নারী আদর্শে শ্রীরামকৃষ্ণ
।। চৈতন্যময় নন্দ।।
পরমব্রহ্মকে মাতৃভাবে সাধনা করার নাম ‘শক্তিসাধনা’। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জীবনব্যাপী এই মাতৃশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হওয়াই বাস্তবে দৈনন্দিন জীবনে নারীকে সম্মান প্রদর্শন। আমাদের ধর্মভূমি ভারতবর্ষের শাশ্বত মাতৃত্বের সর্বোচ্চ মহিমা গরিমার পরিচয় দিয়ে ও তাকে পুনরুজ্জীবিত করে শ্রীরামকৃষ্ণ আমাদের বারংবার ধন্য করে এক নতুন পথের সন্ধান দিয়েছেন। শ্রীশ্রীসারদা মা বলেছিলেন, ‘ঠাকুরের জগতের প্রত্যেকের উপর মাতৃভাব ছিল। সেই ভাব বিকাশের জন্য এবার আমাকে রেখে গেছেন।’ ঠাকুরের মাতৃশক্তিকে সর্বোচ্চ আসন—জগন্মাতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত করাকে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন নারী জাগরণের কথা।
নারী দেবতা—কালী, মা ভবতারিণী শ্রীরামকৃষ্ণদেবের মুখ্য ইষ্টদেবী, রানি রাসমণি প্রতিষ্ঠিত দেবালয়ে তাঁর পৌরোহিত্য, যোগেশ্বরী ভৈরবীকে গুরুরূপে বরণ, স্বীয় পত্নী, লীলাসঙ্গিনী সারদাকে তাঁর দেবী ষোড়শীরূপে আরাধনা—এ সবই শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনের অসামান্য সার্থকতা ও তাঁর নারী পূজার উদ্দীপনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। শুধু শিক্ষা-দীক্ষা, দক্ষতা-যোগ্যতায় ও কর্তব্যনিষ্ঠায় নারীরা সমুন্নতা নন, তাঁদের শ্রেষ্ঠ আদর্শের কথা বুঝিয়ে বলতে গিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ তার সঙ্গে গৃহকর্মে নিপুণা, সন্তান পালনে সুদক্ষা, অতিথি সেবায় তৎপরা, ভক্তি প্রবণতা, স্নেহশীলতা, নম্রতা, মিতব্যয়িতা প্রভৃতি যোগ্যতা যে নারীদের জীবনে সঞ্চারিত হয়েছে তাও উল্লেখ করেছেন। সকল সমাজের নারীদের প্রতি রামকৃষ্ণের সম্মান ও সমাদর সর্বজনবিদিত সত্য।
ভগবতী চণ্ডিকার স্তুতিতে ঋষিগণ বলেছেন: ‘স্ত্রিয়ঃ সমস্তাঃ সকলা জগৎসু’। মহর্ষি মনুর উক্তি: ‘যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতা’—যেখানে নারীগণ পূজিতা হন, সেখানে দেবতারা প্রসন্ন চিত্তে বিরাজ করেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের উপলব্ধিতে জগতে যেখানে যত নারীমূর্তি আছে সবই মহামায়ার জীবন্ত বিগ্রহ। তাঁর লীলাসঙ্গিনী শ্রীশ্রী মা সারদাদেবীকে ভবতারিণী মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী জগজ্জননীর সঙ্গে এক ও অভিন্ন রূপে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। তিনি ফলহারিণী কালীপুজোর রাত্রে মা সারদাকে ষোড়শীরূপে আরাধনা করে জপমালা সহ সুদীর্ঘ সাধনার ফল নির্দ্বিধায় তাঁকে অর্পণ করেছিলেন। এরকম মহান আদর্শ ও দৃষ্টান্ত সারা পৃথিবীতে অপ্রকাশিত।
যুগপ্রভাতে অবতার-বরিষ্ঠ শ্রীরামকৃষ্ণের দিব্যদৃষ্টিতে ধরা পড়ল বহু আকাঙ্ক্ষিত শক্তিবাদের মাহাত্ম্য। তিনি অতি সুন্দরভাবে বলছেন: ‘সেই আদ্যাশক্তির পূজা করতে হয়, তাঁকে প্রসন্ন করতে হয়। তিনিই মেয়েদের রূপ ধারণ করে রয়েছেন। তাই আমার মাতৃভাব।’—শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত।
যিনি উচ্চ-নীচ নির্বিশেষে নারীকে এত মর্যাদা দিয়েছেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধায় তিনি এত উচ্ছ্বসিত, সেই প্রেম ও অনুভূতির নিদর্শন পাওয়া যায় ঠাকুরের একটি কথায়—একবার তাঁকে দর্শন করার জন্য দু’জন গৃহবধূ সারাদিন উপবাস করে দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হন। শ্রীরামকৃষ্ণদেব তা জানতে পেরে পরম স্নেহ ও মমতায় আপ্লুত হয়ে বললেন: ‘তোমরা উপবাস করে এসেছ কেন? খেয়ে আসতে হয়। মেয়েরা আমার মা’র এক একটি রূপ কিনা; তাই তাদের কষ্ট আমি দেখতে পারিনা; জগন্মাতার এক একটি রূপ। খেয়ে আসবে, আনন্দে থাকবে।’ অতঃপর তাঁর আজ্ঞায় সেই বধূরা প্রসাদ পেয়ে এলে ঠাকুর সুখী হয়ে বললেন: ‘তোমরা কিছু খেলে এখন আমার মনটা শীতল হল; আমি মেয়েদের উপবাসী দেখতে পারি না।’—শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত।
শ্রীরামকৃষ্ণের পরিচারিকা বৃন্দেকে তিনি সদা মাতৃভাবে দেখতেন। তাঁকে লক্ষ করে একদিন তিনি বলেছিলেন: ‘যত স্ত্রী দেখ সব তিনিই। আমি তাই বৃন্দেকে কিছু বলতে পারিনা।’ পতিতা নারীরাও নরোত্তম শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কৃপাবারিতে শুচিস্নাত হয়ে জীবনকে চরিতার্থ করেছিলেন। তাদের জীবন সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনে উদ্ধারের উপায় নিরূপণ করে তিনি বলেছেন: ‘তাদেরও উদ্ধার হবে যদি আন্তরিকভাবে ব্যাকুল হয়ে কাঁদে, আর বলে আর করব না। গুরু হরিনাম করলে কি হবে, আন্তরিক কাঁদতে হবে।’ —শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত
রঙ্গমঞ্চের অভিনেত্রীদের প্রতি ছিল শ্রীরামকৃষ্ণের অপার করুণা। তিনি তাঁদের মাতৃত্বের সর্বোচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করে ইতিহাসে এক পরম বিস্ময়ের সৃষ্টি করে গিয়েছেন। স্টার থিয়েটারে ‘চৈতন্যলীলা’ অভিনয় চলার সময় তিনি ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়েন। নাটক শেষে নটী বিনোদিনীকে বলেছিলেন, ‘মা তোমার চৈতন্য হউক।’ বিনোদিনীর প্রতি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদ এখনও সর্বত্র শ্রদ্ধা ও ভক্তির সঙ্গে স্মৃতিচারণ হয়। শ্রীচৈতন্যদেবের ভূমিকাভিনেত্রী বিনোদিনী দাসী লিখেছেন: ‘অভিনয় কার্য শেষ হইলে আমি শ্রীচরণ দর্শনের জন্য যখন আপিস ঘরে তাঁহার চরণ-সমীপে উপস্থিত হইতাম, তিনি প্রসন্নবদনে উঠিয়া নাচিতে নাচিতে বলিতেন, ‘হরি গুরু গুরু হরি, বল মা, হরি গুরু গুরু হরি।’ তাহার পর উভয় হস্ত আমার মাথার উপর দিয়া আমার পাপ-দেহকে পবিত্র করিয়া বলিতেন যে, ‘মা তোমার চৈতন্য হউক।’ তাঁহার সেই সুন্দর প্রসন্ন ক্ষমাময় মূর্তি আমার ন্যায় অধম জনের প্রতি! কী করুণাময় দৃষ্টি! পাতকীতারণ পতিতপাবন যেন আমার সম্মুখে দাঁড়াইয়া আমায় অভয় দিয়াছিলেন।’ (আমার কথা ও অন্যান্য রচনা—বিনোদিনী দাসী)
নারী দেবতা—কালী, মা ভবতারিণী শ্রীরামকৃষ্ণদেবের মুখ্য ইষ্টদেবী, রানি রাসমণি প্রতিষ্ঠিত দেবালয়ে তাঁর পৌরোহিত্য, যোগেশ্বরী ভৈরবীকে গুরুরূপে বরণ, স্বীয় পত্নী, লীলাসঙ্গিনী সারদাকে তাঁর দেবী ষোড়শীরূপে আরাধনা—এ সবই শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনের অসামান্য সার্থকতা ও তাঁর নারী পূজার উদ্দীপনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। শুধু শিক্ষা-দীক্ষা, দক্ষতা-যোগ্যতায় ও কর্তব্যনিষ্ঠায় নারীরা সমুন্নতা নন, তাঁদের শ্রেষ্ঠ আদর্শের কথা বুঝিয়ে বলতে গিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ তার সঙ্গে গৃহকর্মে নিপুণা, সন্তান পালনে সুদক্ষা, অতিথি সেবায় তৎপরা, ভক্তি প্রবণতা, স্নেহশীলতা, নম্রতা, মিতব্যয়িতা প্রভৃতি যোগ্যতা যে নারীদের জীবনে সঞ্চারিত হয়েছে তাও উল্লেখ করেছেন। সকল সমাজের নারীদের প্রতি রামকৃষ্ণের সম্মান ও সমাদর সর্বজনবিদিত সত্য।
ভগবতী চণ্ডিকার স্তুতিতে ঋষিগণ বলেছেন: ‘স্ত্রিয়ঃ সমস্তাঃ সকলা জগৎসু’। মহর্ষি মনুর উক্তি: ‘যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতা’—যেখানে নারীগণ পূজিতা হন, সেখানে দেবতারা প্রসন্ন চিত্তে বিরাজ করেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের উপলব্ধিতে জগতে যেখানে যত নারীমূর্তি আছে সবই মহামায়ার জীবন্ত বিগ্রহ। তাঁর লীলাসঙ্গিনী শ্রীশ্রী মা সারদাদেবীকে ভবতারিণী মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী জগজ্জননীর সঙ্গে এক ও অভিন্ন রূপে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। তিনি ফলহারিণী কালীপুজোর রাত্রে মা সারদাকে ষোড়শীরূপে আরাধনা করে জপমালা সহ সুদীর্ঘ সাধনার ফল নির্দ্বিধায় তাঁকে অর্পণ করেছিলেন। এরকম মহান আদর্শ ও দৃষ্টান্ত সারা পৃথিবীতে অপ্রকাশিত।
যুগপ্রভাতে অবতার-বরিষ্ঠ শ্রীরামকৃষ্ণের দিব্যদৃষ্টিতে ধরা পড়ল বহু আকাঙ্ক্ষিত শক্তিবাদের মাহাত্ম্য। তিনি অতি সুন্দরভাবে বলছেন: ‘সেই আদ্যাশক্তির পূজা করতে হয়, তাঁকে প্রসন্ন করতে হয়। তিনিই মেয়েদের রূপ ধারণ করে রয়েছেন। তাই আমার মাতৃভাব।’—শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত।
যিনি উচ্চ-নীচ নির্বিশেষে নারীকে এত মর্যাদা দিয়েছেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধায় তিনি এত উচ্ছ্বসিত, সেই প্রেম ও অনুভূতির নিদর্শন পাওয়া যায় ঠাকুরের একটি কথায়—একবার তাঁকে দর্শন করার জন্য দু’জন গৃহবধূ সারাদিন উপবাস করে দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হন। শ্রীরামকৃষ্ণদেব তা জানতে পেরে পরম স্নেহ ও মমতায় আপ্লুত হয়ে বললেন: ‘তোমরা উপবাস করে এসেছ কেন? খেয়ে আসতে হয়। মেয়েরা আমার মা’র এক একটি রূপ কিনা; তাই তাদের কষ্ট আমি দেখতে পারিনা; জগন্মাতার এক একটি রূপ। খেয়ে আসবে, আনন্দে থাকবে।’ অতঃপর তাঁর আজ্ঞায় সেই বধূরা প্রসাদ পেয়ে এলে ঠাকুর সুখী হয়ে বললেন: ‘তোমরা কিছু খেলে এখন আমার মনটা শীতল হল; আমি মেয়েদের উপবাসী দেখতে পারি না।’—শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত।
শ্রীরামকৃষ্ণের পরিচারিকা বৃন্দেকে তিনি সদা মাতৃভাবে দেখতেন। তাঁকে লক্ষ করে একদিন তিনি বলেছিলেন: ‘যত স্ত্রী দেখ সব তিনিই। আমি তাই বৃন্দেকে কিছু বলতে পারিনা।’ পতিতা নারীরাও নরোত্তম শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কৃপাবারিতে শুচিস্নাত হয়ে জীবনকে চরিতার্থ করেছিলেন। তাদের জীবন সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনে উদ্ধারের উপায় নিরূপণ করে তিনি বলেছেন: ‘তাদেরও উদ্ধার হবে যদি আন্তরিকভাবে ব্যাকুল হয়ে কাঁদে, আর বলে আর করব না। গুরু হরিনাম করলে কি হবে, আন্তরিক কাঁদতে হবে।’ —শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত
রঙ্গমঞ্চের অভিনেত্রীদের প্রতি ছিল শ্রীরামকৃষ্ণের অপার করুণা। তিনি তাঁদের মাতৃত্বের সর্বোচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করে ইতিহাসে এক পরম বিস্ময়ের সৃষ্টি করে গিয়েছেন। স্টার থিয়েটারে ‘চৈতন্যলীলা’ অভিনয় চলার সময় তিনি ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়েন। নাটক শেষে নটী বিনোদিনীকে বলেছিলেন, ‘মা তোমার চৈতন্য হউক।’ বিনোদিনীর প্রতি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদ এখনও সর্বত্র শ্রদ্ধা ও ভক্তির সঙ্গে স্মৃতিচারণ হয়। শ্রীচৈতন্যদেবের ভূমিকাভিনেত্রী বিনোদিনী দাসী লিখেছেন: ‘অভিনয় কার্য শেষ হইলে আমি শ্রীচরণ দর্শনের জন্য যখন আপিস ঘরে তাঁহার চরণ-সমীপে উপস্থিত হইতাম, তিনি প্রসন্নবদনে উঠিয়া নাচিতে নাচিতে বলিতেন, ‘হরি গুরু গুরু হরি, বল মা, হরি গুরু গুরু হরি।’ তাহার পর উভয় হস্ত আমার মাথার উপর দিয়া আমার পাপ-দেহকে পবিত্র করিয়া বলিতেন যে, ‘মা তোমার চৈতন্য হউক।’ তাঁহার সেই সুন্দর প্রসন্ন ক্ষমাময় মূর্তি আমার ন্যায় অধম জনের প্রতি! কী করুণাময় দৃষ্টি! পাতকীতারণ পতিতপাবন যেন আমার সম্মুখে দাঁড়াইয়া আমায় অভয় দিয়াছিলেন।’ (আমার কথা ও অন্যান্য রচনা—বিনোদিনী দাসী)
কৃতজ্ঞতাঃ বর্তমান
.
