| 18 ফেব্রুয়ারি 2025
Categories
গল্প সাহিত্য

লাবণ্য প্রতিক্ষায়

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যেও মেয়েটি রাস্তা ধরে ছুটে চলছে।

আকাশভাঙা এ বৃষ্টি অবশ্য সেই জৈষ্ঠ্যের বৃষ্টি নয়। যাতে মিশে থাকে কদমের গন্ধ। বা যে বৃষ্টির জলস্নাত হয়ে জারুল আরোও উজ্জ্বল হয়ে বেগুনী মায়া ছড়ায়। এখন আশ্বিন মাস। বাংলা থেকে শরৎ নামের ঋতু টি অনেক আগেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে বিদেয় নিয়েছে। দু’দিন ধরে কখনো ঝিরিঝিরি তো কখনো রিমঝিম বৃষ্টি ঝড়ছে। এই বৃষ্টি ভ্যাপসা গরমকে অনেকটাই কাবু করে ফেলেছে।

আমি অফিস থেকে ফিরছি। মামার আমেরিকা  থেকে এনে দেওয়া  ছাতাটা এমনভাবে আগলে আগলে মাথায় ধরে রেখেছি যেন বৃষ্টিতে আমি ভিজলেও সমস্যা নেই কিন্তু ছাতাটা অক্ষত থাকুক। কেন আগলে রাখবো না? ওই এক মামাই তো এতগুলো বছর আমাদের আগলে রেখেছে। মামা যদি পাশে এভাবে শক্ত হয়ে না দাঁড়িয়ে থাকতো তবে আমরা কবেই এই বৃষ্টির জলের খড়কুটোর মতো ভেসে যেতাম। আমার মায়ের বড় আর একমাত্র ভাই এই মামা। মা যাকে ডাকে ভাইজান বলে। নানীর কাছে গল্প শুনেছি ছোটবেলায় খুব ডানপিটে ছিল মামা, অন্যদিকে মা খুব লক্ষ্মী। বিপরীত বৈশিষ্ট্যের জন্যই কিনা দু’জন একে অপরের উপর যতটাই নির্ভরশীল ছিল ঠিক ততটাই ভালবাসা ছিল। মা খেলতে গিয়ে হেরে কাঁদতে থাকলে মামা গিয়ে বিজয়ী দলকে হারিয়ে আসতো। অন্যদিকে ডানপিটে মামার যন্ত্রণায় অতিষ্ট পাড়া প্রতিবেশীর নালিশে বিরক্ত দাদুর কাছে অনুনয় বিনয় করে মার খাওয়া থেকে মামাকে বাঁচিয়ে দিতো মা।

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি বাসের জন্য। একে তো বৃষ্টি তার উপর অফিস ছুটির সময়। তাই ভিড় যেন উপচে পড়ছে বাসগুলোতে। দু’টো বাসে ওঠার চেষ্টা করে না পেরে রণে ভঙ্গ দিয়ে সি এন জি নেবার চেষ্টা করছি। ফাঁকা সি এন জি গুলোকে অনুরোধ করে, বেশি ভাড়ার লোভ দেখিয়েও মিরপুরে যেতে রাজি করতে পারছে না। মিরপুরের রূপনগরে আমার বাড়ি। এই বাড়ি অবশ্য মা পৈতৃকসুত্রে পেয়েছে। এখানেও অবশ্য সেই মামার ভূমিকাই প্রধান। নানার এই একমাত্র বাড়িটির নিজের স্বত্ব বোনের জন্য ত্যাগ করেছিলো মামা। করবেই বা না কেন? তাঁর বোন যে খুব অসহায় ছিল তখন। উড়নচণ্ডী আর অলস স্বামী তার ব্যবসায় সবকিছু খুইয়ে শেষ পর্যন্ত বোনের গয়নাও ওড়াতে শুরু করেছে তখন। ব্যবসার জন্য সেই কবে থেকে বাড়ি বিক্রি করে ভাড়াবাড়ি তে থাকলেও সে সময় প্রায় ৮ মাসের ভাড়া বাকি। ভাড়া দেবার ভয়ে বা সংসারের খরচের ভয়ে বোনের অকর্মণ্য স্বামী টি নিখোঁজ হয়ে গেলো। বোনের কলেজ পড়ুয়া মেয়েটার টিউশনি’র টাকা দিয়ে মা-মেয়ের কোন রকমে ডালভাত জুটছে। এই অবস্থা কাহাতক দেখা বা সহ্য করা যায়? মামা নানাকে বলে এই বাড়িতে বোনকে এনে তোলে মেয়েসহ। এর কিছুদিন পরেই মামা তার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে আমেরিকা পাড়ি জমায়। সে দেশেই মামা বসত গাড়ে। এরপর আর লাবণ্য দের কষ্ট করতে হয় নি।

লাবণ্য; হ্যাঁ আমার নাম লাবণ্য। বাবা রেখেছিলো। আমার উড়নচণ্ডী, অকর্মণ্য বাবা খুব রবীন্দ্রনাথ পড়তে পছন্দ করতেন। সেই “শেষের কবিতা” থেকে লাবণ্য নামটি এনে দিয়েছেন আমার জন্য। বাবার কাছে আমি যেন সেই গল্পের লাবণ্যই হয়ে উঠেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী নেওয়া বাবা আমাকে সামনে বসিয়ে কত কত কবিতা শোনাতেন; সব নিজের লেখা। মা কে কোনদিন শোনানোর সুযোগ পান নি। মার কাছে এই সব কবিতা লেখা ছিল অকাজ। মা সব সময় বাবাকে তার ভাই মানে মামার মতো হতে বলতো। আমার অকর্মণ্য বাবা হাসতো আর বলতো শঙ্খলতা একজন মানুষ কি আরেকজনের মতো হতে পারে? মায়ের লতা নামটা বাবার কাছে এসে শঙ্খলতা হয়ে যায়। যদিও তাতে  মার খুব আপত্তি আর বিরক্তি ছিল। এটাকেও সে অকাজ বলেই ভাবতো। আমার বাবা রায়হান ইসলাম মামার মতো হতে না পারায় মায়ের কথ্য নির্যাতনে ঠিক এমনি এক বৃষ্টির রাতে ঘর ছাড়ে। তার খুব প্রিয় কবিতার খাতাটি রেখে যায়। কূল হারানো মা তখন দিনরাত বাবাকে শাপশাপান্ত করতো। তবে নানার বাড়ি আমার মায়ের নামে পাকাপোক্ত হয়ে যাবার পর বাবার নাম আমি মায়ের মুখে আর কোনদিন শুনি নি। রায়হান ইসলাম নামের মানুষটি সেই বৃষ্টি রাতের অন্ধকারের মতো ঝাপসা হতে হতে যেন একেবারেই মিলিয়ে গেলো। আমি বাবার সেই কবিতার খাতাটি এখনো লুকিয়ে লুকিয়ে হাতে নেই; বাবাকে অনুভবের চেষ্টা করি, বাবা’র লাবণ্য হয়ে ওঠার চেষ্টা করি। বাবার পর আমার জীবনে কি কোন অমিত এসেছিলো? এসেছিলো তো, বিপুল চৌধুরী নামে এসেছিলো। আমরা নানার বাড়িতে মামার আমেরিকা থেকে পাঠানো টাকায় তখন সবে একটু একটু করে গুছিয়ে বসছি। আমি টিউশনি ছেড়ে খুব মন দিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। আমার হরিণের মতো চোখ, কালো দিঘীর মতো একঢাল চুল, কাঁচা হলুদের মতো রঙ সব ছাপিয়ে চোখের পাতায় একটা তিলই মূখ্য হয়ে উঠলো। সেই তিল নিয়ে একটি করে কবিতা ক্লাশে আমার বসার জায়গাতে প্রতিদিন পাওয়া যেত। প্রথমে আমি কোন দুষ্ট ছেলের কাজ ভেবে এড়িয়ে যেতাম। কিন্তু  ৬ মাস নিয়মিত কবিতা পাবার পর হঠাৎ যখন তা পাওয়া বন্ধ হয়ে গেল তখন কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠতে লাগলাম। আমি যেন কবিতার সেই শব্দের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। নাকি শব্দের আড়ালে বাবাকে খুঁজে পেয়েছিলাম, কে জানে? আমি সেই শব্দগুলোকে হারাতে চাই নি। তাই সপ্তাহখানেক কবিতাহীন থাকার পর একদিন নিজেই একটা চিরকুট লিখলাম,

“শব্দেরা কথা বলে, শব্দেরা হাসে,শব্দেরা স্বপ্ন দেখায়, শব্দেরা কাঁদে, শব্দেরা দিশেহারা, শব্দেরা একা, শব্দেরা খুঁজে ফেরে শাব্দিক মায়া!!”

এটা রেখে দিলাম আমার বসার জায়গাতেই। আর আমাকে নিরাশ না করে ঠিকই সেই শব্দের হাত ধরে বিপুল ধরা দিলো আমার কাছে।

আমাদের কবিতা কবিতা খেলা, শব্দের মায়াজাল বোঁনার তখন বছর ঘুরেছে কেবল। বসন্ত শেষে গ্রীষ্ম সবুজের খেলায় মেতে উঠছে সবে। গাছে গাছে আগুনরাঙা কৃষ্ণচূড়া সবে পাট পাতছে। এমন একদিন বিকেলে বিপুলের দেওয়া দু’একটি ফুল আর অধিকাংশ কলিতে ভরা কৃষ্ণচূড়ার ডাল নিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই মা হ্যাঁচকা টানে নিজের ঘরে নিয়ে গেল। একটা লাল-হলুদের মিশেলে টাঙ্গাইলের সুতি শাড়ি হাতে ধরিয়ে তৈরি হয়ে পাশের ঘরে আসতে বললো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মামার ফোন এলো আমার মোবাইলে,”লাবণ্য খুব ভাল ফ্যামিলির ছেলে মিতুল। বাবার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা দেখাশোনা করে, কুষ্টিয়া বাড়ি। সেখানকার কলেজ থেকেই মাষ্টার্স করেছে।  তুমি ভাল থাকবে। আমার খুব পছন্দ এই ছেলে।” মামার শেষের কথাটাতেই লাবণ্য বুঝে যায় কি বলতে চাইছে মামা। মামার পছন্দই লাবণ্য আর মা’র জীবনে শেষ কথা। কৃষ্ণচূড়ার সেই ডাল টা মাটিতে পড়ে রইলো। সেই রাতেই আকদ্ হয়ে গেলো। এর দুইমাস পর খুব স্বল্প আয়োজনে বিয়ে। মিতুল আসলেই খুব ভাল ছেলে। খুব সংসারী, মন দিয়ে ব্যবসা করে, লাবন্য’র খুব যত্ন নেয়। শুধু বিয়ের দিন থেকেই লাবণ্য নাম টা লাবণি করে দেয় কারণ ওসব নায়িকা নায়িকা নাম মিতুলের পছন্দ নয়। আর পছন্দ নয় কবিতা লেখা, বই পড়া। আর হ্যাঁ লাবণি কে ছেড়ে থাকতে পারবে না বলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়িয়ে কুষ্টিয়ার কলেজে এনে ভর্তি করিয়ে দেয়। প্রতিদিন ওড়নায় মাথা ঢেকে মিতুলের সাথে কলেজে যেতাম আর ফিরতাম আমি। যেহেতু কবিতা লেখা মানেই প্রেম করা তাই কবিতা আর শব্দের খেলা বিসর্জন দিতে হয় আমাকে। তবুও মন তো, একদিন দুপুরবেলা ভাত খেয়ে বাবার সেই কবিতার খাতা টা নিয়ে বসতেই হঠাৎ করেই মিতুলের আবির্ভাব। খাতার এত এত কবিতা যে বাবার লেখা তা মিতুল কোন ভাবেই মানতে রাজি হলো না। মিতুলের কিছু কটুশব্দের সাথে আগেই পরিচয় হয়েছিল আমার। সেদিন যুক্ত হলো একটা থাপ্পড়ও। আর এরপর মিতুল যা করতে উদ্যত হলো তা দেখে যেন আমার মাথায় আকাশভেঙে পড়লো, বাবার সেই কবিতার খাতায় আগুন ধরিয়ে দিলো মিতুল। মিতুলকে এক থাক্কায় সরিয়ে নিজের হাত পুড়িয়ে শেষ পর্যন্ত সেই খাতা রক্ষা হলেও বিয়েটার শেষরক্ষা হলো না। অসতী আর অসভ্যের তকমা নিয়ে আমি ফিরে এলাম মায়ের কাছে। এরপর থেকে আমি আবার লাবণ্য হয়ে উঠলাম। তবে আমার অমিতেরা হারিয়ে গেছে। বিপুল শুনেছি একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি তে চাকরী করে, বৌ-বাচ্চা নিয়ে সাজানো সংসার। তবে কবিতা লেখে কিনা এখনো তা অবশ্য জানা নেই। আর আমার বাবা; সেই কবিতার খাতা নিয়েই কাল যাব এক প্রকাশকের কাছে। যদি কোনদিন নিজের লেখা বই হাতে পেয়ে বাবা বুঝতে পারে তার লাবণ্য এখনো প্রতিক্ষায়….

আর হ্যাঁ বৃষ্টিতে ছুটে চলা সেই মেয়েটি আমার পাশে এসে দাঁড়ালো কিছু সময়। অপেক্ষা করলো কিছু সময়। এরপর এক জলপাই সবুজ পাঞ্জাবী পড়া ছেলের সাথে রিক্সার হুড ফেলে ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মিলিয়ে গেল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত