রামায়নে এক বর্ণনায় রয়েছে স্বর্গে যাবার সোপানশ্রেণী নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন লঙ্কাধীপতি রাবন। স্বর্গে যাবার সিঁড়ির নির্মাণপর্বও শুরু করেছিলেন তিনি, কিন্তু শেষপর্যন্ত অযোধ্যা অধিপতি রামচন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিহত হবার ফলে ব্যর্থ হয় লঙ্কেশের যাবতীয় প্রয়াস। অর্ধ নির্মিত অবস্থায় থেকে যায় স্বর্গের সিঁড়ি। রামায়নের এই পর্ব অনেকের মনেই প্রশ্নের সঞ্চার করে রাবনের স্বর্গের সিঁড়ি নির্মাণ পর্ব কি নিছকই কল্পনা নাকি সত্যি আর সত্যি হলে কোথায় রয়েছে এই স্বর্গের সিঁড়ি ?
বাস্তবে সত্যিই রয়েছে রাবন দ্বারা নির্মিত স্বর্গে যাবার অর্ধ নির্মিত সোপানশ্রেণী। শ্রীলঙ্কার শিগিরিয়া নামক এক স্থানে। শ্রীলঙ্কার সেন্ট্রাল প্রভিন্সের ডাম্বুলা নগরের নিকটে মাটালা জেলায় রয়েছে ঘন অরন্যে আবৃত শিগিরিয়া নামক এক পার্বত্য অঞ্চল। সেই অঞ্চলেই রয়েছে রাবনের বহু চর্চিত স্বর্গের সিঁড়ি। বর্তমানকালে শিগিরিয়া অঞ্চলের এই আশ্চর্যজনক স্বর্গের সিঁড়ি লায়নস রক বা সিংহের প্রস্তর নামে পরিচিত। শুধুমাত্র একটি অতিকায় সুউচ্চ প্রস্তরখণ্ড বেয়ে গিরিবর্ত্ম বেয়ে মহাকাশের দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে এগিয়ে গিয়েছে একের পর এক সোপানশ্রেণী আর প্রস্তরখণ্ডের একেবারে উপরে অবস্থান করছে এক বহু শতাব্দী প্রাচীন রাজপ্রাসাদের ভগ্নস্থুপ। সোপানশ্রেণীর শুরুর দিকে দুপাশের শোভা বর্ধন করছে সিংহের পাঞ্জার সাথে সাদৃশ্য যুক্ত দুটি বিশাল প্রস্তর খণ্ড। রাবন কথার পুস্কলা পথ মহাকাব্য অনুসারে লঙ্কাধীপতি রাবনের নির্দেশে তাঁর রাজ্যের প্রধান স্থপতি মায়া দানব এই স্বর্গের সিঁড়ি নির্মাণ করতে শুরু করেন। এই ময় দানবই নির্মাণ করেছিলেন লায়নস রকের উপরে অবস্থিত সুপ্রাচীন রাজপ্রাসাদের ভগ্নাবশেষটি। রাবনের শাসনকালে শিগিরিয়া অঞ্চলের নাম ছিল অলকামাণ্ডব।
স্থানীয় লোকগাথা অনুসারে সেই সময়ে এই অলকামাণ্ডবই রাবনের রাজধানি ছিল আর এখানেই অবস্থিত ছিল রাবনের রাজপ্রাসাদ। কিন্তু নির্মাণকার্য সম্পূর্ণ হবার পূর্বেই রামচন্দ্র তাঁর অনুজ ভ্রাতা লক্ষণ আর বানর সেনাদের নিয়ে লঙ্কা আক্রমন করেন। সেই মহাযুদ্ধে নিহত হন রাবন। রাবনের মৃত্যুর পর তাঁর নশ্বর দেহ কোন গুপ্তস্থানে লুকিয়ে ফেলেন তাঁর বিশ্বাসঘাতক ভ্রাতা বিভীষণ (লৌকিক কথা অনুযায়ী নাগ বংশোদ্ভূত রা রাবণ এর মৃতদেহ মমি করে কোনো গুহায় লুকিয়ে রেখেছিলো)। এরপর নিজে লঙ্কার রাজসিংহাসনে আসীন হয়ে বিভীষণ তাঁর রাজধানি শিগিরিয়া বা অলকামাণ্ডব থেকে স্থানান্তরিত করে কেলানিয়াতে নিয়ে আসেন। পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে বিস্মৃতির অতলে চলে যায় অলকামাণ্ডবের অর্ধ নির্মিত স্বর্গের সিঁড়ি। আজও শিগিরিয়া অঞ্চলে ভ্রমন করতে গেলে দেখা যায় লায়ন্স রকের স্বর্গের সিঁড়ি আর তার উপরে অবস্থিত প্রাচীন রাজপ্রাসাদের ভগ্নাবশেষ।
ভূমি থেকে অন্তত ৬০০ ফুট উচ্চে অবস্থিত শিগিরিয়ার লায়ন্স রকের রাজপ্রাসাদের ভগ্নস্থুপটি। ইতিহাস বলছে ১৮৩১ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর জোনাথন ফরবস নামের এক সেনাধক্ষ্যর দ্বারা আবিষ্কৃত হয়েছিল শিগিরিয়ার এই রহস্যময় স্বর্গের সিঁড়ি। ব্রিটিশ সেনাধক্ষ্য জোনাথন ফরবসের দিনপঞ্জিকা অনুসারে, “সভ্য সমাজ থেকে বহুদূরে শিগিরিয়ার ঘন অরন্যে আবৃত পর্বত প্রান্তরে সিংহের পাঞ্জার সাথে সাদৃশ্য যুক্ত শুধু একটিমাত্র সুবিশাল আর সুউচ্চ প্রাকৃতিক প্রস্তর খণ্ডের দুর্গম গিরিপ্রান্ত বেয়ে ধাপে ধাপে উপরে আরও বহু উপরে যেন মহাকাশের দিকে ক্রমান্বয়ে উঠে গিয়েছে একাধিক সোপানশ্রেণী। বহু কষ্ট সহ্য করে আর বহু পরিশ্রম করে অবশেষে উপস্থিত হলাম সেই সোপানশ্রেণীর একেবারে অন্তিম প্রান্তে, লায়ন্স রকের শীর্ষদেশে। সেই শীর্ষদেশে অবস্থান করছে এক বহু শতাব্দী প্রাচীন রহস্যময় রাজপ্রাসাদের ভগ্নস্থুপ।”
ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী থেকে শিগিরিয়ার এই রহস্যময় রাজপ্রাসাদলে এক বৌদ্ধ মঠে রূপান্তরিত করা হয়, কিন্তু তাঁর পূর্বে আনুমানিক ৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত শিগিরিয়ার এই রাজপ্রাসাদ কোন এক স্থানীয় শক্তিশালী হিন্দু রাজার রাজপ্রাসাদ ছিল। লায়ন্স রকের শীর্ষে রাজপ্রাসাদ চত্বরে রয়েছে এক সুরম্য উদ্যান আর কয়েকটি প্রাচীন সরোবরের ভগ্নাবশেষ। এরপর এক সুবিশাল পাহাড়ি গুহাকে রাজপ্রাসাদের রূপদান করা হয়েছে। সেই রাজপ্রাসাদের গুহা অভ্যন্তরের প্রাকারে রয়েছে বেশকিছু পুরাকালের সুন্দরী রমণীদের চিত্রকলা। কিছু কিছু স্থানীয় পুরাতত্ত্ববীদদের মতে এইসব রমণীরা প্রাচীনকালে সেই সময়কার স্থানীয় রাজার রাজসভার নর্তকী আর পরিচারিকা ছিলেন। চিত্রগুলিতে দেখা যায় এক আশ্চর্য জিনিষ প্রত্যেক রমণীদের তলদেশ এক রহস্যময় ঘন মেঘরাশি দ্বারা আবৃত।
অর্থাৎ চিত্রনুসারে তাঁরা পৃথিবীর ভূমিতে দণ্ডায়মান নন। তাঁরা মহাশূন্যে ভাসমান অপ্সরা। স্থানীয় অধিবাসীদের মতে এইসব রমণীরা আসলে ছিলেন স্বর্গ থেকে দেবতাদের দ্বারা প্রেরিত অপ্সরাগণ। তাই চিত্রগুলিতে তাঁদের মহাকাশে ভাসমান অবস্থায় দেখা যায়। তাঁদের মতে রাবনের নির্দেশে মায়া দানব শিগিরিয়ার সিঁড়ি নির্মাণ করতে শুরু করেছিলেন স্বর্গের সাথে সংযোগ স্থাপনকারী মেরু পর্বতের সহিত যুক্ত করবার অভিপ্রায়ে। বৌদ্ধ ধর্ম অনুসারে মেরু পর্বত হলো স্বর্গের সাথে সরাসরি সংযোগ স্থাপনকারী এক পবিত্র মহাজাগতিক পর্বত। ভারতবর্ষের হিন্দু আর বৌদ্ধ উভয় ধর্মেই রয়েছে মহাজাগতিক মেরু পর্বতের সংজ্ঞা। বিভিন্ন প্রাচীন ধর্মীয় পুস্তক অনুসারে মেরু পর্বতকে এক সুবিশাল আর মহাজাগতিক স্বর্ণালি আলোকছটার গোলক বা ত্রিকোণ পিণ্ড হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ধর্মীয় পুস্তকগুলির বর্ণনা অনুসারে মেরু পর্বত হলো মহাশূন্যে ভাসমান এক স্বর্ণালি আলোকছটার গোলক যা মর্ত্যভূমি থেকে দর্শন করলে সোনা দ্বারা আবৃত এক পর্বতমালা বলে ভ্রম হয়। শূন্যে ভাসমান এই সোনার পর্বতমালার মধ্যে রয়েছে দেবলোকে যাত্রার পথ। ধর্মীয় পুস্তক অনুসারে মহাকাশের মধ্যবর্তী অঞ্চলে এক ভিন্ন মাত্রায় রয়েছে এই মেরু পর্বত। পাপিতাপি সাধারন মানবজাতির পক্ষে খালি চোখে দর্শন সম্ভব নয় মেরু পর্বতের। জ্ঞানী, গুনি আর মহৎ ব্যক্তিরা কেবলমাত্র সঠিক ধ্যানের সাহায্যে নিজেদের মানসচক্ষু দ্বারা দর্শন লাভ করতে পারেন পবিত্র মেরু পর্বতের।
প্রাচীন ভিনগ্রহীদের আগমনী তত্ত্বে বিশ্বাসী পণ্ডিতদের মতে আসলে এই মেরু পর্বত হলো অন্য মাত্রায় মহাশূন্যে ভাসমান এক অত্যাধুনিক উড়নচাকি বা স্পেসশিপ। উন্নত ভিনগ্রহী দেবতারা বা ভবিষ্যৎ মানবজাতি তাঁদের উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাহায্যে কৃত্তিম ওয়ার্মহোল নির্মাণ করে সফলতার সাথে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় যাত্রা করে এই মেরু পর্বতের সাহায্যে। রাবনের নির্দেশে ময় দানব এই সুবিশাল শিগিরিয়া সোপানশ্রেণী নির্মাণ করে আসলে শূন্যে ভাসমান মেরু পর্বত নামধারী সেই রহস্যময় উড়নচাকির সাথে সংযোগস্থাপন করে অন্য নক্ষত্রলোকে অবস্থিত ভিনগ্রহীদের স্থানে যাত্রা করতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ সংক্ষেপে শিগিরিয়ার প্রাসাদকে দেবতাদের মহাকাশযানের ল্যান্ডিং বা লঞ্চ প্যাড হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন মায়া দানব। এরজন্যই একে স্বর্গের সিঁড়ি নামে অভিহিত করা হয়েছে। আর রাজপ্রাসাদের গুহা অভ্যন্তরে অঙ্কিত প্রাকার চিত্রের অপ্সরারা আসলে মহাকাশ থেকে আগত ভিনগ্রহী নারী মহাকাশচারী। প্রাচীনকালে আমাদের পূর্বপুরুষ আদি মানবরা নিজেদের চর্ম চক্ষুদ্বারা এইসব মহাজাগতিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করে তীব্র বিস্ময়ে ভিনগ্রহীদের দেবতা বলে মনে করেছিলেন এবং নিজেদের দেখা ঘটনাবলির সাথে কল্পনার মিশ্রণ ঘটিয়ে শিগিরিয়া রাজপ্রাসাদের প্রাকার গাত্রের উড়ন্ত রমণীদের চিত্র অঙ্কন করেছিলেন। শিগিরিয়ার রহস্যময় এই স্বর্গের সিঁড়ির চারপাশে আর শীর্ষদেশে রয়েছে আরও বহু অজানা বন্ধ গুহামুখ।
পুরাতত্ত্ববীদদের ধারনা এইসব রহস্যময় বন্ধ গুহামুখের অভ্যন্তরে ঘন আধাঁরের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে আরও বহু অজানা রহস্য, হয়তো এইসব রুদ্ধ গুহা অভ্যন্তরের মধ্যে হাজার হাজার বছর ধরে লুকায়িত রয়েছে লঙ্কাধিপতি রাবনের রহস্যময় পুষ্পকরথ বা তাঁর মরদেহ। হয়তো এইসব রুদ্ধ গুহামুখের ভেতরে রয়েছে ভিন্ন মাত্রা বা অতীত অথবা ভবিষ্যৎকালে সময়যাত্রার চাবিকাঠি। এইসব রুদ্ধ গুহামুখের রহস্যের সমাধান হলে উন্মোচিত হবে রামায়নের অন্তিম পর্বের বহু অজানা রহস্য।
তথ্য সুত্রঃ https://quizolympiadbd.com/%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E…/…/
Story of Sigiriya, by Professor Senerath Paranavitana.
The Mystique of Sigiriya: Whispers of the Mirror Wall, W.J.M. Lokubandara
https://whc.unesco.org/en/list/202
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Sigiriya
https://www.nationalgeographic.com/…/sri-lanka-sigiriya-fo…/
https://lanka.com/about/attractions/sigiriya-rock-fortress/