| 14 ডিসেম্বর 2024
Categories
এই দিনে গদ্য সাহিত্য

মাকে খুব মনে পড়ে

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

আজ ২১ এপ্রিল। গবেষক, চলচ্চিত্র নির্মাতা,সাহিত্যিক রেজা ঘটকের জন্মতিথিইরাবতী পরিবার এই শুভ লগ্নে রেজা ঘটককে জানায় জন্মতিথির শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


মাকে খুব মনে পড়ে। যাদের মা নেই, তাদের পৃথিবী সত্যি সত্যি অন্যরকম। যাদের মা আছে সেই কষ্ট তারা বুঝতে ঠিক পারবে না। বোঝানো সম্ভবও নয়। জীবনের সকল দুঃখ-আনন্দ একসাথে যাকে বলা যেতো, সে ছিল আমার মা। মায়ের চেয়ে বড় বন্ধু পৃথিবীতে নাই। যারা মা হারিয়েছে তাদের চেয়ে অভাগা আর কে হতে পারে! ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি আমি মাকে হারাই। মাকে হারানোর সেই বেদনা আজো সমান ভাবে বুকের গহীনে বাজে। নিরন্তর সেই বোবা কষ্ট আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। মা হারানোর বেদনা জীবদ্দশায় পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন একটা অধ্যায়। এই বেদনা ঠিক ভাষায় অনুবাদ করা যায় না। শব্দে আটকানো যায় না। মুখে বলাও যায় না, কেমন ব্যথাতুর সেই কষ্ট।

আমার মা ছিলেন একজন সত্যিকারের গ্রামীণ বাঙালি নারী। পৃথিবীর সকল সন্তানই মনে করে, তার মায়ের হাতের রান্না সবচেয়ে সুস্বাদু। আমিও তাই মনে করি। আমার মায়ের হাতের রান্নার এখনো আমি সুস্পষ্টভাবেই মনে করতে পারি। খুব ভালো রান্না জানতেন মা। মাকে সারা জীবন সুতার শাড়ি পড়তে দেখেছি। একটা কি দুইটা স্পেশাল শাড়ি মা ট্রাংকে রেখে দিতেন। কোথাও বেড়াতে গেলে সেই শাড়ি পড়তেন। এছাড়া বারো মাস মাকে দেখেছি দুইটা শাড়ি পড়েই জীবনযুদ্ধ চালাতে। সব সময় পড়ার জন্য যে দুইটা শাড়ি, ওগুলো ছিঁড়ে গেলে বাবা আবার নতুন দুইটা শাড়ি কিনে আনতেন। রোজ গোসলের পর মা সেই শাড়ির একটি পড়তেন আর অন্যটি ধুয়ে শুকা দিতেন।

এ নিয়ে মায়ের মধ্যে কোনো দিন কোনো দুর্ভাবনা দেখিনি। মনকষ্টও দেখিনি। দুইটা শাড়িতেই আমার মা ভারী খুশি থাকতেন। বছর শেষে মায়ের দুইটা শাড়ি দিয়ে কাঁথা সেলাই হতো। প্রতি বছর আমরা ভাইবোনরা কেউ একজন সেই কাঁথা আগাম বুকিং দিতাম। কে কোন বছর সেই কাঁথা পাবে তা আগেভাগেই মা ঘোষণা দিতেন। যাতে এই নিয়ে কোনো বচ্চা না হয়। আমরা অনেকগুলো ভাইবোন। পাঁচ ভাই চার বোন। তাই কাঁথা ভাগে পাবার সিরিয়াল আসতে মিনিমাম নয় বছর লাগতো। আমরা ভাইবোনরা তাই নিয়েই বরং সন্তুষ্ট থাকতাম। মা ছিলেন পুরোপুরি গৃহিনী। সংসারের যাবতীয় কাজ নিজের মনে বেশ আনন্দের সঙ্গেই করতেন। কোনো দিন মাকে দেখিনি সংসারের কাজে একটু অবহেলা করতে। সংসারই ছিল মায়ের কাছে এক অন্য ধর্ম।

আমার মা ক্লাস টু-থ্রি পর্যন্ত স্কুলে পড়াশুনা করেছেন। মায়ের দাদুভাই ছিলেন মাস্টার। বাড়িতে তার দাদুর কাছেও পড়া দেবার নিয়ম চালু ছিল। মায়ের কাছে সেই গল্প শুনেছি। আমার বাবাও অনেকটা তাই। ক্লাস থ্রি কিংম্বা ফোর পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন। কিন্তু সন্তানদের স্কুলের ব্যাপারে বাবা মা ছিলেন সমান আগ্রহী। আমাদের পাঁচ ভাইয়ের তিনজন মাস্টার্স করেছি, একজন বিএ পাস করেছে আর একজন মেট্রিক ফেল। চার বোনের একজন মাস্টার্স পাস, দুইজন ক্লাস টেন পর্যন্ত আর একজন ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশুনা। আমাদের গ্রামে এটা অনেকটা বিরল ঘটনা।
আমাদের পড়াশুনার ব্যাপারে মা-বাবার প্রবল আগ্রহের কারণেই আমরা পড়াশুনা করতে পেরেছি। আমাদের বিশাল সংসারে কখনোই সত্যিকারের স্বচ্ছলতা ছিল না। কিন্তু সত্যিকারের সুখ ছিল। মা-বাবার মৃত্যুর পর বরং সেই সুখ কিছুটা ম্লান হয়েছে। কারণ, আমাদের বাড়িতে এখন একই সংসারের ভেতরে অনেক মতের লোক আছে। মা-বাবা জীবিত থাকাকালে মতের অনেক ব্যাপার থাকলেও আমাদের সংসার ছিল সত্যিকার ভাবেই একটি সুনির্দিষ্ট ছকে বাধা। বাবা সেই ছকটি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রন করতেন সংসারের কর্তা হিসেবে। ১৯৯৬ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবা মারা যাবার পর সেই নিয়ন্ত্রন স্বাভাবিক ভাবেই মায়ের উপরে গিয়েছিল।

কিন্তু মা বাবার মত কঠোর ছিলেন না বলে, সেই কঠোর নিয়ম কানুন গুলো ঠিক মত পালন করতে মা অনেকটাই অকার্যকর ছিলেন। মায়ের মধ্যে তখন এক ধরনের নির্ভরতা ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছিল। মা আমাদের সবাইকে সমান চোখে দেখতেন। কিন্তু বাবার মত সমান ভাবে কঠোরতার সঙ্গে পালন করতে পারতেন না। বাবার মৃত্যুর পর মায়ের মধ্যে এই জিনিসটার একটা দুর্বলতা লক্ষ্য করেছি। তা নিয়ে মায়ের মধ্যে কিছু দুঃখবোধও হয়েছিল। অযৌক্তিক অনেক অনেক কারণে আমার মা তাই জীবনের শেষভাগে অনেক দুঃখ পেয়েছেন। সেই দুঃখ প্রদানে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছে আমাদের বাড়িতে যারা বউ হয়ে এসেছে, তারা। তাদের নিজস্ব স্বার্থের কাছে মা তখন অনেক ক্ষেত্রে পরাজিত হয়েছেন। কিন্তু মা তা নিয়ে কোনো দিন প্রকাশ্যে দুঃখ করেননি। নিজের মনের কষ্ট নিজে লুকিয়ে রেখেছেন। কিন্তু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সেই কষ্ট চট করেই আমি বুঝতে পারতাম। মা আমাকে খুটিয়ে খুটিয়ে সব বলতেন। কিন্তু তা নিয়ে সংসারে আবার কেউ অখুশি হোক, সেই ঝামেলায় যেনো আমি না যাই, সে বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ দিতেন।

সাংসারিক ব্যাপার স্যাপারে এই পরাজিত হবার প্রধান কারণ ছিল আমার মায়ের সরলতা। আমার মা খুব সরল সোজা ছিলেন। সবাইকে অন্তর দিয়ে ভালো বাসতেন। সবাইকে কাছে টানতেন। খুব আপন মনে করতেন। অন্যরা সেই সুযোগটির পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করতেন। সংসারে অস্বচ্ছলতার জন্য মাকে অনেক সময় খুব দুঃশ্চিন্তা করতে দেখেছি। কিন্তু কখনো ভেঙ্গে পড়তে দেখিনি। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর সংসারের অনেক ছোটখাটো বিষয়ে মাকে আমি কাঁদতে দেখেছি। কারণ, মাকে কেউ কেউ তখন নানান বিষয়ে অনেক কষ্ট দিয়েছে। যা আমি জীবনে কখনো ভুলবো না। তাদের সেই আচরণগুলো আমাকে এখনো কঠিন পিড়া দেয়। কিন্তু তারা সবাই এখনো আমাদের সংসারের সদস্য। তারাও এখনো তাদের মত আনন্দে আছে। সুখে আছে। কারণ আগের চেয়ে তাদের অনেক স্বচ্ছলতা ফিরেছে। বলতে গেলে ১৯৯০ সাল থেকে আমি সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন এক যাযাবর। কিন্তু মা যতদিন জীবিত ছিলেন মায়ের সঙ্গে আমার আত্মার যোগাযোগ ছিল। এখনো আমার মায়ের সঙ্গে আত্মার যোগাযোগ অটুট রয়েছে।

আমরা ভাইবোন সবাই বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে ছড়ানো ছিটানো। বিভিন্ন উৎসব বা পার্বনে আমরা বাড়িতে এক হতাম। তখন নাদেখা সেসব দুঃখের বিষয় নিয়ে অনেক সময় মা আমার কাছে বিলাপ করতেন। মনের কষ্টের কথা খোলাখুলি বলতেন। আমার ছোট্ট বুদ্ধিতে যতটুকু মাকে শান্তনা দেওয়া সম্ভব ছিল, আমি তাই চেষ্টা করতাম। খেয়াল করতাম, মা কষ্ট ভুলে আবার সবার সঙ্গে বেশ সহজভাবেই মিশতেন। মায়ের এই গুণটি আমি এখন পর্যন্ত অনেক মানুষের মধ্যে ঠিক দেখতে পাই না। নারীদের মধ্যে তা দেখতে পাবার উদাহরণ তো আমার পক্ষে আবিস্কার করা আরো কঠিন। সত্যি সত্যিই কঠিন। জীবনে যত নারী দেখলাম, তারা কইতে নারী কিন্তু চলন বলন একটু বাঁকা। এটা দায়িত্ব নিয়ে অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। বরং ছেলেরা সেই তুলনায় অনেক কঠিন বিষয় খুব সহজে মিটমাট করে ফেলে। কিন্তু নারীদের বিষয় পৃথিবীর প্রলয় পর্যন্ত মিমাংসা হয় না।

আমার মা-বাবা দুজনেই সিগারেট খেতেন। একবার বাবার খুব অসুখ করলো। ডাক্তার বাবার সিগারেটের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন। বাবা সিগারেট ছেড়ে দিয়ে পান ধরলেন। তারপরেও কিছু দিন মা একা একা সিগারেট খেয়েছেন। বাবাই মাকে সিগারেট কিনে দিতেন। মা লুকিয়ে লুকিয়ে খেতেন। ছোট কাকা-কাকীর কাছ থেকে হুক্কাও খেতেন। এক সময় বাবার মত মাও নিজে নিজেই সিগারেট ছেড়ে দেন। আর পান খাওয়ার অভ্যাস করেন।

আমার মা বাংলা ও আরবি পড়তে পারতেন। সহজ সরলাংকের হিসাব কসতে পারতেন। হিসাব জটিল হলে গুলিয়ে ফেলতেন। আমাদের পড়াশুনা দেখে দেখে মা কিছু কিছু ইংরেজি বানান করে পড়তে পারতেন। কিন্তু শিশুদের মত তার একটু লজ্জা লজ্জা লাগতো। মা নিয়মিত নামাজ পড়তেন। রোজ সকালে ফজরের নামাজ পড়ার পর নিয়মিত কোরআন পড়তেন। তারপর সংসারের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। কেবল অসুস্থ হলে এর কিছু ব্যতিক্রম দেখেছি।

বাবার মৃত্যুর চার বছর পর একবার মা পুকুরের ঘাটে অযু করতে গিয়ে স্লিপ কেটে পড়ে যান। বাম হাত ভেঙ্গে ফেলেন। বাম হাতে জোড়া লেগেছিল। কিন্তু মায়ের হাতটা বাঁকা ভাবে জোড়া লেগেছিল। ডাক্তার অপারেশন করে সোজা করতে চেয়েছিল। কিন্তু মা অপারেশন খুব ভয় পেতেন। তাই আর অপারেশন করা হয়নি। বাঁকা বাম হাত নিয়ে মা বাকি জীবন কাটিয়েছেন। নিজের কাপড় নিজে পড়তে পারতেন। আমরা তাই মায়ের হাত অপারেশনের ব্যাপারে তাকে আর নতুন করে কোনো ঝামেলা দেইনি।

আমার নানানানীর ছিল এক ছেলে ছয় মেয়ে। সবার বড় ছিল আমাদের একমাত্র মামা। তারপর বড় খালা। তারপর মা। তারপর বাকি চার খালা। নানা যেদিন মৃত্যুবরণ করল সেদিন একঘণ্টা পর আমার একেবারে ছোটো ভাইটার জন্ম। বড়খালা ছিলেন আমাদের বাড়িতে। বড়খালা আর আমার মা তাদের বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনেছিলেন এক মাস পর। সবচেয়ে আশ্চার্যের বিষয় হল, আমার নানার প্রায় সবগুলো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আমার ছোটো ভাইয়ের মধ্যে এখনো বিরাজমান।
আমার নানা ছিলেন তার বাবার একমাত্র ছেলে। আমার মামাও তার বাবার একমাত্র ছেলে। আর আমার মামারও একটি মাত্র ছেলে। মামাতো ভাইটার কয়টি ছেলে এখন আমার জন্য বলা কষ্টকর। কারণ মায়ের মৃত্যুর সময় মামাতো ভাইকে আমি সর্বশেষ দেখেছিলাম। মামাতো ভাই আর চার মামাতো বোনের খবর আমি জানি। মামাও অনেক আগে মারা গেছেন। মামাতো ভাইবোনদের ছেলেমেয়েদের খবর আর আমার কাছে নাই।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
মায়ের বামপাশে অনু ভাবী (শাড়ি পরা) আর ডানপাশে অনু ভাবী’র পুত্রবধূ ডাক্তার মুক্তি।

আমার মা-খালাদের ছয়জনের এখন তিনজন জীবিত আছেন। বড় খালা, নোয়া খালা আর ছোটখালা। সবার আগে মারা যান সেজো খালা। তারপর মা। আর তিন বছর পর সেজো খালাও মারা যান।

আমার মায়ের প্রৌঢ়া বয়সেই সকল দাঁত পড়ে গিয়েছিল। কোনো ধরনের কৃত্রিম দাঁত মা ইচ্ছে করেই লাগাননি। তাই হাসলে মাকে খুব সুন্দর লাগতো। মা যখন পান খেতেন, তখন তার প্রস্তুতি নিতেই অনেকটা সময় লাগতো। প্রথমে সুপারি কেটে কুচি কুচি করতেন। তারপর পান আর সুপারি মিলিয়ে হামান দস্তার মধ্যে রাখতেন। তারপর গল্প করতেন আর পান ছিছতেন। এক সময় পানের গুড়াগুলো জড়ো করে মুখে পুড়ে দিতেন। তারপর আবার গল্প শুরু করতেন। আর নতুন করে পান ছিছতেন। গল্প যখন শেষ হতো, পান খাওয়া বা পান সংক্রান্ত কার্যক্রমেরও তখন পরিসমাপ্তি ঘটতো।

আমার মায়ের চুল ছিল হাটু পর্যন্ত লম্বা। আমাদের ছোটো ভাইয়ের জন্মের পর সেই চুল অনেক কমে যায়। তবুও যে কোনো নারীর কাছে আমার মায়ের অবশিষ্ট চুলও ছিল ইর্ষার বিষয়। আমার বড় আপার চুল মায়ের মত বেশ লম্বা। কিন্তু মায়ের চুল বেশি লম্বা ছিল। ঘন কালো ছিল। ছোটবেলায় দেখেছি মা চুল পরিস্কার করার জন্য কলাগাছের খোলা বা একেবারে ভেতরের অংশটা পানিতে মিশিয়ে কোনো পাত্রে আগুনে জ্বাল দিতেন। সেই পানি দিয়ে গোসলের সময় চুল পরিস্কার করতেন। অনেক সময় দেখেছি সময় বাঁচাতে পুকুর থেকে সোনালি রঙের মাটি দিয়ে সাবানের মত চুলে মাখতেন গোসলের সময়। তাতেই চুল পরিস্কার হতো খুব। সাবান খুব একটা ব্যবহার করতেন না। ঘরে সাবান থাকলেও মা সাবানের বিকল্প দিয়ে কেন চুল পরিস্কার করতেন, সেটা এখনো আমার কাছে একটা রহস্য।

অথচ আমরা চুল পরিস্কার করার জন্য কত টাইপের স্যাম্পু যে ব্যবহার করি, চুলও পরে সেরাম। অথচ আমার মার চুল কখনো তেমন পড়তে দেখিনি। চুল শুকানোর পর মা খাঁটি নারকেল তেল দিতেন। তারপর একটা শুকনা কাপড় চুলে বেধে রাখতেন। তেলটা সেই কাপড়ে চলে যাবার পর চুল বেধে রাখতেন। বা খুলে রাখতেন। রাতে ঘুমাতে যাবার আগে মা চুল খুলে ঘুমাতেন। চুলগুলো বালিশের পেছনের দিকে খুব যত্ন করে ছড়িয়ে দিতেন। বেশি চুলের কারণে চুল বাধার সময় মা সব সময় কারো সহযোগিতা নিতেন। আমার বোনেরা, চাচিরা, চাচাতো বোনেরা বা পরসি কেউ না কেউ মার চুলে তেল দিয়ে দিতেন। তারপর চুল বেধে দিতেন। তখন তাদের মধ্যে নানান কিসিমের গল্প হতো। মা চুলে কখনো ক্লিপ বা ফিতা পড়েননি। চুল দিয়েই মা চুল বাধতেন। একেবারে ন্যাচারাল।

মামা বা খালাদের চেয়ে আমার মা একটু ছোটখাটো গড়নের ছিলেন। সেজো খালাও ছোটখাটো গড়নের ছিলেন। মামা বা অন্য খালারা অনেক লম্বা লম্বা ছিলেন। আমার বাবা খুব লম্বা ছিলেন। বাবা ছয় ফুট এক ইঞ্চি লম্বা ছিলেন। আমার দাদু ছিলেন আরো লম্বা। ছয় ফুট চার ইঞ্চি। কিন্তু আমার দাদি মায়ের মত ছোটখাটো গড়নের ছিলেন। আমরা অবশ্য দাদিকে দেখিনি। মায়ের কাছে শুধু দাদির গল্প শুনেছি। আমার বড় ভাইয়ের জন্মের আগেই দাদি মারা যান। দাদুভাইকে আমরা পেয়েছি। দাদুভাই কালো ছিলেন। কিন্তু দাদি ছিলেন টুকটুকে ফরসা। আমার বাপচাচারা ফুফুরা সবাই দাদির গায়ের রঙ পেয়েছেন। আমার বাবা-মা দুজনেই ফরসা ছিলেন। আমরা ভাইবোনদের মধ্যে কেবল আমি আর আমার ছোটবোন ছাড়া বাকি সবাই ফরসা।
মায়ের সঙ্গে আমার মধুর স্মৃতি হল, আমার স্কলারশিপে পাওয়া টাকা আমি মায়ের কাছে জমাতাম। কিন্তু নেবার সময় কখনো হিসাব করতাম না। মাও কোনোদিন বলতেন না যে, তোর জমানো টাকা শেষ। কাগজ কলম কেনা, বইকেনা, মেলায় যাবার খরচ, যাত্রায় যাবার খরচ, নৌকা বাইচ দেখতে যাবার খরচ, কোথাও বেড়াতে যাবার খরচ সব সময় মায়ের কাছ থেকেই নিতাম। স্কুল জীবন আমার এভাবেই কেটেছে। কেবল উপরের ক্লাসে ওঠার পর মানে কলেজে আসার পর থেকে খরচ নিতাম বাবার কাছ থেকে। বড় ভাইও অনেক সময় খরচ দিতেন। সেই হিসাবের বিড়াম্বনা এখনো মাঝে মাঝে শুনতে হয়। কারণ সংসারে আজ পর্যন্ত আমি কোনো টাকা পয়সা দিতে পারিনি।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
ছবির ক্যাপশান: ছবিতে মার ডানপাশে আমার ইমিডিয়েট ছোটভাই জাকির, কোলে ওর মেয়ে জয়িতা, মার পেছনে মেঝো ভাই এমদাদের ছেলে উৎস, উৎসর বামপাশে বড়ভাইয়ের ছোটমেয়ে মৌরী, আর মৌরীর সামনে মেঝো ভাইয়ের মেয়ে এষা।
আমার আরেকটি দুঃখ হল, মা-বাবা কারো সাথেই আমার কোনো ছবি নেই। এটা আমি খুব মিস করি।

ছোটবেলায় মাকে আমি কিছু কাজে খুব সহযোগিতা করতাম। বিশেষ করে স্কুল জীবনে। প্রতি বছর বৈশাখী মেলা থেকে মার জন্য আমি কুলা আর তালপাতার পাখা কিনে আনতাম। এটা ছিল পার্মানেন্ট জব। আর ধান ওঠার পর মাঠ থেকে নাড়া কেটে আনতাম। প্রতি বছর আমি নিজ উদ্যোগে একটি নাড়ার পালা দিতাম। সেই নাড়া শুকিয়ে মা ভাত রান্না করতেন। এ বিষয়ে আমার চাচাতো ভাই কালামের সঙ্গে আমার একটা অদৃশ্য প্রতিযোগিতা চলতো। কিন্তু সেই নাড়া রান্না করার জন্য মার খুব উপকারে লাগতো। এছাড়া মা গরুর গোবর দিয়ে পাটখড়ির মুঠি বানিয়ে শুকাতেন। যেগুলো বর্ষাকালে রান্নার কাজে জ্বালানি হিসেবে খুব ব্যবহৃত হতো।

মা অবসর পেলেই রেডিও শুনতে খুব পছন্দ করতেন। গান শুনতে খুব পছন্দ করতেন। আর রেডিও তে নাটক হলে সবার সঙ্গে বসে শুনতেন। কিন্তু নাটক শেষ হলে অন্য কাউকে আবার সেই নাটকের মূলবিষয় মাকে বুঝিয়ে দিতে হতো। কারণ নাটকের শুরুর অংশ প্রায় কখনোই মার শোনা হতো না। কাজ শেষ করে নাটক শুনতে বসতে বসতে নাটকের একটা অংশ আগেই হয়ে যেতো। বাবা ছিল এক্ষেত্রে বিপরীত। বাবা শুনতেন খবর। বিবিসি আর ভয়েস অব আমেরিকা রোজ শুনতেন বাবা। আবার সেই খবর আমার সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে বিচার বিশ্লেষণ করতেন। ইরাক ইরান যুদ্ধের আট বছর, ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সালের প্রায় প্রতিটি খবর বাবা আমার সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে বিচার বিশ্লেষণ করতেন। আমি তখন স্কুলের ছাত্র হলেও বাবা সেই খবর আমার সঙ্গে আলোচনা করতেন।

আমি পড়ার টেবিল ছেড়ে খবরের সেই সময় টুকু বাবার সঙ্গে আড্ডা দেবার স্বাধীনতা ভোগ করতাম। অন্য ভাইবোনেরা যে সুযোগটা পেতো না। বা আগ্রহ দেখাতো না।
খবর শোনার স্বাধীনতা পেলেও সেই সময় আমার একটি বাড়তি চাকির করতে হতো। বাবার হাত-পা টিপে দিতাম। পিঠের চামড়া টিপে দিতাম। মাথা বানিয়ে দিতাম। আর বাবা খবরের বিষয়গুলো আমার সঙ্গে আলোচনা করতেন। রাতে বাবা ঘুমিয়ে যাবার পর রেডিওটা চলে আসতো আমার দখলে।

কেবল খুলনা বা ঢাকা সেন্টারে কোনো নাটক থাকলে সেই রাতে বাড়ির অন্য অনেকের সঙ্গে রেডিওতে নাটক শোনা শেয়ার করার ব্যাপার ছিল। বাবা বাড়িতে থাকলে গান শোনার নিয়ম ছিল ভলিউম কমিয়ে। আর বাবা বাড়িতে না থাকলে অটোমেটিক আমরা রেডিওর ভলিউম বাড়িয়ে দিতাম। মা অবশ্য তা নিয়ে তেমন কিছুই বলতেন না। শুধু খেয়াল রাখতেন রাতে যাতে বাবা খবর শুনতে পারেন, সেরকম ব্যাটারি যেনো থাকে।

বাবা অবশ্য রেডিওতে শব্দ কম শোনা গেলে টর্চলাইট খুলে ব্যাটারি দিতেন। অনেক সময় নাটক শোনার জন্য আমরা চুরি করে বাবার টর্চলাইট থেকে ব্যাটারি নিয়ে রেডিওতে ঢুকাতাম। বাবা অবশ্য পরের রাতে টের পেতেন। আর টর্চের ব্যাটারি দুর্বল হয়ে গেলে নতুন ব্যাটারি কিনে টর্চের ব্যাটারিগুলো আমাদের রেডিও শোনার জন্য দিয়ে দিতেন। কারণ বাবা টর্চলাইটে ফকফকা সাদা আলো পছন্দ করতেন। যখনই সেই আলো লালচে হতো, তখনই আমরা সেই ব্যাটারিগুলো রেডিও শোনার জন্য পেতাম।

দিনের বেলায় বাবা টর্চের তিনটা ব্যাটারির একেবারে পেছনেরটা উল্টা করে রাখতেন। এতে নাকি ব্যাটারি ভালো থাকতো। দিনের বেলায় কখনো চুরি করে বাবার টর্চ থেকে ব্যাটারি নিলে রেডিও শোনার পর তা যদি ঠিকঠাক রাখতে না পারতাম, মার কাছ থেকে পরে শুনতাম যে, বাবা ঠিকই টের পেয়েছেন। আর বকাঝকা করেছেন। তখন রেডিও বাদ দিয়ে পড়াশনায় একটু মনযোগ দিতাম পিঠ বাঁচাতে।

মাত্র এগারো বছর হল মা নেই, অথচ মনে হয় কত বছর মাকে দেখি না। মনে হয় হাজার বছর ধরে মাকে দেখি না। কতোকাল মার ডাক শুনি না। কতোকাল মার কণ্ঠ শুনি না। কতোকাল মাকে ডাকি না। কতোকাল মা মা বলে কোনো আবদার করি না। কতোকাল কারো বিরুদ্ধে মায়ের কাছে নালিশ দেই না। অন্য কারো নালিশ মায়ের থেকে শুনি না। কতোকাল মাকে জড়িয়ে ধরি না। মা, তুমি কোথায় আছো!! কেমন আছো তুমি, মা।

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত