| 20 এপ্রিল 2024
Categories
নারী লোকসংস্কৃতি

বিরাধের সীতা হরণ

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

শুভাশিস মৈত্র


রাবণের আগেও এক বার সীতাহরণের ব্যর্থ চেষ্টা হয়েছিল। তবে সেই গল্পে যাওয়ার আগে একটু সলতে পাকানো দরকার। তাই সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে সীতার চরিত্র প্রসঙ্গে দু’একটা কথা বলা জরুরি। সীতার যখন রামের সঙ্গে বিয়ে হল তখন সীতার বয়স ৬ এবং রামের ১৩। আর যখন রাম বনবাসে যাচ্ছেন, তখন সীতা ১৮, রামের বয়স ২৫। অষ্টাদশবর্ষীয়া সীতা কি অযোধ্যার সিংহাসনে বসে রাজ্য শাসন করতে পারতেন? সে এক অন্য রামায়ণ হত তাহলে। সেই সুযোগ কিন্তু এসেছিল। রামের সঙ্গে বনবাসে যাওয়ার সময়, সবার থেকে বিদায় নেওয়ার মুহূর্তে সীতা যখন বনবাসের উপযুক্ত পোশাক পরার চেষ্টা করছেন(চীর-পরিধান) কিন্তু পারছেন না, রাম তখন এগিয়ে এলেন তাঁকে সাহায্য করতে। তা দেখে রাজগুরু বশিষ্ঠমুনি কৈকেয়ীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, সীতা বনে যাবেন না। তিনি রামচন্দ্রের ন্যায্য আসন অধিকার করে থাকবেন। কারণ দশরথের দেওয়া বরে সীতার কোনও উল্লেখ নেই। সীতাই রামের আত্মা, তিনিই পৃথিবী পালন করবেন অযোধ্যায় থেকে। সীতা অবশ্য সে-কথায় কান দেননি। আরও কথা। সীতা জানতেন তাঁকে বনবাসী হতেই হবে। তিনি খুব শৈশবে মায়ের পাশে বসে পণ্ডিতদের মুখে এমনই ভবিষ্যৎবাণী শুনেছিলেন। আবার এটা নিয়তিও। সীতাকে রাবণের মৃত্যুর কারণ হতে হবে। তা স্থির হয়ে আছে সত্যযুগেই। কারণ সীতার প্রতিশোধ নেওয়া বাকি আছে। বহু সহস্র বছর আগে সত্যযুগে হিমালয়ে তপস্যানিরতা ব্রহ্মর্ষি কুশধ্বজের কন্যা বেদবতীকে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁর চুল স্পর্শ করেছিলেন রাবণ। বেদবতী হিমালয়ে বিষ্ণুর জন্য ৩০ কোটি ৬৭ লক্ষ ২০ হাজার বছর ধরে তপস্যা করছিলেন।  রাবণের এই কাজে অপমানিত বেদবতী নিজের মাথার চুল কামিয়ে ফেললেন। তিনি বললেন, চুল স্পর্শ করে রাবণ তাঁকে ধর্ষণ করেছেন। তাই তিনি অগ্নিতে প্রবেশ করলেন। তার আগে রাবণকে অভিশাপ দিয়ে বললেন, তিনি ফিরে আসবেন রাবণকে বধ করতে। এই বেদবতীই জন্ম নিলেন সীতা হয়ে ত্রেতাযুগে।

যাই হোক সীতা তো চলে গেলেন বনে রাম-লক্ষ্মণের সঙ্গে। আর বন যে ভয়ের জয়গা সে কথা রাম সীতা বহু ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যাত্রার আগে। সীতা ছিলেন অত্যন্ত ব্যক্তিত্বময়ী এক মহিলা। রামের কোনও কথায় তিনি কান দেননি। এবং রাম বার বার সীতাকে অযোধ্যায় রেখে যাওয়ার কথা বললে সীতা হুমকি দিলেন, তিনি তাহলে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করবেন। সীতার ব্যক্তিত্বের আরও প্রমাণ পাওয়া যায়, যখন রাম স্থির করলেন বাল্মীকির আশ্রম থেকে লব-কুশ সহ সীতাকে তিনি ফিরিয়ে নেবেন। তখন সীতার বয়স ৪৪। রামের ৫১। সীতা কিন্তু রামের এই ‘দয়া’ গ্রহণ করলেন না। রামের সামনেই তিনি পাতালে প্রবেশ করলেন। রামের নির্দেশে সিতাকে যখন লক্ষ্মণ বাল্মীকির আশ্রমে ছেড়ে চলে গেলেন, সীতার বয়স তখন ৩২, তখনই সীতা অপমানে আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু তখন তিনি সন্তানসম্ভবা। তাই পিছিয়ে এলেন। এবং সম্ভবত অপেক্ষা করছিলেন পাতাল প্রবেশ করে একটা জবাব দেওয়ার। সে অবশ্য অন্য গল্প।

মূল গল্পে এবার ফেরা যাক। রাবণের আগেও এক বার সীতাহরণ হয়েছিল। ঘটনাটা এরকম। দণ্ডকারণ্যে বাস করে নরখাদক রাক্ষস বিরাধ। তার পরনে রক্তমাখা বাঘছাল। তার ত্রিশূলে তিনটে সিংহ, চারটে বাঘ, দুটো নেকড়ে, দশটা হরিণ আর একটা হাতির মাথা গাঁথা। তার শরীরটা পাহাড়ের মতো। বনের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছেন রাম, লক্ষ্মণ এবং সীতা। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হল রাক্ষস বিরাধ। বিরাধ প্রথমেই সীতাকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা দিল। বাল্মীকি বলছেন, এই প্রথম সীতার শরীরে পরপুরুষের ছোঁয়া লাগল। বিরাধ নিজের পরিচয় দিয়ে রামকে বলল, তার মা শতহ্রদা, বাবা যব। ব্রহ্মা তাকে বর দিয়েছেন, কেউ তাকে অস্ত্র দিয়ে মারতে পারবে না। আসলে বিরাধ ছিল এক অভিশপ্ত গন্ধর্ব। গন্ধর্বরা স্বর্গের গায়ক। অপ্সরাদের সঙ্গে ছিল তাদের অবাধ মেলামেশা। ইন্দ্রের সভায় অপ্সরাদের সঙ্গে গায়ক হিসেবে থাকত গন্ধর্বরা। বিখ্যাত কয়েক জন গন্ধর্বের নাম হল হাহা, হুহু, হংস, বিশ্ববায়ু, তম্বুরু। এই তম্বুরুই অভিশপ্ত বিরাধ। অপ্সরা রম্ভার সঙ্গে গল্পগুজব করতে করতে তম্বুরু নিজের কাজের কথা ভুলে গিয়েছিল। তাতেই কুবেরের অভিশাপে রাক্ষস জন্মের অভিশাপ পায় তম্বুরু। সঙ্গে নিদানও ছিল। রামের হাতে মৃত্যু হলে ফের গন্ধর্ব রূপ ফিরে পেয়ে বিরাধ স্বর্গে ফিরে আসবে তম্বুরু হয়ে।

সীতাকে কোলে তুলে বিয়ে করতে চাই বলে তো হাঁটা দিল বিরাধ। এবং রাম-লক্ষ্মণকে অশালীন ভাষায় গালাগাল করতে থাকল। বলল, তোরা দুই পুরুষ এক জন মহিলাকে নিয়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছিস, তোদের উদ্দেশ্য ভাল না। রাম বিলাপ করে বললেন, ‘এক্ষণে সেই মধ্যম জননী কৈকেয়ী দেবীর অভিলাষ পূর্ণ হইল। সুমিত্রানন্দন! রাজ্য হরণ, পিতার মৃত্যু ও বৈদেহী সীতাদেবীর বর অঙ্গে পরপুরুষস্পর্শ, – ইহা অপেক্ষা আমার সমধিক দুঃখ আর কিছুই নাই।’ তা শুনে প্রথমে লক্ষণ কাঁদতে শুরু করলেন। তার পর ক্রুদ্ধ হয়ে সাপের মতো দীর্ঘশ্বাস পড়তে থাকল লক্ষ্মণের। লক্ষ্মণ রামকে বললেন, ‘কেন অনাথের ন্যায় বিলাপ করিতেছেন?’ এর পর লক্ষ্মণের পরামর্শে রাম ভয়য়ঙ্কর অতি বেগবান, গরুড় এবং বায়ুর মতো দ্রুতগামী সাতটি বাণ নিক্ষেপ করলেন বিরাধকে হত্যা করতে। বিরাধের শরীর ভেদ করে ঢুকে গেল বাণগুলি। বিরাধের শরীর রক্তে ভেসে গেল। তখন শরবিদ্ধ রাক্ষস সীতাকে কোল থেকে নামিয়ে রাম লক্ষ্মণের দিকে ধেয়ে গেল। রাম আরও বাণ ছুড়তে শুরু করলেন। এই বার রাক্ষস সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে মুখব্যাদান করে হাই তুলতেই সব শর দেহ থেকে বেরিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। রাম লক্ষ্মণের আক্রমণ চলতে থাকল। বিরাধ আহত হল, কিন্তু ব্রহ্মার বরে সে তো অস্ত্র দ্বারা অবধ্য। এর পর বিরাধ এক হাত দিয়ে রাম, অন্য হাত দিয়ে লক্ষ্মণকে তুলে নিয়ে গভীর জঙ্গলের দিকে হাঁটা দিল। সীতা তখন বিরাধকে বললেন, তুমি ওদের ছেড়ে দাও, তুমি আমাকেই নিয়ে যাও। এই কথা শুনে রাম-লক্ষ্মণ খড়গ দিয়ে আঘাত করে এবং অস্ত্রের বদলে শারীরিক শক্তি দিয়ে বিরাধের দুই হাত ভেঙে দিয়ে প্রবল ভাবে তাকে মারতে শুরু করলেন। তাতে অবসন্ন হয়ে বিরাধ পড়ে গেল। রাম তার গলায় পা দিয়ে লক্ষ্মণকে বললেন, বিরাট এক গর্ত খুঁড়তে। জীবিতই কবর দেওয়া হবে বিরাধকে। বিরাধ তখন বুঝল তার মুক্তির সময় সমাগত। রামকে তার অভিশাপের কাহিনি বলে বলল, তোমার হাতে মৃত্যুতেই আমার শাপমুক্তি। এই হল রাবণের আগে, প্রথম সীতা হরণের কাহিনি।

 

 

কৃতজ্ঞতা: বঙ্গদর্শন

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত