| 18 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক সাহিত্য

সবজে রুমাল রহস্য (পর্ব-১০)

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

অপ্রত্যাশিত প্ল্যান থেকে জন্ম নেয়া একটি নভেলা। তৃষ্ণা বসাকের ভাবনা।
সেদিন কয়েকজন সৃষ্টিশীল মানুষ আড্ডা দিচ্ছিলেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে, আড্ডার শেষে একটি সবুজ রুমালের দেখা মিললো। একটি রুমাল কে বিড়াল করে দেবার জাদু তো প্রবাদের মত। এখানেও হলো তাই হঠাৎ পাওয়া সবুজ রুমাল টি পেয়েই সব ওলটপালট হয়ে গেল একদল সৃষ্টিশীল মানুষের ভাবনায়।জাদুর মতোই কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই ফেলে যাওয়া এক টুকরো রুমাল হয়ে গেলো ১২-ইয়ারি নভেলা ‘সবজে রুমাল রহস্য’।

পরপর লিখবেন ১২ জন। প্রথম পর্ব লিখলেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় এবং শেষ করবেন তৃষ্ণা বসাক। মধ্যে থাকবেন ১০ জন যথাক্রমেঃ

সোনালি, তপশ্রী পাল, ব্রততী সেন দাস, নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত, নন্দিনী সেনগুপ্ত, শ্যামলী আচার্য, কৃষ্ণা রায়, ইন্দ্রনীল বক্সী, সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিতাভ দাস। আজ থাকছে সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা রহস্য নভেলার দশম পর্ব।

কানের কাছেই বাজছে হর্ণ।তাপস কোনরকমে নিজেকে সামলে গাড়ির দরজা খুলে উঠে পড়ে।এই ভীড় কাটিয়েই আজ ওকে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে।কথাটা ভাবতেই গলা শুকিয়ে আসে। জলের বোতল রাখা ছিল পেছনের সিটের পকেটে। ঢকঢক করে এক বোতল জল শেষ করে ও।আঃ! কি যে আরাম লাগছে জলটা খেয়ে।

মায়ের মত বয়সের একজন মানুষ মিসিং হয় কিকরে?ভালো করে হাঁটতে অবধি পারেনা।আজ বাড়ি ফিরে সুচন্দ্রাকে বলতে হবে,এভাবে কাজের লোকের হাতে বাড়ি,  মা সবাইকে ফেলে ওর বেরিয়ে যাওয়া একদম ঠিক নয়। হল তো একটা অঘটন!

পাশের গাড়িটা পাস দিতে না দিতেই ঝড়ের বেগে এগিয়ে গেল। তাপস নিজের মনেই গজগজ করে ,“ননসেন্স,ইডিয়ট!”

গালাগালটা দিয়ে দেবার পর মনে হচ্ছে মাথাটা যেন ঠিকঠাক কাজ করছে।তাপস বাড়িতে গাড়ি ঢোকাতে ঢোকাতে ভাবছিল মাকে ধরে কার কি লাভ হবে?আশির ওপরে বয়স,শরীরের একটা যন্ত্রও ঠিকঠাক কাজ করেনা।কিন্তু ঘটনা হল গতকাল বিকেল পাঁচটা থেকে তিনি নিখোঁজ।তাই আজ সকালে আবার থানায় এসেছিল ও।সব আত্মীয়দের বাড়ি ফোন করা হয়েছে, টুবুর বন্ধুর ফ্ল্যাটের ওখানেও খোঁজ করা হয়েছে।হাসপাতালগুলোতেও খবর নেওয়া হয়েছে।একটা জলজ্যান্ত মানুষ এভাবে উবে যেতে পারে?বাড়িশুদ্ধু সবাই বিমর্ষ হয়ে আছে।  

ফ্ল্যাটে  ঢোকার মুখেই নজরে আসে ঠিক দরজার সামনেই একটা ব্রাউন রঙের খাম পড়ে। অভ্যাসমত কুড়িয়ে পকেটে ঢোকায় ও।কিন্তু ভেতরে ঢুকেই চমকে যায় ।মা বড় সোফায় শুয়ে আছে,ওপাশের একানে সোফায় বসে সুচন্দ্রা ফোন করছে,আর মাম্পি একটা মগে  জল ন্যাকড়া ভিজিয়ে মায়ের পা পরিষ্কার করে দিচ্ছে।

“ব্যাপার কি?আমাকে জানাবে তো।সারারাস্তা আমি…।”

“সুযোগ পাইনি।মার শরীরটা এমন খারাপ হল।ডাক্তারবাবুকে কল দিয়েছিলাম।উনি বললেন প্রেসারটা আবার বেড়েছে।”

“মা কোথায় গিয়েছিল?”

“জানিনা।একটা অটোতে ফিরল।পয়সা দেবার শক্তিটুকুও ছিলনা।আসামাত্র শুইয়ে দিয়েছি।একটা কথা বলারও অবস্থায় ছিলনা।।ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে শুধু।ভাগ্যিস মাম্পি ওই সময়ে নীচে গিয়েছিল।”

তাপস আর কথা না বাড়িয়ে পোশাক ছাড়তে ভেতরের ঘরে গেল।ঠিক পেছন পেছন ঢুকল সুচন্দ্রা।“তোমাকে না জানিয়ে আমি একটা কাজ সেরেছি।আজ ব্যাঙ্কে গিয়েছিলাম।রুমালটা লকারে চালান করেছি।”

“বেশ করেছ।তোমার কি মনে হয়েছিল ওটা নিতে আমাদের বাড়িতে কেউ আসতে পারে?”

“পারে না, এসেছে।পরে বলছি।মাম্পিকে চা দিতে বলেই আসছি।”

সুচন্দ্রা বেরিয়ে যেতেই পোশাক পালটে পকেট থেকে খামটা বার করে তাপস। একটা সাদা কাগজ। তার এক কোনে দুটো মাছ আঁকা।

সুচন্দ্রা  ঘরে ঢুকে ওকে থমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পাশ দিয়ে গলা বাড়ায়।তারপর দুজনে গিয়েই সোফায় বসে।

“না ব্যাপারটা ঠিক ভালো ঠেকছে না।এটা আবার কী?সব জায়গায় মিশরীয় মাছের ছবি!আর দেখো খামে কোন নাম নেই।কে পাঠাল,কে পাবে,কিসস্যু না।”

“তাইতো দেখছি।”সুচন্দ্রা কাগজ নিয়ে নাকে ঠেকায়।“না কোন গন্ধ নেই।”

“এবার খুলে বল কী হয়েছিল।”

কথার মধ্যেই ঢোকে মাম্পি। ঘরে ঢুকে চা রাখতে রাখতে বলে, “দিদি, তোমাকে একটা কথা বলতে একদম ভুলে গেছি।ওই যে লোকটা এসে দিদাকে নিয়ে গেল ও কদিন আগেই বাড়িতে এসেছিল,দুপুরবেলা।দিদার খোঁজ করেছিল।আমি বলেছিলাম দিদা ঘুমোচ্ছে,আর দিদি বাড়িতে নেই ।আপনি পরে আসবেন।”

তারমানে দুর্গাদাস আগেও এসেছে।অথচ সেদিন ফেসবুকের বন্ধুদের জন্য ডাকা বিশেষ আয়োজনে এলো না। মাম্পি চলে যেতে দুজনে মুখ চাওয়া চাওয়ি করে।সুচন্দ্রা মোবাইল ফোনে খুটখুট করতে করতে বলে, “অদ্ভুত ব্যাপার!দুর্গাদাস ফেসবুকে ওর প্রোফাইল অফ্‌ করে দিয়েছে।আর হোয়াটস্‌আপেও কোন মেসেজ যাচ্ছে না।কাল থেকে যতবার ওকে ফোন করছি সুইচড্‌অফ্‌ বলছে।”

তাপস বলে, “এ তো হবারই ছিল।হয়ত ওটা ফেক প্রোফাইল। তোমাকে বারবার এসব গ্রুপে থাকতে বারণ করেছি। এবার?কথা শুনলে কোন কিছুই হত না!”

সুচন্দ্রা কুন্ঠিত গলায় বলে, “তোমাকে সব ঘটনাটা বলা হয়নি।শুনবে?”

তাপস আরাম করে বিছানায় পা তুলে বসে।“হ্যাঁ বল,বিপদে না পড়লে তো তুমি আমার কাছে আসো না।”

                

জ্যোতিপ্রকাশ সিনহার বাড়িতে আসার সিদ্ধান্ত তাপসের।ওরা দুজনে টুবুকে পাহারায় রেখে বেরিয়েছে।মা এখন অনেকটা স্টেডি।তবে আছন্ন ভাবটা পুরোপুরি কাটেনি।

জ্যোতিপ্রকাশ মানুষটা ভালো।বলামাত্র সময় দিয়েছেন।আর ওদের খাতির করে ওপরে এনে বসিয়েছেন।উনি বসে আছেন ওনার লেখাপড়ার টেবিলে।আলো জ্বেলে ম্যাগনিফাইং গ্লাসের নীচে রেখে, সুচন্দ্রার আনা কাগজটা ভালো করে দেখছেন। দেখতে দেখতেই মাথা নাড়েন।“এই চিহ্নকে আমার জ্ঞানে কি বলে সে তো আগেই বলেছি। এর মাধ্যমে শুভকামনাই করা হয় ।এখন অন্য দিকটা হল এইধরনের শুভকামনার মানে কী?মনে হয় জানাতে চাইছে “আমি এসেছি।” আর একটা কথা রুমালটা কোথায়?সুচন্দ্রা বলতে যাচ্ছিল। তাপস ওর হাতে একটা চিমটি কাটে।

“ওটা আপাততঃ থানায়।”তাপস বলে।

“থানায় কেন?”

“নিরাপত্তার জন্য।”

সুচন্দ্রারা  উঠে পড়ে।ওনার দিকে হাত জোর করে বলে, “অনেক কষ্ট দিলাম।কিছু মনে কব্রবেন না।”

নিচে নামতে নামতে সুচন্দ্রা বলতে যাচ্ছিল, “রুমালটা…।”

তাপস বলে ওঠে “নিয়েছ তো? কাল সারাদিন ওটা ব্যবহার করলাম,অথচ কাচতে দিতেই ভুলে গিয়েছিলাম।”

সুচন্দ্রা পেছন ফিরে দেখে জ্যোতিপ্রকাশ নি;শব্দে সিঁড়ির মাথায় এসে দাঁড়িয়েছেন।

বাড়ি এসে ওরা হতবাক।রাত নটা হবে,ওদের ফ্ল্যাটের দরজা হাট করে খোলা। আলো জ্বলছে।মা যেমন ডিভানে তেমনই শুয়ে আছেন। মাম্পি মুখ বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে বাইরের ঘরের বড় সোফার পেছনে।ভয়েই বোধহয় জ্ঞান হারিয়েছে ও।

মুখে চোখে জলের ঝাপটা দিতে ভারি অদ্ভুত কথা বলল মেয়েটা।ওরা বেরোবার পরপরই টুবুর একটা ফোন আসে।ও মাম্পিকে বলে, “আধঘন্টার মধ্যে ঘুরে আসছি।কেউ এলে কী হোলে দেখে নিয়ে কথা বলবি।তবে দরজা খুলবি না।”

সেই মত থাকবে ভেবেছিল ও।কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটি ছেলে এসে ওকে বলে বাইরের ঘরে টেবিলের ওপর টুবু একটা বই ফেলে গিয়েছে,ওকে নিয়ে যেতে বলছে।ও দরজা খুলে দিতেই চোখের নিমেষে ওকে চেপে ধরে বেঁধে ফেলে।সারা বাড়ি হাঁটকে কি যে খুঁজছিল ছেলেটা কে জানে? একবার ওর কাছে এসে চোখ খোলা দেখে মুখে রুমাল চাপা দিয়ে দিল।তারপরে আর কিছুই খেয়াল নেই ওর।

কথাটা ভুল নয়।সারা ফ্ল্যাটের সব আলমারি,বুক কেস একেবারে লন্ডভন্ড করে কিছু খুঁজেছে কেউ।বই,জামাকাপড়,বাসনপত্র যা তা ভাবে ছড়ানো ছেটানো অবস্থায় মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে।এতকিছু তুলতে হবে,গোছাতে হবে।বিদ্যুৎ ঝলকের মত একটা চিন্তা সুচন্দ্রার মাথায় খেলে যায়।ছুটে এসে মাম্পিকে জিজ্ঞেস করে ও, “কিছু জানতে চেয়েছে?”

হ্যাঁ,বাঁধা অবস্থায় বারবার বলছিল, “রুমালটা কোথায়?”আরো বলছিল, “ফ্লাওয়ার ভাসটা নেই? কোথায় আছে বল শিগগির?”

সুচন্দ্রার মনে পড়ে ফ্লাওয়ারভাসটা ধোয়ার জন্য ও বাথরুমে একটা বালতিতে সাবানে ডুবিয়ে রেখেছে।তাড়াতাড়ি গিয়ে ওটা তোলে বালতি থেকে।অবাক কান্ড ভাসটা রঙ বদলে এখন একদম সোনালি।অথচ ডোবানোর সময় ওটা খয়েরি কালারের ছিল।পেছন পেছন এসে তাপসও অবাক হয়ে যায়!সুচন্দ্রা ওকে মাম্পির জন্য মুখে আঙুল চাপা দিয়ে কোন কথা বলতেই বারণ করে ।বালতিতে ভাসটা আবার ডুবিয়ে দেয় ও।যা মনে হচ্ছে ওটা বাথরুমেই নিরাপদে থাকবে।

                     

আধা আলো আধা অন্ধকারে একদম ঝাপসা লাগছে সবকিছু।কাউকে দেখা যাচ্ছেনা, অথচ সবকথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।ওকে ঢুকিয়ে দিয়ে লোকটা যে কোথায় চলে গেল কে জানে? এঘরে কিছু একটা ব্যাপার আছে।ভাবছিল বাবলু।

এরকম ছোটখাটো ধান্দা ও মাঝেসাঝেই করে থাকে।ভালো পাত্তি পাওয়া যায়।তবে আজকের কাজটা একটু টাফ হয়ে গেসল।শালা ছুকরিটা ধ্যাপসা মুরগীর মত দেখতে হলে কী হবে,গায়ে জোর আছে।ভালো ফাইট দিয়েছে।তবে পরে ভয়ে এমন নেতিয়ে গেল।টসকে গেল ভেবে ভয় পেয়েছিল ও।

বোকা পাঁঠি একটা।বাড়িতে কী আছে,কোথায় আছে, কিস্যু জানেনা। বাধ্য হয়েই সব কিছু ঘাঁটতে হল।তা ফক্কা!মনেহয় খবরটা যে দিয়েছে সে ব্যাটা দুনম্বরি।এখন এরা বিশ্বেস করলে হয়। নগদ কিছু মিলবে বলে তো মনে হয়না। ফ্ল্যাটে ধরা পড়লে অবিশ্যি বেদম ক্যালানি জুটত!

যেন দেওয়াল ফুঁড়েই আসে কথাটা। “তুমার নামই বাবলু আছে?”

“হ্যাঁ স্যার।”

“কাম হোলো ?”

“না স্যার।সব জায়গায় হাঁটকেছি।ওরা মনেহয় বাড়িতে ওগুলো রাখেনি।”

“বোগাস!তুমার মুখ দেখল নাকি?”

“হ্যাঁ স্যার।নাহলে ঢুকতে পেতাম না।”

“হুম! এলাকা ছোড়বে।হাঁ সিক্স মান্থ তুমাকে কেউ দেখবে না।সমঝ লো?”

“কিন্তু স্যার এলাকা ছাড়লে…।”

“চোপ্‌ হারামজাদা। ইদিকে একদম গুসবে না..। সমঝ গিয়া না …।”

“বুঝেছি।”

ঘর অন্ধকার থাকে। বাবলু চলে যাবার পর আবার লাইট জ্বলে।

“হ্যালো ম্যাডাম?হাঁ হাঁ।লছমীর কুছু ঠিকানা লাগেনি…। না।হোয়নি।বিলকুল ফেলিওর। একটা ছোকরাকে ভেজেছিলাম।রেজাল্ট জিরো।ওরা বলছে মাল সরিয়ে দিয়েছে।”

“আমার ওটা চাই।সঙ্গে রুমালটা।অনলি থ্রি ডেজ।ক্লিয়ার?”

“কিন্তু ম্যাডাম…।যাঃ শালা! ফোন কেটে দিল তো।”

                       

সুচন্দ্রা চায়ের ট্রে মাম্পির হাতে দিয়ে ঘরে ঢোকে।বাইরের ঘরে আজ এসেছেন থানা থেকে অভিরূপ সরকার।সঙ্গে একজন সুদর্শন ভদ্রলোক।শাশুড়ি মা দুদিন হল হাঁটা চলা করছেন।সেদিনের ঘটনা তেমন কিছুই বলতে পারছেন না।এমনকি অটোতে কে তুলে দিয়েছে সেটাও না।অভিরূপ বাবুর অনুরোধে তাকেও ডিভানে ঠেস দিয়ে বসানো হয়েছে।তাপস ঘরে ঢোকার পর সুচন্দ্রা ইশারা করে।মাম্পি চায়ের কাপে চা ঢেলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।প্লেটে স্ন্যাক্স্‌ সাজিয়ে দিতে দিতে সুচন্দ্রা থমকায় অভিরূপের কথায়।

“ইনি দুর্গাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়।”অভিরূপ সরকার ঠিক তখনই ওই ভদ্রলোকের দিকে নির্দেশ করে বলছিলেন।

ভদ্রলোক অল্প হাসেন। “হ্যাঁ আমিই দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাতি।পেশায় ইতিহাসের শিক্ষক।আপাততঃ দিল্লীর জ়ে এন ইউ তে কর্মরত।আমার দাদুই শ্রীযুক্ত দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।হ্যাঁ তিনিই, যিনি এই বাড়ির দাদুর বন্ধু ছিলেন। ঠাকুমাকে বিদেশে গেলে অনেক গিফট্‌ এনে দিতেন।”

“মানে আপনি দুর্গাপ্রসাদ…!”

“হ্যাঁ আমিই।এবছর দিল্লী থেকে ফেরার পথে আমার কয়েকটা মূল্যবান খাতা,বই ডায়েরি চুরি হয়ে যায়।আমি মিসিং ডায়েরি করি।সেই সূত্রেই আমার অভিরূপ বাবুর সঙ্গে যোগাযোগ।”

সুচন্দ্রা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা।চেয়ারে বসে অভিরূপ বাবুর দিকে তাকাতে গিয়ে দেখে উনি একদৃষ্টে শাশুড়ি মায়ের দিকে তাকিয়ে আছেন।

“কুন্তলা ঠামি,চিনতে পারছেন?”বলে ওঠেন উনি।

“কে বাপি তুমি?তাহলে ওটা কে?”

“ও কেউ নয় মা।ওটা ভুল মানুষ।”সুচন্দ্রা ওনাকে আশ্বস্ত করে।

দূর্গাপ্রসাদের দিকে ফেরে ও, “আচ্ছা আপনি আমাদের ব্যাপারটার খবর পেলেন কিভাবে?”

“কাগজে বেরিয়েছে তো। রাহুল ভাবনানি একজন বড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট।তার মৃত্যু্র সঙ্গে আমার কেসের কিছু সম্পর্ক আছে কিনা তাই নিয়ে অভিরূপ বাবুর সঙ্গে আমার আগেই আলোচনা হয়েছিল। আর রিসেন্টলি আপনাদের ব্যাপারটাও জানিয়েছেন উনিই।

অভিরূপ বাবু মধ্যিখানে ওনাকে থামিয়ে দেন।“আপনাদের ফ্যামেলির সঙ্গে ওনার যোগাযোগের ব্যাপারটা জানতে পেরেই ওনাকে এখানে নিয়ে এসেছি।ইনফ্যাক্ট আমার মনে হচ্ছে এগুলোর পারস্পরিক কোন যোগসূত্র আছে।”

দুর্গাপ্রসাদ আবার নড়েচড়ে বলতে শুরু করেন।“যোগ থাকার সম্ভাবনা ষোল আনার মধ্যে আঠারোআনা। নীতা ম্যাডামের সঙ্গে ওনার যে কানেকসান আছে সে আমি আগেই জানতাম। দিল্লীর ওই অকসান হাউসে আমি বহুবার গিয়েছি। ইনফ্যাক্ট ওদের বিজনেসের যে কিছু অন্যরকমের বেআইনি উদ্দেশ্য আছে সেটা বুঝতে না পারলে আমি ওখানে যাওয়া বন্ধ করতাম না।

আমার ওইসব ডায়েরি গুলোর মধ্যে দাদুর নিজের হাতের লেখা একটা ডায়েরি ছিল।যাতে ওই ফ্লাওয়ার ভাসের উল্লেখ আছে।ওটা বংশ পরম্পরায় ছিল একটি পরিবারে।ওই পরিবারের কোন পূর্বপুরুষ ভেষজ চিকিৎসা করে সম্রাট টুটেনখামেনকে নীরোগ করেন।তিনি খুশি হয়ে মিশরীয় কারুকার্য্য করা ফ্লাওয়ারভাস উপহার দেন ওই চিকিৎসককে।ওই ফুলদানী রঙ পরিবর্তন করে।যে বাড়িতে ওটি থাকে তাদের সৌভাগ্য বৃদ্ধি পায় ।

সুচন্দ্রা এবার বলে “কিন্তু ওটা আপনার ঠাকুরদার হাতে এলো কি করে?”

সেই উপকারের গল্প।তবে আরেকটা ব্যাপারও ছিল।ওদের বংশের কোন মহিলার নাতি এটা আমার দাদুকে উপহার দেন।উনি নাকি বলেছিলেন, “এ বিক্রির জিনিস নয়।কিন্তু ইদানিং এটার খবর বেশ কিছু মানুষ জেনে গিয়েছে। বাড়িতে হামলা হচ্ছে।এটা বাড়িতে রাখা যাবেনা। খবরটা পাঁচকান হবার আগেই এটা আপনি ভারতবর্ষে নিয়ে যান।”

“উনি কি কিছু বলেছিলেন?এত দামী একটা জিনিষ কেন এবাড়িতে দিয়ে দিলেন?”তাপস জানতে চায়।

“ডায়েরিতে উল্লেখ আছে।লিখেছেন,মনিকুন্তলাকে কিছু না জানিয়েই ফুলদানীটা দিয়েছি।ও ওটার মূল্য জানলে ঘাবড়ে যেত।”দুর্গাপ্রসাদ ধীরে ধীরে বলেন।

সুচন্দ্রার মুখ ভয়ে শুকিয়ে গিয়েছে।ও বলে, “ওই সবুজ রূমালটা …।ওটা যে কিভাবে এবাড়িতে এলো।কিছুই বুঝছি না।”

এরমধ্যে কখন যে মনিকুন্তলা উঠে বসেছেন,ওরা কেউ লক্ষ্য করেনি।উনি বলেন, “বউমা আমাকে একটু চা দেবে?গলাটা বড্ডো শুকনো লাগছে।কয়েকটা কথা তোমাকে বলা দরকার।চা খেয়েই বলব।”

সুচন্দ্রা তাড়াতাড়ি চা দেয় ওনাকে।দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসিয়েও দেয়।উনি ধীরে ধীরে বলতে শুরু করেন।“দুর্গাদা ফুলদানীটা দেবার সময় আমাকে জানিয়েছিলেন টাকার অঙ্কে ওটার মূল্য অনেক,তাই একটু সাবধানে রাখি যেন।ওনার বন্ধু কিছু উপহার না পেয়ে অভিমান করায় আমি ওটা আর ব্যবহার করিনি।ট্রাঙ্কেই রাখা ছিল।আর একটা কথা,বউমা, বারবার তোমাকে সেদিন বলেছিলাম রুমালটা কে ফেলে গেল?তুমি খোঁজ নিয়েও জানতে পারোনি।আমার পরে অন্য একটা সম্ভাবনার কথা মনে হয়।”

“কী মনে হয় মা?” সুচন্দ্রা উৎসুক হয়।

“সেদিন ধোপানি এসেছিল বাড়িতে কাপড় দিতে।ও ফেলে গেল না তো?”

“ধোপানি?”তাপস জানতে চায়।

“হ্যাঁ।কাপড় দিতে এসেছিল।আর একটু বেলায় ঠেলা গাড়ি করে একজন পাপোষ,ঝুড়ি বিক্রি করে গেল।ও নয় তো?পরে এসেছিল কুরিয়ারের লোকটা।”

অভিরূপ বলেন, “ওসব ভেবে লাভ নেই।কে দিয়ে গেল তার থেকেও বড় কথা হল কেন দিল? উদ্দেশ্য কী ছিল?”

সুচন্দ্রা বলে, “এই তো মা অনেককিছুই মনে করতে পারছেন।একটু ভেবে বলুনতো সেদিন ওই দুর্গাদাস কোথায় নিয়ে গেছিল আপনাকে?আর কিভাবেই বা ফেরৎ দিল?”

“ওর নিয়ে যাওয়াটা মনে আছে।একটা পাঁচমিশিলি বাড়ি।তার একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল তো।ঠান্ডা ঘর, অল্প পাওয়ারের আলো। একটা ঝিমঝিমে বাজনা বাজছে।ঘরজুড়ে মিষ্টি গন্ধ!ও বউমা মনে পড়েছে,গন্ধটা ঠিক রুমালের গন্ধের মত।ওই দুর্গাদাস আমার কপালে হাত বুলিয়ে কীসব জিজ্ঞেস করছিল।আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।”

সুচন্দ্রা বলে, “পুরো একটা দিন বাড়ি ফেরেননি।এভাবে যার তার সঙ্গে আর বেরোবেন না।তাছাড়া আমরা এখন বিপদের মধ্যে আছি।”

“ঠিক বলেছেন ম্যাডাম।আপনারা এখন …।মানে একটু সাবধানে থাকবেন।বাইরে দুজন পুলিশ প্লেন পোশাকে গার্ড দিচ্ছে।আমরা সিওর ওরা আবার হানা দেবে।”

ওরা দুজন বেরিয়ে যাবার পরপরই মোবাইল আবার বেজে ওঠে।সেই ঝিমঝিমে মিউজিক।কথা নেই।

সুচন্দ্রা মোবাইল ডিসকানেক্ট করে দেওয়ার পরপরই ওদের বাড়ির ফোন বেজে ওঠে খুব মিহি গলায় একজন মহিলা জানতে চান, “আচ্ছা সুচন্দ্রা ম্যাডামকে একটু দেওয়া যাবে?”

                     

  

   

  

                      

                        

     

  

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত