কবি রাণা চট্টোপাধ্যায় এবং গেঁথে রাখা আলোর অক্ষরগুলি
কবি রাণা চট্টোপাধ্যায়ের অকাল প্রয়াণে ইরাবতী পরিবার শোকাহত। বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা স্মৃতিচারণে সদ্য প্রয়াত কবিকে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
শ্রদ্ধেয় কবি রাণা চট্টোপাধ্যায় পা বাড়ালেন অমৃতলোকের পথে।গতকাল এই খবর শোনার পর থেকে মন ভারি হয়ে আছে।খুব কষ্ট হচ্ছে। কয়েকদিন আগেও তাঁর সাথে ফোনে কথা হল।খবরাখবর নিলাম।তিনি বললেন –এই বয়সে আর ভালো থাকা, তবু আছি। তার পরও আধঘন্টা কথা বললেন।বাবার খবর নিলেন।কেতকীর কথা বললেন। একবার কথা বলতে শুরু করলে তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে বলে যেতেন।সাহিত্যের অনেক অজানা তথ্য এবং সুচারু বিশ্লেষন উঠে আসত তাঁর মূল্যবান কথায়। এই লোভ থেকেই তাঁর সাথে কথা বলতে ভালো লাগত আমার। অসুস্থ শরীর জেনেও তাই হয়তো বারবার বিরক্ত করে ফেলতাম ।তখন কি জানতাম আর কোনদিন গল্প হবে না তাঁর সাথে?
ছয়ের দশকের বিশিষ্ট কবি রাণা চট্টোপাধ্যায়। জন্ম উত্তরবাংলার করদ রাজ্য কুচবিহারে ভারতের স্বাধীনতা লাভের ঠিক ছ দিন আগে ৯ আগষ্ট ১৯৪৭। বিল্বগ্রামের চাটুজ্জে বংশের পরিচিতি সর্বজনবিদিত। তিনি এই পরিবারের সন্তান। তাঁর পিতামহ জতীন্দ্রমোহন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন নেত্রকোনার ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট। পন্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার তার পিতামহের অগ্রজ। কবিতা তাঁর রক্তে, স্নায়ুতে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সাহিত্যের সাথে বসবাস ছোটবেলা থেকেই। কবিতায় এক নতুন ভূবন বানিয়েছেন তিনি।তাঁর কবিমন কোন বাহ্যিক পরিকাঠামোর সীমায় আবদ্ধ ছিল না। সমস্ত রকম প্রাতিষ্ঠানিকতার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে এক স্বতন্ত্র মেধা , চিন্তা এবং অনুভূতির উজ্বল বর্ণমালা হয়ে উঠেছে তাঁর নির্মাণভূবন। যে ভূবনের যাত্রাপথে ছড়িয়ে আছে সামনে প্রিয়তম পথ, শকুন্তলার মুখ, এসো মৃত্যুর হাওয়ায় , নষ্ট যৌবন অন্ধকার বসন্ত, বিকেলের আলোর ভিতরে , আলোর অক্ষরগুলি গেঁথেছি একাকী, নীল সামিয়ানার নিচে,তোমার সজল মুখ,জন্ম জন্মান্তর ধরে আছি থেকে আরম্ভ করে জয়মাল্য নিতে তো আসিনি প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ, এছাড়াও বাংলা কবিতার পালাবদল, মধু কোকনদে প্রভৃতি প্রবন্ধগ্রন্থ লিখেছেন , লোক সাহিত্য নিয়েও প্রচুর কাজ আছে । অনুবাদ করেছেন কিউবার অজস্র কবিতা । আবহমান নামে একটি কাব্যনাট্য লিখেছেন। রচনা করেছেন কবি ও সাহিত্যিকদের সান্নিধ্যকথা – কিছু স্মৃতি , কিছু বিভাস । আব্দুল মান্নাফের দেশ তাঁর একমাত্র গল্পপুস্তিকা। বিশ্ব সংস্কৃতির শেকড়ের সাথে সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করার নিরলস প্রয়াস এবং প্রেম, প্রকৃতি এবং মানবিক চৈতন্যলোকের অন্তর্ভেদী বিন্যাস তাঁর কবিতাকে আন্তর্জাতিক সমানুভবে ব্যপ্ত করেছে। পঞ্চাশ বছর ধরে সম্পাদনা করেছেন জিগীষা পত্রিকা। যার মূলকথাই হচ্ছে সাহিত্যের আন্দোলন কারোও দাসত্ব করার জন্য নয়। জিগীষা অর্থাত জয় করবার ইচ্ছে। এই অদম্য ইচ্ছে নিয়ে তিনি শুরু করেছেন তার পথচলা, কেন সত্তরের কাছাকাছি এসে তাঁকে বলতে হয়, জয়মাল্য নিতে তো আসিনি? আমি প্রশ্ন করেছিলাম। মৃদু হেসেছিলেন, সত্তর আসুক তুমি নিজেই বুঝতে পারবে।
সাকুল্যে তাঁর সাথে আমার সাক্ষাত হয়েছে নয় থেকে দশবার।তেমন কিছু বেশি নয়।কথাবার্তা চিঠি লেখার সংখ্যাটা একটু বেশি হবে। এরমধ্যে কেতকীর জন্য একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম আমি, সেখানে অকপটে তিনি অনেক কথা জানিয়েছিলেন। সেসব এই তো সেদিন। এ তো বাইরের দেখা , কিন্তু অন্তরের দেখা তাঁর লেখাকে চেনা সেসব খুব ছোটবেলা থেকেই। কেতকীর প্রতি সংখ্যায় যাঁদের লেখা থাকত, যে মানুষগুলিকে বাদ দিয়ে কেতকীর প্রকাশ সম্ভব ছিল না কবি রাণা চট্টোপাধ্যায় তাঁদের অন্যতম। কবিতা, গুচ্ছ কবিতা , প্রবন্ধ, কাব্যগ্রন্থ আলোচনা সবকিছুই দক্ষ হাতে লিখেছেন কেতকীতে।কেতকীর সুবর্ণজয়ন্তীতে তাঁর মতো কৃতি মানুষকে আমরা সম্মান জানাতে পেরে গর্বিত হয়েছি। তিনি ও সুভদ্রাদি আসবেন বলেও অসুস্থতার জন্য আসতে পারেন নি সেসময়। এই নিয়ে আমার একটু অভিমান হয়েছিল।কিন্তু তাঁর নিবিড় স্নেহ একে দীর্ঘস্থায়ী হতে দেয়নি।
বাবার চেয়ে দশ বছরের ছোট হলেও রাণা চট্টোপাধ্যায়ের অন্তরের সংযোগ ছিল নিবিড়। এই সখ্যতা পাঁচ দশকের বেশি সময়ের । কেতকী প্রকাশের আগে থেকেই।বাবা ‘ রাণাবাবু’ বলেই ডাকতেন, তিনিও মোহিনীবাবু বলতেন।
বাবা অসুস্থ হওয়ার পর তিনি নিয়মিতই খোজ নিতেন।বাবার অস্পষ্ট জড়ানো কথা যা আমরাই বুঝতে পারতাম না তখন।তিনি বুঝতে পারতেন এবং ফোনে যে কথা হত তা বিশ্লেষণ করে বলেও দিতেন আমাদের ।আমি অবাক হয়ে যেতাম – আপনি বুঝতে পারলেন? অন্য কেউ বুঝতে পারে না। আমরাও পারি না অনেকসময়।
তাঁর গলা একটু অশ্রুরুদ্ধ মনে হল, তবু সংযত গলায় তিনি বললেন – সম্পর্কটা বন্ধুত্বের, হৃদয়ের। মোহিনীবাবু কী বলছেন ? কী বলতে চান? তা আমি জানব না ? এই আকুতিই যদি স্পর্শ করতে না পারি তাহলে কীসের বন্ধুত্ব। পাঁচ দশকে এভাবেই তো মানুষটাকে চিনেছি।
এই বন্ধুত্ব আজকের সাহিত্যে বিরল হয়ে আসছে। দুর্লভ হয়ে আসছে এরকম মানুষগুলিও। কবি রাণা চট্টোপাধ্যায় স্পষ্টবাদী সোজ়াসাপটা মানুষ। মুখের উপর অপ্রিয় সত্য বলতে তিনি আড়ষ্টতা অনুভব করতেন না কখনই। এতে তাঁর শত্রুসংখ্যা হয়তো বেড়েছে কিন্তু অনুরাগীর সংখ্যা কমেনি। কারণ রাণা চট্টোপাধ্যায় মানেই ঠোটকাটা নির্ভীক একজন ঋজু মানুষ, এই পরিচয় তাঁকে অনেকের থেকে পৃথক করেছে।তাঁর কবিতার ক্ষেত্রেও এই ঋজুতা ছিল অনিবার্যভাবে প্রকট
আমরা যারা ভালোকে ভালো
খারাপকে খারাপ বলতে শিখেছিলাম
আমরা যারা ছাগল দিয়ে
যব ভাঙাতে চাইনি
ক্ষুধা বলতে ক্ষুধার কথাই ভেবেছি
তারা খুব অসহায় বোধ করছে এখন
( কেতকীকে একুশ বছর পর)
গতানুগতিক প্রথা ও নিয়মধারা অগ্রাহ্য করে তিনি মানুষের জয় পরাজয়, সংকল্প, ত্যাগ স্বপ্ন অথবা প্রদূষণগুলিকে চিহ্নিত করেছেন নির্মম আঁচড়ে। তাঁর শব্দের ছায়ায় এসে দাঁড়ালে আমরা দেখতে পাই
লিখতে বসলেই দেখি মানুষের ঠোটে
সাত সাগর আর তেরো নদীর দু;খ
গালে হাত একুশের সুকান্ত পাথর হয়ে
যাদবপুরের সেতু আগলে বসে আছে।
আর দূর নক্ষত্রলোকের শূন্যতা
জানি মৌমাছির মতো ঘুরে ঘুরে
চাক বোঝাই করছে মধু দিয়ে
( শৈশবের ঘোড়ারা )
কবিতার ভেতর এই সত্য যেখানে কোন ভোজ়বাজির আয়োজন নেই বরং তা বাংলা কবিতার ক্ষেত্রভূমিকে উর্বরিত করেছে শৈল্পিক অঙ্গিকারে সৃষ্টিশীল প্রজ্ঞায়
সাবলীল ছবিগুলি পড়ে থাকে
রাস্তা জুড়ে
আমি পার হই
আমার বয়স বাড়ে, পুরোনো দিনের লেখা
কবিতার থেকে
উঠে আসছি আমি
চিনতে পারি না রাস্তার বাক
রহস্যময় ছবিগুলি পড়ে থাকে
কেউ দেখতে পায় না
শুধু আমি দেখি ছবির মিছিল
( কয়েকটি রহস্যময় ছবি)
বিশ্বপ্রেক্ষিতের ধারাবাহিক রূপান্তর সময়ের সাথে সাথে কীভাবে বিবর্তিত হয়ে উঠে, মানবতাবাদী পরম্পরা এবং বিপ্লবী সামাজিক ঐতিহ্যের নিস্তেজমান বিবর্ণতার ছবিই উঠে এসেছে, যা ম্লান করে দেয় দৃষ্টিকে। সন্দেহ জন্ম নেয়, রহস্যময়তাকে আরোও তীব্র করে।
মৃত্যু তাঁর কবিতায় বিভিন্ন ভাবে বিধৃত হয়েছে। প্রিয়তম পথকেও তিনি স্বাগত জানিয়েছেন এসো মৃত্যুর হাওয়ায়।আবার কখনও কখনোও মৃত্যুর বিরুদ্ধে ধ্বনিত হয়েছে প্রতিবাদ
নিচ্ছো তো প্রতিদিন শিশু বৃদ্ধ অনেকের প্রাণ
তারপরও জঙ্গি সাজো বারুদ ফাটাও?
এখনও হইনি বৃদ্ধ দেখ কত মানবসন্তান
নিশ্চিন্তে উঠেছে ট্রেনে- বাসে নিরাপত্তা দাও।
এদিকে এসো না মৃত্যু হাতে নিয়ে বোমা
জীবন তো সামান্য দিনের
অতর্কিতে কেড়ে নিলে করব না ক্ষমা
( এদিকে এসো না মৃত্যু )
কবিমাত্রেই ব্যক্তি। তাই আলোড়িত সত্তার উত্থানপতন কবিতার গায়ে জমা হয় পলির মতো। জীবনে অর্জিত অভিজ্ঞতার আলো ছায়া দিয়ে তিনি যেমন অনুভব করেছিলেন এই সত্য পাশাপাশি সামাজিক সমষ্টির একক হিসেবে সমাজে ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এভাবেই উচ্চারিত হয়েছে নিজস্ব প্রতিবেদন।
আলোর অক্ষরগুলি এভাবেই একাকী গেঁথেছেন তিনি সঙ্গোপনে একান্ত নির্জনে।এই আত্মক্ষরণের মৃত্যু নেই, মৃত্যু নেই এই শিল্পভূমির। কবি রাণা চট্টোপাধ্যায় আছেন, থাকবেন । ঋজু মেরুদন্ড নিয়ে অসীম নীল সামিয়ানার নিচে জ্বল জ্বল করছে তাঁর প্রিয়তম কবিতার পথ-
প্রত্যেক মানুষের কিছু না কিছু সুখ থাকে, অসুখ থাকে
দুঃখ থাকে, ভালোবাসা ও স্নেহ থাকে-
আমার কিছুই নেই
পড়ন্ত বিকেলে এসব ভাবতে ভাবতে পথ চলি
দূর দিয়ে ট্রেন যায়, শহরতলির ট্রেন
ইস্পাতের লাইন দিয়ে, মানুষের বসতির উপর দিয়ে-
আমি দেখি, কেন দেখি ?
আমার মেরুদন্ড নেই কেউ বলেছিল
কেউ বলেছিল আমি নীল সামিয়ানার নিচে দাঁড়িয়ে থাকব অনন্তকাল-
প্রত্যেক মানুষেরই কিছু না কিছু কথা থাকে
আমার নেই, মাথার ভেতর ঘুরপাক করে বায়ু
পড়ন্ত বিকেলে হাটতে হাটতে কোথায় এলাম?
নির্মম শত্রুতা করে যাও বোবার সঙ্গে কেন?
আমি জানি একদিন হাড়মাস জ্বালিয়ে তোমাদের উপহার দেবো।
সেইদিন খুব দূরে নেই।
যখন আমার মেরুদন্ড সোজাসুজি উঠে যাবে এভারেষ্ট ছাড়িয়ে।
( প্রত্যেক মানুষের কিছু সুখ থাকে)
কবি, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক
জন্ম ১৯৭২, পুরুলিয়ায়। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতকোত্তর। দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনে কর্মরত। প্রকাশিত গ্রন্থ এক ডজন। পেয়েছেন ত্রিবৃত্ত পুরস্কার মালীবুড়ো সন্মান সহ বেশ কিছু পুরস্কার ও সন্মাননা। কেতকী পত্রিকার সম্পাদনার সাথে যুক্ত।