অপ্রত্যাশিত প্ল্যান থেকে জন্ম নেয়া একটি নভেলা। তৃষ্ণা বসাকের ভাবনা।
সেদিন কয়েকজন সৃষ্টিশীল মানুষ আড্ডা দিচ্ছিলেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে, আড্ডার শেষে একটি সবুজ রুমালের দেখা মিললো। একটি রুমাল কে বিড়াল করে দেবার জাদু তো প্রবাদের মত। এখানেও হলো তাই হঠাৎ পাওয়া সবুজ রুমাল টি পেয়েই সব ওলটপালট হয়ে গেল একদল সৃষ্টিশীল মানুষের ভাবনায়।জাদুর মতোই কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই ফেলে যাওয়া এক টুকরো রুমাল হয়ে গেলো ১২-ইয়ারি নভেলা ‘সবজে রুমাল রহস্য’।
পরপর লিখবেন ১২ জন। প্রথম পর্ব লিখলেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় এবং শেষ করবেন তৃষ্ণা বসাক। মধ্যে থাকবেন ১০ জন যথাক্রমেঃ
সোনালি, তপশ্রী পাল, ব্রততী সেন দাস, নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত, নন্দিনী সেনগুপ্ত, শ্যামলী আচার্য, কৃষ্ণা রায়, ইন্দ্রনীল বক্সী, সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিতাভ দাস। আজ থাকছে তৃষ্ণা বসাকের লেখা রহস্য নভেলার শেষ পর্ব।
অচেনা রাস্তা
ম্যাডাম, নিচে একটা গাড়ি এসেছে, আপনাকে নিতে।
ব্যস্ত হয়ে ওঠে সুচন্দ্রা, বেশ কিছু বছর লিখছে সে, কিন্তু কোন সাহিত্যসভার প্রধান অতিথি এই প্রথম, সে সিকিওরিটিকে বলে, ‘একটা মেয়ে এসেছে না?’
‘না ম্যাম, শুধু ড্রাইভার, বলছে এখনি না বেরোলে লেট হয়ে যাবে, পুরো রাস্তা জ্যাম আছে।’
‘আচ্ছা, এখনি আসছি, ওয়েট করতে বলো।’
একটা সিল্কের বোমকাই, মেরুন টেম্পল পাড়, ঘিয়ে রঙ, অনেক ভেবেচিন্তে এই শাড়িটা বেছেছে আজ। প্রধান অতিথির সঙ্গে যাবে বেশ।এটা আসলে শাশুড়ির শাড়ি, সিল্ক পরেন না তিনি অনেকদিন, তাই দিয়ে দিয়েছেন তাকে।
ওখানে তার চেনাশোনা কে কে থাকবে কে জানে। এই কদিন এই রুমাল রুমাল করে সব মাথায় উঠেছে, কাউকে আলাদা করে জানানো হয়নি, ফেসবুকে পোস্ট দেওয়াও হয়ে ওঠেনি, চেনা কেউ থাকলে ছবি তুলে দিত, পোস্ট করতে সুবিধে হত। এখন ওই মধুমিতাকেই বলতে হবে। কথা বলে তো মনে হল খুব ভালো মেয়ে। কি গদগদ গলায় কথা বলছিল। নিশ্চয় খুব ব্যস্ত অনুষ্ঠান নিয়ে, তাই নিজে নিতে আসতে পারল না। কিন্তু অন্য কারো আসা উচিত ছিল না কি? দূর, না এসেছে, ভালই হয়েছে, বকবক করে মাথা খারাপ করে দিত। এই ভালো, বেশ একা একা যাওয়া যাবে। অনেকদিন নিজের সঙ্গে সময় কাটায়নি সুচন্দ্রা। এত বছর তো সংসার, সংসার করেই কেটে গেল। এখন ছেলে বড় হবার পর নিজের মতো একটা বন্ধুবৃত্ত, লেখার জগত তৈরি করেছে, সেখানেও কি ঝামেলা! কোত্থেকে একটা রুমাল জুটে… যাক আজ একটা ভালো অনুষ্ঠানে যাচ্ছে, এক হিসেবে একটা আউটিং হয়ে যাবে, সুচন্দ্রা দ্রুত হাতে চোখে লাইনার লাগায়, কপালে মাঝারি মেরুন টিপ, লিপস্টিকটা একটু হাল্কাই রাখে, প্রধান অতিথি বলে কথা। সাজ যেন সম্পূর্ণ হয় না সুগন্ধ ছাড়া। সুচন্দ্রা তাড়াহুড়ো করে ড্রেসিং টেবিলের ওপরে রাখা পারফিউমের শিশি থেকে স্প্রে করে শরীরের পালস পয়েন্ট গুলোতে। আর অমনি সে চমকে যায়, এই পারফিউমটা কোত্থথেকে এল? এ তো সেই ঝিম ধরানো গন্ধটা! আর কদিন পরে তাদের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি, তাহলে কি তাপস আগেভাগে তার গিফট কিনে ড্রেসিং টেবিলে রেখে দিয়েছে? কিন্তু কিনল তো কিনল, বেয়াক্কেলের মতো সেই ঝিমঝিমে গন্ধ? নাহ, এসব নিয়ে ভাবলে এখন দেরি হয়ে যাবে। কম দূর নয় তো, সেই লেক টাউন। কী যেন নাম হলটার? কার্ডটা পরশু দিয়ে গেছে একটা ছেলে এসে, সুচন্দ্রা তখন মাকে দেখতে ভবানীপুর গেছিল, খুলে দেখাই হয়নি, কোথায় রেখেছে যে ছাই। খুঁজতে খুঁজতে সে ডাইনিং স্পেসে আসে। অনেক সময়ে দরকারি কাগজপত্র এখানেই একটা ট্রেতে রাখে সে, আসলে তার আলাদা লেখার টেবিল নেই, এখানেই ল্যাপটপ নিয়ে লেখে সে, ক্লান্ত লাগলে ল্যাপটপটা বিছানায় নিয়ে চলে যায়। ডাইনিং টেবিলে এসে সে দেখল শাশুড়ি সেখানেই বসে। ওঁকে চা দিয়ে সে রেডি হতে গেছিল। এখনো তিনি সেখানেই বসে মন দিয়ে কী একটা পড়ছেন। সুচন্দ্রা চমকে ওঠে। আজকের অনুষ্ঠানের কার্ডটা না? ডাইনিং টেবিলে পড়ে আছে দেখে তুলে নিয়েছেন হয়তো। কিন্তু একটা অনুষ্ঠানের কার্ডে এত মন দিয়ে দেখার কী আছে, ভেবে পেল না সে। এমনিতে কোনদিন তার কোন কাগজপত্র ঘাঁটার স্বভাব নেই অবশ্য তাঁর, উলটে একদিন একটা কাশ্মীরি কাঠের বাক্স তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছেন, এটা তাঁর চিঠির ঝাঁপি, সুচন্দ্রা তো লেখালেখি করে, পড়ে দেখতে পারে এর থেকে সে গল্পের কিছু মালমশলা পায় কিনা। সে অবশ্য কয়েক মাস আগের কথা। সুচন্দ্রার ভারি বয়ে গেছে ওইসব মান্ধাতা আমলের চিঠি পড়ে দেখতে। অবশ্য মুখের ওপর কিছু বলেনি, চুপচাপ নিয়ে আলমারিতে শাড়ির তলায় রেখে দিয়েছে। এখন কিন্তু সে বেশ অভদ্রতা করেই শাশুড়ির হাত থেকে কার্ডটা ছোঁ মেরে নিয়ে বলল ‘ওহ মা, আমি সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি, আর আপনি এটা নিয়ে বসে আছেন? আচ্ছা, আমি বেরোচ্ছি, মাম্পিকে বলবেন, আই হোলে দেখে তবেই যেন দরজা খোলে, আর হুটহাট পাড়া বেড়াতে চলে যায় না যেন আপনাকে ফেলে, আর আপনার ছেলে ফিরলে, কড়াইশুঁটির কচুরিগুলো যেন গরম গরম ভেজে দেয়, আলুর দম আছে, চারটের বেশি যেন না দেয়, আর আপনিও ওই সঙ্গে খেয়ে নেবেন, ফ্রিজে নলেন গুড়ের সন্দেশ আছে। আমার ফিরতে কিন্তু দেরি হবে, লেক টাউনে জায়গাটা, আর টুবু খেয়ে ফিরবে, কোয়েস্টে বন্ধুদের ট্রিট দেবে, মুভি দেখবে, সবে চাকরি পেল, এর মধ্যেই দেখুন’ ঝড়ের মতো কথাগুলো বলে যাচ্ছিল সুচন্দ্রা, সে খেয়াল করল না, মণিকুন্তলা কী যেন বিড়বিড় করছেন, খেয়াল করলে সে শুনতে পেত, ‘চিঠিগুলোর কোণে একই রকম ছবি ছাপা থাকত, ল্যাজটা একটু ওপর দিকে তোলা’
বেরোতে যাবে, অমনি মণিকুন্তলা বললেন ‘কোথায় যাচ্ছ বউমা? বেশি রাত করো না, জানো তো তাপু এসব বেশি পছন্দ করে না’
মাথা জ্বলে গেল সুচন্দ্রার। এতবড় একটা সম্মান তার আজ, আর বাড়ির লোকের একটুও সমর্থন নেই, এই তো লেখকের জীবন। সারাজীবন তাপস তাকে চাকরি করতে দিল না, পি এইচ ডি এনরোল করেও করা হল না, কি না টুবুর দেখাশোনা হবে না, তাপস অফিস থেকে ফিরে এসে একা থাকবে! এখন সব দায়িত্ব শেষ করে নিজের মতো একটু বাঁচতে চাইছে সে, সেখানেও বাধা। দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করে লিফটের বোতাম টেপে সে।
গাড়ির সিটে বসতেই এতক্ষণে হালকা লাগে একটু। ওহ, বাড়ি থেকে বেরনো মুখের কথা! হাজার ঝামেলা। তবে একবার বেরিয়ে পড়লে কয়েক ঘণ্টার মতো নিশ্চিন্ত। ছেলে, বর, শাশুড়ি, দুধ, মাছওলা, ফেরিওলা, পুজোর চাঁদা সমস্ত কিছু থেকে সাময়িক শান্তি। ফোনই ধরবে না আজ। সাইলেন্ট করে দেয় ফোনটা। রুবি কানেক্টর পেরিয়ে যেতে মনটা বেশ ফুরফুরে লাগে। তার দৌড় গড়িয়াহাট থেকে বাংলা অকাদেমি পর্যন্ত। কদাচিৎ কলেজ স্ট্রিট। এখনো তার কোন বই বার হয় নি। সবাই বলছে বই বার করে নাকি লাভ নেই। কেউ পড়ে না আজকাল বই। কিন্তু এবার তার একটা বই না বার করলেই নয়। বই ছাড়া কি লেখক হয়? দেখবে একবার মিত্রাদিকে বলে। ওঁর তো অনেক চেনাশোনা। নিজের চিন্তায় এত মগ্ন ছিল সুচন্দ্রা, খেয়ালই করেনি একটা কালো গাড়ি তাদের গাড়িটাকে অনেকক্ষণ ফলো করছে, সেই ট্রাঙ্গুলার পার্ক থেকেই। এটাও সে খেয়াল করল না, রুবি থেকে সায়েন্স সিটি পৌঁছে গাড়িটা হঠাত বাসন্তী হাইওয়ের রাস্তা ধরল। যখন খেয়াল হল, তখন চারপাশ বেশ নির্জন, ব্যস্ত ট্রাফিকের জায়গায় মেঠো পথ, দূরে দূরে দু একটা কারখানা, সূর্য পাটে যাবার আগে খুনখারাবি লালে ব্রাশ চুবিয়ে আকাশের গায়ে এলোপাথাড়ি ঘষছে।এত রক্ত কেন! সুচন্দ্রার কেমন যেন শীত করে উঠল। এই ডিসেম্বরেও শহর কলকাতায় তেমন শীত কই? কিন্তু এটা তো শহর নয়। এখানে গাড়ি কেন ঢুকল? অনুষ্ঠানটা তো লেক টাউনে হবার কথা না? হাতে ধরা কার্ডটা তাড়াতাড়ি খোলে সুচন্দ্রা। এই তো ‘গল্পের শহর’ পত্রিকার আনুষ্ঠানিক প্রকাশ অনুষ্ঠান, প্রধান অতিথি -প্রখ্যাত লেখিকা সুচন্দ্রা ব্যানার্জি। কমরেড বিজলি ঘোষ স্মৃতিভবন, লেকটাউন, জয়া সিনেমা হলের সন্নিকটে। তাহলে, তাহলে গাড়ি এই রাস্তায় ঢুকল কেন? সুচন্দ্রা শুখনো খসখসে গলায় ড্রাইভারকে বলে, ‘আপনি এদিকে কোথায় যাচ্ছেন? অনুষ্ঠান তো লেক টাউনে।’ ড্রাইভার মাথা না ঘুরিয়ে মিহি গলায় বলে ‘একজন উঠবেন এখান থেকে’। সুচন্দ্রা খানিকটা আশ্বস্ত হয়। ছোট পত্রিকা। তাদের পক্ষে বিশেষ অতিথি, প্রধান অতিথি, সবাইকে তো আর আলাদা আলাদা গাড়িতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সেটা আগে জানিয়ে দিলেই হত। ভারি বিরক্ত লাগে । গিয়েই মধুমিতা মেয়েটাকে বলবে। হঠাত গাড়ি থেমে যায়, দুপাশে ধানক্ষেত, ধানের কাটা নাড়া পড়ে আছে। কেমন একটা বিষণ্ণতা ঘিরে আছে চারপাশ। দূরে একটা ভাঙ্গাচোরা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। বিশেষ অতিথি এইরকম বাড়িতে থাকেন? নামটা কি তাঁর? কার্ডটা আরেকবার দেখতে যায় সুচন্দ্রা। অমনি কার্ডের এককোণে একটা মাছের জলছাপ তার চোখে ধাক্কা দেয়। বিদ্যুতচমকের মতো মাথায় আসে বেরোবার সময় শাশুড়ি বিড়বিড় করে কী যেন বলছিলেন? ‘চিঠিগুলোর কোণে একইরকম ছবি ছাপা থাকত, লেজটা একটু ওপরদিকে তোলা।’ এই প্রথম সুচন্দ্রার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমেল স্রোত নেমে যায়। পারফিউমের সেই ঝিম ধরা গন্ধ, মধুমিতার না আসা, বাসন্তী হাইওয়েতে গাড়ি ঢোকা, নির্জন প্রান্তরে গাড়ি থেমে যাওয়া, রহস্যজনক বিশেষ অতিথি- যেন একটা রুমালের ফাঁসের মতো তার গলায় চেপে বসে। সে গাড়ির দরজা খুলে বাইরে নেমে আসে, উল্টোদিকে কোন গাড়ি দেখলেই থামাতে হবে। ফোন করবে তাপসকে? হঠাৎ একটা পায়ের শব্দে চমকে ওঠে সে, পেছন থেকে কে যেন তার কাঁধে হাত রাখে। চিৎকার করতে গিয়ে গলায় একটা ফ্যাসফেসে আওয়াজ বেরোয়। ‘কাকে ফোন করছেন সুচন্দ্রাদি? দিন আমাকে দিন, আমি করে দিচ্ছি’
ঘুরে তাকিয়ে সুচন্দ্রার কথা সরে না, দুর্গাদাস গোগল, সেই ঠগটা!
‘আমাকে এখানে এনেছ কেন? গাড়ি ঘোরাও, বাড়ি ফিরব’
‘ধীরে রজনী, ধীরে। আগে বলুন পদিপিসির বর্মিবাক্স থুড়ি কাশ্মীরি কাঠের বাক্সটা কোথায় রেখেছেন? সেটা আগে আমাদের লোক নিয়ে আসুক, তারপর আপনি বাড়ি গিয়ে গপ্পো উপন্যাস মহাকাব্য যা ইচ্ছে লিখুন’ কাশ্মীরি কাঠের বাক্স! যেটাতে শাশুড়ির আদ্যিকালের চিঠি বোঝাই, সেটা নিয়ে কী করবে এরা?
সুচন্দ্রার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। সে বলে ‘গিয়ে কিচ্ছু পাবে না, আমি আসার আগে পুলিশকে সব জানিয়ে এসেছি’
গোগল যেন খেলাচ্ছলে পকেট থেকে একটা রিভলবার বার করে। ভয়ে দিকবিদিক শূন্য হয়ে ওকে ধাক্কা দিয়ে ছুটে পালাতে যায় সুচন্দ্রা। অমনি পেছন থেকে ভারি একটা জোরে মাথায় এসে লাগে। রক্ত, রক্ত। ওই আকাশটার মতো। জ্ঞান হারিয়ে ধানক্ষেতে লুটিয়ে পড়ে সুচন্দ্রা।
দূর থেকে জলের ছলছল শব্দ আসে। সুচন্দ্রা কি সমুদ্রে বেড়াতে এসেছে? নাকি এটা নীল নদ? কি নীল চারদিকে!গহন নীল জলে আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে সে, টুবু, টুবু…। ছেলেটা খুব ফিশ ফ্রাই খেতে ভালো বাসে। ‘মাম্পি, ফিলের প্যাকেটটা এনেছি কিনা দেখ তো, ফ্রাইগুলো গড়ে রাখি’, কিন্তু, সে তো আরও অতলে ডুবে যাচ্ছে, ফ্রাইগুলো গড়ে যাওয়া হল না, একটা গল্প আধখানা লেখা রয়েছে, কখন শেষ করবে? কে যেন বলেছিল, ওগুলো থেকে তুমি অনেক গল্পের রসদ পাবে, কিন্তু সুচন্দ্রা যে ডুবে যাচ্ছে, হঠাৎ একটা অতিকায় মাছের লেজ দেখতে পায় সে, মরিয়ার মতো আঁকড়ে ধরে সেটা, এটা কি সেই মনুর নৌকো টেনে নিয়ে যাওয়া মাছ? সৃষ্টি বেঁচে যাবে এবারকার মতো…। কে যেন বলছে, ‘এত করে বারণ করি যেকোন জায়গা থেকে ডাকলেই ছুটে ছুটে যেও না, আর এই সব ফেসবুক, হোয়াটস্আপ , এগুলোই হয়েছে যত নষ্টের মূল। ওই করতে গিয়েই এখন বোঝ’, গলাটা খুব চেনা চেনা লাগে, কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারে না সুচন্দ্রা, কে যেন মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে ডাকছে , মা,ও মা!।সুচন্দ্রা আবার জ্ঞান হারায়।
আজ বসন্ত
সরস্বতী পুজোর বেশি দেরি নেই আর। সুচন্দ্রার ছাদবাগান এখনো আলো করে আছে গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, আরও কত মরশুমি ফুল, যদিও হাওয়ায় একটা ফুরফুরে হালকা মেজাজ বলে দিচ্ছে, এবার অন্য ফুল ফোটার সময় এসে গেল। পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, শিমুল। প্রতি বছর ছাদে বসন্তোৎসব করে সে। এবার আর ওসব নিয়ে ভাবছে না, শরীরটা তার এখনো পুরোপুরি সেরে ওঠেনি, সারাদিন বিছানাতেই কেটে যায়, হাউস কোট ছাড়েই না। আজ সে অনেকদিন পরে একটা খেশ শাড়ি পড়েছে, মাম্পি চুল বেঁধে দিয়েছে, নিজেই বিছানায় বসে বসে হাত আয়নায় কপালে টিপ পরল, ঠোঁটে ভেজলিন দিতে গিয়েও একটু লিপস্টিক লাগিয়ে নিল, আজ খুব ভালো লাগছে তার।
টুবু তাকে ধরে ধরে ড্রয়িং রুমে নিয়ে এল। নিজেই আসতে পারত এটুকু। কিন্তু ছেলের স্পশর্টা তার খুব ভালো লাগল আজ। সে ঢুকতেই ইতিমধ্যেই বসে থাকা তিন পুরুষ উঠে দাঁড়ায়, তাপস, অভিরূপ সরকার আর দুর্গাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। সুচন্দ্রা বসতে বসতে দেখল মণিকুন্তলাও বসে আছেন উলটোদিকের ইজিচেয়ারে। ওর মনে হল অনর্থক তাঁকে এসবের মধ্যে…
মাম্পি সবাইকে কফি, মাফিন আর চিজ বিস্কিট এনে দিল। কী নৈঃশব্দ্য ঘরটায়, বুকে চেপে বসছিল। সুচন্দ্রার ইচ্ছে করছ্নি ছাদবাগানে চলে যায়। কিন্তু, আজ যে এখানে তাকে থাকতেই হবে। তাপস এখনো তার সঙ্গে দরকার ছাড়া কথা বলে না। সে মনে করে সুচন্দ্রাই এই বিপদ ডেকে এনেছে।
কফি শেষ করে গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করেন অভিরূপ।
‘ প্রথমেই বলি, মিসেস ব্যানার্জি, আপনার সঙ্গে যা ঘটেছে, তার জন্যে কোনমতেই আপনি দায়ী নন, তাই শুধু শুধু অপরাধবোধে ভুগে নিজের শরীর, মন খারাপ করবেন না। আসলে অতীতের মধ্যেই আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের বীজ নিহিত থাকে, আমারা না জেনে না বুঝে তাই মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব ঘটনার মধ্যে জড়িয়ে যাই, যা আমরা স্বপ্নেও ভাবি না। তাই আমি বলি আমরা আসলে অতীতের সন্তান, ইতিহাসজাতক।’
মাম্পি কফির কাপ, প্লেট সরিয়ে নিয়ে যায়, মাফিন, চিজ বিস্কিট কেউ ছুঁয়েও দেখেনি, ওগুলো পড়ে থাকে , অভিরূপবাবু আবার বলতে শুরু করেন ‘ একটা জিনিস গোয়েন্দা না হয়েও সবাই বুঝতে পারছেন। এ বাড়িতে যা যা ঘটেছে, তার সঙ্গে মিশরের একটা সম্পর্ক আছে। রুমালের বিশেষ ধরনের কাপড়, তাতে উৎকীর্ণ লিপি, নীতা আহমেদ -র কায়রো ইউনিভার্সিটি। আর এইসব কিছু এসে একটা বিন্দুতেই মিলে যায়, একটি মানুষে, তাঁর নামও আপনারা সবাই জানেন, দুর্গাদাসবাবু, তাপসবাবুর বাবার বন্ধু। তারমানে সব শুরুর আগের একটা শুরু থাকে, সুচন্দ্রা যা শুরু করেছেন বলে মনে হয়েছে, তা আসলে অনেক আগেই শুরু হয়েছিল। আর শুধু মিশর নয়, এসব কিছুর সঙ্গে বসন্তের একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে।’
বসন্ত! সোফায় বসে সোজাসুজি ছাদবাগানটা দেখতে পাচ্ছে সুচন্দ্রা। কতদিন সে বাগানে যায়নি, অযত্নের ছাপ গাছপালায়, এবার বসন্তে গান, কবিতা, আবির নিয়ে, বন্ধুদল নিয়ে মেতে উঠবে কি তার ছাদ?
অভিরূপ সরকার বলেন ‘মিসেস ব্যানার্জি কোনদিন দেখেননি দুর্গাদাসবাবুকে, মানে মিসেস ব্যানার্জি জুনিয়র, সুচন্দ্রা দেবী, যিনি তাপসবাবুর সঙ্গে বিয়ের পর এই বাড়িতে থাকছেন গত বাইশ বছর। না টানা নয়, তাপসবাবু বেশ কিছু বছর রুরকি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়াতেন, তখন ওঁরা তিনজনে রুরকিতেই থাকতেন, মোটামুটি ২০১৩ সাল থেকে ওঁরা আবার এই বাড়িতে ফিরে আসেন। তাপসবাবু তখন নিজের একটা ডিজাইন ফার্ম খুলেছেন তারাতলা ছাড়িয়ে।’
তাপসের বিস্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে অভিরূপ বলেন ‘টুবুবাবু, মানে শ্রীমান তীর্থংকর আমাকে জানিয়েছে এসব। নেহাতই নির্দোষ পারিবারিক ইতিহাস।’
নির্দোষ পারিবারিক ইতিহাস- শব্দ তিনটে কেমন বেখাপ্পার মতো হাওয়ায় ঝুলে থাকে। মণিকুন্তলা মাম্পিকে ইশারায় বলেন জলের বোতলটা দিতে।
অভিরূপ যেন একটু থেমে থাকেন মণিকুন্তলাকে জল খাওয়ার সময় দিতে, তারপর শুরু করেন ‘ সুচন্দ্রাদেবী, আপনারা যখন ২০১৩ সালে এ বাড়ি ফিরে এলেন, তার দু বছর আগে বসন্ত এসে গেছে। চমকাবেন না, এই সেই বসন্ত, ইতিহাস যাকে বলে আরব বসন্ত, ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি কায়রোর তাহরির স্কোয়ারে বিশাল জমায়েত। সবাই চায় প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের পদত্যাগ। হোসনি মুবারক গেলেন, এলেন মহম্মদ মোরসি। যার পেছনে ছিল মুসলিম ব্রাদারহুড পার্টি। মোরসিও উৎখাত হলেন। তারপর চলল চরম নৈরাজ্য। প্রচুর মুসলিম ব্রাদারহুড খুন হল, অনেকে পালিয়ে আত্মগোপন করে রইল অন্য দেশে, তাদের মধ্যেও ভাঙন দেখা দিল, শাখা, উপশাখা হল, কেউ কেউ চাইল পুরনো ভাবধারা আমূল সংস্কার করে নতুন মিশরের জন্ম দিতে।’
তাপস অসহিষ্ণু হয়ে বললেন ‘মিঃ সরকার আপনি কোথায় সুচন্দ্রার দুষ্কৃতীরা ধরা পড়েছে কিনা বলবেন, এসব কি ভ্যান্তাড়া করছেন, ইতিহাস, আরব বসন্ত, অল বুলশিট’
‘আর মিনিট পনেরো লাগবে আমার। হ্যাঁ, কোথায় যেন ছিলাম, আরব বসন্ত। ইতিহাসের এক আশ্চর্য ক্রান্তিকাল। সেই তাহরির স্কোয়ারের জমায়েতে দেখতে পাচ্ছি, হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে নীতা আর ফিরোজ। রাজনীতির থেকে মাদক আর কিছু হয় না তাপসবাবু, এর খোঁজ নার্কোটিক বিভাগ পাবে না। ওদের প্রেমের প্রথম পর্ব একটা নতুন দেশ গড়ার স্বপ্নে মশগুল। আর সেসময়ই ওদের সঙ্গে আলাপ দুর্গাদাসবাবুর। নীতা, ফিরোজ আর এইরকম সমমনস্ক কয়েকজন মিলে যখন নতুন একটা রাজনৈতিক দল খুলল, তার থিংক ট্যাংক ছিলেন এই দুর্গাদাসবাবুই। সেসময় নীতা আর ফিরোজ দুজনেই অগ্নিশুদ্ধ তরুণ, সমাজ বদলের স্বপ্নে মশগুল। আজকের নীতা আর ফিরোজকে তাদের সঙ্গে মেলানো যাবে না’
‘নীতা, সিন্ধি মেয়ে ছিল আর ফিরোজ বাংলাদেশের, আমার মতো। ওরা দলটার নাম দিতে চেয়েছিল নীল মেঘনা, অফিসিয়ালি অবশ্য অন্য নাম,’
সবাই চমকে তাকায় মণিকুন্তলাদেবীর দিকে। অভিরূপ ওঁর কাছে গিয়ে বলে ‘আপনি বলুন মাসীমা, কিছু লুকোবেন না’
‘না লুকোব কেন? সারাজীবন অনেক ভয় নিয়েই তো বাঁচলাম, সমাজের ভয়, সম্মানের ভয়। আশি বছর পার করে, ওসব আমার ঘুচে গেছে। আজ আমি বলে যাই, মানুষটা আমায় খুব ভালবাসত, আমিও। তা বলে কি স্বামীর কোন অযত্ন করেছি? আসলে কি জানো বাবা, ঘরে এক-আধটা জানলা না থাকলে ঘর ঠিক ঘর থাকে না। তাপুর বাবা মানুষটা নিজের কাজ ছাড়া কিছু বুঝতেন না। আমি ছিলাম এ বাড়ির আর পাঁচটা আসবাবের মতো। আছি, এইটুকুই। দুর্গাদাসবাবু দেশবিদেশে ঘুরতেন, মনটাও ওঁর ছিল পৃথিবীর মতো বড়। আমাকে বলতেন , মণি, চলো এবার তোমাকে নিয়ে যাবই।’ হ্যাঁ সবার আড়ালে সে আমাকে তুমি বলত, আর মণি। আমি অবশ্য কোনদিন আপনিটা ছাড়তে পারিনি। আমি যেতে পারব না জেনে সে আমাকে সব জায়গা থেকে চিঠি লিখত, তাপুর বাবা চিঠি খুলে পড়ত বলে, সাধারণ চিঠির মধ্যে কিছু সঙ্কেত ঢুকিয়ে দিত, যা শুধু উনি আর আমি বুঝতাম। আর এই চিঠিতেই জেনেছিলাম, ওই নতুন দলের প্রতীক উনি করে দিয়েছেন মাছ, মিশরের কোন দেবীর আদলে নাকি। কী যেন নাম, হাতমেহিত।প্রাচীন মিশ্রে এই দেবী ছিলেন নতুন জীবন আর সুরক্ষার প্রতীক। নীতাদের পার্টি তো মিশরকে তাই দিতে চেয়েছিল। ওদের খুব উঁচু ধাপের সদস্যদের গায়ে মাছের উল্কিও করা থাকত। পরে অবশ্য ওদের পার্টিতে বেন জল ঢোকে, আল নুর বলে একটা পার্টির সঙ্গে প্রায়ই ওদের সংঘর্ষ হতে থাকে, সেইরকম কোন এক এনকাউন্টারে নীতার পায়ের আঙ্গুল যায়’
তাপস বিরক্ত গলায় বলেন ‘মাম্পি, মাকে ভেতরে নিয়ে যা তো। ভীমরতি যত’
মাছ! চমকে ওঠে সুচন্দ্রা। রুমালে প্রায় আবছা মাছের আদল, কার্ডে মাছ, সব কেমন মিলে যাচ্ছে।
অভিরূপ সরকার দৃঢ় গলায় বলেন ‘না মাসীমা কোথাও যাবেন না। বলেছিলাম না সুচন্দ্রা দেবী, দুটো বসন্তের কথা, এক আরব বসন্ত, আর এক এই জীবনের অকাল বসন্ত, যা দুটো পীড়িত মনে সুবাতাস নিয়ে আসে। কিন্তু এই বসন্তকে ভয় পায় তারা, যারা জীবনটাকে মনে করে মার্চ পাস্ট, বসন্তের মার্চ মাস এদের কাছে পাস্ট। যেমন তাপস বাবুর বাবা, তেমনি তাপস বাবু। তাই দুর্গাদাসবাবুর এ বাড়িতে আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল, শেষ যেবার এলেন…।’
‘তাপুর বাবা বাড়ি ছিলেন না, সেটা অবশ্য উনি জানতেন না, আমাকে একটা বাক্স দিয়ে বলে গেলেন আমার সবকিছু তোমায় দিয়ে গেলাম, সাবধানে রেখো। যদি কখনো মনোময় তাড়িয়ে দেয়, এর মধ্যে সাত রাজার ধন রইল, তোমার কোন অভাব হবে না।’
আমি কেঁদে ফেললাম, বললাম, আমি শুধু তোমাকেই চাই, সেই প্রথম তুমি বলে ফেললাম, উনি বুকে টেনে আমার ঠোঁটে’ তাপসবাবু ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে গেলেন।
অভিরূপ ডেকে বললেন ‘যাবেন না তাপসবাবু, সত্যি যা, তাকে মানতে শিখুন। আচ্ছা মাসীমা আমি বলি এবার। নীতার সঙ্গে ফিরোজের বিয়েটা খুব তিক্ততার মধ্যে দিয়ে ভাঙল। ভাঙ্গা মন নিয়ে এদেশে ফিরে এল নীতা। যদিও সে ততদিনে নিজের শরীরের মূল্য বুঝে গেছে। দিল্লিতে তার দেখা হল রাহুল ভাবনানির সঙ্গে, ভাবনানি লোকটা যেমন করাপ্ট, তেমনি লম্পট। নীতার শরীর যেমন তার নিজের জন্য দরকার ছিল, তেমনি ক্লায়েন্ট ধরতেও। কারণ সে অকশন হাউসের আড়ালে একটা আন্তর্জাতিক অ্যান্টিক পাচারচক্র চালাত। নীতা ওর সঙ্গে কলকাতায় চলে এল। কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই সে হাঁফিয়ে উঠেছিল। তার মাঝে মাঝেই মিশরের দিনগুলো মনে পড়ত, বিশেষ করে ফিরোজকে। তার থেকেও বেশি সে সেই উত্তাল সময়টা মিস করতে শুরু করেছিল। এইসময় শ্রীমান গোগল, যার আসল নাম এখনো জানা যায়নি, সে দুর্গাপ্রসাদের ডায়েরি চুরি করে, অনেক কিছু জেনে ফেলে। সেখানে নীতার রাজনৈতিক অতীতের কথা ছিল যেমন, তেমনি দুর্গাদাসবাবু যে কিছু দামি জিনিস কলকাতায় মণিকুন্তলা ব্যানার্জির কাছে রেখে গেছেন, সেই কথাও সে জানতে পারে। তবে আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন, দুর্গাপ্রসাদের কাছে যে এই ডায়েরি আছে, তা গোগল জানল কী করে?’
সুচন্দ্রা দুর্বল গলায় বলে ‘আমিও তাই ভাবছিলাম। গোগলকে ছিঁচকে চোর বলে মনে হয় না। ও নিশ্চয় খবর পেয়েছিল কোথাও থেকে’
‘ঠিক তাই। আমিও ভাবছিলাম। কে খবর দিতে পারে? খুব ঘনিষ্ট কেউ ছাড়া এমন খবর পাওয়া অসম্ভব। আচ্ছা দুর্গাপ্রসাদ বাবু, আপনি বলেছেন আপনি একাই থাকেন।‘
দুর্গাপ্রসাদবাবু যেন একটু চমকে উঠে বললেন ‘হ্যাঁ একাই তো থাকি। মা বাবা চলে যাবার পর থেকে একাই থাকি’
‘ সেটা আপনি সত্যি কথাই বলেছেন। কিন্তু যেটা বলেন নি সেটা হল আপনার মা বাবা থাকতে থাকতেই আপনি বিয়ে করেন, কোন কারণে সে বিয়ে টেকেনি, আপনার স্ত্রী আপনাকে ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন।’
দুর্গাপ্রসাদবাবু একটু বিরক্ত গলায় বলেন ‘সে সব কথা এখানে কীভাবে আসছে। এসব আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। ‘
‘আসছে দুর্গাপ্রসাদবাবু। কারণ আপনার সেই স্ত্রীর নাম মীনাক্ষী মুখার্জি’
ঘরের সবাই চমকে ওঠে। ফেসবুক গ্রুপের এই নামটা এ বাড়ির সবাই চেনে। বেশ কয়েকবার সে এসেছে এ বাড়িতে।’
মীনাক্ষি!
‘হ্যাঁ কী আশ্চর্য দেখুন, এখানেও মাছ। কলকাতায় আসার পর গোগল আর মীনাক্ষি কাছাকাছি আসে। গোগোল ইতিহাস, পুরাতত্বে আগ্রহী, কিন্তু ওর একটা ক্রিমিনাল বেন্ড আছে। মীনাক্ষির মুখে শুনে ও দুর্গাপ্রসাদের ডায়েরি চুরি করে, তারপর দুদিক দিয়ে খেলা শুরু হয়। একদিকে ও চেষ্টা করে নীতাকে দোহন করতে, অন্যদিকে মীনাক্ষিকে এই বাড়িতে রুমাল ফেলে, মাছ আঁকা কাগজ রেখে, বিশেষ গন্ধ ছড়িয়ে ও চেষ্টা করে মণিকুন্তলা দেবীর ওপর মানসিক চাপ বাড়াতে। মীনাক্ষি ভালই জানত, সুচন্দ্রার বন্ধুরা চলে যাবার পর সবকিছু গুছিয়ে তুলে রাখা মণিকুন্তলা দেবীর স্বভাব। একটা অচেনা নম্বর থেকে সুচন্দ্রাকে ফোন করাটাও ওর প্ল্যান। কিন্তু নীতা খুব শক্ত মেয়ে, সে উলটে বলে ফ্লাওয়ার ভাসটা ওর চাই, কারণ ওর বিশ্বাস ছিল ওটা পেলে ভাগ্য আবার ফিরে আসবে। যদিও এই ব্যাপারটার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। রঙ বদল করাটা নেহাতই বাতাসের জলকণার অক্সিজেনের সঙ্গে এর পিগমেন্টের রাসায়নিক বিক্রিয়া।অক্সিডেশন। কিন্তু মানুষের বিশ্বাস কোন যুক্তি মানে না। ও চাইত ভাবনানীর কবল থেকে বেরিয়ে গিয়ে আবার কায়রোতে ফিরে যেতে। গোগল ওর সঙ্গে এঁটে উঠতে না পেরে ভাবনানীকে খুন করে ওকে বিপদে ফেলতে চায়। এদিকে একদিন মাসীমাকে নিয়ে গিয়ে হিপ্নোটিজমের মাধ্যমে ও জেনে যায়, আসল জিনিস আছে সুচন্দ্রার কাছে। আর তাই এই অনুষ্ঠানের ফাঁদ পাতা’
সুচন্দ্রার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে সব। কিন্তু গোগোল যেভাবে তাকে মেরেছিল, ওই জনমানবশূন্য জায়গায়, তার তো বেঁচে ফিরে আসার কথাই নয়, কে তাকে বাঁচাল? এই প্রশ্নটা অনেকদিন তার মাথায় ঘুরছে। সে জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে থাকে অভিরূপের দিকে।
অভিরূপ তাপসবাবুর দিকে চেয়ে একটু হাসেন। তারপর বলে ‘তাপসবাবু একদিন হায়দ্রাবাদে গেছিলেন মনে আছে তো?’সুচন্দ্রা অবাক হয়ে যায়।
‘হ্যাঁ, মাঝেমাঝেই তো যায়।‘
‘সেদিন কিন্তু যাননি। কলকাতার অফিস থেকেই উনি সোজা আমার কাছে গেছিলেন। উনি বলেছিলেন গোগলের সঙ্গে আপনার অ্যাফেয়ার চলছে। ওঁর কথাতেই আপনার পেছনে ছায়ার মতো লেগে ছিল কলকাতা পুলিশ’
সুচন্দ্রার মাথাটা ঘুরে যায়। ‘তুমি, তুমি আমায় সন্দেহ করো? ছিঃ! সারাজীবন এই জন্যে কেরিয়ার করতে দাওনি, আর এখন যখন আমি নিজের মতো কিছু নিয়ে একটু ভালো থাকার চেষ্টা করছি, তখনো তুমি, ছিঃ’
‘কাঁদবেন না সুচন্দ্রাদেবী। আমি আগেই বলেছিলাম, আমরা সবাই ইতিহাসের জাতক। সন্দেহ রোগটা উনি ওঁর বাবার কাছ থেকেই পেয়েছেন। তবে এই সন্দেহ আপনার প্রাণ বাঁচিয়েছে। তবে শুধু ওঁর কথায় না, সেদিন আপনাকে বিশেষ ভাবে ফলো করি মিত্রাদির সঙ্গে কথা বলার পর’
‘মিত্রাদি!’
‘আরে আমিও তো ইতিহাসের জাতক না কি? আপনি নিশ্চয় ভাবছেন পুলিশ হয়ে এত ভালো বাংলা বলছি কীভাবে? মিত্রাদি আমার মাসতুতো দিদি, ওঁর বাবা বিখ্যাত বাংলার অধ্যাপক বিমান গুপ্তর নাম শুনেছেন নিশ্চয়’
সুচন্দ্রার বিস্ময় কাটে না। অভিরূপ বলেন ‘তাপসবাবুর কাছে এর মধ্যে একদিন শুনি আপনি মিত্রাদির ডাকে একটি পত্রিকায় গল্প লিখছেন আর তাদের অনুষ্ঠানেও যাচ্ছেন। আমি দিদিকে ফোন করি অমনি। দিদি বলেন এই নামে কোন কাগজ নেই, আর এমন কোন অনুষ্ঠানও হচ্ছে না। তখন সন্দেহ দানা বাঁধে। আপনাকে ফলো করে আমরা অপরাধীদের হাতে নাতে পাকড়াব ভেবেছিলাম’
‘পারলেন তো না, অপদার্থের দল!’
তাপসবাবুর খোঁচা গায়ে না মেখে অভিরূপ বলেন ‘হ্যাঁ আমরা যেতে না যেতেই পাখি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। মীনাক্ষিকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে আজ সকালের খবর ওদের দুজনকে ভুবনেশ্বব্রে দেখা গেছে।’
টুবু হঠাত কথা বলে ওঠে ‘আরও একটা খবর আছে। এখুনি আমার এক বন্ধু দিশানী মেসেজ করল। ওকে একটু বলেছিলাম রুমাল রহস্যের কথা। নীতা আহমেদ সুইসাইড করেছে।’
অভিরূপ লাফিয়ে উঠে বলেন ‘সুইসাইড! কীভাবে?’
‘আঠেরো তলার ব্যালকনি থেকে ঝাঁপ দিয়ে’
‘অসম্ভব! হতেই পারে না। নীতা আহমেদ সুইসাইড করার মেয়েই নয়। ফিরোজ !ফিরোজ !এইভাবে।’ অভিরূপ ছুটে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে ‘বাকিটা পরের দিন। আপনার রান্না খাব সেদিন’ টুবুর ফোন আসে, ও নিজের ঘরে চলে যায়। তাপস চলে যান নিজের স্টাডিতে। মাম্পি রান্নাঘরে। ঘরে শুধু সুচন্দ্রা আর মণিকুন্তলা মুখোমুখি। সুচন্দ্রা কাঁপা গলায় বলে ‘কী আছে মা ওই বাক্সে? যার জন্য এত খুন, অশান্তি?’
মণিকুন্তলা কেটে কেটে বলেন ‘একটা ম্যাপ। কোন প্রাচীন পুঁথি থেকে পাওয়া একটা ম্যাপ। একটা রাজপ্রাসাদের চোরকুঠুরিতে থাকা অনেক গুপ্তধন’ বলতে বলতে কেমন যেন জড়িয়ে আসে ওঁর গলা। মাঝে মাঝেই বসে থেকে থেকে ঘুমিয়ে পড়েন উনি। সুচন্দ্রার মনে হল কাশ্মীরি কাঠের বাক্সে আদৌ এমন কিছু নেই, যা কিছু গুপ্তধন আছে, তা আছে আশি পেরনো এই নারীর মনে। তার মনে। সে রহস্য কে ভেদ করবে?

এই সময়ের বাংলা সাহিত্যের একজন একনিষ্ঠ কবি ও কথাকার। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, কল্পবিজ্ঞান, মৈথিলী অনুবাদকর্মে তিনি প্রতিমুহুর্তে পাঠকের সামনে খুলে দিচ্ছেন অনাস্বাদিত জগৎ। জন্ম কলকাতায়। শৈশবে নাটক দিয়ে লেখালেখির শুরু, প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘সামগন্ধ রক্তের ভিতরে’, দেশ, ১৯৯২। প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘আবার অমল’ রবিবাসরীয় আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯৯৫।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.ই. ও এম.টেক তৃষ্ণা পূর্ণসময়ের সাহিত্যকর্মের টানে ছেড়েছেন লোভনীয় অর্থকরী বহু পেশা। সরকারি মুদ্রণ সংস্থায় প্রশাসনিক পদ, উপদেষ্টা বৃত্তি,বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিদর্শী অধ্যাপনা, সাহিত্য অকাদেমিতে আঞ্চলিক ভাষায় অভিধান প্রকল্পের দায়িত্বভার- প্রভৃতি বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁর লেখনীকে এক বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।
প্রাপ্ত পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে- পূর্ণেন্দু ভৌমিক স্মৃতি পুরস্কার ২০১২, সম্বিত সাহিত্য পুরস্কার ২০১৩, কবি অমিতেশ মাইতি স্মৃতি সাহিত্য সম্মান ২০১৩, ইলা চন্দ স্মৃতি পুরস্কার (বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ) ২০১৩, ডলি মিদ্যা স্মৃতি পুরস্কার ২০১৫, সোমেন চন্দ স্মারক সম্মান (পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি) ২০১৮, সাহিত্য কৃতি সম্মান (কারিগর) ২০১৯ ও অন্যান্য আরো পুরস্কার।
প্রকাশিত গ্রন্থ
কবিতা
বেড়াল না নীলঘন্টা?, একুশ শতক, ২০০২
উলটে মেলো, একুশ শতক, ২০১৩
অজাতক সমগ্র থেকে, কলিকাতা লেটারপ্রেস, ২০১৭
গোপন ট্যাটু, কৃতি, ২০১৮
লাইব্রেরি শার্ট খোলো, কৃতি, ২০১৯
অনুবাদ কবিতা
অজিত আজাদের কবিতা, নবারম্ভ প্রকাশন, ২০১৮
মূল মৈথিলী থেকে অনুবাদ- তৃষ্ণা বসাক
গল্প
ছায়াযাপন, একুশ শতক, ২০০৯
দশটি গল্প, পরশপাথর, ২০১১
নির্বাচিত ২৫টি গল্প, একুশ শতক, ২০১৪
ইয়াকুবমামার ভারতবর্ষ, প্রশাখা প্রকাশনী, ২০১৮
গল্প ৪৯, কৃতি, ২০১৯
উপন্যাস
বাড়িঘর, একুশ শতক, ২০১১
অনুপ্রবেশ, এবং মুশায়েরা,২০১৭
এখানে টাওয়ার নেই, একুশ শতক, ২০১৭
স্বপ্নের শিকারা, এবং মুশায়েরা, ২০১৯
অগ্নিবলয়, আকাশ, ২০২০
প্রবন্ধ
প্রযুক্তি ও নারী- বিবর্তনের প্রতি-ইতিহাস, গাংচিল, ২০১০
মেয়েদের একাল, সেকাল ও চিরকাল, সোপান, ২০২০
প্রযুক্তি
ছাপাখানার অ-আ-ক-খ, শিশু কিশোর আকাদেমি, ২০১০
সহলেখক- সৌমেন বসাক
সম্পাদনা
ভারতীয় ভাষার গল্প, এবং মুশায়েরা,২০১৭
মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প, এবং মুশায়েরা, ২০১৭