| 23 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সম্পাদকের পছন্দ সাহিত্য

দিন চলে যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

আমি যে হারানোর কথা বলছি তার জন্যে কেউ কখনও সংবাদপত্রের হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ স্তম্ভে বিজ্ঞাপন দেবেন না। এই হারানো আমাদের জীবনে এতই অনিবার্য যার জন্যে আমাদের স্থায়ী কোনও ক্ষোভ নেই। সময় সময় এমনই উদাসীন, কী হারাল বুঝেও বুঝি না, ভেবেও ভাবি না। প্রতি মুহূর্তে মুহূর্ত হারিয়ে যাচ্ছে, প্রতিদিন হারিয়ে যাচ্ছে দিনে। গাছের পাতা যেমন ঝড়ে যায় তেমনি আবার নব কিশলয়ে নবীন হয়ে ওঠে। কিন্তু জীবন থেকে যে মুহূর্ত প্রতিনিয়ত সময়ের স্রোতে অনন্তের দিকে ভেসে চলেছে, তারা কোথায় গিয়ে কোন সাগরের মোহনায় পাললিক ব-দ্বীপ তৈরি করছে, জীবন জানে না। জীবনের ঘূর্ণাবর্তে পড়ে হারিয়ে যাওয়াই হল এর ধর্ম।

যে-কোনও মানুষই জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গেই ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য। এর কিছুটা আপেক্ষিকভাবে স্থিতিশীল, কিছুনশ্বর। যেমন, যে বাড়িতে জন্মেছিলাম, সেই বাড়িটা এখনও আছে, আরও শখানেক বছর হয়তো থাকবে। রোদে পুড়ে, জলে ভিজে কিছু প্রাচীন হয়েছে, যৌবনের চেকনাই হয়তো নেই, তবু পুরোনো বাড়িটা তার অস্তিত্ব বজায়। রেখেছে। উত্তরের দিকের দৌড়-বারান্দা, যে বারান্দায় আমি শৈশবে ট্রাইসাইকেল চালাতাম, সেই বারান্দাটা যেমন ছিল তেমনই আছে। কিন্তু শৈশবে ঠিক বেলা তিনটের সময় মুখে পান দোক্তার খিলি পুরে যে দুর্গার মা বারান্দা মুছত সে আর নেই। ট্রাইসাইকেলটাও নেই। আমি কিন্তু আছি। এখন বলাইয়ের মা বারান্দা মোছে। তখন যেন ক্ষণিকের জন্যে অতীত উঁকি দিয়ে যায়। অস্পষ্ট, ঝাপসা শৈশব, জল উড়ে যাওয়া আয়নায় হঠাৎ স্পষ্ট হয়ে আবার ঝাপসা হয়ে যায়। বলাইয়ের মাকে দুর্গার মা বলে ভাবতে ইচ্ছে করে।

বারান্দায় পুবের বাঁকে যেখানে সকালের রোদ থইথই করে, সেখানে ছেলেবেলায় মা আমাকে রোজ স্নান করাতেন। কাঠের পিঁড়ে পেতে লোহার বালতি থেকে রোদের তাতে ঠান্ডা কমে যাওয়া জল ঘটি করে মাথায় ঢেলে দিতেন। জল ঢালতে ঢালতে একটা জলাশয় মতো হত, আমি তখন। সাঁতার কাটার চেষ্টা করতুম। মা তখন পিঠে ফুলো চড় মেরে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিতেন। মা-র হাতের চুড়ি কিনকিন করে উঠত। সেই বারান্দার বাঁকে এখনও সকালের রোদ জমা হয়। মা কিন্তু বহুদিন চলে গেলেন। এখন হাজার চেষ্টা করলেও শৈশব আর ফিরবে না, মা-ও আর ফিরে আসবে না। বারান্দার ও জায়গাটায় এখন নীল প্লাস্টিকের বালতিতে জল থাকে। রোদ খেলা করে জল থেকে ছিটকে ওঠে উলটো দিকের দেওয়ালে। ছেলেবেলায় জলটাকে দুলিয়ে দিয়ে দেওয়ালের গায়ে রোদের প্রতিফলনকে নৃত্যচঞ্চল করে ভোলা একটা মজার খেলা ছিল। এখন আর সে বয়স নেই। অথচ জলও আছে, রোদও আছে। কোনওভাবে তিরিশটা বছর পেছোতে পারলে আবার সেই মুহূর্তগুলো ফিরে পেতাম। সময় বড় একমুখী। নদীতে তবু জোয়ার-ভাটা আছে, জল যায় আবার ফিরে আসে, সময়ের নদীতে কেবলই ভাটার টান।

আমাদের ঠাকুরঘরের কুলুঙ্গিতে একটা মা লক্ষ্মীর পট আছে। চল্লিশ বছর আগে এক শীতের সকালে মা, জ্যাঠাইমা, পিসিমারা কালীঘাটে গিয়ে ওই পটটা কিনেছিলেন। মা লক্ষ্মী এখনও সেই কুলুঙ্গিতে আছেন। তলার দিকটা এক ধরনের পোকা তিল তিল করে খেয়ে চলেছে, তবু মুখের হাসি অম্লান। সেই পুরোনো পেতলের প্রদীপ সন্ধ্যায় কেঁপে কেঁপে জ্বলে। সারা ঘরে সেই একই ভাবে ছায়া কাঁপে। আজও কেউ না কেউ গলায় আঁচল দিয়ে হাঁটু মুড়ে প্রণাম করে; তবে সে আমার মা-ও নয়, জ্যাঠাইমাও নয়। অথচ এই একই ঘরে তিরিশ বছর আগে আমার শৈশব বসে থাকত বাবু হয়ে, একপাশে মা, একপাশে জ্যাঠাইমা ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজন। প্রদীপ কাঁপত ছায়া নিয়ে দেওয়ালের গায়ে। উপাসনার বই খুলে জ্যাঠাইমা সুর করে পড়তেন, মাতঃ সরস্বতী, ভগবতী ভারতী। আমরাও সেই সুরে সুর মিলিয়ে সন্ধ্যাকে রাতের দিকে নিয়ে যেতুম। রাতের পর রাত পেরিয়ে আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি সেখানে সন্ধ্যা আছে, প্রদীপ আছে, পট আছে, এমনকী পাতা খোলা বিবর্ণ কীটদষ্ট উপাসনার বইটাও আছে, নেই কেবল শৈশব। অথচ মাঝে মাঝে মনে হয় শৈশবটা হারায়নি, কোথাও না কোথাও ফুলের দাগের মতো, সিঁদুরের টিপের মতো লেগে আছে। মাতৃজঠরের জ্বণের মতো প্রৌঢ় আমি-র সঙ্গে তার নাড়ির যোগ রয়েছে, জঠরের শিশুর মতো মাঝে মাঝে নড়েচড়ে উঠছে, কেবল ভূমিষ্ঠ হতে পারছে না। যেন বহুকাল আগে নদীর জলে হারিয়ে যাওয়া একটি মুদ্রা। স্তরে স্তরে পলি জমেছে তার ওপর। স্রোত খেলা করে চলেছে। অদৃশ্য হলেও আছে। শৈশবের কাঠিমেই পরতে পরতে জড়িয়েছে সময়ের সুতো। দৌড়োতে পারিনি বলেই সময় আমাকে ছেড়ে ক্রমশ দূর থেকে দূরেই চলে যাচ্ছে।

আমাদের বাগানে একটা নিমগাছ আছে। আমাদের দুজনের বয়েসই প্রায় এক। আমার শৈশব এই গাছের তলায় এক সময় খেলা করত। হাত বাড়িয়ে নিমপাতা পাড়তুম। সেই গাছ এখন। বিশাল মহীরুহ। তার সমস্ত ডালপালা এখন আমার নাগালের বাইরে। ধুলোখেলার বয়স যখন ছিল তখন গাছটার কাণ্ডে একটা পেতলের ড্রপিং পিন মেরে দিয়েছিলুম। সেই পেতলের টিপ এখন চব্বিশ ফুট উঁচুতে। ছুটির দুপুরে গাছটার রোদ ছিটোনো পাতার দিকে তাকিয়ে মনটা যখন হু-হু করে ওঠে তখন গাছের সঙ্গে কথা বলি,—তুমি আছ কিন্তু অনেকেই নেই। তুমি আমার সহজ অঙ্ক। জীবনের বছরের হিসেবে সময়কে আমি তোমার জন্যেই ফুটে মাপতে পারছি। ওই যে পেতলের টিপ, ঊর্ধ্বে মাত্র চব্বিশ ফুট এগিয়েছে। চব্বিশ ফুটেই আমি রিক্ত, নিঃস্ব, পোড়োবাড়ির প্রৌঢ় পুরোহিত। সময় আর কয়েক ফুট এগোলেই আমার খেলা শেষ।

দক্ষিণের ঘরে একটা ইজিচেয়ার পাতা আছে। বহুকাল আগে জ্যাঠামশাই এই চেয়ারটায় বসতেন। শীতকালে গায়ে জড়ানো থাকত বাদামি রঙের কাশ্মীরী শাল। একটা হাঁটুর ওপর আমি চেপে বসতুম। সমানে চলত নানা আবদার।

ইজিচেয়ারটা এখনও পাতা আছে। হাতলে এখনও হয়তো জ্যাঠামশাইয়ের চায়ের কাপের তলা থেকে লেগে যাওয়া চায়ের শুকনো দাগ খুঁজলে পাওয়া যাবে। আমি মাঝে মাঝে নাট্যকারের মতো পুরোনো দৃশ্য সাজাবার চেষ্টা করেছি জ্যাঠামশাইকে ফিরিয়ে এনেছি, জ্যাঠাইমাকে বসিয়েছি ড্রেসিং টেবিলের সামনে চুল বাঁধতে। মাকে একই সময় বসিয়েছি খাটের পাশে, আমাকে রেখেছি ঘরের মেঝেতে জ্যাঠামশাইয়ের কালো চটি জোড়ার পাশে, হাতে দিয়েছিদম দেওয়া খেলনা—একটা জাপানি ট্যাঙ্ক। শূন্য ঘরে সময়কে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছি, পরমুহূর্তে শূন্যতা আরও বেড়েছে, হঠাৎ আলোর পর অন্ধকার আরও গভীর হয়েছে। আয়না আমারই বিষণ্ণ মুখ আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে, চেয়ার বলতে চেয়েছে—তুমিই এখন বোসো, এরপর অন্য কেউ বসবে। খাট বলেছে আমার স্মৃতি নেই, তাই আমি কাষ্ঠকঠিন।

বাদামি শালটার ওপর দিয়ে সময়ের স্রোত বয়ে গেলেও ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। শালটার গায়ে অস্পষ্ট একটু কালির দাগ লেগে আছে। এটা মঙ্গলার কাজ। মঙ্গলা আমার ছেলেবেলার। বেড়াল। মশারির চাল বেয়ে খড়খড় করে ওপরে উঠে গিয়ে দুষ্টু দুষ্টু মুখে নীচের দিকে তাকাত, তাল খুঁজত ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ার। সেই মঙ্গলা কালির দোয়াত উলটে দিয়েছিল শালের ওপর। শালের মালিক এখন আর নেই। মঙ্গলাকে প্রচণ্ড প্রহার করা হয়েছিল। পরের দিন মঙ্গলা মারা। গেল। তার সঙ্গে আমার জীবনের যোগ রয়ে গেল এই কালির দাগে। অস্পষ্ট দাগটা যেন আমার কোলের কাছে শুয়ে থাকা গুটিশুটি মঙ্গলা। একদিন সে ছিল, এই দাগটা তার প্রমাণ।

মা মারা যাওয়ার পর একদিন বাক্স খুলে মা-র ফুল হাতা নীল সোয়েটারটা উলটে-পালটে দেখেছিলুম। যে অঙ্গে একদিন এই সোয়েটারটা উষ্ণতা দিত সে অঙ্গ বহুদিন আগে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ঘ্রাণ নিয়ে দেখলুম, মা-র গন্ধ লেগে আছে কি না। না, একটা পুরোনো ধুলো-ধুলো গন্ধ ছাড়া আর কিছু নিশ্বাসে পেলুম না। হঠাৎ আবিষ্কার করলুম পিঠের দিকে একটা লম্বা চুল জড়িয়ে আছে। সোঁয়া-সোঁয়া উলের সঙ্গে আটকে আছে। নিশ্চয়ই মা-র চুল। শেষ যে দিন সোয়েটার খুলে রেখেছিলেন, সেই দিন হয়তো আটকে গিয়েছিল। একগাছা চুল পড়ে আছে, মানুষটি কিন্তু বহুদিন চলে গেছেন। হঠাৎ যেন সময়ের উজান বেয়ে শৈশবকে ধরে ফেললুম। চলে গেলুম জামতাড়ার এক খোলা মাঠে। শীতের সকাল। দূরে একটা ঝাপসা পাহাড়। তিনটি চরিত্র সামনে এসে দাঁড়াল। বাবার যৌবন, আমার শৈশব, মা-র মৃত্যুর আগের বছর। মা আমার হাত ধরে ধীরে ধীরে শিশিরভেজা কাঁকুরে মাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছেন। ক্লান্ত চলার ভঙ্গি। মাথায় সিল্কের স্কার্ফ। পেছন থেকে বাবা হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন,—সাপ, সাপ। মা আমার হাত ধরে ছিটকে সরে এলেন। কুচকুচে কালো রঙের একটা সাপ এঁকেবেঁকে চলেছে। মা। আমাকে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নিতে চাইছেন, বুকের কাছে। অসুস্থ শরীর। শক্তি নেই। পেরেও পারছেন না। বাবার হাতে একটা পাথর। বলছেন ভয় নেই, ভয় নেই। সোয়েটার গায়ে ফেলে বত্রিশ বছর আগের মা-র স্পর্শ পাওয়ার জন্যে আমার প্রৌঢ় শরীর আকুল হয়ে উঠল। সময় হেসে বললে, অনেক দূরে চলে গেছি। তোমার জীবনের কোমল মুহূর্তটি তুমি চিরকালের গর্ভে ফেলে দিয়েছ, আর ফিরে পাওয়ার উপায় নেই।

ফিরে পাব না ছাত্রজীবনের সঙ্গীদের শিক্ষকদের। জীবনে বিকেল ঘুরে ঘুরে আসে কিন্তু সব বিকেলই এক নয়। গঙ্গার ধারে একদিন যাদের সঙ্গে বসে পালতোলা নৌকো দেখতুম, যে ছেলেটি চকখড়ি দিয়ে ঘাটের বাঁধানো পৈঠেতে ডেভিড কপারফিল্ডের, মিঃ ক্রিকলের ছবি আঁকত সুন্দর কার্টুনের ঢঙে, কিংবা যে ছেলেটি অপূর্ব সুরেলা গলায় বৈজু বাওরার গান গাইত, বচপনকে মহব্বতকো দিল সে না জুদা করনা, সেই শচীন, সেই নীতু আর কোনওদিনও ওই ঘাটের সেই জায়গাটায় এসে বসবে না। বহু গান, বহু হাসি, বহু আলোচনা ভেসে চলে গেছে। কে কোথায় ছিটকে গেছি জানি না।

বর্ষা গেছে, শীত এসেছে, গঙ্গা বয়ে চলেছে আজও; ঘাটের পৈঠেতে শ্যাওলা আরও পুরু হয়েছে। যেখানেই থাকুক নীতুর চুলে পাক ধরেছে, শচীন আছে কি নেই বলা শক্ত। পুরোনো রেকর্ডে বৈজু বাওরার গানটা যখনই কানে আসে, তখনই আমার ছাত্রজীবন সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখের সামনে নীতুকে দেখতে পাই। বিষণ্ণ মুখ। ডেনরি-অন-শোন-এর ছেলে কলকাতায় এসেছিল পড়তে। থাকত মামার বাড়িতে, বড় কষ্ট করে। এখন কোথায় আছে? কোন নগরে, কোন বন্দরে! এখনও গান গায়, কে শোনে?

গঙ্গার পাতায় আজও মুখ থুবড়ে পড়ে আছে একটা ভাঙা নৌকো। নৌকোটা ছিল রজনী মাঝির। ঘাটে বাঁধা থাকত। ঢেউয়ের দোলায় দুলত। পরীক্ষার পর পড়ার চাপ যখন কম থাকত তখন। জ্যোৎস্না রাতে আমরা নৌকোটায় বসে জলের আওয়াজ শুনতুম, ভবিষ্যৎ জীবনের পরিকল্পনা তৈরি করতুম। এক সময় লণ্ঠন হাতে রজনী পাড়ে এসে দাঁড়াত। হেঁকে বলত—জোয়ার আসছে নৌকো খোলো। রজনী মারা গেছে বহুকাল। তার ঘরের চাল উড়ে গেছে, দেওয়াল পড়ে গেছে। তার ঘরের সব গোপন অংশ বাইরের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। চালের বাতায় রজনীর হুঁকোটা এখনও বাঁধা আছে। দাওয়ার পাশে পাতা উনুনের একপাশ ধসে পড়েছে। দীর্ঘকালের। রান্নার স্মৃতি দেওয়ালের গায়ে কালো হয়ে আছে। মাছ ধরার জালটা মাকড়সার জালের মতো একপাশে ঝুলছে। কখনও কখনও শৈশব খুঁজতে গঙ্গার ধারে সন্ধ্যার অন্ধকারে গেলে রজনীর নৌকোটাকে মনে মনে তুলে আবার জলে ভাসাই। সঙ্গীসাথীদের ডেকে ডেকে জড়ো করি। কান খাড়া করে থাকি কখন রজনীর ডাক শুনব—মাঝি নৌকো ভাসাও জোয়ার আসছে।

দেয়ালের হুকে একটা তম্বুরা ঝুলছে। ছুটির দিনের দুপুরে আমাকে চুপিচুপি কাছে ডাকে। সময়ের জলাশয় থেকে কুড়ি বছর আগের কয়েকটা মুহূর্ত বড়শি গেঁথে তুলে আনি। দক্ষিণের। বারান্দা দিয়ে ঝুঁকে আছে একটি যুবক রাস্তার দিকে। আমারই যৌবন। দূরে রাস্তার মোড়ে দেখা যাচ্ছে দীর্ঘকায়, গৌরবর্ণ এক বৃদ্ধ হনহন করে এগিয়ে আসছেন, বগলে তম্বুরা। আমার দাদু। কানাইবাবুর দোকান থেকে পুরোনো তম্বুরা কিনে আনছেন দাদু। হাঁটুগেড়ে বসে সুর বাঁধছেন। চোখ বুজিয়ে সুর ছাড়তে ছাড়তে বলছেন আহা, যেন কাঁসর-ঘণ্টা বাজছে, ওঁকার ধ্বনি উঠছে। দাদু গাইছেন আমার দিন যে আগত দেখি জগৎ জননী। দু-চোখ বেয়ে জলের ধারা নামছে।

টাটায় গিয়ে দাদু মারা গেলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, রোজ একটু করে ধুলো ঝেড়ো পান্তুরানি। আমাকে আদর করে ওই নামেই ডাকতেন। আমি ভালো হয়ে এসে আবার গান। শোনাব, ওঠো মা করুণাময়ী খোল গোকুটির দ্বার। দাদু আর ফিরলেন না, মৃত্যুর পাঁচ মিনিট আগে পুত্রবধূকে বললেন—তুলে বসিয়ে দাও, পান্তুরানিকে বলো তানপুরাটা দিতে, গানটা গাই। ইউরেমিয়ার যে কণ্ঠ প্রায় বুজে এসেছিল হঠাৎ ছেড়ে গেল। দাদু গাইতে গাইতে চলে গেলেন—ওঠো মা করুণাময়ী খোল গো কুটির দ্বার, আঁধারে হেরিতে নারি হৃদি কাঁদে অনিবার।

মাঝেমধ্যে এমনই এক-একটা ছাড়পত্র নিয়ে আমি অতীতে বেড়াতে যাই। পুরোনো জিনিসপত্র রাখার ঘরে একদিন হঠাৎ জ্যাঠামশাইয়ের মাছ ধরার ছিপ আর ভাঙা হুইলটা পেয়ে গেলুম। ওইটাই আমার ছাড়পত্র। অতীতের সুড়ঙ্গ বেয়ে সোজা শৈশবে। কোনও এক সকাল। পুকুরধারে বসে আছেন জ্যাঠামশাই ফাতনার দিকে চেয়ে। পাশে গোটাকতক সিগারেটের টিন—কোনওটায় চার, কোনওটায় টোপ। কালো জলে থিরথির করে হাওয়া খেলছে। মাঝে মাঝে ঘাই মেরে উঠছে বড় মাছ। দিনের শেষে নির্জন পথে পেল্লায় মাছ হাতে আমরা ফিরছি। দরজার চৌকাঠে মা দাঁড়িয়ে আছেন মৎস্যশিকারিদের সংবর্ধনা জানাতে। মা-র কাঁধে হাত দিয়ে গায়ে গা লাগিয়ে জ্যাঠাইমা। ভাঙা হুইলটাই যেন কড়কড় শব্দ করে উঠল, মাছের টানে ছিপের মাথাটা বেঁকে। গেল। বদ্ধ ঘরেই পুকুরের ভিজে হাওয়া উঠল, ঝাঁঝি, শ্যাওলা, কচুরিপানার গন্ধ এল।

ওই ঘরেই পেলুম তারের খাঁচা। পাখিটা উড়ে গেছে বহুদিন। কোথায় গেছে? কোথায় কার সঙ্গে পেতেছে সংসার! ছেলেবেলার লাটাইয়ের দুটো চাকা পেলুম। আমার এগারো বছরের বয়েসটা হাফপ্যান্ট আর শার্ট পরে সামনে দিয়ে ছুটে দুপুরের ন্যাড়া ছাদে গিয়ে উঠল। তামার মতো আকাশে চিল উড়ছে, উড়ছে আমার ময়ূরপঙ্খি।

পুরোনো বইয়ের মধ্যে থেকে পুরোনো চিঠি বেরিয়ে আসে। যিনি লিখেছেন, তিনি আর লিখবেন না। কাকার চিঠি। অমুক তারিখে আমি আসছি। কাকা আসছেন, সঙ্গে আসছে কয়েকটা আনন্দের দিন। হই-হুল্লোড়, হাত দেখা, জ্যোতিষচর্চা, হিপনোটিজম। বিশাল ছাদে চাঁদের আলোয় মাদুর পেতে আশ্চর্য সব গল্প। শেষ যেদিন এলেন সেদিন গায়ে পাঞ্জাবির বদলে টেনিস শার্ট। জামাটা হ্যাঙারে না রেখে মেঝেতে ফেলে রাখলেন। তুলে রাখছি বলতে বললেন, অত যত্ন। করে কী হবে? ইঙ্গিতটা বুঝিনি। চায়ের সঙ্গে ভালো বিস্কুট দেওয়া হল, বললেন, দিচ্ছিস দে, খেয়ে যাই। গলাটা কেমন উদাস। অনেক রাতে বললুম, কাল সকালে কোষ্ঠীটা একবার। দেখবেন। বললেন, সকালে আর সময় হবে না রে, এখুনি দে। রসিকতা ভেবে ঘুমিয়ে পড়লুম। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে বলে গেলুম, তাড়াতাড়ি ফিরে এসে দুজনে বসব। বললেন, তখন তো আমি থাকব না রে! বিশ্বাস করিনি। দুটোর সময় উদ্বিগ্ন মুখে বাবা অফিসে এলেন, শিগগির চল। তখনকার কলকাতার সবচেয়ে উঁচু বাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ে কাকা আত্মহত্যা করেছেন। চিঠিটা হাতে নিলেই সেই ভয়ংকর ঝড়ের রাত ফিরে আসে! আকাশ ভেঙে পড়েছে মর্গ। পোস্টমর্টেমের টেবিলে শুয়ে আছেন সদা হাস্যময় কাকা। গায়ে রক্তেভেজা টেনিস শার্ট। একটা পাদুমড়েমুচড়ে গেছে।

মামার চিঠি। আমাকে সাবধানে থাকতে বলে, শরীরের যত্ন নেওয়ার কথা বলে বসন্তের এক সন্ধ্যায় নিজেই চলে গেছেন।

সময় শুধু নেয় না, কিছু মানুষকে দেউলে করে ঝুলিয়ে রাখে। সময়ের সবচেয়ে বড় রসিকতা। সময় ধার করে বেঁচে থাকা। শূন্য পাত্র হাতে নিয়ে একপাশে বসে দিন গোনা। শরীরের সন্ধিতে সন্ধিতে মৃত্যুর পরোয়ানা। চোখে সাদা পরদা, কোঁচকানো দেহত্বক বৃদ্ধ পিতাকে দেখলে মনে হয় সময়ে ফকির। ভাঁটার নদী। তারছেড়া তানপুরা। সময়ের ভীমরুল সব শুষে নিয়েছে। অ্যালবামে বিভিন্ন সময়ের ছবিতে এই দেউলে মানুষটির বহতা জীবনের ছবি আছে। পুরীর সমুদ্রতীরে, মুসৌরীর গানহিলে, সাহেবগঞ্জের পাহাড়ে। চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে দৃপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন আমার যুবক বাবা। বাবার জীবনে আমার জীবনের মিলন যেন প্রবাহ পথে দুটো নদীর। মিলন। দুটো নদীই এক হয়ে চলেছে মোহনার দিকে। একজন পথের শেষে, সামনে মহাশূন্য হা হা করছে। পশ্চিম আকাশে আগুন ঢেলে সূর্য ডুবছে। আর একজন আসছে পেছনে পেছনে। দূর থেকে দেখলে লাল আকাশের পটে টিলার ওপর একটি রিক্ত মানুষের অপেক্ষার ভঙ্গিতে বসে থাকা সিয়েট। হঠাৎ দেখবে নেই। তখন সে পৌঁছে যাবে পথের শেষে।

দক্ষিণের ঘরের মেঝেতে শুয়ে হঠাৎ একদিন আটটা পেরেকের মাথা আবিষ্কার করেছি। সবকটা মেঝেতে পোঁতা। এক-একটি পেরেক এক-একটি মৃত্যুর হিসেব। ষাটটা বছর স্থির হয়ে আছে আটটা পেরেকের মাথা। দক্ষিণের এই ঘরটা হল মৃত্যুর ঘর। সিঁড়ির কাছাকাছি। দেউলে। মানুষদের বিছানা পড়ে এই ঘরে। বাঁ-দিকের দরজাটা খুলে দিলেই একটু চাতাল মতো জায়গা, সিঁড়ি নেমে গেছে ঘুরে ঘুরে। ওই তো যাওয়ার পথ। মাথার কাছে খাটের পাশে সাইড-টেবিল। ফিডিংকাপ থাকবে, দু-একটা লেবু থাকবে। ওষুধের শিশি থাকবে। স্টোর থেকে বেরোবে বেডপ্যান। থাকবে একটা চেয়ার। রাতের দিকে গম্ভীর মুখে ডাক্তার এসে বসবেন। গলায় স্টেথিসকোপ। সময়ের হিসেব নেবেন। প্রেসক্রিপশান লিখবেন। তিরিশ বছর আগে আসতেন জয়ন্ত ডাক্তার। এখন হয়তো আসবেন ডাক্তার কুশারী। ঘাড় ঘোরালেই দেখা যাবে তিনি নেমে যাচ্ছেন সিঁড়ি দিয়ে ধীর পায়ে। গায়ে উদাসীনতার সাদা কোট। নেমে যাচ্ছে আশা। সন্ধেবেলা ঘরে কেউ ধুনো দিয়ে যাবে। অনেকদিনের অসুখ-অসুখ গন্ধ যদি একটু কাটে। দেয়ালে ঝুলছে আগে আগে যাঁরা গেছেন তাঁদের ভরা-দিনের ছবি।

হঠাৎ একদিন দরজার বাইরে ফিশফিশ কথা শোনা যাবে। লোকটির সময় শেষ হয়েছে। একটা রাত কাটে কি না সন্দেহ। মাথার কাছের জানলা ধরে দাঁড়িয়ে আছে রাতের উদার আকাশ। টিপটিপ করে জ্বলছে সময়ের রাজারা হাজার হাজার বছর ধরে যারা পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আছে, আরও লক্ষ লক্ষ বছর থাকবে। তন্দ্রার ঘোরে সারাজীবন একবার ঘুরে যাবে। ওই তো সেই শিশু, মা-র কোলে, সন্ধ্যার শাঁখ বাজছে। ওই তো সেই কিশোর, বাবার হাত ধরে প্রথম স্কুলে যাচ্ছে। ওই তো সেই যুবক, কলেজে চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডরে একটি মেয়ের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে—প্রথম প্রেম। ওই তো বসেছে বিয়ের পিঁড়িতে। গলায় রজনীগন্ধার মালা। ফুলশয্যার বিছানা। চলে যাওয়া জীবন, চলে যাওয়া মুহূর্তের স্রোত উলটো বইছে।

রাস্তার ওপারে চায়ের দোকানে রাতের কথার খই ফুটছে। ডিম ফোঁটাবার শব্দ আসছে। কে যেন বলছে ওমলেটটা একটু নরম থাকে যেন কার্তিক। ওমলেট আমিও ভালোবাসি। নরম ওমলেট খাবার আর সময় নেই। আবার খাওয়া যাবে অন্য কোথাও অন্য কোনওখানে। মালাটা ছিঁড়ে গেছে। সমস্ত পুঁতি ছড়িয়ে পড়েছে। একটা একটা করে কুড়োতে পারি কি না দেখি! না বড় শক্ত কাজ।

দক্ষিণের ঘরের আটটা পেরেক নটা হবে। এটা নতুন, মাথাটা অন্যগুলোর চেয়ে চকচকে। চশমাটা কেউ খাপে ভরে রাখবে। কলমের মাথাটা বন্ধ করে রাখবে। বিয়ের গরদের পাঞ্জাবিটা পরিয়ে দেবে। নতুন ধুতিগুলো ছাপিয়ে শাড়ি করে নেবে। নতুন চটিজোড়া রাকে তুলে রাখবে। আমি তখন খাট থেকে ফুটতিনেক উঁচুতে ছবি হয়ে ঝুলব! সব মুহূর্ত খরচ করে আমি তখন চলে গেছি সময়ের ভাণ্ডারে আমার রিক্ত ঝুলি নতুন করে ভরে নিতে। আমার দু-পাটি বাঁধানো দাঁত আলমারির কাঁচের ওপাশ থেকে অবয়বহীন হাসি ছড়াবে ইন্টারন্যাল লাফ-এ গ্রিন উইদাউট এ ফেস।

পরিশিষ্ট

Time present and time past
Are both perhaps present in time future
And time future contained in time past.
If all time is eternally present
All time is unredeemable.

[T. S. Eliot.]

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত