| 17 এপ্রিল 2024
Categories
শিশুতোষ সাহিত্য

শিশুতোষ গল্প: একঝাঁক রঙিন প্রজাপতি । সোমা দে

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

মিঠাইয়ের ভীষণ মন খারাপ। কতদিন হয়ে গেল! সপ্তাহ পেরিয়ে মাস! বাসার দরজা আর খোলে না। স্কুল নেই। মা- বাবার সাথে বেড়াতে যাওয়া নেই। এমনকি ভাই- বোনদেরও দেখা নেই। মিঠাই কেবলি ভাবছে আর ভাবছে আবার কবে দেখা হবে সবার সাথে। মিঠাইয়ের ভাই-বোনের সংখ্যা অনেক। তারা থাকেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে। প্রতিবেশী দুই ভাই সবুজ আর রোদ্দুর। থাকে এ বাড়ির পাঁচ তলায়। ঠিক মিঠাইদের মাথার ওপরের ফ্ল্যাটে। সেই ফ্ল্যাটের পাশেই থাকে চশমা পরা রায়া আর এত্ত টুকুন টিয়া। মিঠাইয়ের দুই বোন। আরও আছে মিঠাইয়ের মার বন্ধুর মেয়ে টুকটুকি। মিঠাইদের পাড়াতেই থাকে। সেও আরেকটা বোন। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা বেশ বড়। পাঁচ। আর মিঠাইকে নিয়ে হল ছয়।

এই ছয় জনের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে বড় মিঠাই। সবার মধ্যমণি। মিঠাইকে নিয়ে ভাই-বোনদের মধ্যে বেশ কাড়াকাড়ি চলে। সবাই দিদির প্রিয়পাত্র হতে চায় । মিঠাইও সবাইকে নিয়ে ভাবে। ওদের ভাল-মন্দ দেখে। রায়া বড় ভাল মেয়ে। মিঠাই দিদি যা করে, রায়ারও তাই করা চাই। তাইতো মিঠাইয়ের মত লেখা-পড়া, ছবি আঁকা সব কিছুতে রায়ারও জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু আজকাল রায়ার মুখ থেকে সেই মিষ্টি হাসিটি যেন উধাও হয়ে গেছে। বোন টিয়ার জন্মের পর থেকেই এমনটা হচ্ছে। রায়ার মনে হয়, টিয়াকে বাপি-মামনি একটু বেশি ভালবাসে। টিয়াও তেমনি হয়েছে বাবা! হামাগুড়ি দিয়ে কেবলই রায়ার দিকে আসতে চায়। রায়ার আঁকা ছবি ছিঁড়ে কুটি কুটি করে। রায়ার খেলনা ভেঙে ফেলে হরদম। তাও কেউ টিয়াকে কিছু বলে না। রায়ার তাই ভাল লাগে না। মন বেশি খারাপ হলে সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ডাকে, ”মিঠাই দিদি, আমি আসতে পারি, তোমার কাছে?”
নিচ তলা থেকে মিঠাই বলে, “দাঁড়াও, হোমটাস্ক সেরে নেই। এক ঘণ্টা পরে আসতে পারো।”

ঠিক এক ঘণ্টা বাদে কলিং বেল বেজে ওঠে। দরজার ওপাশে পিঙ্ক ফ্রেমের চশমা পড়া রায়ার দেখা মেলে। তারপরে দু’ জনে মিলে এই গল্প, সেই গল্প -কত কী যে চলে!

সবুজ আর রোদ্দুরকে নিয়ে মিঠাইয়ের বড্ড ভাবনা। ওরা কি কোনদিনও শান্ত -শিষ্ট হবে না! মাথার ওপরে দিন-রাত গুটি গুটি পায়ের শব্দ শোনা যায়। সবুজ আর রোদ্দুর দুপদাপ হাঁটছে, খেলছে। ফুটবল, ক্রিকেট, গাড়ি -গাড়ি কিংবা নিছক মারামারি। সবসময় এসব চলতে থাকে। তাইতো ওদের বাসার সব কিছু ভাঙা। টিভি, শোপিস, কিবোর্ড, খেলনা, জানলার কাঁচ -সবকিছু। তবুও কমে না ওদের দুরন্তপনা। ধুপধাপ শব্দে বিরক্ত হয়ে মাঝে মাঝে মিঠাই নিচতলা থেকে চেঁচিয়ে বলে- এবার একটু থামবে তোমরা? বাপরে, আমাকে এবার ঘুমাতে দাও। সাথে সাথে সবুজ আর রোদ্দুর থেমে যায়। মিঠাই দিদির কথা ওরা খুব মানে। দুষ্টুমিতে অতিষ্ঠ হয়ে ওদের মা মাঝে-মাঝে বলে, যাও তো,!মিঠাইদের বাসা থেকে ঘুরে এস। আমি একটু ঘুমিয়ে নেই।

সবুজ আর রোদ্দুরকে তখন পায় কে! দুদ্দাড় করে এসে হাজির হয় মিঠাই দিদির কাছে। দুষ্টুমি ভুলে একদম লক্ষ্মী ছেলে হয়ে যায়। মিঠাইয়ের বারান্দার গাছগুলোকে আদর করে। দিদির সাথে একমনে ছবি আঁকে। ওয়ার্ড গেম খেলে। দিদির এলোমেলো জিনিস গুছিয়ে দেয়। একটু দুষ্টু হলেও সবুজ আর রোদ্দুর বড্ড ভাল মনের ছেলে। ভীষণ মিষ্টি তাদের মুখের হাসি। একজন বলে, “দিদি, বড় হয়ে আমরা তোমাকে চা বানিয়ে খাওয়াব। আর একজন বলে- আমি ড্রাইভার হয়ে গাড়ি চালিয়ে তোমাকে অফিসে দিয়ে আসব।” মিঠাই খিল খিল করে হেসে বলে- তা বেশ। এবার দুষ্টুমি একটু কমাও। লেখাপড়ায় মন দাও।

প্রায় বিকেলে লাল-নীল-সবুজ ফ্রক পরে মায়ের হাত ধরে টুকটুকি চলে আসে মিঠাইদের বাসায়। এখনো পড়তে শেখেনি টুকটুকি। মিঠাইয়ের বইগুলো, ছবি আঁকার খাতা, খেলনা-সব কিছু চোখ বড় বড় করে নেড়েচেড়ে দেখে। টুকটুকি একটু পেটুক। খেতে ভালবাসে খুব। তাই সে এলে কড়া নিয়ম ভেঙে মিঠাইয়ের মা চিপস -চকলেট আনায়। মিঠাইয়ের সাথে বসে টুকটুকি কুটুস-কুটুস খায়। মিঠাই ওকে ছড়া-রূপকথা পড়ে শোনায়। মন দিয়ে বসে শোনে টুকটুকি। মুহূর্তেই মুখস্ত হয়ে যায় সব কিছু। মিঠাই দিদিকে সে ভীষণ ভালবাসে। প্রতিদিন দিদির কাছে আসার বায়না ধরে কিন্তু টুকটুকিকে নিয়েই যত ঝামেলা। ওকে মিঠাইয়ের পাশে দেখলে রায়ার মুখ ভার হয়ে যায়। অন্যদিকে, সবুজ-রোদ্দুরকে দেখলেই ভয়ে টুকটুকি লুকিয়ে পড়ে দরজার ওপাশে। কখনোবা মিঠাইয়ের পড়ার টেবিলের নীচে। তাইতো টুকটুকি এলে মিঠাই অন্যদের খেলতে ডাকে না। ভীষণ বুদ্ধিমতী দিদি মিঠাই। এভাবেই ভাই-বোনদের সামলে রাখে।

আজ মিঠাইয়ের জন্মদিন। নিজের ঘরে একা বসে সারাদিন ওদের কথা ভাবছে সে। এতদিন হল, রায়া ডাকছে না বারান্দা থেকে। সবুজ- রোদ্দুরের দুপদাপ শব্দ থেমে গেছে। টুকটুকি আর আসছে না। কেমন আছে ওরা? প্রতি বছর তার জন্মদিনে ওরা সবাই একসাথে আসে। শুধু ওরা নয়। আরও অনেকে আসে। যোগ দেয়, মিঠাইয়ের কাজিন বোন লালি আর ঝিমলিও। সবার হাতে থাকে রঙিন কাগজে মোড়া উপহার। একসাথে চলে হুটোপুটি। আবৃত্তি, গান, নাচ- সব কিছু মিলে মিঠাইদের ছোট্ট বাসাটি মুখরিত হয়ে ওঠে। মিঠাই ওদের নিয়ে কেক কাটে। প্রিয় চিকেন ফ্রাই খায়। আইসক্রিম খায়। কিন্তু এবছর কোন আয়োজন নেই। মা-বাবার কোন সাড়া-শব্দ নেই। কথা ছিল, এবারের জন্মদিনে সবাই মিলে পিৎজা খেতে যাবে। কিন্তু কোথায় কি! মিঠাইয়ের ভীষণ কান্না পায়। এমন কেন হল? এমন ভাইরাস কেন এল পৃথিবীতে? কেন সে চলে যাচ্ছে না? মিঠাই ভাবতে পারে না আর। ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে শেষ-মেশ। হঠাৎ মায়ের গলা শোনা যায়-মিঠাই, কোথায় তুমি? সবাই তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে যে।

চমকে ওঠে মিঠাই। এক দৌড়ে ড্রইং রুমে মায়ের কাছে পৌঁছে তো সে একদম বোকা বনে গেল। পুরো ঘর লাল-নীল কাগজ কেটে সাজিয়ে ফেলেছে বাবা । মা বানিয়ে ফেলেছে মস্ত এক কেক। মোমবাতি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। মা ভিডিও কল করেছে। টেবিলে রাখা ল্যাপটপ জুড়ে দেখা যাচ্ছে প্রিয় মুখগুলো। রায়া, টিয়া, টুকটুকি, সবুজ, রোদ্দুর, লালি, ঝিমলি সবাই মিলে হাসি হাসি মুখে বলে উঠল- হ্যাপি বার্থ ডে, মিঠাই দিদি। মিঠাই যে কী বলবে! টুক করে কেক কেটে ওদের সাথে গল্পে মেতে উঠল। রায়ার মুখে হাসি ফুটেছে। তার কোলে টিয়াকে দেখে তো অবাক মিঠাই। বলল- সে কি! টিয়া তোমাকে কামড়ে দিচ্ছে না?
– না, না। টিয়া ভাল মেয়ে হয়ে গেছে। আমাকে অনেক আদর করে এখন। আর বিরক্ত করে না।
টিয়া হাসছে মিঠাই দিদিকে দেখে। হাত নাড়ছে। সবুজ- রোদ্দুরও অনেক শান্ত হয়ে গেছে। দুই ভাই মিলে একটি ইউটিউব চ্যানেল খোলার প্ল্যান করছে। সেখানে নাকি কীসব মজার রান্নার ভিডিও আপলোড করবে। অবাক কাণ্ড টুকটুকি এর মধ্যে পড়তে শিখে গেছে। লালি, ঝিমলি ছড়া লিখতে শুরু করেছে। মিঠাই বলল, চল আমরা সবাই মিলে কিছু একটা করি একসাথে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল ঝগড়া- মারামারি। এ এটা করতে চায় তো ও ওটা করবে। মিঠাই আবার ফিরে এল দিদির ভূমিকায়। বলল, থাম এবার। চল সবাই মিলে একটা গান করি। জানি তোমরা সবাই গানটা গাইতে পার।
– কোন গানটা বল না, দিদি। কোন গানটা সবাই জানি?
-কেন, আমাদের জাতীয় সঙ্গীত
– তাইতো, চল চল এক্ষুনি শুরু করি।
সবাই একসাথে গেয়ে উঠল, “আমার সোনার বাংলা/ আমি তোমায় ভালবাসি …।”

মিঠাইয়ের মা-বাবা অবাক হয়ে দেখল, বন্ধ ঘর জুড়ে ডানা মেলে নেচে চলেছে একঝাঁক রঙিন প্রজাপতি।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত