ার, টেবিল, সোফাসেট, আলমারিগুলো আমার নয়
গাছ, পুকুর, জল, বৃষ্টিধারা শুধু আমার
চুল, চিবুক, স্তন, ঊরু আমার নয়,
প্রেমিকের ব্যাকুল অবয়বগুলো আমার
রাষ্ট্রপ্রধান কি মেনে নেবেন আমার প্রস্তাবগুলো
কবিতার লাবণ্য দিয়ে নিজস্ব প্রাধান্য বিস্তার
অন্তিমে উদ্দেশ্য যার?
কুচকাওয়াজ, কামান কিম্বা সামরিক সালাম নয়
বাগানগুলো শুধু আমার
মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, আন্তর্জাতিক সাহায্য তহবিল নয়
মিল-অমিলের স্বরবর্ণগুলো শুধু আমার
রাষ্ট্রপ্রধান কি মেনে নেবেন আমার প্রস্তাবগুলো
পররাষ্ট্রনীতির বদলে প্রেম, মন্ত্রীর বদলে কবি
মাইক্রোফোনের বদলে বিহ্বল বকুলের ঘ্রাণ?
টেলিফোন নয়, রেডিও নয়, সংবাদপত্র নয়
গানের রেকর্ডগুলো আমার
ডিক্টেশন নয়, সেক্রেটারি নয়, শর্টহ্যাণ্ড নয়
রবীন্দ্রনাথের পোর্টেটগুলো আমার
রাষ্ট্রপ্রধান কি মেনে নেবেন আমার প্রস্তাবগুলো
জেনারেলদের হুকুম দেবেন রবীন্দ্রচর্চার? মন্ত্রীদের
কিনে দেবেন সোনালি গীটার? ব্যাঙ্কারদের
বানিয়ে দেবেন কবিতার নিপুণ সমঝদার?
রাষ্ট্রপ্রধান কি মেনে নেবেন আমার প্রস্তাবগুলো?
গীতবিতান ছাড়া কিছু রপ্তানি করা যাবে না বিদেশে
হ্যারিবেলাফোন্তের রেকর্ড ছাড়া অন্য কোনো আমদানি,
প্রতিটি পুলিশের জন্য আয়োনেস্কোর নাটক
অবশ্য পাঠ্য হবে,
সেনাবাহিনীর জন্য শিল্পকলার দীর্ঘ ইতিহাস;
রাষ্ট্রপ্রধান কি মেনে নেবেন আমার প্রস্তাবগুলো.
মেনে নেবেন?
রুটিন । বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
গ্রাম দিয়ে ঘেরা শহরকে, আর
চোখ দিয়ে ছেড়া দৃশ্য
ভিখিরিকে করো নিঃস্ব
কৃষ্ণচূড়াকে সাদা করে দাও
কাড়ো অন্ধের যষ্টি
নকশি কাঁথায় একটা নকশা
তোলো তো পষ্টাপষ্টি
মুখেভাতে কেউ ছড়া চায় যদি
লিখে দিও এপিটাফ
পুণ্যের গাছ আলো করে আছে
আবহমান পাপ
ঠোঁট দিয়ে প্রাণপণ চাপো ঠোঁট
জিভ দিয়ে টানো জিভ
দ্যাখো, আদমের পীঁজর ফাটিয়ে
বেরিয়ে আসছে ইভ
আহত হবার দিন । শঙ্খ ঘোষ
আহত হবার দিন তােমার মুখের রেখা ঠিক
কতখানি ঢেউ দেয়, ভাবাে।
এত কি সহজে ধরা দেবে?
চলে এসাে এইখানে, এসাে এই গঙ্গার কিনারে
শ্মশানের পাশে বসে সামনে তাকিয়ে দেখাে। দেখাে বহমান
ভাবাে এর ইতিহাস, ভাবাে-বা পরাণ, কথকতা,
কত মেঘমন্ডলের অন্ধকার শুষে নিয়ে জেগে ওঠে রুপােলি বলয়, বলাে
‘আমিও কি ততখানি নই?’
আহত হবার দিন তােমার মুখের রেখা দেখে
কীভাবে জানবে কেউ? কেউ কিছু জানতেও পারে না তুমি জয়ী।
ঘর । মন্দাক্রান্তা সেন
ঘর বলতে ছায়ায় ঘেরা বাড়ি
দূয়োর খুলে উঠোনে পা পড়ে
ঘর বলতে ফিরব তাড়াতাড়ি
ঘর বলতে তোমায় মনে পড়ে
ঘর বলতে মাঠের পরে মাঠ
আলের ধারে রোদ মেলেছে পা
দিঘির কোলে ভাঙা শানের ঘাট
ভাত রেঁধেছি, নাইতে যাবে না?
ঘর বলতে সন্ধে নেমে এলে
পিদিম জ্বেলে বসব পাশাপাশি
নিঝুম পাড়া, আটটা বেজে গেলে
দূরের থেকে শুনব রেলের বাঁশি
ঘর বলতে সমস্ত রাত ধরে
ঘুমের চেয়েও নিবিড় ভালোবাসা
ঘর বলতে তোমার দুচোখ ভরে
স্বপ্নগুলো কুড়িয়ে নিয়ে আসা
ঘর বলতে এসব খুটিনাটি
ঘর বলতে আকাশ থেকে ভূমি
একদিকে পথ বিষম হাঁটাহাঁটি
পথের শেষে, ঘর বলতে – তুমি।।
সরল রেখার জন্য । জগন্নাথ চক্রবর্তী
সামান্য একটা সরল রেখার জন্য মাথা খুঁড়ছি,
পাচ্ছি না।
পৃথিবীতে কোথাও একটা সরল রেখা নেই,
আকাশ অপরাজিতা নীল, কিন্তু গোলাকার,
দীগন্তও চক্রনেমিক্রম,
নদী আঁকাবাঁকা, পাহাড় এবড়োখেবড়ো,
হ্রদ চ্যাপ্টা, উপকূল বুকে হাঁটা সরীসৃপের মত খাঁজকাটা,
কুকুরের লেজ কুন্ডলী, হরিণের শিং ঝাঁকড়া,
গোরুর খুর দ্বিধা, আর গ্র্যান্ডট্র্যাঙ্ক রোড উধাও
কিন্তু এলোমেলো।
সৃষ্টিতে সরলরেখা বোধহয় জন্মায়নি।
যত দাগ সব হয় ডিম, নয় নারকেল, নয়ে কলার মোচা,
বৃত্ত, উপবৃত্ত ইত্যাদি,
একটাও সোজা নয়।
কোনো মানুষই সোজা নয়
তাই বোঝা শক্ত।
মাথার উপর সূর্য – জবাকুসুম –
তিনিও সোজা চলেন না,
উত্তরায়ন থেকে দক্ষিণায়ন
মাতালের মত টলছেন।
সোজা কিছুই চোখে পড়ছে না।
তোমার চোখের ঈষৎ ভাষাও
আমার বুকের মধ্যে এসে কেমন যেন বেঁকে যাচ্ছে,
আর আমার সোজা ইচ্ছেটাও তোমার দ্বিধার মধ্যে
কেবলি কৌণিক।
সামান্য একটা সরল রেখার জন্য
আমরা বসে আছি।।
শিলা । নবনীতা দেব সেন
চল্লিশ বছর হলাে
দেখা হয়নি।
এমনকি স্বপ্নেও —
এমনকি স্বপ্নেও আপনি
চূড়ান্ত সাবধানী
সুরক্ষাচক্রের মধ্যে সতর্কে লুকোন ৷
তথাপি সে শাদা কার্নেশন
চল্লিশবছর ধরে ফুটে থাকে
অন্ধকার মাঠে
উইপিং উইলােকে ছুঁয়ে
বহে যায় সানবনার ধারা
নদীতে প্রবাসী নৌকো
দাঁড় টানছে পূর্বজন্ম বসে।
এত সব সত্য, তবু
চল্লিশ বছর ধরে দেখা হয় না, দেখা
হয় না, দেখা হয় না, এমন কি স্বপ্নেও
অথচ দেখুন।
কবরখানার শিলা
কীরকম ত্রস্ত কেঁপে ওঠে —
অতিবৃদ্ধ শ্যাওলার ওপরে
গােলাপ পাপড়ির ছোঁয়া পেলে?