| 19 মার্চ 2024
Categories
ইতিহাস নারী

বেগম হজরত মহল ওরফে মাহক পরী

আনুমানিক পঠনকাল: 12 মিনিট

১.
নেপাল রাজপ্রাসাদের সিংহদরজা দিয়ে নেমে যাওয়া রাস্তাটার নাম দরবার মার্গ। দরবার মার্গের ঘণ্টা ঘরে, প্রাসাদ থেকে মাত্র এক ঢিলের দূরত্বে, নেপালি জামে মসজিদের আঙিনায় বেগম হজরত মহলের কবর। অযোধ্যার সিপাহি বিদ্রোহের নেত্রী, নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের তালাকপ্রাপ্ত বিবি বেগম হজরত মহল। দরবার মার্গের ছায়াচ্ছন্ন ফুটপাত দিয়ে হেঁটে গেলে বেগমের কবরের আগে পড়ে নেপালি মুসলিমদের প্রাচীনতম ইবাদতখানা, প্রায় ছয় শ বছরের পুরোনো কাশ্মীরি তাকিয়া মসজিদ।
সেদিন ছিল ১২ ডিসেম্বর (২০১৬)। পরদিন ঈদুল মিলাদুন্নবী। কাশ্মীরি তাকিয়া মসজিদের জলের ফোয়ারা ঘিরে রান্নাবাড়ার আয়োজন চলছে। পবিত্র অনুষ্ঠানের রান্নার জোগান দিচ্ছেন কজন নেপালি মেয়ে। খানা পাকাবেন মনে হয় মাথায় চূড়া করে খোঁপা বাঁধা, কোমরে দোপাট্টা জড়ানো এই জেনানারাই। বকরির রেজালা। পোলাও। গোলাপপানি। জরদা। মসজিদ কমিটির সভাপতি লোভ দেখালে বাইরে বাইরে হাসি আর মনে মনে পরের দিনের দাওয়াত কবুল করে ফেলি।
এ শহরের কোনো এক প্রাচীন মসজিদের ধারে হজরত মহলকে গোর দেয়া হয়েছে প্রায় সোয়া শ বছর আগে। শুরুতে তথ্য বলতে হাতে এটুকুই ছিল। আর ছিল কবরের স্থান নিয়ে কাঠমান্ডুর ১৯৫৯ সালের ‘দ্য কমনার’-এ প্রকাশিত একটি খবর- একদিকে গণ শৌচাগার আরেকদিকে পেট্রল পাম্প, তার মাঝখানে সিপাহি বিদ্রোহের বীরাঙ্গনা হজরত মহলের কবর। খোদাই করা পাথরে সজ্জিত নেই, নিদেন পাথরেও বাঁধাই নয়, অতীত মহিমা নিয়ে পরিত্যক্ত একাকি শুয়ে আছেন। দ্রুত অপসৃয়মান সময় তাঁর বীরগাঁথা গেছে ভুলে। কবরের হালত নিয়ে পরে আরো একটি খবর নজরে আসে, যা প্রকাশিত হয় ১৫ জুন ২০০৭ তারিখের হিন্দুস্থান টাইমস-এ। প্রতিবেদক বেগম হজরত মহলের কবরটিকে মাজার বলে উল্লেখ করে লিখেছেন- বর্তমানে এটি একটি ময়লাখোলা, যেখানে বিয়ারের ক্যানসহ নানা আবর্জনা ফেলা হয়। আর রাতের আঁধারে বেগমের এ ‘মাজার’ পর্যবসিত হয় পাবলিক টয়লেটে।
এমন এক বদখত স্থানের তালাশে বেরিয়ে আমরা বিচলিতবোধ করছিলাম না। বরং শীতের দুপুরে দরবার মার্গ দিয়ে হাঁটতে বেশ লাগছিল। ভিড়-ভাট্টা নেই। বাতাসটা চমৎকার। রোদটাও মিষ্টি। দিগন্তে ক্ষণে ক্ষণে বরফের ত্রিকোণ টোপর-পরা হিমালয়-শৃঙ্গের আবির্ভাব। সবচেয়ে বড় কথা ভাসা ভাসা হলেও হজরত মহলের কবরের হদিস মিলেছে। মাঝখানে কাশ্মীরি তাকিয়া মসজিদে ঢুকে তো চোখ ছানাবড়া। এমন জেনানা-ফ্রেন্ডলি মসজিদের দুসরা নজির নেই আমাদের কাছে। নিজেদের বিস্তর খাতির-যত্ন হচ্ছে বলে নয়, মসজিদ-সংলগ্ন মাদ্রাসায় ছেলেমেয়ের সহশিক্ষার ব্যবস্থার ফলে মসজিদ প্রাঙ্গণে ঝাঁকে ঝাঁকে কিশোরীর আনাগোনা, রাঁধুনিদের ব্যস্তসমস্ত চলাফেরা, সেই সঙ্গে আমি, বাসবী বড়য়া আর এক নেপালি বন্ধু মিলে তিন বেপর্দা জেনানা তো আছিই। তবু ফের মোলাকাতের কড়ার করে মসজিদ কমিটির সভাপতির কাছে বিদায় নিয়ে আমাদের বেরিয়ে পড়তে হলো। পরের গন্তব্য নেপালি জামে মসজিদ, যার এক পাশের আঙিনায় বেগম হজরত মহলের কবর।
এবার খোদ ইমাম সাহেব জায়নামাজ গুটিয়ে এগিয়ে এলেন। আমরা পায়ে পায়ে যাই বেগমের কবরের দিকে। সামনেই সবুজ টিনের দরজায় সাদা কালিতে ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ড। এখানে প্রসিদ্ধ ভারতীয় ফ্রিডম ফাইটার বেগম হজরত মহলের সমাধিসৌধ, যা তৈরি ও সংরক্ষণের দায়িত্বে নেপালি জামে মসজিদ ব্যবস্থাপক কমিটি। ঘণ্টাঘর, কাঠমান্ডু, নেপাল। দরজার তালা খুলে দিতে আমরা তাজ্জব। কারুকাজময় পাথরে সজ্জিত না হলেও বেগমের সমাধি গড়া হয়েছে ধাপে ধাপে মার্বেলের সিঁড়ি কেটে। কবরের ধারের সাদা মার্বেলের দেয়ালগাত্রে তাম্রফলকে লেখা-

Tomb of Begum Hazrat Mahal

[1820-7 April 1879]

Freedom Fighter of India (Awadh)

ফলকের ওপরে ঢাকনাঅলা ঝুলন্ত বাতি। কবরের শিয়রের ফলকের দিকে ইঙ্গিত করতে ইমাম সাহেব জানালেন, বেগম হজরত মহল শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন নেপালে, ইসায়ি তারিখ ৭ এপ্রিল ১৮৭৯ এ সাদামাটা বাক্যটিই আরবি হরফে এখানে লিপিবদ্ধ আছে। সেই সঙ্গে জানা গেল, কবরের এ ঠাটবাট মাত্র তিন বছরের। ২০১৩ সালে এর আমূল সংস্কার করা হয়। মসজিদ কমিটির সভাপতি শামিম আনসারির উদ্যোগেই হয়েছে কাজটি। তিনি প্রথম উপলব্ধি করেন যে, মহান এক বেগম তাঁদের মসজিদের কোণার জঞ্জালের তলায় চিরনিদ্রায় শায়িত। তাঁর শেষ আশ্রয়স্থলের অবহেলা করা ঠিক হচ্ছে না। এর দু বছর পর, ২০১৫ সাল থেকে কাঠমান্ডুস্থ ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বেগমের মৃত্যুদিনে মার্বেল-বাঁধাই কবরে পুস্পমাল্য অপর্ণের অনুষ্ঠান চালু হয়েছে। সেদিন ফতেহা পাঠ করেন মাদ্রাসার মৌলবি আলেমগণ। বেগম পীর-আউলিয়া বা দরবেশ নন বলে কবরে বাতি দেয়া, ধূপ পোড়ানো এসব হয় না। এ বছরও (২০১৬) বেগমের মৃত্যু দিনে ভারতীয় হাই কমিশনার এসে কবরে ফুল দিয়ে সম্মান জানিয়ে গেছেন। দূতাবাস সমাধির দেখভালের দায়িত্ব নিতে চাইলে মসজিদ কমিটি রাজি হয়নি। কমিটি নিজেই এ মহৎ কাজটি করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
‘কেন? বেগম তো নেপালের কেউ নন!’ আমার প্রশ্নটা বন্ধু নিমা কার্কে নেপালি ভাষায় তর্জমা করে দিলে ইমাম সাহেব বলেন বেগম ভারতের ফ্রিডম ফাইটার এবং একজন মুসলিম নারী। তাই তাঁদের কাছে তাঁর এত কদর ও সম্মান। বেগমের কপাল মন্দ তাই ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গেছেন। তারপর প্রাসাদের চাবি আর হীরামোতি নিয়ে চলে আসেন নেপালে। এসবের বিনিময়ে রাজা জং বাহাদুর রানা তাঁকে আশ্রয় দেন। তার আগে লক্ষ্নো লুট করেন জঙ্গ বাহাদুর। বেগম ইন্তেকাল ফরমালে এই রাজাই তাঁকে দাফন করেন দরবারের সামনে।
মানুষ কত অদ্ভূত! আর আমরা এ সম্পর্কে কত কম জানি! নিজেদের কম-জানা উপলব্ধি করে আমরা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাউয়ি করি। ঝটিতি নিচু দেয়ালের ওপর দিয়ে দরবার মার্গের দিকে তাকাই এক ঝলক। রানার প্রাসাদ (রাজপ্রাসাদ) খুব কাছেই। এখান থেকে মাত্র এক ঢিল দূর।


Irabotee.com,শৌনক দত্ত,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,iraboti,irabotee.com in


২.
নাম ছিল তাঁর মহক পরী। গায়ের ঘর্ম হতে গোলাপের সৌরভ নিঃসরণের জন্য এ নাম। আর এ উপাধিটি দেন নবাব ওয়াজেদ আলি শা। কবিতাও বাঁধেন এ নিয়ে, গদ্যে ভেঙে নিলে যার অর্থ দাঁড়ায় একটা ঘরোয়া কন্যা আমার ঘরে এসেছিল, তাঁর ঘর্ম থেকে গোলাপের ঘ্রাণ নিঃসরিত হতো। তিনি ছিলেন খুবই রূপবতী আর তাঁর নাম হয়েছিল মহক পরী।
নিকা বিবি আর মুতা বিবি ছাড়া ‘পরী’ উপাধিধারী এক ঝাঁক নারী ছিলেন ওয়াজেদ আলি শাহের মহলে। তাঁরা আসতেন অর্থ-বিত্ত ও সম্মানের দিক দিয়ে প্রান্তিক শ্রেণি থেকে। পরীদের পহেলে নবাবের নাচ-গানের ইস্কুলে ভর্তি করানো হতো। কেউ কেউ ভালো নাচিয়ে গাইয়ে হয়েছেন সেই সুবাদে। যে পরীর প্রতি নবাবের নেকনজর পড়ত, তিনি মুতা বিবি হতেন। কেউ শাহজাদা-শাহজাদির মা-ও হয়েছেন কপালগুণে। জানা যায় হজরত মহল ছিলেন খানগি বা খাঙ্গি গোত্রের, যারা পরিবারের সঙ্গে থেকে গোপনে দেহব্যবসা করেন। হজরত মহলের নাম তখন মোহাম্মদী বেগম। বাড়ি ফৈজাবাদ। একদিন বাবা তাঁকে বেচে দেন লক্ষৌর রাজহারেমে। হারেম থেকে নবাবের ইচ্ছায় চালান হন পরীখানায়। আরেক সূত্রে জানা যায়, এতিম ছিলেন মোহাম্মদী বেগম। যে ফুফু তাঁর দেখভাল করতেন, তিনিই বেচে দেন রাজহারেমে। সে যা-ই হোক, বারাঙ্গনা, বাইজি, রক্ষিতা এ ছিল বেগম হজরত মহলের পূর্ব-পরিচয়। এরপর পরী অবস্থায় অন্তঃসত্ত্বা হলে নবাব যখন তাঁকে প্রাসাদের পর্দায় আসার হুকুম দেন, তিনি খুশিমনেই তা তামিল করেন। এখানেই শেষ নয়। ফের নাচগানের কথা উঠলে বেগম জোরগলায় তা নাকচ করে দেন সঙ্গে সঙ্গে। বেগমের হয়ত নাচে-গানে মেতে থাকার ধাত ছিল না। হয়ত তিনি জীবন দিয়ে বুঝেছিলেন শিল্পকলা তাঁর জন্য সম্মান বয়ে আনবে না। বরং অতীতের মতো অসম্মান আর অমর্যাদার কারণ হবে। যখন পুত্র ব্রিজিস কদরের জন্ম হয়, নবাব ওয়াজেদ আলির কাছ থেকে নাম পান হজরত মহল আর শ্বশুর খেতাব দেন ইফতিকার-উন-নিসা (সমস্ত স্ত্রীজাতির গর্ব)। এ অযাচিত সম্মান তিনি উপভোগ করতে পারেননি বেশিদিন। এক রহস্যময় কারণে নবাবের আট মুতাবিবির সঙ্গে হজরত মহলও তালাক হয়ে যান। সামান্য ভাতা দিয়ে রাজপ্রাসাদ থেকে বের করে দেওয়া হয় তাঁকে। নবাবেব নাকি তখন খুব গোসসা হয়েছিল হজরত মহলের ওপর। কেননা গুজব রটেছিল বেগম পেয়ার করেন প্রাসাদের পাহারাদার মাহমুদ খান ওরফে মাম্মু খানকে। এর ক বছর পর, সিপাহি বিদ্রোহের সময় মাম্মু খান বেগম হজরত মহলের ডান হাত হন। আর ইংরেজরা ব্রিজিস কদরকে নবাবের অবৈধ উত্তরাধিকারী প্রমাণ করতে মাম্মু খানের জারজ সন্তান বলে প্রচার চালায়। উল্লেখ্য মাহমুদ খান ওরফে মাম্মু খান যখন হজরত মহলের প্রাসাদের দারোগা হন, তখন ব্রিজিসের বয়স ছয়। তা ছাড়া তখনকার রেওয়াজ অনুযায়ী খোজারাই হতেন প্রাসাদের পাহারাদার বা রক্ষী।
লক্ষৌর তখন নানা রকম খবর পয়দা করে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। একদিকে নৃত্য-গীতসহ নবাবের বিচিত্র খেয়াল, আরেকদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছোবল মারার পাঁয়তারা। দুরাত্মার কখনো ছলের অভাব হয় না। হালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণের মতো মিথ্যা বাহানায় ১৮৫৬ সালের ৭ ফ্রেরুয়ারী অযোধ্যাকে গ্রাস করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। লক্ষৌর খোদা বকশ কারবালা ময়দানে সহ নাগরিক নবাব ওয়াজেদ আলি শাহকে চোখের জলে বিদায় জানায়। ‘মহল মহল বেগম রোঁয়ে, গলি গলি রোঁয়ে পাথুরিয়া’- বিদায়লগ্নে গীত বাঁধেন নবাব। তারপর চিরতরে লক্ষৌ ছাড়েন। ১৩ মে ১৮৫৬ পৌঁছলেন কলকাতা। বছর গড়াতেই ব্রিটিশ-ভারত জুড়ে শুরু হলো সিপাহি বিদ্রোহ। বিদ্রোহের প্রতীক পদ্মফুল আর রুটি ছড়িয়ে দেওয়া হলো ব্যারাকে ব্যারাকে। ব্যারাক ছেড়ে গাইতে গাইতে বেরিয়ে পড়ল বিদ্রোহি সিপাহিজনতা- ‘দরিয়া মে তুফান, বড়ি দূর ইংলিশ স্থান। জলদি যাও জলদি যাও, ফিরিঙ্গি বেঈমান।’
নবাব গদিচ্যুত হওয়ার সময় সেনাবাহিনীর যে ৬০ হাজার লোক বরখাস্ত হয়, এই বরখাস্তকৃত নবাবি সেনারা বিদ্রোহে যোগ দেয়। তাঁদের মদদ দেয় নানা বিক্ষুব্ধ শ্রেণি ও পেশার মানুষ। সরকার পরিচালনা কেন্দ্র ছত্তর মনজিলের কাছে প্রায়ই নবাবের বেকার কর্মচারীরা জমায়েত হতেন আর ব্রিটিশদের অভিশাপ দিতেন। খাফসা ধর্মীয় বা রাজকীয় অনুষ্ঠানাদিতে পরার এক প্রকার জুতা। নবাবের পতনের পর খাফসা তৈরি বন্ধ হয়ে গেলে মুচি-চামাররা ইংরেজ সরকারের মুন্ডুপাত করতে করতে নগর থেকে বেরিয়ে যান। অন্যায়ভাবে নবাবের রাজ্য কেড়ে নেওয়া, ইংরেজের লাগামহীন করারোপ, রাস্তাঘাট নির্মাণের নামে হাবিলি, ইমারত, উপাসনালয়ের ধংসসাধন, জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি কারণেও মানুষের মনে ক্ষোভ জমছিল। তাতে ইন্ধন জোগায় এনফিল্ড রাইফেল। এর টোটায় গরু আর শুকরের চর্বি মেশানো রয়েছে- এমন প্রচারে তুলকালাম শুরু হয়। লক্ষৌর তার আশেপাশের সরাইগুলি হয়ে ওঠে বিদ্রোহিদের আড্ডাখানা। ওখানে বিপ্লবের প্রচারক, মদদকারি, সিপাহি, বারবনিতারা জমায়েত হতে থাকে। অচিরেই লক্ষৌর পরিণত হয় বারুদের স্তূপে।
অযোধ্যার সিপাহি বিদ্রোহের স্মরণীয় দিন ৩০ জুন, ১৮৫৭। লক্ষৌর থেকে ৮ মাইল দূরে চিনহাটের যুদ্ধে বিদ্রোহী সিপাহিদের কাছে পরাজিত হয় ব্রিটিশ বাহিনী। আশ্রয় নেয় লক্ষৌর রেসিডেন্সি ভবনে। বিজয়ী সিপাহিরা লক্ষৌ প্রবেশ করে মচ্ছিভবন কেল্লার দখল নেয়। অবরোধ করে পলাতক ব্রিটিশদের আশ্রয়স্থল রেসিডেন্সি ভবন। তারপর বিদ্রোহি নেতারা যখন অযোধ্যার সিংহাসনে বসানোর জন্য নবাবের ওয়ারিশ খুঁজছিলেন, তাতে সাড়া দিয়ে সপুত্র এগিয়ে আসেন সাহসী জেনানা হজরত মহল। আর এভাবে ফের পাদপীঠে আসেন তিনি। এবার নবাবের নেকনজরে পড়ার মুখাপেক্ষী নন, অযোধ্যার মানুষের জীবন-মরণের চাবি-কাঠি স্বয়ং তাঁর হাতে।
চিনহাটের বিজয়ের পাঁচ দিন পর ৫ জুলাই রাজ্যাভিষেক হয় ব্রিজিস কদরের। সেদিন সকাল থেকে মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টি ধরে এলে মা-ছেলের শোভাযাত্রা চান্দিওয়ালি বারাদরিতে পৌঁছে। একুশ বার তোপ দেগে শুরু হয় ব্রিজিস কদরের অভিষেক অনুষ্ঠান। সিপাহিরা আওয়াজ তোলে- ‘হর হর মহাদেও, দীন দীন আল্লাহু আকবর।’ ব্রিজিস কদরের অভিষেক অনুষ্ঠানে ভারতবর্ষের মাটি থেকে ফিরিঙ্গি বিতাড়ণের শপথ গ্রহণের নির্দেশ দেন বেগম হজরত মহল। মুসলমানরা কোরানশরিফ, হিন্দুরা তুলসি, গঙ্গাজল স্পর্শ করে শপথ নেন। অযোধ্যার রাজমুকুটটি মেজর ব্যানক্স লুটে নিয়েছিল। তাই ম্যানডিল নামের এক সাধারণ মুকুট পরিয়ে ব্রিজিস কদরের অভিষেক সম্পন্ন হয়। বিগত নবাবদের আমলে প্রায় এক শ বছর বকলমে ব্রিটিশ প্রভাবাধীন স্বাধীন রাজ্য ছিল অযোধ্যা। এবার যেন যথার্থই আজাদি পেল।
ব্রিজিস কদরের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে মশহুর বাইজি উমরাওজানের ডাক পড়ে। সে উপলক্ষে ব্রিজিস কদরকে নিয়ে তিনি যে কবিতা লিখেন, তার দুটি ছত্র হচ্ছে- ‘তোমার এ সরলতা জাগাবে হাজার প্রাণে সাড়া। তাদেরও বাসবে ভালো তোমার অনিষ্ট খোঁজে যারা।’ তারপর প্রাসাদে সময়-অসময় মুজরার ডাক পড়ত উমরাওজানের। রাতে কাইজারবাগে থেকেও যেতেন প্রায় সময় রাজপুরুষ কুতুবুদ্দিনের বদান্যতায়। তখনকার কিছু কবিতা, গজল টুকরা কাগজে লিখে পানের ডাবরে রেখে দিয়েছিলেন। ইংরেজের তাড়া খেয়ে বেগম হজরত মহল যেদিন কাইজারবাগ ছেড়ে যান, সেদিন ভয়ে আতংকে পালানোর সময় উমরাওজানের পানের ডিবা তো গেলই, জুতা, দোপাট্টাও খোয়া যায়। সেদিন ছিল মার্চের ১৬ তারিখ, ১৮৫৮। নওরোজ উৎসবের আর মাত্র কদিন বাকি। তারপর উমরাওজান বুন্দি পর্যন্ত বেগমের সঙ্গে যান।
সে যাই হোক, স্বল্প সময়ের জন্য হলেও ১১ বছর বয়সে অযোধ্যার সিংহাসনে বসলেন ব্রিজিস কদর। বেগম হজরত মহল হলেন পুত্রের অভিভাবক, রাজনৈতিক উপদেষ্টা আর সামরিক কাউন্সিলের প্রধান। ব্রিজিস কদরের অভিষেকের পরদিন ৬ জুন অযোধ্যার সর্বত্র বেগমের ঘোষণাপত্র প্রচারিত হয়- ‘জনগণ ইশ্বরের, দেশ দিল্লির বাদশায়ের, শাসন ব্রিজিস কদরের।’ এর কিছু দিন পর অযোধ্যার শাসকরূপে ব্রিজিস কদরের স্বীকৃতি আদায়ে নজরানাসহ দিল্লির দরবারে খত পাঠান বেগম। বলাবাহুল্য বিদ্রোহি সিপাহিদের ঘোষিত তামাম হিন্দুস্থানের বাদশা বাহাদুর শাহ জাফর সানন্দেই বেগমের আর্জি মঞ্জুর করেন। বাদশা-স্বীকৃত ব্রিজিসের সেই হুকুমত দিল্লি পতনের পরও টিকেছিল বেশ কিছু দিন। ১৮৫৭ সালের জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত টানা যুদ্ধ চলে লক্ষৌ ও তার আশপাশে। তারপর হাতে গোনা কিছু দিন শান্তির সময়। তখন নজর দিতে হচ্ছিল শান্তি-শৃঙ্খলার দিকে। যুদ্ধের বাজারে প্রাত্যহিক জিনিসপত্রের চড়া দাম। বেগম মহল্লা মহল্লায় সেরেস্তা নিয়োগ করেন, যেন খাদ্যাভাবে ভুখমারীর শিকার না হয় কোনো ইনসান। তিনি নগরীর বাতাসে আগাম ব্রিটিশের গোলার গন্ধ পাচ্ছিলেন। তাই শহর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করতে হচ্ছিল। আন্তঃকলহ মেটাতে হচ্ছিল। বিদ্রোহি রাজ-রাজাদের সঙ্গে সৌহার্দ্য বজায় রাখতে হচ্ছিল।
লক্ষৌ পুর্নদখলের পূর্বে ব্রিটিশ জেনারেল আউট্রামের কাছ থেকে পত্র আসে বেগমের কাছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জনাবে আলিয়া বেগম হজরত মহলের সঙ্গে সন্ধি-চুক্তি স্থাপনে প্রস্তুত। তিনি অস্ত্র ত্যাগ করলে মাসিক এক লক্ষ টাকা ভাতা পাবেন। আর পুত্রসহ শান্তিতে বসবাস করতে পারবেন নিজ প্রাসাদে। হজরত মহল আউটরামের খত আগুনে পুড়িয়ে কোম্পানির বিরুদ্ধে আমৃত্যু লড়াইয়ের ডাক দেন। কাজও করেন সেই মতো। আলমবাগের যুদ্ধে বেগম হাতির হাওদায় চড়ে রণক্ষেত্রে হাজির হন। কর্ণেল উইলিয়াম হাডসনের বিরুদ্ধে স্বয়ং যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে আগবাড়ান। হাডসন অযোধ্যার বেগমকুঠিতে গুলিবিদ্ধ হয়। ক্ষোভে এক বিদ্রোহি সেনা তখনই তার কল্লা কেটে ফেলে। এর আগে হাডসন দিল্লি থেকে লক্ষৌ পুনরুদ্ধারে অগ্রসর হচ্ছে শুনে বেগম হজরত মহল তার মৃত্যুদন্ড জারি করেছিলেন। কেননা দিল্লিতে বিনাবিচারে মোগল শাহজাদাদের হত্যা করেছিল এই কুখ্যাত কর্ণেল। আত্মসমর্পণ করা সত্তে¡ও বাহাদুর শাহের ১৬ জন পুত্রের মধ্যে অনেককেই বিচারের সন্মুখীন করা হয়। ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। তিন শাহজাদাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। যদিও তারা অস্ত্রসমর্পণ করেছিল। তাদের বলা হয় পোশাক খুলে আসতে। পরদিন খুনি উইলিয়াম হাডসন তার বোনকে চিঠিতে জানায়, ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমি তাতার জাতির তৈমুর বংশের প্রধান সদস্যদের নির্মূল করেছি। আমি নিষ্ঠুর নই। কিন্তু আমি স্বীকার করছি যে, পৃথিবীকে এই দুষ্ট ক্ষতের কবল থেকে রক্ষা করার সুযোগ আমি উপভোগ করেছি।’
মোগলদের প্রতি ঘৃণার কি বিভৎস উদগার! বেগম সাধ্যমতো এর জওয়াব দিয়েছিলেন। ১৮৫৮ সালের ১৬ মার্চ পুত্র ব্রিজিস কদরকে নিয়ে লক্ষৌ ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। তারপর ইটাওয়ালি, শাহজাহানপুর, বেরেলি হয়ে ঘর্ঘরা নদীর তীরে চৌকা ঘাটে আসেন। ১৮৫৮ সালের ১৩ জুন ইংরেজ সেনাপতি হোপ গ্রান্ট অতর্কিতে হামলা চালায় চৌকা ঘাটে। বেগম চৌকা ঘাট ছেড়ে বরাইচ জেলার বুন্দিদুর্গে আশ্রয় নেন। বরাইচ জেলার দক্ষিণে ঘর্ঘরা নদী আর উত্তরে নেপাল। এখান থেকে বছরব্যাপী এক দীর্ঘস্থায়ী লড়াই পরিচালনা করেন বেগম। রানি ভিক্টোরিয়ার ঘোষণার পাল্টা ঘোষণাপত্রও তিনি জারি করেন বরাইচ জেলার বুন্দিদুর্গ থেকে।
দিল্লি, কানপুর, ঝাঁসি আর লক্ষৌর মতো সিপাহি বিদ্রোহের মূল কেন্দ্রগুলির পতন ঘটলে রানি ভিক্টোরিয়া কোম্পানির কাছ থেকে ভারতের শাসনদন্ড হাতে নিয়ে একটি ঘোষণাপত্র জারি করেন। তার একটি পাল্টা ঘোষণা হজরত মহল জারি করেন বুন্দিদুর্গ থেকে। ভিক্টোরিয়ার ঘোষণা পুরাদস্তুর ধোঁকাবাজি বলে নিজের লোকদের হুঁশিয়ার করেন বেগম। আদতে রানির রাজত্বে খোল-নলচে সবই ঠিক রাখা হচ্ছিল- কোম্পানির আইন-কানুন, বন্দোবস্ত, কর্মচারী, গভর্নর জেনারেল, বিচার ব্যবস্থা। মহারানির ক্ষমতাগ্রহণ অর্থপূর্ণ হতে পারত- বেগম হজরত মহল যুক্তি দিয়ে বলেন, যদি তিনি জনগণের ইচ্ছামাফিক তাদের রাজ্য ফিরিয়ে দিতেন। ঘোষণায় রানি যে ক্ষমার আশ্বাস দিচ্ছিলেন, তাতে আস্থা ছিল না হজরত মহলের। তবে ক্ষেত্রবিশেষে কিছু কিছু রাজক্ষমা প্রদর্শনের ব্যাপারে বেগম তাঁর ঘোষণায় বলেন, ‘কোনো রাজা বা রানি কখনো বিদ্রোহের জন্য সমস্ত সেনাবাহিনী ও জনগণকে সাজা দেয় না।… কেননা যতক্ষণ সাজা শব্দটি বহাল থাকবে, ততক্ষণ বিদ্রোহ দমিত হবে না। একটা বিখ্যাত প্রবাদ আছে, মরতা ক্যা না করতা- মরণাপন্ন মানুষ কী না করে!’
‘খ্রিষ্টধর্ম হলো প্রকৃত ধর্ম কিন্তু অন্য ধর্মের কেউই জুলুমের শিকার হবে না।’ রানি ভিক্টোরিয়ার এ ঘোষণার মূলে দারুন চপেটাঘাত করেন বেগম। তিনি রানিকে তিরস্কার করে বলেন- বিচার বিভাগীয় প্রশাসন ব্যবস্থায় ধর্মের সত্যমিথ্যা যাচাই করার কী আছে? হিন্দু-মুসলমান-ইহুদি, সূর্য বা অগ্নিউপাসক যারা, তাদের ধর্ম প্রকৃত ধর্ম নয় কেন মহারানির কাছে?
ততদিনে বেগমের পায়ের তলার মাটি সরে গেছে। সিপাহি বিদ্রোহের অনেক নেতা, সেনাসদস্য নেপালের তরাইয়ের জঙ্গলে- ক্ষুধার্ত, পরিশ্রান্ত, আহত, মরণাপন্ন। পেছনে সর্বস্ব ফেলে ভিখিরির মতো দুর্গম অরণ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাত্র কদিন আগেও যারা অসীম সাহসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ওপর হামলা করে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল, এখন জোঁক তাঁদের রক্ত শুষে নিচ্ছে, মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া হচ্ছে, চরম অসহায় হালতে বন্যজন্তুর আহারে পরিণত হচ্ছে।
বরাইচের বুন্দিদুর্গ আক্রান্ত হলে বেগম হজরত মহল কিছু সংখ্যক সেনা-সামন্তসহ গুটি বসন্তে আক্রান্ত পুত্র ব্রিজিস কদরকে নিয়ে নেপাল সীমান্তে হাজির হন। উদ্দেশ্য কাঠমান্ডুতে আশ্রয়গ্রহণ। পথে কাপুরুষতার অভিযোগে পরিত্যক্ত হন বেগমের বহু দিনের বিশ্বস্ত সাথি মাম্মু খান। তারপর নেপাল সীমান্তে বসে চিঠি চালাচালি শুরু হয় নেপালরাজ জং বাহাদুর আর ব্রিজিস কদরের তরফে বেগম হজরত মহলের। জঙ্গ বাহাদুর রানা ছিলেন কোম্পানির লক্ষৌ পুনরুদ্ধারের মিত্র। মাত্র বছর খানেক আগে ৯ হাজার পদাতিক আর ২ হাজার ৮ শ ৭০ জন ঘোড়সওয়ার নিয়ে লক্ষৌ পূর্ব দরওয়াজা দিয়ে হামলা চালান। বিজয়ীর বেশে ফিরে যান গনিমতের মাল, ইংরেজের প্রতিশ্রুত পুরস্কার, খেতাব আর বীরের যশ নিয়ে। বেগমের লক্ষৌ বেহাত হওয়ার পেছনে জং বাহাদুরের গোর্খা সৈন্যদের ভূমিকা কোনো অংশে কম ছিল না। তবু তাঁর দোরেই হাজির হন বেগম। জং বাহাদুর কিছুতেই তাঁর মিত্রপক্ষের দুশমনদের নিজ ভূখন্ডে ঠাঁই দেবেন না, বেগমও তাঁকে ছাড়বেন না। এক সময় বেগমের হিকমতের কাছে জংয়ের প্রভুভক্তি হার মানে। এ সম্পর্কে নেপালের ব্রিটিশ রেসিডেন্ট জি. রামসে ব্রিটিশ-ভারতের বিদেশ বিভাগের সেক্রেটারিকে ১৩ জুন ১৮৫৯ তারিখের এক পত্রে লিখেন, ‘মহারাজ জং বাহাদুর গত ১০/১২ দিন থেকে বেগম হজরত মহলকে নিয়ে অত্যন্ত বেআরামে আছেন।… জং বাহাদুর আমাকে প্রস্তাব দিয়েছেন, আমি যদি রাজি থাকি তবে বেগমকে তিনি কাঠমান্ডুতে আমন্ত্রণ জানাবেন। তারপর আমি আর জং বাহাদুর বেগমকে ‘সাধারণ ক্ষমা’ গ্রহণে অনুপ্রাণিত করব।’ ১৮৬০ সালের ৩ সেপ্টেম্বরের আরেকটি চিঠিতে রামসে ফোর্ট উইলিয়ামের বিদেশ বিভাগের সেক্রেটারিকে জানান, ‘জং বাহাদুর আগে থেকেই ঠিক করেছিলেন- নানা, বালা আর তাঁদের আত্মীয়দের আশ্রয় দেবেন, কারণ তাঁরা ব্রাহ্মণ।’ সে সময় নেপালে ঢুকে পড়া প্রায় তিন হাজার বিদ্রোহিকে ব্রিটিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন নেপালরাজ। কিছু সংখ্যক স্বেচ্ছায় ফিরে গিয়ে আত্মসমর্পন করেছিল। ঘরে ফিরে গিয়েছিল এক থেকে দেড় হাজার। আর নেপালে চাষবাসের কাজে লিপ্ত হয় তিন শতাধিক। নানাসাহেব তরাইয়ের জঙ্গলে মারা যান। কাঠমান্ডুতে পাকাপাকিভাবে আশ্রয় নেন সপুত্র বেগম হজরত মহল আর নানাসাহেবের বালিকা বধূ কাশিবাঈ। এক সময় জং বাহাদুরের হারেমে ঠাঁই হয় কাশি বাঈয়ের। বেগম হজরত মহলের বাকি জীবন (বিশ বছর) কাটে নেপালে। এ সময়ে কাঠমান্ডুতে হিন্দুস্থানি মসজিদ নির্মাণ করেন, যার বর্তমান নাম নেপালি জামে মসজিদ, যার চাতালের এক কোণে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত। বেগম লক্ষৌ ঘরানার রেওয়াজ মাফিক তখন কিছু কবিতা লেখেন। তাঁর একটি কবিতার ভগ্নাংশ-
এক তামান্না থি
কি আজাদ ওয়াতান হো যায়ে
জিস মে জিনে না দিয়া
চেন সে র্মানে না দিয়া
যুল্ম কি আন্ধিয়া
র্বাতি রাহি
লামহা লামহা
ফির ভি
পারচুম কো
আসমান সে উতারনে না দিয়া।

৩.
আমরা আরেকদিন দরবারমার্গে গেলে নেপালি জামে মসজিদের সভাপতি শামিম আনসারির সঙ্গে দেখা। তিনি মোটরবাইক পার্ক করে তাজিম সহকারে আমাদের প্লাস্টিকের চেয়ারে বসান। জনাব আনসারি ছোটবেলায় এখানে নামাজ পড়তে আসতেন। তখনো তিনি জানতেন না যে, হজরত মহল কে। তখন এটি ছিল মাটি আর ঘাসে ছাওয়া সাধারণ একটি কবর। আদতে সিপাহি বিদ্রোহের দেড়শ বছর পূর্তিতেই খবরটা জানাজানি হয়েছিল। তার আগে তিনি বাবার কাছে শুনেছেন, বেগম হজরত মহলের সঙ্গে তাঁর পূর্বপুরুষ লক্ষৌ থেকে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন সিপাহি বিদ্রোহের ফৌজ। তখন অনেকে আসে এখানে। তবে তাঁরাই নেপালে ঠাঁই-গাড়া প্রথম মুসলিম কমিউনিটি নন। আদ্যিকাল থেকে কাশ্মীরি বণিকেরা শাল, কম্বল, গালিচা, কার্পেট, ফার আর পশমের পণ্যসামগ্রী খচ্চর বা ইয়াকের পিঠে চাপিয়ে তিব্বতের রাজধানী লাসা যেতেন কাঠমান্ডু হয়ে। এভাবে আসা-যাওয়ার পথে বিয়ে থা করে এখানে থিতু হন কেউ কেউ। কাশ্মীর থেকে সবার আগে আসেন এক দরবেশ। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন কাশ্মীরি তাকিয়া মসজিদ (১৫২৪)। মোগলদের স্বর্ণযুগে নেপালের মল্লা রাজারা মুসলিম দরবারের নৃত্য-গীত, পোশাক-আশাক, আতর-অলংকারে মোহিত হয়েছিলেন। তাঁরা ভারত থেকে দাওয়াত করে নিয়ে যান সঙ্গীতজ্ঞ, সুগন্ধিপ্রস্তুতকারক আর অলঙ্কার ডিজাইনারদের। তারও আগে আগুনের গোলা প্রস্তুতকারীদের আমন্ত্রণ করে আনেন নেপালের নানা ভাগের রাজা-সামন্তরা।
শামিম আনসারির বয়স যখন ১৫/১৬, তখন তিনি একবার লক্ষৌ যান। কিন্তু সেখানে কোনো আত্মীয়ের দেখা পাননি। দেড়শ বছরে কে কোথায় হারিয়ে গেছে! লক্ষৌর আগের সেই জুলুসও নেই। তা থাকার কথাও নয়।
‘বানারস্ কা সুবাহ’ আর ‘লক্ষৌ’ কা সামন্ত’ রাতের লক্ষৌর জলসা, মুশায়েরা আর মজলিশের যে প্রবাদপ্রতীম শানশওকত, তা সেই কবেই গুজার গিয়া! তবে অতীতের ছিঁটেফোটা কোথাও কোথাও এখনো যেন লেগে রয়েছে। অর্কেস্ট্রার ড্রামের মতো চাঁদি পিটিয়ে পাতলা পাত বানানোর শব্দ। শুভ্র সুতি-কাপড়ে সাদা সুতার চিকনের কারুকাজ। বাতাসে আতর আর সুগন্ধি তেলের সঙ্গে মিশে আছে মিঠাই-মন্ডার সুবাস। এ বারের মাত্র দেড় দিনের লক্ষৌ সফরে শামিম আনসারির মতো আমাদেরও সে রকম মনে হয়েছিল। তেল চুবচুবে তুন্ডি কাবাবে জিব উল্টে এলেও দ্বিতীয় দিন লক্ষৌর বিরিয়ানি হতাশ করেনি। নবাবদের নাকি কম বয়সে সব দাঁত পড়ে যায়। তাই তেলে ডোবা তুলতুলে নরম তুন্ডির এত প্রশস্তি।
লক্ষৌ শহরের মূল আকর্ষণ হোসেইনাবাদ, যেখানে বড় ইমামবাড়া, রুমি দরওয়াজা, ক্লক টাওয়ার ইত্যাদি রয়েছে। প্রশস্ত পাথুরে পথের দুধারে এ সব ঐতিহাসিক স্থাপনা। ছোট ইমামবাড়া এখনো জাগ্রত। রঙিন বাত্তিতে ফাতেমীয় এক্সজিবিশন চলছে। ফুটপাতের চায়ের দোকানে বসে, সন্ধ্যাবাতি জ্বলে উঠলে জায়গাটা মোহনীয় মনে হয়। চায়ের দোকানদার সৈয়দবংশীয় শরিফ আদমি, নবাবদেরই বংশধর। শহরের লানতের জন্য তিনি ইংরেজদের গালি দিলেন মিঠা বুলিতে। চায়ের স্বাদ আর পরিবেশনার তরতিবের জন্য আমরা দ্বিতীয় দফা চা চাইলাম। এ রাজকীয় ইমারতের পেছনে যে ঝুপড়ি বস্তি, ওখানে নবাব-ফরজন্দরা বাস করেন। পানি-ফুচকা খেয়ে যাচ্ছে এক জীর্ণবসনা বালিকা। ময়লা দোপাট্টায় মুখ মুছে ফুচকার দাম মিটিয়ে ঘুরে তাকালে নিমেষে চোখের সামনে ফুটে ওঠে মোহাম্মদী বেগমের কিশোরীবেলার আলো-আঁধারি তসবির। মা-মরা গরিব ঘরের মেয়ে, যাকে বাবা বা ফুফু বেচে দিয়েছিল এ হোসেইনাবাদের কোনো এক মহল্লায়। পরে সে হয়েছিল ওয়াজেদ আলি শাহের পরীখানার মহক পরী, তারপর প্রাসাদের মাননীয়া বেগম হজরত মহল। পরিশেষে সিপাহি বিদ্রোহের নেত্রী, যার নামে এ শহরের ভিক্টোরিয়া পার্কের নাম বদলে রাখা হয়েছে বেগম হজরত মহল পার্ক। ১৯৮৪ সালের ডাকটিকিটে সিপাহি বিদ্রোহের নেতাদের সঙ্গে ছাপা হয়েছে তাঁর প্রতিকৃতি। নানাসাহেবের মাথার একপাশে হেলানো কাছিমাকৃতির পাগড়ি আর সালঙ্কারা বেগম হজরত মহলের মুখে হুক্কার নল। নলটা ঠোঁটের অপেক্ষাকৃত নিচে ধরা। বিরামহীন হুক্কার ধোঁয়া ছাড়তেন বলে তিনি হুক্কাঅলী বেগম নামে লক্ষৌতে সবিশেষ খ্যাতি লাভ করেন। সেভাবেই আঁকা হয়েছে ছবিটা। ব্যতিক্রম শুধু লক্ষৌর ‘দস্তরখান’ নামের মশহুর খাবারের দোকানের দেয়ালচিত্রটি।
দস্তরখানের বাইরের দেয়ালের কুলঙ্গিতে অযোধ্যার পহেলা নবাব শুভ্র দাড়ির দরবেশি চেহারার বুরহান উল মুলুকের মানুষ-প্রমাণ সাইজের বিশাল প্রতিকৃতি। খুব চালু খাবারের দোকান দস্তরখান। টোকেন হাতে অনেকে আঙিনায়, গ্যারাজের ছায়ায় অপেক্ষা করছে। আমরা বাইরের চৌপায়ায় বসে অতন্দ্র প্রহরীর মতো দন্ডায়মান নবাবের কুলঙ্গির ছবিটা দেখি। পথে আদিনাথ যোগীর বহরের কারণে আটকে থাকতে হয়েছিল অনেকক্ষণ। টেক্সিতে বসে বিলবোর্ডে লটকানো তাঁর জাফরানি হাসি নয়নভরে দেখতে হয়েছিল। তারপর কোনোক্রমে দস্তরখান। এ বেলা লক্ষৌর বিরিয়ানি। দাঁত থাকতে তুন্ডি কাবাব আর কিছুতেই নয়।
খাবারের অর্ডার দিয়ে সামনে তাকাতেই চোখে পড়ে দেয়ালে বাঁধানো বেগম হজরত মহলের প্রতিকৃতি। এখানে তিনি হুক্কাহীন। খাবার আসতে দেরি হচ্ছে বলে ছবিটা নজর করে দেখি। ডানপাশে সিঁথি করা, টিকলির চেইন সিঁথি থেকে কিঞ্চিৎ সরে গেছে। বারো ঘাটের জল খাওয়া বেশ চালাক-চতুর আর সুন্দর মুখশ্রীর নব্য যুবতী। আর অসম্ভব আত্মপ্রত্যয়ী। কিছুতেই হারবে না, হারলে চলবে না- এমন এক দৃঢ়তার ছাপ যেন চোখে-মুখে। চিত্রের সময়টা হয়ত তালাকের আগে, নবাবজাদার মা হয়েছেন যখন। নবাবপুত্রের মা হলেও নবাবের তালাকপ্রাপ্ত বিবি- বিদ্রোহের ডামাঢোলে হুকুমতের রাশ ধরে রাখা, এলেম না থাকলে সম্ভব হতো না, যেখানে ফিরিঙ্গিসহ এন্তার কুৎসাকারী, বাঘা বাঘা প্রতিদ্বদ্বী, পারিষদবর্গ রয়েছে। বেগমের রূপ, তাগদ, হিকমত- এ সমস্ত কিছুই যেন একযোগে দেয়ালের চিত্র থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছিল।

 

 

তথ্যসূত্র
১. ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের বীরাঙ্গনা বেগম হজরত মহল- সত্য সাউ
২. আখতারনামা- শামিম আহমেদ
৩. উমরাওজান- মির্জা মুহম্মদ রুশোয়া
৪. বেগম হজরত মহল, তথ্যচিত্র

 

 

ছবি: সংগৃহিত 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত