| 20 এপ্রিল 2024
Categories
লোকসংস্কৃতি

বসন্তোৎসবের সন্ধানে । দেবলীনা রায়চৌধুরী ব্যানার্জি

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

কদিন ধরে একটা বিষয় খোঁচা দিচ্ছে, এই যে বসন্তোৎসব তার প্রাচীন রূপটি তো এমন ছিল না। ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতার প্রাঙ্গণে ভিন্ন ভিন্ন দেবতা অধিদেবতার আরাধনার সাথে  গভীর সাদৃশ্য কিন্তু লক্ষ্য করা গেছে দেশ কালের সীমানার বাইরে। ভেবে দেখলে পাওয়া যায় বসন্তোৎসবের রূপান্তর। ভারতেই দুটি ভিন্ন কালে দুটি ভিন্ন রূপ দেখা যায় এই উৎসবের। কিন্তু কবে থেকে এই পরিবর্তন আর কেনই বা এই পরিবর্তন তার ব্যাপারে ইতিহাস আজ নিশ্চুপ। ভারতের যে প্রাচীন বসন্তোৎসবের চিত্র আমরা পাই তার সাথে প্রচলিত দোল উৎসবের সাদৃশ্য কম বরং সুদূর গ্রীস মেসোপটেমিয়ার  বসন্তোৎসবের সাথে প্রগাঢ় মিল দেখা যায়।

এখানে তিনটি আলাদা আলাদা সভ্যতার তিনজন দেবতা/অধিদেবতার  কথা বলব আর তার সাথে সম্পর্কিত বিস্মৃতপ্রায় বসন্তোৎসবের কথা।

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,In search of spring festival

থামুজ (Thammuz):

থামুজ, যার অপর নাম ডুমুজিড ছিলেন মেসোপটেমিয়া সভ্যতার এক অধিদেবতা।  ইংরেজিতে যাদের Deity বলা হয়। যাই হোক, এই থামুজকে কৃষি, সেচ, উর্বরতা প্রভৃতির দেবতা হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। কাহিনী অনুসারে তার রূপে মুগ্ধ ছিলেন বহু নারী ও পুরুষ। থামুজের প্রভাব খর্ব হয় অনেক পরে ইনান্না বা ইশতার (আমাদের দেবী দুর্গার মতো অনেকটা) দেবীর পুজো শুরু হলে। ‘পেগান’ বা প্রকৃতিপূজার ক্ষেত্রে দেবতাদের মৃত্যু, পুনর্জন্ম, প্রভৃতির বিষয়গুলি কিন্তু খুব স্বাভাবিক। মিশরের অসিরিসকেই ভাবুন। কথিত আছে এই থামুজকে এক বন্য শূকর মেরে ফেলেন এবং তার রক্তে একটি নদী লাল হয়ে যায়। পরে অবশ্য এই দেবতা পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠেন তার উপাসকদের কান্নায়। বছরের একটি সময়, অর্থাৎ ঠিক বসন্তকালে প্রতিবছর এই থামুজের উপাসনা হতো বেশ অদ্ভুতভাবেই। বছরের একটি বিশেষ দিনে তার উপাসকেরা দল বেঁধে শোক পালন করত। করতে করতেই তাদের মধ্যে একজন হঠাৎ উঠেই ঘোষণা করতেন দেবতা থামুজ বেঁচে উঠেছেন। এবং তারা সকলে মিলে তাদের প্রিয় দেবতার পুনরাগমন উদযাপন করতেন নিজেদের মধ্যে। রঙ, ফুলের রেণু , দ্রাক্ষারসে বিভোর হয়ে মেতে উঠতেন সকলে। অর্গলহীন, বাঁধাবন্ধহীন মেলামেশায় একটা গোটা দিন কাটতো তাদের। John Milton এর “Paradise Lost”-এর প্রথম পর্বেই থামুজের কথা এবং এই অনুষ্ঠানের কথা বলা আছে। মিল্টন লিখেছেন,

Thammuz came next behind,

Whose annual wound in Lebanon allured

The Syrian damsels to lament his fate

In amorous ditties all a summer’s day.

বলা বাহুল্য, এখানে তিনি anti-christian এবং নরকের অধীশ্বর লুসিফারের সঙ্গী।

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,In search of spring festival

আডোনিস (Adonis) : 

গ্রীক ও রোমান মিথ অনুসারে পিতা-পুত্রির অজাচারে জন্ম হয় অপূর্ব সুন্দর একটি ছেলের, নাম আডোনিস। একদিকে হেডেস (Hades/Pluto) বা পাতাল বা মৃত্যুলোকের দেবতার পরমপ্রিয়া স্ত্রী পারসিফোন (Proserpine/Persephone) অন্যদিকে দেবী ভিনাস (Aphrodite/Venus) আডোনিসের জন্যে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। গ্রীক মিথে আডোনিসও কৃষি, যৌনতা, উর্বরতার প্রতীক ছিলেন। তিনিও মেসোপটেমিয়ান মিথের গল্পের মতো একইভাবে বন্য শূকরের আক্রমণে মারা যান। লাল হয়ে ওঠে আডোনিস নদীর জল। প্রেমের দেবীর নির্দেশে শুরু হয় আডোনিয়া উৎসব। এই উৎসবে হতো বৃক্ষরোপণ। সে সমস্ত গাছ রোপণ করা হতো যা একবছরই বাঁচে। গাছ পরের বছর শুকিয়ে গেলে তাকে আডোনিসের মৃত্যুর প্রতীক ধরে পূজারিণীরা উন্মাদের মতো বিলাপ করতেন। এই পূজারিণীদের বলা হতো মেইনাড (Maenad)। P. B. Shelleyর কবিতা Ode to the West Windএর বিখ্যাত লাইনটি আওড়ানোর লোভ না সামলেই বলি –

Like the bright hair uplifted from the head

Of some fierce Maenad, even from the dim verge

Of the horizon to the zenith’s height,

The locks of the approaching storm.

আসন্ন ঝড়ের সাথে আডোনিসের পূজারীনিদের তুলনা বুঝিয়ে দেয় তাদের অর্গলমুক্ত, নেশাগ্রস্থ অবস্থার কথা। এই আডোনিয়া উৎসবের মুল বিষয় ছিল উর্বরতা ও যৌনতার উদযাপন। তেমনই আরও কিছু উৎসব ছিল স্কিরা, হালোয়া প্রভৃতি। মূলত নারীরাই পালন করতেন। শুধু তাই না, অভিজাত নারীরা এবং গণিকারাও সকলে মিলেই উদযাপন করতেন। সমাজের বিধিনিষেধ, সমাজিক মর্যাদার ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়েই পালন করতেন তারা।

ব্যাক্কাস (Bacchus/Dionysus) :

গ্রীকদের দেবরাজ জিউস ও সিমেলের গভীর প্রেমের অবৈধ সন্তান ব্যাক্কাস। ইনি মাদকতার দেবতা। জন্মের আগেই মা সিমেল মারা গেলে পিতা জিউস তাকে গর্ভ থেকে বের করে নিজের উরুর মধ্যে ঢুকিয়ে রাখে। সময়মতো সুস্থভাবে জন্ম হয় ব্যাক্কাসের। এনাকে কেন্দ্র করে উদযাপিত হতো ব্যাক্কানেলিয়া। নেশার উৎসব। এর থেকেই Viticulture এর সূত্রপাত। জানেন তো গ্রীসে মাদকতার উৎসব থেকেই কিন্তু বিখ্যাত একটি জিনিসের জন্ম? নাটক। মুখোশ পড়ে, সেজে গুজে এই অনুষ্ঠানে মানুষ নাচ গান করত বিনোদনের জন্য। Dithyramb বা goat song বা পাঁঠার গান গাইত মানুষ। পাঁঠার গ্রীক পরিভাষা ‘Tragos’ থেকেই তো Tragedy। এক্ষেত্রেও একই ব্যাপার – পুনরুজ্জীবন, যৌনতা, উর্বরতা ও যৌবনের আরাধনা।

রোমান সভ্যতার শুরুর দিকে এবং ওই সভ্যতার মধ্যযুগ অব্দি একটা একইরকম উৎসবের কথা আমরা পাই সান্দ্রা বত্তিচেল্লির আঁকায় যার নাম ‘প্রিমেভেরা’ বা (Primevera। এই প্রিমেভেরার আক্ষরিক অনুবাদ হলো মদনোৎসব বা বসন্তোৎসব। বসন্তকালের আগমনে মানুষ মেতে উঠতেন একদিনের অর্গলহীন, লোকলজ্জাহীন মেলামেশায়। কুমকুম, ফাগ মেখে মনের মতো সঙ্গী খুঁজে একটি দিন অতিবাহিত করত তারা। সাধারণত নারীরাই বেছে নিতে পারতেন তার সঙ্গীকে। এই উৎসবের কথা আছে পেত্রার্কের ডেকামেরন কাব্যগ্রন্থে। পরে দান্তের দিভিনা কম্মেদিয়ার (Divine Comedy, Inferno) ‘নরক’ অংশেও পাওয়া গেছে। টেনিসনের কবিতাতেও এই উৎসবের উল্লেখ আছে।

কামদেব বা মদন (Kama) :

ভাগবত পুরাণে কামনা বা ইপ্সার দেবতা মদনের সৃষ্টি করেন ব্রহ্মা তার হৃদয় থেকে। নর-নারায়ণের তপস্যা ভঙ্গ করতে ইন্দ্র কামদেবকে প্রেরণ করেন অবশ্য বিফলও হন। উক্ত পুরাণে তারকাসুর বধের জন্য কার্ত্তিকের জন্ম ত্বরান্বিত করতে কামদেবের বা মদন ও তার স্ত্রী রতির আগমণ হয়। কামশরে জর্জরিত ক্রুদ্ধ শিবের রোষানলে তিনি ভস্ম হন অর্থাৎ মৃত্যু হয় তার। পরে অবশ্য রতির প্রচেষ্টায় পুনরুজ্জীবিত হন এই প্রেম, রূপ, যৌনতার দেবতা। যার উদ্দেশ্যে পালিত হতো মদনোৎসব। সৌন্দর্য, কাম, মদিরতায় ডোবা রঙের উৎসব। শরদিন্দুর ঐতিহাসিক কাহিনীতেও এর পরিষ্কার উল্লেখ আছে। বিশেষত ‘সেতু’ গল্পটিতে –

“একবার মাত্র তাহাকে দেখিয়াছি মদনোৎসবের কুম্কুম-অরুণিত সায়াহ্নে। উজ্জয়িনীর নগর উদ্যানে মদনোৎসবে যোগ দিয়েছিলাম। একদিনের জন্য প্রবীণতার শাসন শিথিল হইয়া গিয়াছে। অবরোধ নাই, অবগুণ্ঠন নাই – লজ্জা নাই। যৌবনের মহোৎসব।”

 

প্রাচীন কাব্যগুলিতে যেমন ভাষের রত্নাবলী কাব্যে রাজা উদয়নের সাথে সিংহলকুমারী রত্নাবলীর প্রথম দেখা হয় মদনোৎসবে অর্থাৎ কামদেবের পূজায়। এছাড়াও এই উৎসবের উল্লেখ ‘মালতীমাধব’ কাব্যে, রবিঠাকুরের ‘অভিসার’ কবিতাতেও পাওয়া যায়। গুপ্তযুগের পরে এই অনুষ্ঠানের চাকচিক্য হারিয়ে যায় এবং উৎসবটির প্রচলন খুঁজে পাওয়া যায় না। Pagan Culture বা প্রকৃতিপূজার প্রাঙ্গণে যৌনতা বা উর্বরাশক্তির আরাধনা কিন্তু মানুষ খোলা মনেই করতেন। বসন্তকালে এই পূজা হতো কুমকুম, পরাগ, ফাগ, মাদকদ্রব্যের সাথে। অতএব, এ কথা বলাই যায় যে মদনোৎসব কিন্তু আমাদের পরিচিত দোলোৎসবের পূর্বসূরি, যেখানে দেহজ চাহিদা বা ইপ্সাকেও গুরুত্ব দেওয়া হতো। আর অস্বাভাবিকও নয়। প্রকৃতি স্বাধীন – বাঁধাবন্ধনহীন, সৃষ্টি ও ধ্বংসের নিয়মিত চক্রে আবর্তিত। সমাজসিদ্ধ নিয়ম, নীতি প্রকৃতির পুজোয় খাটে না।

তাহলে কী দেখা যায়, যে প্রাচীন সভ্যতাগুলিতেই প্রকৃতির পূজায় মনের সাথে দেহের গুরুত্ব সমান দেখা যাচ্ছে। এবার প্রশ্ন হলো, বসন্তোৎসব মদনোৎসবের থেকে দোল উৎসবে কবে আর কীভাবে পরিনত হলো? এই উৎসবে মদনের স্থানে মোহন অভিষিক্ত হলেন কী করে? সে ইতিহাস আজ নীরব। শ্রীশঙ্করাচার্যের দর্শনে মায়াকে ভ্রান্তি বলা এবং তৎ পরবর্তীকালে হিন্দুধর্মের একটা নতুন দিগন্ত খুলে যাওয়ার সাথে সাথে প্রকৃতিবাদ বা Naturalistic approach বা পেগানিজমের পরিসমাপ্তি ঘটে, না সময়ের সাথে সাথে আর্থ-সামাজিক অবস্থা জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ওঠার জন্য সমাজিকতা উৎসব, পার্বণেও তার ছোঁয়াচ লাগে কি না তা সুস্পষ্ট নয়। তারও পরবর্তী সময়ে দেহজ কামের প্রাকৃত স্থানান্তরিত হয় অপ্রাকৃত কাম-এর অবতারণায়। অর্থাৎ মদন থেকে মোহনের পূজায় রূপান্তর। কিন্তু বিশ্বমিথের প্রাঙ্গণে এই দেশ কাল নির্বিশেষে দেবতা ও উৎসবের মধ্যেকার  গভীর সাদৃশ্য আজও সতেজ, সজীব, শাশ্বত।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত