আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিটআজ ৮ এপ্রিল। কবি, শিক্ষক ও গবেষক ড.শোয়াইব জিবরানের জন্মদিন। ৪৮ বসন্ত পেরিয়ে আজ ৪৯ এ পা …ইরাবতীর পাঠকদের জন্য রইল কবি‘র কবিতা। ‘কাঠ চেরাইয়ের শব্দ’র কবি শোয়াইব জিবরানের প্রতি রইল ইরাবতী পরিবারের পক্ষ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
পাখিরাত
মধ্যরাতে চুপিচুপি তার চুলে সুর তুলে দেখি
উড়ে এসেছে হাজার পাখি
খাঁচায় ধরা দেওয়া পাখি আর ঘাসেদের সেই ঘনরাত।
এমনি তাকে লোহার সিন্দুকে ভরে দিয়েছিলেন অবিশ্বাসী পিতা
দুটো শস্যদানা নারকেলের খোলে
দেহের উত্তাপে ক্ষুণ্ন মিটিয়েছি।
শিয়রে মোমবাতি জ্বলে
আমরা জ্বলি দেহের আগুনে
আগুন আগুন খেলা অর্ধরাত।
তারপর মধ্যরাতে দিঘির মতো সে চুপচাপ।
আমি সংগোপনে যেন পাখি প্রিয়
বাঁশিপ্রিয় মাঠের রাখাল
হাওয়া এনেছে বয়ে কী যে হাহাকার
মায়ের স্মৃতি মনে রেখে
তার চুলে যেই চক্ষু করেছি গোপন
অমনি খুব মৃদু পায়ে সুর এল
চুলের ভেতর কণ্ঠে তুলে নিলো গান
উড়ে এল হাজার পাখি, আহা উড়ে যাওয়া পাখি।
কবি ঘটনা
মাঝরাতে ডেকে তিনি তাকে দু’মুঠো রৌদ্র দিলেন, দু’হাতে। তাই ছড়ালো মন্ত্রের মতো অন্ধকারে মুঠো মুঠো রোদ, নামল শাহবাগী ভোর।
পালক হতে পায়রা উড়ালেন শা’পরান পুবের দেশে
ভোর হতেই খোলাকল হতে গড়িয়ে পড়ল জল। মদগ্রস্ত চক্ষু ধুলেন গৌণকবি। তাতেই আমাদের ভীষণ কবিতা হলো।
সেই দুই হাত উড়াচ্ছে দ্যাখ রৌদ্রধুলো। কে তাকে ডেকে দিয়েছিল এমন আলো, চারিদিকে না আলো, না অন্ধকার, এমন সান্ধ্যপুঁথি আহা গৌণকবি!
শ্লোকবলার ছোটবোন
বাঁশ বাগান ও একটি চাঁদ ছিল মেয়েটির
সে প্রতিরাতে চাঁদ উঠাত বাঁশ বাগানের মাথায়
চোখে কাজল পরে কাঁদত,
‘কাজলা দিদি কই, কাজলা দিদি কই’
আজ সে প্রেমিকা, আজ রজস্বলা।
এখন রাতে উঠান জোড়া শাদা পাটের বৃষ্টি হলে
ডাকে ডাহুকী, ফেটে যায় তার ছাতি
ও শ্লোকবলার ছোটবোন, আজ রাতে এইবেলা
বাঁশ বাগানের মাথায় চাঁদ, কার বিরহ আনো?
বালকের প্রতি
ও হে মুদ্রিত বালক, চাকা ঘুরাতে ঘুরাতে ফিরছি
তোমার দিকে, তুমি শুয়ে আছ মদনকুমার ঘাটে
একা একা। পাশে তির তির জল
কত দূরে যাও গো নদী, কত দূরে যাও
আমাদের যৌথদিন আর দূরে
জেগে ওঠা মেঘমালা
খড়ের ঘরে(বনেদি কৃষকের পুত্র মোরা)বীর্যগন্ধভাপ
আহা যুগল ঊরু! ঐ যে বেদনা ভেসে আসে সাফোর কণ্ঠ হতে
কষ্ট আমার তোমার পাশে বসে আছে ভিন যুবক!
বৈজয়ন্তীদের গল্প
কাকসন্ধ্যা উড়তে উড়তে নামলো বৈজয়ন্তীদের বাড়ি। বৈজয়ন্তীরা পাঁচবোন। রজস্বলা। মাস শেষে বাসার গলি গলিয়ে পড়ে কাদাজল!
মা তাদের গেছেন আজ দূর কূলবনে
বড়োবোন চক্ষুবতী। চোখ তার দু’টুকরো আকাশ। জমানো মেঘ, বৃষ্টি, দুপুর রৌদ্র, হলুদ হরীতকী।
মেজোবোন কর্ণহার। অজন্তা ইলোরার অলংকার। কোকিল আর ঘুঘুর গান দু’টোই বুঝেন নীরব হলে বসতি।
সেজোবোন নাকচাবি। উট আর বেজির গ্রীবা। ভূমিকম্প, বন্যা, বালাই টের পান দশহাত দূর হতে। ঘামের ঘ্রাণ।
ন’সেজো বৈজয়ন্তী। হাত তার চাল ধোয়া। চুড়ি পরে পুরুষের পরাণ কাঁপিয়ে। আর ছোট মুখরা। সেই জানিয়েছে তারা আজ আত্মকামিতায় মেতেছে। মা গেছেন দূরবনে।
পঞ্চজন আমার প্রেমিকা, আত্মা গেছেন দূর বনে।
ছায়া এলিজি
রাত্রি ছিলে। রাস্তায় একা পেয়ে শুনিয়েছ গান, মানে বুঝি নি। আজ অন্ধকারে ভয়ে ভয়ে তুলে ধরেছি মাথা, ঐ যে আকাশ নুলোভাই আর তারা সাতজন, বোনের লাশ নিয়ে শ্মশানেতে যায় নিত্যরাতে, কী বেদনা তাদের সাথে খেলা করে, জানি।
ভাষা তার অর্ধ বুঝি। যিনি জেগে আছেন মাঠের ওপারে, বটগাছ নদী আর বাতাস নিয়ে। আত্মা মাঝে মাঝে পাঠাই তার খোঁজে, কী কঙ্কাল বেঁচেবত্তে থাকা, অর্ধ স্বপ্ন আর অর্ধ জাগরতা নিয়ে। দিবানিশি।
সে ডাকে। দিঘির জলে ডুবে গেলে চাঁদের দেহ। আমি কি আর ফিরে যেতে পারি? ফিরে কি কেহ? যে ফেলে এসেছে ছায়া পথের ধুলোয়।
ছায়া ফেলে হাঁটি। তিনি স্নেহ আর শৈশব। তার সাথে জানাশোনা ছিল সেকালে, আজ শুধু মাছির মতো মুখ মনে পড়ে। রাত্রি ছিলে।
শিকারি
মাথায় পালক নিয়ে এই অসময়ে বেরুনো কি ঠিক হবে?
চারিদিকে আগুন নদী, পথঘাট অগ্নিবাতাস।
যারা গিয়েছিল অন্ধ পাখি হাতে কোড়া শিকারে
ফিরে নি। রক্তের ঘ্রাণ বাতাসে
চাপ চাপ ছড়িয়ে আছে।
পিতা প্রপিতামহ খেয়েছে বনের বাঘ
আমি সামান্য ভগ্নস্বাস্থ্য বালক, দু’হাতে কী আর আগলাবো
রক্তমাখা দাঁত, নখর, বাঘডাক।
নাকেমুখে বনের কাঁটা, পাতা লেগে আছে
কাঠুরিয়া শক্ত কুড়ালে কেটেছে বৃক্ষকোমর
অরণ্য হাত পা ছড়িয়ে বনের গায়ে পড়েছে
আমার শুধুই অরণ্যবাস, না কাঠুরিয়া, না শিকারি।
নারী এবং হরিণমাংস খেয়েছে যারা, জিহ্বা পাতালব্যাপী
নারীর গর্ভে জন্ম মাগো, পিতা ছিলেন হরিণ শিকারি
ব্যাধের সংসারে জন্ম বধূ বংশসুতোবনে
আমার হাতেই দিয়েছে তুলে তিরধনু পাখির পালক
এই অসময়ে করাল বনে কার কাছে আত্মা রাখি?
ধুলোর গাথা
চাকার উপর ক্লান্ত শুয়ে ছিল পথ
চাকা ঘোরাতে ঘোরাতে পথ ফিরছিল বাড়ি।
পথের উপর ছিলাম সামান্য পথিক
ছুটে আসা অশ্বখুর, ধুলো, শত্রুর হল্লা
শব্দ গুনতে গুনতে বিপন্ন অস্থির।
যারা ছিল ঘরে ঘরে পিতা পুত্র মাতা
তারা তুলেছে হাহাকার, ছুটেছে চৌদিকে
রাজা ছিলেন সুরাঘুমে তিনি গেছেন বনে
আর আমি সামান্য শব্দশিকারি
শত্রুর ধুলো গুণে সন্তান করেছি প্রসব
তারা আজ ধুলোর উত্তরাধিকারী।
ঘর
একটুখানি ঘরের জন্যই তো
আমাকে এত বাহিরে ঘুরে মরতে হয়
ঝড়, বৃষ্টি, আগুন ঝঞ্ঝায়, একেলা সন্ধ্যায়।
দিগন্তবিস্তারী আকাশও আমাকে এতটা
খোলা স্থান দিতে পারে না, যা পারে ছাদের নিচের এতটুকু
আমি দশফুটের ছায়ার জন্য ঘুরিয়া বেড়াই দশ দিগন্ত।
বৃক্ষকে সকলে প্রশংসা করে ছায়ার জন্যই তো?
অথচ কতই তুচ্ছ সে তোমার আঁচলের কাছে
আমি তোমার একটুখানি আঁচলের ছায়ার জন্য
কত না দ্রুত ঘরে ফিরি ফেনা, রক্তমাখা পায়।
শান্তা।
হরণ
আমাকে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছো তোমার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। যত যাচ্ছো তোমার দিকে
আমার গন্তব্য তত দূরে সরে যাচ্ছে।
গলায় বসে যাচ্ছে তোমার থাবার নখর
আর আকাশের লালিমায় ছড়িয়ে পড়ছে আমার গোঙানি, কেউ শুনছে না।
যে যার উড়ায় ব্যস্ত।
আকাশে ছড়িয়ে পড়া রক্তরং দেখে
কেউ একজন হাহাকার করবে
শুধু এই আশায় আমি আমার মৃত্যুকে সয়ে চলেছি।
যাত্রা, মহিষ পিঠে
মহিষ পিঠে চলেছি বহুকাল জল-জলাজঙ্গলা পেরিয়ে।
আমি কি রাখাল তবে ছিলাম বাথানের,
নাকি দূর কোনো গাঁয়ে
বদ হাওয়া লেগে অসাড় দেহ। লোকে দিয়েছে তুলে
সাপে কাঁটা চাঁদ সওদাগর, মহিষডিঙায়।
মনে নেই কিছু। শুধু একটু একটু লোকালয় স্মৃতি,
অস্পষ্ট মানুষের মুখ
হয়তো মায়ের, হয়তো প্রেমিকার।
চলেছি এই রাতে যেন জলাধারের ওপারে আছে স্বাস্থ্যসদন
আছে সবুজ গ্রাম, বৃক্ষশোভা, নগর কিনারে
কোনো ওঁ নিরাময়া।
কী অসুখ জানা নেই কারও—আমার কিংবা মহিষের,
চলেছি বহুকাল যেন দূরত্বই আরোগ্য অথবা
পথের ধারেই আছে
পথ্য সব বনৌষধি।
জলাজঙ্গলার পথে মহিষের খুরের জল
আর কাদা ভাঙার শব্দ আর
আমার গোঙানি
অখনে এইখানে দূর হতে মৃদু মৃদু শোনা যায়।
পথে পথে জমে আছে আবর্জনা, পাতা ঝরার।
ধুলো মনে।
অথচ এখানে খুব সবুজ ছিল, কচি পাতার।
ফুলও ফুটেছিল
সেই সকল বসন্তদিনে।
আকাশে যে তুলো তুলো শাদা শাদা মেঘ শরতের
সে-ও ছিল, আমাদের মনে।
পাখিও ডাকত কায়াতরুর পঞ্চবি ডালে ডালে
আর যা যা করতে পারি স্মরণ মধুমাসের, আনন্দ দিনের
সকলই ছিল।
সেই সব ঋতুমাসের, তোমাকে নিয়ে থাকা দিনে।
আজ খুব বৃষ্টি আজ খুব বর্ষা
পাতাঝরা, ধুলোদিনে।
এই নোনাজলের বর্ষায় তুমি ভিজে চলেছ
ভিজে চলেছে তোমার কবর, জয়দেবপুরে।
Related