শিকার
বাড়িতে মরা-কান্না পড়ে যায়।
“ওরে আমার বাপরে! ওরে আমার মা রে! হা বিধেতা, শেষটায় এই লিখেছিলে আমার কপালে!”
গলা শোনা যায় মেজ বউ কুসুমেরই সব চাইতে উপরে। এই দস্তুর এ বাড়ির। বাড়িতে টালমাটাল আপদ বিপদ কিছু হলেই, কিছু হবার সম্ভাবনা হলেই, পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসবে কুসুম। আশপাশ কাঁপিয়ে। পাড়াপড়শি জানিয়ে।
” ওরে আমার বাবা রে। ওরে আমার মা রে, হা রে বিধেতা, কার চরণে কী পাপ করেছিলাম রে। আমার কপালডা ক্যান এমনভাবে পুড়ল রে। তার আগে দেহডা ক্যান ভস্ম হল না, ও মা, ও বাবা। হে বিধেতা।”
কুসুম কেঁদে ফাটাচ্ছে, কাঁদতে আরম্ভ করেছে আর আর মেয়েরা। ওরা কাঁদছে ইনিয়ে বিনিয়ে, ফুঁসে ফুঁপিয়ে।
এক পহর রাত তখনও আছে। ড্যাবা ড্যাবা চাঁদটা আকাশে নেই। একটা স্তব্ধ গুমোট অন্ধকার। ঝিঁঝি পোকাদের ডাকটাও বন্ধ। কোথাও কোনো সাড়া শব্দ নেই। ভোরের আলো চোখ খোলেনি। ভোরের বাতাস পাখা মেলেনি। অন্ধকারের মধ্যে মূর্তিগুলোকে আবছা আবছা দৌঁড়াদৌড়া করতে দেখা যাচ্ছে এ-ঘ সে-ঘর।
মেজ ভাই কুঁড়োরামই সংসারের সব। বড় ক্ষেত্তর, নামেই, নির্বিরোধ ভাল মানুষ। বোকাসোকা মুখ করে হাৎনের এক কোনায় বসে তামুক টানছে। কিছু বোঝবার, চিন্তা করবার শক্তি আর নেই। যা কিছু কাজ সব জড়ো হয়েছে হুকোটার খোলে। ফুটোয় ঠোঁট লাগিয়ে তাই জোরে জোরে টানছে। তবু একবার কী করতে যাচ্ছিল। হাঁ হাঁ করে উঠল কুঁড়োরাম!
“তুমি বসো, তুমার দরকারডা কী এদিকে আসবার।” কুঁড়োরাম বলে দিয়েছে।
ব্যস ক্ষেত্তর নিশ্চিন্ত হয়েছে। মন খোলাসা করে তামুক সেজেছে। আর সেই থেকে বসে বসে টানছে। ভাই-এর উপর অগাধ বিশ্বাস তার। কত্তে কম্মাতে কুঁড়োই।
বিরাশি বছরের বুড়ি মা, শুয়ে রয়েছে পুরের ঘরে! বুড়ো মাকড়সার মতো আঁকড়ে ধরে আছে দুমাসের নাতিটিকে বুকের শক্ত ঘোড়লের মধ্যে। মাথার ভেতরে সবকিছু ঘুরপাক খাচ্ছে বন বন করে। কী হল? এ কী হল? খানিকটা অস্পষ্ট কষ্ট, খানিকটা আবছা ভয়। ইষ্টিনামও বেভুল হয়ে গেছে। শুধু সজাগ আছে চোখের জল। একমাত্র তাই গড়িয়ে গড়িয়ে পরছে। ভিজিয়ে দিয়ে চলেছে আপন মনে।
কুঁড়োরাম আর বাঁশরীই যা করবার করছে। দৌঁড় ঝাঁপ। বাঁধা ছাঁদা। গোছগাছ। আর ঘুরছে ছোট বউ বাতাসী। ছোট্টখাট্ট বউটি লাটিমের মতো পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে। মাথায় সেই অন্ধকারেও এক হাত ঘোমটা। ভাশুর-ভাতারের সঙ্গে কোনও সময় চোখাচোখি হয়ে যায় তার তো ঠিক-ঠিকানা নেই কিছু, বাড়ির মধ্যে উৎসাহ উত্তেজনা একমাত্র তারই। মেজ বউ যে শুধু কাঁদতে বসে গেল কেন বাতাসী তার হদিস পায়না কিছু। বেশ তো, ভালই তো হচ্ছে যাওয়া হচ্ছে, অন্যত্তর। নতুন দেশ, নতুন জায়গা, নতুন জায়গা দেখা হবে। কি হবে বাপু এই এক ঘেয়ে এক জায়গায় থেকে। তার বিয়ে হয়েছে দু’বছর। এর মধ্যেই তার হাঁফ ধরে গেছে। তার ভাল লাগে না এই গ্রাম। বাতাসী ছোটবেলায় শহরে থেকেছে। তার বাপ চটকলে খাটত। সে দেখেছে বৈচিত্র। শহরেই জাঁক-জমক, ঠাঁটবাঁট। দিদিরা একেবারেই অজ। গাঁ ছেড়ে পা বাড়ায়নি কোথাও। তাই ভিটে ছাড়ব ছাড়ব করে কান্না।
কুঁড়োরামের হাঁকডাকে ঘর কাঁপতে থাকে। যেমন চেহারা। দুহাতে বেড় পাওয়া যায় না। তেমনি গলার আওয়াজ। কুঁড়োরামের বাবা ওর ছোটবেলার কান্না শুনে বলত, “বিটা আমার সমুদ্দুরের শংখ গলায় বাঁধে আয়েছে।”
” ও অন্নর মা, আরে এদিকে আসো দিন দেখি। মাগীর কান্না আর ফুরোয় না। ওখানে পুখোর কাটে ফেলল বোধায়। ” হাঁক ছাড়ে, ” বলি বসে বসে কাঁদবা না কুপিডে এটটু জ্বালে দিয়ে যাবা। বিধেতা ক্যান যে মাগীদের ছিড়িষ্টি করিছিল রে–“
আবার সেই বাতাসীই এসে কুপি দিয়ে যায়।
কুঁড়োরাম বলে, বউমা তুমি! ক্যান, ও মাগীর কি ভাতার মরিছে যে সেই থেকি ঘেংড়ি পাড়তিছে।”
সঙ্গে সঙ্গে হাতও চলছে কুঁড়োরামের। বড় বিছানার বাণ্ডিলটা চেপে চুপে ঠেসে গোল পাকিয়ে রাখল। দু’হাত দিয়ে ঠেসে ধরে হাঁক পাড়ল।
“কই রে, বেঁশো, কাঁথা আনতি কি কোলকেতা যাতি হল?”
বাঁশরী নারকোলের রশি আনল। তারপর দুভাই মিলে টেনে টুনে বেশ করে বেঁধে ফেলল বিছানাটা।
এক পাশে সরিয়ে রেখে বলে উঠল, “তালি তিনডে হল বিছানা, কি বলিস। আরে গুডা দুই হবেনে। যা, মারে উঠতি ক। গুছায়ে ফ্যাল ওঘরের বিছানা গুলোন। ছেঁড়াটেড়াগুলো ফেলে রাখিস। অত বুঝা সামলানো যাবে না।”
কুঁড়োরাম ছুটে যায় রান্নাঘরে। একটা বস্তা টেনে নেয়। ভরতে থাকে বাসনকোসন। হাঁক ছাড়ে, ” ও পুটে, তোর মারে পাঠা দিন এ ঘরে। কি আছে কি না আছে সে সব দেখে নিয়া কি বিটাছাওয়ালের কম্ম।”
শেষ পর্যন্ত কুসুম উঠে আসে। ওর কান্না এখন চলে ইনিয়ে বিনিয়ে, ঘেঙিয়ে ঘেঙিয়ে এটা ওটা এগিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে চিৎকার করে বাতাসীকে এটা সেটা করতে বলে। আবার কাঁদতে থাকে।
“ও ছোটবউ, কাঁধউচো থালখান দিয়ে যা। মারে জিজ্ঞেস কর দিন ছিক্ষেত্তরের বাটিডে কনে। ও ছোট বউ, তোর খাটের নীচে দুখান বগিথাল আছে। জামবাটিডে বোধায় আদাড়ে। ও বুঁচি, মাজে দে দিন শিগগির করে।”
দুটো বস্তা নিমেষে ভরে যায়। কত জিনিস? তার কি ঠিক আছে কিছু? গোনাগুনতি আছে? বাপ-পিতাম’র ভিটে ছাড়া চাড্ডিখানি কথা? নাড়ির সঙ্গে যোগ তার। অষ্টপাকে বাঁধন। তামুক টানতে টানতে ক্ষেত্তরের চোখে বারে বারে জল এসে পরে। চোখের জল মুছে হুঁকোর খোলে লাগা লালাটা মুছে জোরে জোরে টান দিতে থাকে। পুরুষ পুরুষের পায়ের ছাপ পড়ে আছে এই বাড়ির আনাচে কানাছে। তার বাবা, তা-র বাবা, তা-র বাবা জন্ম নিয়েছে এখানে। বেড়ে উঠেছে এ বাড়ির ধুলো কাদা মেখে। এ ছেড়ে যাওয়া সহজ কথা? যেতে চায়নি কেউই, কাল গোটা রাতটাই বচসা হয়েছে। কুসুমকে বোঝাতে সব চাইতে কষ্ট হয়েছে। শেষ পর্যন্ত কোট ধরে বসে ছিল। কুসুমের এক কথা।
“মরি মরবো, শ্বশুরের ভিটেতেই মরবো, যাবো না আর কুথাও।”
থাকতেই কি ওদের অসাধ! কিন্তু কেউ যে থাকল না গাঁয়ের। মাতব্বর প্রধান যারা, যারা শক্তিমন্ত তারাই থাকতে সাহস করল না। পালাল হুড়হুড় করে, পাকিস্তানে শুধু নাকি মুসলমানরাই থাকবে। হিন্দুদের নাকি স্থান নেই সেখানে, মাতব্বরদের কাছেও ছুটেছিল তারা। মেদ্ধা সাহেব, গাজি সাহেবরা তো ভরসা দিলেন। ভিটে ছেড়ে যেতে বারণ করলেন। গুজব কথায় কান দিতে নিষেধ করলেন। পাকিস্তান কি, হিন্দুস্তান কি, এই গাঁয়ের মাটি তাদের। সেই ভরসাতেই তো ছিল এত দিন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে সবাই পালাল বাড়ি-ঘর খালি করে। খালি বাড়ি-ঘর পেয়ে ঢুকতে লাগল বিদেশি বিজাতিরা। কথা বোঝে না যাদের, ভাবসাবও বোঝে না, নানারকম কথায় আতঙ্ক বাড়ে। লম্বা চওড়া বলিষ্ঠ চেহারা দেখে ভয় হয়। তবুও না হয় থাকা যেত, যদি থাকত সবাই, যদি পেত কত্তাদের অভয়, প্রতিবেশী শক্তিমানদের দরদ ভালবাসা। কিন্তু গাঁয়ের সবাই যখন পালাল, সব কটা গাঁ যখন প্রায় খালি হয়ে এল, যখন কেউ রইল না, টেপাখোলায়, হরিনারায়ণপুরে, সহদে’য়, মোষবাতানে, গাঙ দিঘড়েয়, তখন ওরাই বা একঘর কি করে থাকে টিম টিম করে! ওদেরও তো মান সম্ভ্রম আছে। আছে মাগ মেয়ে। তবে? গড়িমসি করতে করতে এতদিন কাটল।
কিন্তু মেয়েদের বোঝাতে পারে যে তার জন্ম হয়েছে নাকি এখনও? বেশি কিছু বললেই ফ্যাঁচ করে কান্না। সব চাইতে কোট আবার কুসুমেরই বেশি। শ্বশুরের ভিটে ছেড়ে যাব কোথায়? সেটা যেন আর বোঝে না পুরুষ মানুষ। কষ্ট যেন তাদের হয় না। বারো হাত কাপড়ও যাদের কাছা দিতে আঁটে না, শেষ পর্যন্ত বিধান নিতে হবে তাদের কাছ থেকে। গরম হয়ে উঠল কুঁড়োরাম। হাত মুখ নেড়ে মাটিতে পা আছড়িয়ে পাগলা মোষের মতো চেঁচাতে লাগল।
“তবে থাক ও-মাগী পড়ে। ওই যে কনথে যেন আয়েছে সব মিনষেরা, যখন মাগীর হাত ধরে হিড়হিড় করে টানে নিয়ে যাবেনে বনবাদাড়ে, তখন ঠিক হবেনে। যেমন বজ্জাত তেমন হওয়া চাই তো।”
যা মুখে এলো তাই বলে গেল কুঁড়োরাম। কুসুম আর আপত্তি করল না। কথা বন্ধ করল কিন্তু কান্না না। এ কান্না একান্ত মেয়েদের।
“ও বউমা!” শ্বাশুড়ি ডাক দিল, “তেঁতুলের আচারের ঠিলেডা আছে ওই শিকেয় ঝলনো! উডা যেন ভুলে যায়ে না, ক্ষ্যাত্তরের আবার ও না হলি খাওয়া হয় না। আর দ্যাখো কাঁটালের বিচির ঠিলেডাও নিও, বুঝলে? আর পশ্চিমির ঘরের সিন্দুকি পুরনো ঘিটুক আছে। কিছু যেন ফেলে যায়ে না।”
বুড়ি আরও অনেক কিছু বলতে চায়। কত কী যেন ফেলে যাচ্ছে! কিন্তু মনে করতে পারে না। ভাঁজ-পড়া মগজে সব স্মৃতি জট পাকিয়ে গেছে। সমস্ত শরীরে এক নিদারুণ অস্বস্তি। একটা শুকনো শক্ত আঠাল ঢ্যালা গলার নলীতে আটকে থাকে। অসহ্য যন্ত্রণায় সর্ব শরীর কাঁপতে থাকে। পুরনো চোখের ভাঁজপড়া কোণ দিয়ে জল গড়িয়ে গড়িয়ে পরে। বিড়বিড় করে কী যেন বলে। বোঝা যায় না।
শেষ পর্যন্ত কমসম করেও, বাদ-সাদ দিয়েও, বিছানার বাণ্ডিল হল পাঁচটা। বাক্স পেঁট্রা চারটে। দুটো বাসনের বস্তা। একটা কাঠের নকশা-কাটা হাত বাক্স। তিনটে মুড়ি-মোয়ার টিন। দুটো গুড়ের ঠিলে। একটা আচারের টিন। তিনটে ধামা ভর্তি টুকিটাকি জিনিস। পাঁচটা হেরিকেন (মাত্র দুটোর চিমনি আছে)। তবু কিছু নেওয়া হয়নি। যেদিকে চোখ পড়ে, ঘরের কোণে, হাতনের উপর, ছানছেয়, জিনিসপত্তর রয়ে গেল। গড়াগড়ি, ছড়াছড়ি।
শ্বাশুড়ি বলে, “ও বউমা, বাড়ুন তিন গাছ নিলিই পারতে। বিদেশ বিঁভুই ঠাই কোন সোমায় যে কোনডের দরকার লাগে কওয়া তো যায় না।”
কিন্তু কুঁড়োরাম নিতে দেয়নি। প্রাণে তারও লেগেছে বুকের ভেতর তারও হয়েছে খানখান। কিন্তু আক্কেল-হারা হলে তো আর চলে না, তাই শেষ পর্যন্ত সে তাড়া লাগিয়ে ধমকে নিষেধ করেছে। বারবার করে গুণে দেখেছে কুঁড়োরাম। বাঁশরী বড় বড় গোটা গোটা অক্ষরে লিস্টি করে নিয়েছে সব। এ ফন্দিটা বাতাসীর। এরা তো রেলগাড়ি চড়ে কালে-ভদ্রে। কায়দা-কানুন জানে না। বোঝে না কিছু। বাতাসী তার বাবাকে দেখত ফর্দ করতে কোথাও কখনও যাবার হলে। তাই এ ফন্দিটা চুপি চুপি বাঁশরীকে ডেকে বলে দিয়েছে। ক্ষেত্তর বুঝ করে নিয়েছে তামাক টিকের কৌটোটা। নিয়েছে হুকোটা আর কল্কেটা।
দু গাড়ি মালা আর একখানা ছইঢাকা গাড়িতে ওরা। ঘরে ঘরে তালা মেরে, বাস্তু-ভিটে প্রণাম করে, আমশাখারি স্পর্শ করে, যাত্রা করল। ক্যাঁচ কোঁচ ক্যা-আঁচ। চলতে থাকে গাড়ি কটা। খানাখন্দে ধাক্কা খায়। সর্ব শরীরে ঝাঁকুনি লাগে। পায়ে পায়ে ধুলো উড়ে পেছনটা ঝাপসা করে দেয়। খুশি হয়েছে বাচ্চাগুলো। টেপি, পুঁটে, বুঁচি এদিক দিয়ে ওদিক দিয়ে ভুলুক মারে। যা দেখে বিস্মিত হয়। খুশি হয়। দু মাসের বাচ্চাটা বুড়ির কোলে শুয়ে অবাক অবাক চোখ দুটো দিয়ে ছইয়ের দলানি দেখে। আর খুশি হয়েছে বাতাসী। ঘরের গুমোটে ওর বুকে পাষাণ চাপে। খোলামেলায় মনটা ওর হালকা হয়।
“দেখো দিদি, শহর জায়গাটি সোন্দর। শান-বাঁধানো পাকা রাস্তা। ধুলো নেই, কাদা নেই। অন্ধকার পর্যন্ত নেই।”
বাতাসী ফিসফিস করে বলে। চাপা আওয়াজেও খুশির ঝলক টের পাওয়া যায়। জগদ্দল কাঁকিনাড়ার অস্পষ্ট স্মৃতিছবিটা ওর চোখে ভেসে ওঠে। বাতাসীর বাবা কলে খাটত ওখানেই।
কোনো কথাই কুসুমের কানে ঢোকে না। মনটা ব্যথায় ব্যথায় দুমড়িয়ে যায়। সমস্ত অনুভূতি জল হয়ে চোখে কোনা বেয়ে গড়িয়ে পরে। ন’বছর বয়েসে বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে এসেছিল। তারপর এক-নাগাড়ে উনিশ বছর। শ্বশুর মরেছে। বড়জা মরেছে। দু দুটো ছেলে মরেছে। কত কত দিন! বাস। কেবলই মনে হয় কী যেন ফেলে এল। কাকে যেন রেখে এল। ধবধবে পাকাচুলওয়ালা একটা মাথা। চওড়া লালপেড়ে শাড়ি-পরানো আলতা-মাখানো দুখানা পা, কচি কচি কয়েকটা হাত যেন ওকে ফিরতে বলেছে। ওর কানে শুধু বাজছে, বউমা চললে, ও বউ চললি, মা চললি, চলে গেলি, চলে যাচ্ছিস! আমাদের ছেড়ে যাচ্ছিস! কুসুম আছাড় খেয়ে পরে গাড়ির মধ্যে। আঁচলে মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে কাঁদে।
বাড়িটাকে আর দেখা যায় না। সুপারিগাছগুলোর মাথা, চিনিটারা আমগাছটার ডগা আর হাজারখাগী কাঁঠালগাছের মগডালটাকে একটু একটু দেখা যায়। জলে ঝাপসা হয়ে আসে চোখ।
কুঁড়োরাম ছইয়ের আড়াল থেকে হাঁকাড় মেরে উঠতে যায়, “এই মাগী খবরদার কাঁদবি নে।“ কিন্তু চোখের জলে রুক্ষতাটা মিইয়ে পড়ে।
বুড়ি স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। কোলের উপর নাতিটা নড়াচড়া করছে। গোরুর গাড়িটা ঝাঁকি খেয়ে হেলে পড়েছে। বিড় বিড় করে কী হিসেব করে চলেছে। কী একটা ফেলে এসেছে। মনে করতে পারছে না। কিছুতেই মনে পড়ছে না। মাথাটা ছিঁড়ে ফেলবে না কি?
“ও বউমা গয়ার ঘটিডে কই? তাতে যে একটু গঙ্গাজল ছিল।“
বাতাসী গলা নিচু করে জবাব দেয়, “বউঠাউরির কাছে আছে।“
বারো মাইল দূরে লঞ্চের ঘাট। সেখান থেকে ন’পাড়ার ইস্টিশান। তারপর? তারপর কোথায় কেউ জানে না। কোথায় যাবে ঠিক নেই। কোথাও একটা ঠিক করতে হবে।
টেঁপাখোলার বাজারে অশ্বিনী শিকদেরের সঙ্গে দেখা। হিসেবি লোক। বিপদের আভাসেই সরে পড়েছেন। পরিবারবর্গ নিরাপদ জায়গায় এখে মালপত্রের বিধিব্যবস্থা করতে এসেছেন।
“কী, সব চললি তা হলি?”
“আর না যায়ে করবো কী কন তো।“
“তা যাওয়া হচ্ছে কনে?”
“তার কিছু ঠিক হয়নি। আপনারা তো অনেকদিনই দেশ ছাড়েছেন। আপনারা এখন আছেন কনে?”
“আমরা তো নবদ্বীপ আছি।“
“নবদ্বীপ। সে তো ভাল জায়গা। হুজ্জুতহাঙ্গামা নেইঃ তীত্থস্তান। নিত্য গঙ্গাস্নান, দুবেলা গৌর-দর্শন। ও কুঁড়ো, তবে তো ওখেনে গেলিই হয় রে। কী বলেন অশ্বিনী তাওই, আপনারা পাঁচজন যেখেনে আছেন।“
“হ্যা , হ্যাঁ, তাই চল।“
সন্ধ্যে নাগাদ ওরা লঞ্চ ঘাটে পৌঁছাল। এক এক করে নামছে সবাই ঘাড়ি থেকে। একটা কুকুর এসে ভিড়ে গেল ওদের সঙ্গে। ডাকত লাগল কুঁই কুঁই। শুঁকতে লাগল এর ওর গা। বেশ কুকুরটা। ঝুমরো ঝুমরো চুল। কুঁতকুঁতে চোখ।
টেঁপির হাতটা চেটে দিতেই ‘ও মাগগো’ বলে টেঁপি দিল এক লাফ। বাঁশরী একটা লাঠি কুড়িয়ে মারতে গেল।
ক্ষেত্তর বলল, “আহা, থাক থাক।“
লঞ্চের ঘাটে ভিড়ের অন্ত নেই। লোক। মাল। একেবারে নাগরি-ঠাসা।
বাতাসী ফিসফিস করে, “দেশ গাঁয়ে আর লোক থাকবে না বোধ হয়।“
লঞ্চ আসতে না আসতে ঠেলাঠেলি পড়ে যায়। লঞ্চটা আসেও টইটুম্বুর হয়ে। একেবারে অ-জান লোক। কোনওদিন বাড়ি থেকে বের হয়নি। শুলক সন্ধান জানে না। কায়দা কানুন বোঝে না। ভিড়ে ঢুকতে ভয় পায়। উঠতে পারে না লঞ্চে। লঞ্চ চলে যায়। ওরা সেই চরাতেই পড়ে থাকে। কুঁড়েরামের মতো লোকও হকচকিয়ে যায়।
হুকুম দেয় “ নে, রান্নাবান্না কর। খায়েদায়ে তো নিই। তারপর দ্যাখবানে।“
চড়ার উপর রান্নাবান্না হল। খাওয়াদাওয়া চুকল। বাতাসী সারাটা দিন যেন বাতাসেই ভেসে বেড়াল। উপছে-পড়া খুশির তোড়ে সামাল দিতে পারছে না নিজেকে। বহুদিন বদ্ধ ছিল। আটকা ছিল। আজকে খোলা পেয়ে খেলা শুরু করল। খুনশুড়ি করল টেঁপি পুঁটের সঙ্গে। বুঁচিকে রাগিয়ে দিল। কুকুরটাকে দু’হাতে চটকাল। কুসুমের ছেলেটাকে কাঁদিয়ে আবার শান্ত করল।
একদিন দু’দিন নয়। পরপর চারদিন উঠতে পারল না লঞ্চে। মেজাজ বিগড়ে গেল কুঁড়োরামের। এ উঠতে পারে তো অত মাল তুলতে পারে না। সময় মেলে না। বারবার ওঠানো নামানো করতে করতে বেসামাল। গালাগালি করে, চেঁচামেচি করে চড়াটা মাথায় তুলল কুঁড়োরাম।
“বিধাতা এত থাকতি ক্যান যে গুচ্ছের মাগী ছিরিষ্টি কললেন, তা কবে কিডা। অকম্মার ধাড়ি সব। কুড়ের বাথান।“
কুঁড়োরামের গালাগালির শেষ নেই। একদিন এল কতকগুলো কেমনতরো পোষাক-আশাক-আঁটা জোয়ানমদ্দ লোক। খোলাল বাক্স। আলগা করল বিছানা। টানা হেঁচড়া। হেনস্থার একশেষ। শেষকালে দশটাকা নিয়ে সরে পড়ল। রাগে পাগলা বয়ার হয়ে উঠল কুঁড়োরাম। লাথি মেরে নদীতে ফেলল এক বস্তা বাসন।
কুসুম ছুটে এল, ‘হাঁ হাঁ! কর কী? কর কী?”
কুঁড়োরামের হাতখানা ধরতে গেল।
“সরে যা মাগী।“
তাড়া দিল কুঁড়োরাম। চোখ দুটো ভাঁটাফুলের মতো লাল করে বলল, সর শিগগির। নাকি তোরেও দেব ওখানে ঠেলে।“
মধুমতির আবর্তিত জলটা দেখিয়ে দিল। কুসুম ভয় পেয়ে সরে যায়।
সেদিন লঞ্চ আসতেই বিছানা ছুঁড়ে, বাক্স ছুঁড়ে, একে ঠেলে তাকে ফেলে, সবাইকে কোনও রকমে তুলে দিল।
“হাঁ হাঁ, কর কী?”
“এই—এই, মাথা ফাটাবা নাকি!”
“আরে ইডা কনকার বেয়াদব রে!”
“চোপরাও!”
“খবরদার!”
“এই মুখ সামাল!”
বেধে গেল ঝগড়া। ঠেলাঠেলি। ঘুষোঘুষি। ঘুষো খেয়ে কুঁড়োরামের বাঁ দিকের ভুরুর উপর কালশিটে পড়ে গেল। দিল একজনের নাক ফাটিয়ে। ক্ষেত্তর ছুটে এল। বাঁশরী এল। আরও লোকজন জুটে গেল। বুড়ি ইষ্টনাম জপতে লাগল। মেয়েদের মধ্যে কান্নাকাটি পড়ে গেল। সারেং এসে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল। দু দল দুদিকে সরে গেল। মিটমাট হয়ে গেল। আবার সব চুপ। ভুরুর উপর হাত বুলাতে বুলাতে এক কোনায় রেলিংয়ের ধারে এসে দাঁড়াল কুঁড়োরাম। টেপি পুঁটে বুঁচি বাপের কাছে ঘেঁষে দাড়াল। কুকুরটা পাউড়ি থেকে ওদের দেখে ঘন ঘন লেজ নেড়ে কাতরাতে লাগল কুঁই কুঁই করে। লঞ্চ ছাড়বার ভেঁপু দিল। বাতাসী ডাঙারটার দিকে চেয়ে আছে। ওর চোখ জলে ভরে এসেছে। এক দৃষ্টে ফলন্ত আমড়াগাছটির দিকে চেয়ে রইল। কালকেও ও আর বুঁচি আমড়ার কুশি খেয়েছে ওই গাছের। ক্ষেত্তর কাকে উদ্দেশ করে প্রণাম করল। পুঁড়ে কুকুরটাকে হাত বাড়িয়ে ডাক দিল।, “আ তু, তু তু উ উ।“ ঘন ঘন লেজ নাড়তে নাড়তে কুকুরটা কাতরভাবে ডেকে উঠল, “কেঁ-উঁ-উঁ-উঁ। ঝাঁকানি দিয়ে লঞ্চ ছাড়ল। চড়াটা দূরে সরতে লাগল। চড়ার উপর কী যেন একটা পরে আছে। চিক চিক্করছে রোদ্দুরে।
পুঁটের খুব মজা। লঞ্চের আগে আগে কুকুরটা দোড়াচ্ছে। পুঁটে হাত বাড়িয়ে ডাক দিল,”আয় আয়।“ দেখতে দেখতে কুকুরটা লাফ দিয়ে জলে পড়ল। পড়ল একেবারে লঞ্চের সামনে।
“হেই—হেই!”
“আহা-হা, কেটে একেবারে দুখানা হয়ে গিয়েছে গো। কেষ্টর জীবটা। আহা, আহা।“
“দিদি গো মরে গেল।“
ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল বাতাসী। একটা কালো দেহ পাশ দিয়ে ভেসে গেল। লাল লাল জল অনেক অনে—ক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পরল। বাতাসীর কানে ভাসতে লাগল কুকুরটার আর্তনাদ কেঁ-উঁ-উঁ-উঁ—অনেকক্ষণ। অনেকদূর। অনেকদিন।
ন’পাড়া ইস্টিশানে নবদ্বীপের টিকিট নেই। রানাঘাটের পাওয়া গেল। মালামাল নিয়ে ট্রেনে চড়াও তেমনি ফৈজত। দু-দু টাকা মোট। গাড়িতে চড়িয়ে দেওয়া অবধি। অনেক দরাদরি। অনেক কষাকষি। অনেক তত্ত্বতোয়াজের পর টাকা টাকা রফা হল। হুড়মুড়িয়ে এসে গেল গাড়ি। তিল রাখবার জায়গা নেই। তবু মানুষগুলো উঠল কী করে! গাড়ি ছাড়ল। কুসুমের আতঙ্ক কাটল খানিকটা। ট্রেনের শব্দ ওদের কানে একেবারে নতুন। কান পেতে শুনতে বেশ ভাল লাগে। ইস্টিশানের পর ইস্টিশান পার হয়ে যায়। আরও মাল ওঠে। আরও মানুষ।
বনগাঁ। জংশন। গাড়ি বদলে রানাঘাট। হাঙ্গামা বাধল মালের টিকিট নিয়ে। সাদা-পোষাক-পরা বাবু এসে মালের টিকিট চাইলেন। টিকিট নেই? ধমক লাগালেন। টিকিট নেই। আবদার। চল থানায়। হাতে ধরা, পায়ে ধরা। অনুনয় বিনয়। কে শোনে। বাবুর ডিউটি যে লোক ধরা। হাতে পেয়েছেন যখন আর ছাড়াছাড়ি নেই। পাকিস্তান থেকে আসছি। আমরা হিন্দু। অসহায় বাস্তুহারা সম্বলশূন্য প্রায়। কিছু জানি নে। কিছু শুনতে চাইনে। লগেজ-টিকিট আছে? দেখাও। নেই? চালান যাও। তবে হ্যাঁ, বিপদে পড়েছ। বিধি-ব্যবস্থা আছে বৈকি। দাও দশ টাকা। দশ টাকা? ওর কমে হয় না? তবে থানায় যাও। একেবারে আধলাটি খরচ করতে হবে না। বে-আইনী কাজ করেছ। ভোগো তার ফলটা।
পাঁচটা টাকা দিয়ে, বাবা ডেকে, তবে রেহাই পাওয়া গেল শেষ পর্যন্ত। আবার নবদ্বীপ ঘাট ইস্টিশানে পাঁচ টাকা। কুলি এক টাকা প্রতি মোট। নৌকা এক টাকা প্রতি মাথা, আট আনা প্রতি মাল।
হুড় হুড় করে বেরিয়ে গেল জমি-বেচা টাকাগুলো।
কুঁড়োরাম, বাঁশরী আর ক্ষেত্তর মুখ চাওয়া-চাউয়ি করতে লাগল। লোকগুলো কি হাঙর? চড়ার উপর বসে বসে বাহারে বাড়িগুলোর দিকে চেয়ে রইল তিন ভাই। যত রাজ্যের আশঙ্কা আতঙ্ক ভয় সন্ধ্যের সঙ্গে সঙ্গে ওদের ঘিরে ধরল। সহানুভূতিহীন অপরিচিত জায়গা। কোঠা বাড়িগুলো মনে হল রাক্ষসের পেট। কবন্ধ সব রাক্ষস। আজকের মতো চড়াতেই থাকা যাক। এই বটগাছটার নিচে। গঙ্গায় নাও ধোও। বাপ-পিতামোকে উদ্দেশ করে দু গণ্ডূষ পুণ্যবারি দাও। ততক্ষণ একটু অশ্বিনী তাওইয়ের খোঁজ করে আসা যাক। ওই পথে খাবার-দাবার কিনে আনলেই হবে। বেরিয়ে পড়ল কুঁড়োরাম আর বাঁশরী।
অনখা জায়গায় এসে হকচকিয়ে গেছে বুড়ি। চুপ মেরে গেছে কুসুম। ক্ষেত্তরের মন ভক্তিরসে ভরোভরো। সন্ধ্যারতির কাঁসর-ঘণ্টা শোনা যাচ্ছে হত, তত ক্ষেত্তর দুলে দুলে হরিনাম করে চলেছে গুনগুন করে। উৎসাহ শুধু বাতাসীর। ভরা খুশিতে ছলকে পড়ছে। সব নতুন। সব ভাল। চড়াটা, বুড়ো খাঁকড়া বটগাছটা। পাটনিদের সুর করে চিৎকার। সব ভাল লাগে বাতাসীর। পাটনিরা কেমন সুর করে চেঁচায়।
“সোরকারবাবু, সাতান্নো নোম্বোর। নয়টা লোক সাতটা মোওট। মোটটা কেমন টেনে টেনে বলে ওরা। বাতাসীর হাসি আসে।
এ-যে মস্ত শহর। অজগরের মতো অজস্র রাস্তা। সাপের জিবের মতো অসংখ্য গলি। কোন মুখে যাবে? কাকে জিজ্ঞেস করবে? কুঁড়োরাম অস্বস্তি বোধ করে। দিশে পায় না বাঁশরী। ওরা মোড় গুনে, চিহ্ন রেখে এগুতে থাকে। যত এগিয়ে যায় ওরা ততই শহর বাড়তে থাকে। রাত্তির হয়। লোহার খুঁটোর উপর ঠুঙ্গি-পরা বিজলি বাতি ঝিলিক মেরে জ্বলে ওঠে। এবার দুজনে ফেরে। সম্ভব নয় এই ভিড়ের মধ্যে অশ্বিনী তাওইকে খুঁজে বের করা। মানুষের অরণ্যে পথাহারা হবার আশঙ্কা তাদের বিচলিত করে। অশ্বিনী তাওইয়ের কাছ থেকে ভাল করে ঠিকানাটা নেওয়া উচিত ছিল। এঃ, বদড গু’খুরি হয়ে গেছে।
সে রাতটা কোনও রকমে কাটল। ভোরবেলাতেই কুঁড়োরাম বাড়ির খোঁজে বের হল। অশ্বিনী তাওইয়ের আশা ছাড়তে হল। খোঁজাখুঁজি করে ধরল এক দালালকে। দালালের চোখে-মুখে কথা। করিৎকর্মা লোক বটে।
“বাড়ি? কটা বাড়ি চাই বলুন। পাঁচ মিনিটে বাড়ি করে দেব, চলুন। এসেছেন বিদেশ থেকে কত কষ্ট করে, আর আমরা এটুকু করব না?”
কী মিষ্টি কথা! এখানে এত মহৎ লোক থাকে? হবে না, এত বড় একটা তীর্থস্থান। ঠাঁই নিতে হয় তো বৃহৎ স্থানে নাও। এ বাড়ি সে বাড়ি করে অনেক বাড়ি অনেক বাড়িই দেখাল দালাল্টি। সবই কোটা বাড়ি। একটা পছন্দসই বাড়ি মিলল। ভাড়া কত? তিরিশ টাকা। পাগল! অত টাকা কোথায়? আত-দশ টাকার মধ্যে হয় না? আশ দশ টাকার বাড়ি মেলে না এখানে। আবার দর-কষাকষি, হাত কচলা-কচলি। শেষটায় বারো টাকায় রফা হল। তিন মাসের ভাড়া অগ্রিম। পঞ্চাশ টাকা সেলামি। আর দালালি পাঁচ টাকা। এক থোকে একানব্বই টাকা দালালের হাতে গুনে দিল কুঁড়োরাম। ভাঙাতে হল শেষ সম্বল একশো টাকার নোটটা। থাকল মাত্তর নয় টাকা। যাক মাথা গোঁজবার ঠাঁই তো জুটল। পরে বিচার করা যাবে। ভাবা যাবে বারান্তরে।
“বিকেলে এসে বাড়ি খুলে দিয়ে যাবোখন। চাবিও তখন দিয়ে যাব। যাবেন না যেন কোথাও বেরিয়ে।“
“না না, যাব আর কোথায়? আপনি আসবেন শিগগির করে। আজই ও-বাড়িতে ওঠা চাই।“
“বিলক্ষণ। সে আর বলতে। গাছতলায় কি থাকা যায়! আমি ঘরগুলো ধুয়ে রাখবখন।“ দালাল চটপট চলে যায়।
“মহাশয় ব্যক্তি,” ক্ষেত্তর বলে। “শ্রীধামে আশ্রয় যে পেলাম এ ত বাপ মিতামর পুণ্যে।“
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। গঙ্গার জলে সূর্যের আলো মিলিয়ে যায়। সন্ধ্যা গাঢ় হয়। রাত্রি গভীর হয়। ভোরের সূর্য গঙ্গার জলে আলো ফেলে। কিন্তু দালালটি আর ফিরল না। সমস্ত রাত কটি প্রাণী গাছতলায় বসে কাটায়। ছোটরা গুটিশুটি মেরে ঘুমোয়। রাতের ঠাণ্ডায় কেঁপেকেঁপে ওঠে। কেশে ওঠে। বড়দের চোখে ঘুম নেই, জল নেই, আগুন নেই। পাথর হয়ে গেছে। বিশ্বাস হয় না এতবড় প্রবঞ্চনা। অনেকক্ষণ পরে ক্ষেত্তরের মুখ দিয়ে একটা আর্তনাদ বের হয়, “ভগবান!”
আশ্রয় একটা পাওয়া গেল। যোগাড় করে দিলে ওখানকারই একজন লোক। নাম তার সুন্দর গোঁসাই। আধাবয়েসী এই লোকটা বাস্তুহারা-ত্রাণ-সমিতির সম্পাদক। গায়ে পড়েই আলাপ করল। নিজের উদ্যোগে ঘরখানা ভাড়া করে দিল। ঘর দেখে ওদের তো চক্ষুস্থির। দেশের বাড়িতে ভাঙাচোরা হলেও চার পোঁতায় চারখানা ঘর ছিল। এখন এই একখানা ঘুপসি অন্ধকার কুঠরিতে সবাই মিলে থাকবে কী করে?
সুন্দর গোঁসাই এক গাল হেসে বলে, “তাও তো পেলেন মশাই। আপনাদের আশীর্বাদে সবাই একটু মান্যগণ্য করে, সহায় সম্পত্তি কিছু আছে এই নগরে। তাই কোনওরকমে এটুকুন যোগাড় করতে পেরেছি।“
কথাটা সত্য। কুঁড়োরাম জানে। একদিনেই ওর চরম আক্কেল হয়ে গেছে। বারান্দায় রাঁধবার জায়গা। ওইখানেই খেয়ে নিতে হয়। তারপদর ঘরে গিয়ে সব ঢোকে। পুরুষরা এক দিকে, মাঝখানে নাতিনাতনির দঙ্গল নিয়ে বুড়ি, ওপাশে বৌরা। বাতাসীর চিরকেলে অভ্যাস আগোছাল আলুথালু শোয়া। একদিন ঘুম ভাঙতেই কুঁড়োরামের নজরে পড়ল ঘুমন্ত বাতাসীর আগোছাল কাপড়-খসা দেহটা। চোখ বুজে টলতে টলতে বেরিয়ে এল কুঁড়োরাম বাইরে। মরমে মরে গেল। ইচ্ছে হল চোখ দুটোকে অন্ধ করে দেয়। ছি ছি ছি! ভাদ্দর-বউয়ের আব্রু রক্ষা করবার সামর্থ্য নেই তার। সেদিন না-খেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করল। ঠাকুরবাড়ি জল বাতাসা দিল। গঙ্গাস্নান করল। সেইদিন থেকে কুঁড়োরাম বাইরে শুতে লাগল।
কুসুম বিপদে পড়ে গেছে খুব। বুড়ির বুকে পিঠে ব্যথা। গলা দিয়ে রাতদিন ঘড় ঘড় শব্দ বের হয়। মাঝে মাঝে কোনও রকমে ডাক দেয়, “বউমা।“ কুসুম উঠে আসে। বুড়ি কিছু বলতে পারে না। চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়ে। পিঁচুটিতে আটকে থাকে চোখ। ছোট ছেলেটার হাম হয়েছে। রাতদিন চিৎকার করছে। বাতাসী সামাল দিয়ে উঠতে পারে না। পুঁটের পেট নেমেছে ক’দিন থেকে, সারাবার লক্ষণ নেই।
তবুও সুন্দর গোঁসাই ছিল তাই চলছে। কুঁড়োরামকে ভরসা দেয়। বারান্দায় বসে পরামর্শ হয়। বাজারে একটা ছোট দোকান করবে কুঁড়োরাম। এই মনের সাধ। টাকা কিছু যোগাড় করে দেবে গোঁসাই। কথার ফাঁকে ফাঁকে দরজার ফাঁক দিয়ে নজর পড়ে গোঁসাইয়ের, বাতাসী উবু হয়ে উননে ফুঁ দিচ্ছে। আধখানা স্তনাভাস গোঁসাইয়ের চোখে ছাপ ফেলে।
ক্ষেত্তরের সঙ্গে সুন্দরের খুব জমেছে।
“জ্ঞানপথে কতদূর যাওয়া যায়? কতদূর যেতে পারে? জ্ঞানীপথে অহংকে তুষ্ট করা ছাড়া আর কিছু লভ্য নয়। ভক্তির পথই শ্রেষ্ঠ পথ। সবকিছু তাঁর কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে বগল বাজিয়ে পথ চলা যায়। হরি হে দয়াময়!”
দরজার ফাঁক দিয়ে নজর চালায়। বাতাসী উঠে গেছে। রসের কথা আর তেমন জমে না। তবু সুন্দর গোঁসাই যা করবার করছে। দোকান-ঘর খুঁজছে। ওদের বিনা ভেটে গৌরদর্শন করিয়েছে। নবদ্বীপে এ প্রতিপত্তি বড় কম নয়। যমরাজ ভুল করে হয়তো রেহাই দিতে পারে। কিন্তু নবদ্বীপচন্দ্রের পাহারাদাররা পাঁচ আনার এক পয়সা বাজিয়ে না নিয়ে কাউকে মন্দিরে ঢুকতে দেবে না। এ জীবন ক্ষণস্থায়ী, ততোধিক ক্ষণস্থায়ী এক-ঈকটা গোঁসাইয়ের পালা। তার মধ্যে বিনা ভেটে মাছিকেও ঢুকতে দেওয়া নয়। সোয়া পাঁচ আনা ভেট দাও প্রভু দর্শন কর। ফোকটে পুণ্য অর্জনও জুয়াচুরি। তবে সুন্দর গোঁসাইয়ের কথা আলাদা। সে নিজের আত্মীয় বলে ওদেরকে দেখিয়ে আনল সব। ক্ষেত্তরের রোমাঞ্চ হয়। নাটমন্দিরে দাঁড়িয়ে থর থর করে কাঁপতে থাকে। চোখ বুজে ধ্যান করে। কে ভাবতে পেরেছিল? কে জানতে পেরেছিল ওর এ সৌভাগ্য হবে?
জমা পুঁজি নিঃশেষ হয়ে যায়। যা দু-একখানা সোনাদানা ছিল তাও অদৃশ্য। অত বড় বাসনের বস্তাটা একেবারে চুপসে গেছে।
“এবার টেরেনে চড়া যাবে অনেক সহজে। কত বোঝা হালকা হয়ে গেছে দেখিছিস?”
কুঁড়োরাম রসিকতা করতে যায়। ঠিক জমাতে পারে না। জমে ওঠে না। সুন্দর গোঁসাই বলেছে, রাস-পূর্ণিমা না গেলে আর কোনও বিধি-ব্যবস্থা হবে না।
রাস-পূর্ণিমার ভাসানের দিন সে কী ভীড়। সমস্ত রাস্তা মানুষ ঠাসা। ওদের বেরোবার ইচ্ছা ছিল না। সুন্দর গোঁসাইয়ের পীড়াপীড়িতে আর ‘না’ বলতে পারেনি। এমন উৎসব দেখবার জন্য দেশবিদেশ থেকে লোক আসে! আর নবদ্বীপে থেকেও এ উৎসব দেখবে না, তা কি হয়! বুড়ি নাতি-নাতনি নিয়ে বাড়িতে আছে। শরীরটা ভাল হলেও দুর্বলতা আছে। বাপরে, কী ভিড়! বাতাসীর শরীর যেন গুঁড়িয়ে যাবে। এত ভিড়ে না এলেই ভাল হত। এক-একটা ঠাকুর আসছে। ডগর কাড়ায় ঘা পরছে কড়ড় কড়ড়। সানাই বাজছে। ঢোল কাঁসি। মদ খেয়ে চুর হয়ে ছেলে বুড়ো কোমর বাঁকিয়ে নাচছে। আর খিস্তি গান। নাচ দেখে বাতাসীর খিল খিল করে কী হাসি!
কুসুমও হেসে ফেলে। মরণ! গান শুনে কানে আঙুল দেয়। ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায়। কী বড় বড়, কত রকম ঠাকুর। গোনাগুনতি নেই। হঠাৎ গোলমাল বাধে। মারামারি। ঠেলাঠেলি। কুনুইয়ের চাপে বাতাসী ছিটকে পড়ে। দল-ছাড়া হয়ে যায়। চিৎকার করে ওঠে, “দিদি গো।” পেছন থেকে কে যেন হাত চেপে ধরে। কানের কাছে মুখ নামিয়ে কানের সঙ্গে ঠোঁট লাগিয়ে বলে ওঠে, “ভয় নেই।”
বাতাসী ফিরে চায়। সুন্দর গোঁসাই। মুখে মৃদু মৃদু হাসি। হাত ধরে টান মেরে বলে, ” চল, বাড়ি পৌঁছে দিই।”
বাতাসী আর ফিরল না। দুদিন ধরে খোঁজাখুঁজি। তো্লপাড় করে তুলল শহর, কিন্তু নেই। বাতাসীর পাত্তা নেই। সুন্দর গোঁসাইয়েরও আর দেখা নেই। ওদের আশেপাশে আতঙ্ক ভয়। নিরুপায় ক্রোধ। আর উপরে নিরালম্ব আকাশ। কেউ ভাবে না। কেউ কাঁদে না।
না, কুসুম কাঁদল সেদিন। আছাড় খেয়ে পড়ে কুসুম। বুকফাটা কান্নায় পথের মানুষ জড়ো হয়।
“ওগো, আমার কী হবে গো! ওরে আমায় ফেলে কনে গেল গো! ও বাবা।”
কুঁড়োরাম নিস্পন্দ হয়ে পরে আছে। ঠাণ্ডা পায়ের উপর খুঁড়ে খুঁড়ে কুসুম কাঁদছে। ছেলেমেয়েগুলো তারস্বরে চেঁচায়। ক্ষেত্তর গুম মেরে বসে থাকে। বুড়ি ঠিক বুঝে উঠতে পারে না ব্যাপারটা। ছোট নাতিটিকে দুলিয়ে দুলিয়ে বলে, “ঘুমো দাদা, ঘুমো।”
বাঁশরী লোকজন আনে, বাঁশ দড়ি আনে।
“যা শালা কলেরার মড়া। এই যে দাদা ছাড়ো দিখিনি গোটা তিনেক টাকা। একটু মাল আনিয়ে নিই।”
বাঁশরী বিনা বাক্যে টাকা বের করে দেয়। মিউনিসিপ্যালিটির ডাক্তার আসে। সকলের হাতে কলেরার টিকে দেওয়া হয়। গাদি গাদি বিছানা পোড়ানো হয়। ঘর দুয়ারে ছিটানো হয় ওষুধ। সাদা সাদা পাউডার।
রাতের অন্ধকার আবার ফিকে হয়ে আসে। আবছা আলোয় ওদের ঘর থেকে বেরোতে দেখা যায়। আজ আর দৌড় ঝাঁপ নেই। হৈ চৈ নেই। বাঁশরী বুড়ির হাত ধরে এক হাতে! অন্য হাতে একটা মোট। ক্ষেত্তর কাঁপতে কাঁপতে হাঁটে। কুসুম ছেলেটাকে কাঁখে করে। পুঁটে, বুঁচি, টেপির হাত ধরে চলতে থাকে। মনে হয় দুখানা অদৃশ্য হাত পেছন পেছন আসছে। বসাবে বুঝি এক খাবল। কুসুম প্রাণপণে সামনে চেয়ে থাকে।
খেয়া ঘাটের নৌকা দুলে ওঠে। দাঁড়ের শব্দ নিস্তব্ধ গঙ্গায়। ছপ ছপ ছপাৎ মাঝি একবার সবাইকে গুনে নেয়।
তারপর স্তব্ধতা বিদীর্ণ করে হেঁকে ওঠে, “সোরকারবাবু, আট লম্বর। ছয় জন লোক আর একটা মোওট আছে। সাতজন লো-ও-ক।”
এমনি ডাক সেদিনও শুনেছিল কুসুম। যেদিন ওপার থেকে এপারে আসে। মাঝির সুর করা ডাকটা বাতাসীর মুখস্ত ছিল। প্রায়ই বলত, “ও, দিদি, শোন শোন। সোরকারবাবু নোয় জন লোক। আর সাতটা মো-ও-ট। সাতাননো নম্বর।
মাঝির হাঁকে চমকে ওঠে কুসুম।
“সোরকারবাবু সাত জন লোক। আট লম্বর নৌকা। সাতজন লোক আর একঠো মো-ও-ট।”
বাংলাদেশের যশোর জেলায় হাট গোপালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ২২ জুন, ১৯২৩ সনে, ১৫ ডিসেম্বর, ২০০০ সালে মারা যান। একজন প্রথিতযশা বাঙালি সাংবাদিক ও সাহিত্যিক। তিনি রূপদর্শী ছদ্মনামে গল্প ও উপন্যাস রচনা করেছেন।
সাংবাদিকতার জন্যে তিনি ১৯৭৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ‘কো জয় উক’ স্মৃতি পুরস্কার এবং ১৯৮১ সালে ম্যাগসাসে পুরস্কারে সম্মানিত হন। একই বছর মহারাষ্ট্র সরকারের পুরস্কার, ১৯৯৩ সালে হরদয়াল হারমোনি পুরস্কার, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ পুরস্কার পান। তিনি ১৯৭০ খৃষ্টাব্দে আনন্দ পুরস্কার ও ১৯৮২ তে বঙ্কিম পুরস্কার পান। কলকাতা মেট্রো রেলের নতুন প্রস্তাবিত চিংড়িহাটা স্টেশনটি গৌরকিশোর ঘোষের স্মৃতিতে রাখা হয়েছে।