| 29 নভেম্বর 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ভরপেট খাওয়ার গল্প

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
সমীরণ সন্ধ্যে থেকে ভাবছিলো কারা যেন বলে ঋতুপর্ণের উনিশে এপ্রিল ব্যারিম্যানের অটাম সোনাটা প্রভাবিত, এটা খতিয়ে দেখা দরকার তাই সে এক ঘন্টা ঊনত্রিশ মিনিটের সিনেমাটা দেখে বুঝলো অই লোকগুলি বোকা ও ফালতু  যারা তা ভেবেছিলো আর বোঝে এ মূলত মাতাকন্যার মধ্যবর্তী এক তীব্র, ভয়াবহ, কুৎসিত ঘৃণার দলিল।ইনটেলেকচুয়ালিটি প্রায় সময় নিজের আত্মজ আত্মজার কাছেও খুব একা করে দেয়। তীব্র বৃষ্টির এই রাত এগারোটায় সে ভাবে, লিভ উলম্যান আর ইংগ্রিড ব্যারিম্যান আসলে সিনেমার আকাশে মধুর বৈদ্যুতিক ঝিলিক যেমন কিনা আমাদের মাধবী কিংবা শাবানা আজমী অথবা পাশের বাড়ির মেয়ে জয়শ্রী কবির। সুন্দরের সাথে বিপন্নতা না থাকলে সুন্দর কি আরো সুন্দর হয়! আর বিপন্নরাই ত বুদ্ধিদীপ্ত, প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে করে। সমীরণ ভাবে, এই রকম রাতে, বজ্রপাতের রাতে, কে যেন খানিক বাদে বাদে ফটোতোলা রাতে তাকে পেলে পুরনো প্রেমিকার চিঠিগুলি দিয়ে বলতো, এসো প্লেন বানাই আর ওরা উড়ে যাক যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতির উপর দিয়ে যেভাবে খাদ্যভর্তি বিমান উড়ে যায়। এইসব ভাবতে ভাবতে তার দুচোখে ঘুম নামে। ঘুমগুলিও ইউনিক। সে দেখে, কুরোসাওয়ার হাতে হাতপাখা, পাটালি গুড়ের সন্দেশ খেয়ে বলছেন, খেতে ভালো তো! সত্যজিৎ হাসছেন আর সন্দীপ জলের গেলাস হাতে দাঁড়িয়ে।  সকালে ঘুম ভেঙে যেতে মনে পড়লো শুচির কথা। তাই চারুকলা। তার বসে থাকাটি অনেকক্ষণ দেখলো সমীরণ, স্রেফ বসে থাকা৷ পা ছড়িয়ে, কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকলে মানুষ এইভাবে বসে থাকে। শুচি’র সাথে দেখা করবার-ই কথা। কিন্তু ঐ বসে থাকার স্তব্ধ অথচ ঈষৎ সঙ্গীতময় সৌন্দর্যে কোনো টোকা দিতে ইচ্ছে করলো না। সমীরণ হেঁটে হেঁটে অফিস ফিরে গেলো৷
এই বিজ্ঞাপনী সংস্থার অনেক উদ্ভাবন তার মগজ থেকেই বেরিয়েছে কিন্তু আজকাল তার সৃজনশীলতার ভয়াবহ সংকট তৈরি হয়েছে। গুঁড়ো সাবানের একটি ছোটোখাটো কোম্পানিকে আজ বিকেলেই কাজ তৈরি করে দেয়ার কথা কিন্তু কিছুই মাথায় আসছে না৷ অনেকদিন ধরে শুচি’ই তার মাথার অনেকটা দখল করে রেখেছে৷ 
একটা সার্ফিং বোর্ডে সে আর শুচি সার্ফিং করছে আর সামনে উত্তাল জলতরঙ্গ… শুচি’র সানন্দ চিৎকার… তন্দ্রার ঘোর কেটে যেতে নিজের ছোটো কিউবিকলে নিজেই লজ্জা পেলো। নীলা সমীরণের জীবনের আরেকটা অমীমাংসিত রহস্য। একা থাকার সময় খুব তীব্র ভাবে নীলার স্মৃতি তাকে পেয়ে বসে। সাড়ে বারো বছরের সম্পর্ক সেই স্কুল থেকে, হঠাৎ হারিয়ে গেলো জীবন থেকে…  নীলার মা ছিলেন না, বাবা শোকের ধাক্কা সামলাতে পারলেন না। একটা একক পরিবার শহর থেকে নিরবে হারিয়ে গেলো…
অনেকদিন নীলাকে খুঁজে খুঁজে আজ জীবনের আটত্রিশতম জন্মদিনে কোনো একটা সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে সমীরণ। একা, নিঃসঙ্গ মৃত্যু সে বড়ো ভয় পায়। তার পিসি সংসার থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর পিসেমশাই আর বিয়ে  করেননি৷ একদিন শীতের সকালে একা একা মৃত অবস্থায় পাওয়া গেলো তাঁকে৷ ঘুমের মধ্যেই চলে গেছেন৷ পিসি একদিন রাস্তায় তাকে দেখে মাথার চুল ঘেঁটে দিয়েছিলেন- বড়ো ঝলমলে দেখাচ্ছিলো তাঁকে, সে বই পছন্দ করে বলে তার হাতে তিনি পাঁচশো টাকা গুঁজে দিয়েছিলেন জোর করে। আজ বছর বিশেক পর সেই পিসিকে দেখতে খুব ইচ্ছে করলো- একদিন হেমসেন লেনের পুরনো বাড়িটাতে গিয়েছিলো, একটা ছোট্ট শৈশব দৃশ্য মনে পড়ে গেলো, পিসি তাকে স্নান করিয়ে দিচ্ছেন, তিনি তখন কাপড় কাচছিলেন, অকস্মাৎ তার মাথায় ওয়ান লাইনার আসে- এই এক অবাক রহস্য। কোনো এক অনুপ্রাণিত মুহূর্তে সে আসবে, তার জন্যে অপেক্ষা করে থাকতে হয়… দুপুর গড়িয়ে বিকেল। কাজ শেষ করে উঠে পড়লো। 
কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না, মুঠোফোনে ভাইব্রেশন। ‘এলেন না যে’, এসএমএস শুচি’র। কিছু পাঠায় না সমীরণ, রোদ আজ রেগে আছে। সমু, তুমি বড়ো হয়ে যাচ্ছো- নিজে নিজে বিড়বিড় করে। আজকেও রুমাল আনতে ভুলে গেছে তাই ঘাম মোছা হয় না। ‘সমুদা, কোথায় যাচ্ছেন?’ একটা পুরনো মডেলের টয়োটার জানালা দিয়ে পূর্বার মুন্ডু উঁকি দেয়। সমীরণ স্মিত হাসে। ‘চলেন না আপনাকে লিফট দিই।’ পূর্বার কথায় সমীরণ মাথা নাড়ে৷ ‘না, অভ্যাস খারাপ করা ভালো নয়।’ সমীরণের হাসিটি এক সময় তার মফস্বলের কলেজের অনেক মেয়ের রাতের স্বপ্ন ছিলো৷ পূর্বা চলে গেলো। খানিকটা মোটা হয়েছে সে৷ এক সময়, বছর বারো আগে সে অনেক ছিপছিপে ছিলো- উদয়াস্ত পরিশ্রম করে বেড়াতো- টিউশনি করতো অনেকগুলো,ওর স্বামী ওকে ছেড়ে দিয়েছিলো। কাউকে একটি অভিযোগ করেনি পূর্বা, একমাত্র ছেলের বয়স তখন এক বছর, একটা বর্ষার বিকেল এই খরখরে দুপুর মরে যেতে মনে পড়লো৷ কলিং বেলের শব্দে আধো ঘুমে উঠে এসেছিলো সমীরণ৷ ‘ সমুদা, শ দুয়েক টাকা হবে?’ পূর্বাকে বিনা বাক্যব্যয়ে টাকাটা দিয়ে ঐভাবেই ঘুমিয়ে পড়লো। রাত নটায় ঝুম বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙলো। মনে পড়লো পূর্বার কথা। নিজের উপর লজ্জা এলো। বাইরের ঘরে এসে দেখলো পূর্বা চুপচাপ বসে আছে। অনেকটা কান্নার ছাপ। দু’টি ঘর অনেক পরিপাটি মনে হচ্ছে। ‘কি পূর্বা যাওনি?’ প্রথম কথা সমীরণের। পূর্বা অবোধ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে। ‘আমি কখনো কারো কাছে  টাকা চাইনি সমুদা।’ – আবার কান্না, মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্ট। খানিক বিরক্ত-ই হয়েছিলো সে। ‘বাসায় যাও, চলো পৌঁছে দিই’,  একটিও কথা না বলে পূর্বা বেরিয়ে গিয়েছিলো। আর আসেনি৷ সেই প্রথম আর সেই শেষ। অনেকদিন পর বড়ো এক বাক্সে অনেকগুলো বই আর সঙ্গে চিরকুট ‘আমার স্বপ্ন তুমি বোঝো না সমুদা। তোমারটা আমি বুঝি।’- তখন পূর্বা আমেরিকায়, তারপর গোটা ইউরোপ, এখন বাংলাদেশে থিতু৷ কখনো সমীরণ তার এই বাঁক বদলের কথা জানতে চায়নি। আজো চাইলো না৷ খালি রঞ্জনের মুখ মনে পড়ে। পূর্বা’র ছেলে। হেমসেন লেনের এই বাড়িটাতে অনেক বছর আগে একবার এসেছিলো সমীরণ৷ পিসে মশাইয়ের মৃত্যুর কথা জানাতে৷ পিসী যাননি৷ বুড়ো, শুকনোমতন দারোয়ান তাকে বসিয়ে রাখলো অনেকটা সময়। তারপর দোতলায় পিসীর কাছে যাওয়ার ডাক এলো৷ ঢাউস এক খাটে শুয়ে আছেন৷ তাকে দেখতে মলিন হাসি ফুটে উঠলো। ইশারায় ডাকলেন কাছে গিয়ে বসার জন্যে৷ খাটের সাথে একদম মিশে গিয়েছেন৷ মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন সেই ছেলেবেলার মতন আর পিসীর চোখে জল, সমু দু’হাতে জল মুছিয়ে দেয়৷ কেমন এক দীন ভিখারির মতো চেহারা তাঁর! চোখের ভাষায় এক জীবন আটকে রাখা প্রতিবাদ। ‘ভুল হয়ে গেছে বাবা’- খুব মৃদু গলায় বলেন তিনি৷ ‘একটা দেবতার মতো মানুষকে অকারণে কষ্ট দিলাম’- চোখের জল বাঁধ মানে না৷ ‘প্রতি বছর পুজোর সময় আমি আর তোর পিসেমশাই হেঁটে হেঁটে পুজো দেখতাম। রিক্সায় চড়ার পয়সা ছিলো না, কিন্তু তাতেই আনন্দের কমতি ছিলো না।’ কিছু ফল আর বিস্কুট নিয়ে ঘরে ঢোকে একটি মেয়ে, স্নিগ্ধ মুখ। কোমর ছাপানো চুল। ‘আমার মেয়ে রিনি।’ রিনি, নুয়ে পড়ে প্রণাম করে সমীরণকে। রিনি চলে যায়। ‘সুন্দর তো আমার বোনটা।’ বলার মতো কথা না পেয়ে বলে সমীরণ। ‘খুব ভুল হয়ে গেছে বাবা।’ তিনি আবারো বলেন মৃদু, আসন্নমৃত্যু গলায়। সমীরণ উঠে পড়ে৷ ‘পিসী, আজ চলি’ – ‘মাঝে মাঝে আসিস’, পিসী গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। সমীরণ বেরিয়ে আসে, ভাবে, রিনি’র মুখে পিসেমশাইয়ের অনেক আদল, এমনকি তাঁর চিবুকের জন্মদাগটাও হুবহু রিনি! মোবাইলের ভাইব্রেশন আবার। ‘রাগ করেছেন?’
শুচি’র এসএমএস, আজ স্মৃতি আর বাস্তবতার ভারে অনেক ক্লান্ত সমীরণ৷ এই রকম সময়ে নীলাকে খুব গালি দিতে ইচ্ছে করে। এই সময়ে চারদিকে, না না দশদিকে যখন স্যাটেলাইট ঘুরে বেড়াচ্ছে তখন কেমন করে একটা মানুষ হারিয়ে যায়! কোতোয়ালির ঠিক মোড়টাতেই রাস্তা পেরোবার সময় নিয়ন্ত্রণহীন একটি ট্রাকের ধাক্কায় সমীরণ চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে গেলো। এমনকি নীলা কিংবা পূর্বার আদল ভাবার সময় পেলো না। বাবার জন্যে ওষুধ নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হলো না। একটি গল্পেরও  মৃত্যু ঘটলো এইভাবে। শুচি’র আরেকটি এসএমএস আসার শব্দে সমীরণের বিচ্ছিন্ন পা থেকে ছিটকে পড়া মোবাইল কেঁপে উঠলো৷ তার গায়ে আঁচও লাগেনি। একটি মৃত মানুষের পাশে এইভাবে একটি জীবিত মোবাইল পড়ে থাকলো৷ মানুষ জড়ো হতে থাকলো। একটি পথশিশু টুক করে ফোনটা নিয়ে ছুট দিলো। কয়েকদিন সে পেট ভরে খেতে পারবে৷

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত