| 29 মার্চ 2024
Categories
ইতিহাস

প্রথম মহামারী একটি সুমের উপাখ্যান

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

তুষার মুখার্জী

 

মানব ইতিহাসের প্রথম মহামারী কবে শুরু হল তার ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যেতেই পারে। তবে জানা ইতিহাসের আগেও তো মানুষ ছিল, তখনও মহামারী হত কি? একটি সুমের উপাখ্যান বলছে হত। কত আগে? তখন পৃথিবীতে মানুষের সবে সৃষ্টি হয়েছে, তার কিছু পরেই।
মহামারীর কারন সহজ। জনসংখ্যা কমানো।
কত আগের কাহিনী এটা? এটি পাওয়া গেছে ব্যাবিলনে, মাটির তালে কিউনিফর্ম লিপিতে লেখা, তিনটি আলাদা সময়ে লেখা কাহিনীর মধ্যে সামান্য অদল বদল ছিল। দুটি লেখা ছিল আসিরীয় লিপিকারদের লেখা, একটি আসিরীয় ভাষায় অন্যটি ব্যবিলনীয় ভাষায়। আর তৃতীয়টি ছিল লেখা হয়েছিল ব্যাবিলনের রাজা আম্মি-সাদুকার আমলে (১৬৪৭-১৬২৬ সাধারন পূর্বাব্দ(BCE))। তবে আসল কাহিনীর সুত্রপাত সুমেরদের আমলের।

মহাপ্রলয়ে যখন পৃথিবী ডুবে গেল তার ২৪০০ বৎসর আগের ঘটনা এটা। এই মহাপ্রলয় কিন্তু বাইবেলের মহা প্রলয়ের বহু আগের ঘটনা। আজ থেকে পাঁচ সাত হাজার বৎসর আগের ঘটনা।

তাহলে সেই আনুমানিক হিসাবে এই মহামারী ঘটে আজ থেকে সাড়ে নয় হাজার বৎসর আগে। তবে গোলমাল আছে হিসাবে। আর সব প্রাচীন কাহিনীর মত যথাযথ সময়ের হিসাব মেলানো যাবে না। তা না যাক। ঘটনাটাই এখানে আসল।
মহামারীর নামও জানা আছে। রোগের নাম সুরুপ্পু-রোগ।

এই কাহিনীর সাথে সুমেরদের দেবদেবী জড়িত। তাই একটু পরিচয় হোক ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত সুমের দেবদেবীদের।

দেবতা আন বা আনু হলেন স্বর্গলোকের অধীশ্বর, দেবপিতা। তাঁর দুই ছেলে এনলিল আর এনকি হলেন বীপরিত চরিত্রের। ঝড়ের দেবতা এনলিল বদমেজাজী-রাগী এবং কিছুটা গোঁয়ার। মিষ্টি জলের দেবতা এনকি জ্ঞানী, ধীর স্থির, মানব দরদী। মৃত্যুদেবতা (মৃত্যুদেবতা এরেস্কিগাল হলেও এখানে তিনি অনুপস্থিত, তাঁর দুত বা বলা যাক যমদুত) হলেন নামাতারা।

কাহিনীর শুরু আরো অনেক আগের। কারন প্রথমে তো পৃথিবীতে মানুষই ছিলো না। সেই আদিমকালেই ঠিক হল প্রধান দেবতা আন স্বর্গলোকে বাস করবেন। এনকি থাকবেন পৃথিবীতে তাঁর নিয়ন্ত্রনে থাকবে পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান আর মিষ্টি জল (সমুদ্রের নোনা জল বাদে সবটা)পানীয় জল। এনলিল থাকবেন পৃথিবীতে, তাঁর দায়িত্ব হল পৃথিবীকে ভালো করে গড়ে তোলা।
এখন এই পৃথিবী গড়ার কাজে শ্রমিক দরকার। তাদের কাজ হবে ক্রমাগত খাল কেটে চাষের জমিতে জল সেচের ব্যবস্থা করা। (যদি মানুষই নেই তো চাষ কে করবে, বা কেন করবে এসব জিজ্ঞেস করতে নেই)। সেই খাল কাটার কাজ করতে লাগানো হল নীচুস্তরের ইগিগি দেবতাদের। চল্লিশ বৎসর বিরামহীন কাজ করতে করতে ইগিগি দেবতারা বিদ্রোহ করলেন। আর কাজ করবেন না। শুরু হল মানব সভ্যতার প্রথম শ্রমিক বিদ্রোহ, ঘেরাও, আগুন লাগানো, স্লোগান দেওয়া এই সব। যা আমরা সবাই ভালোই জানি। এবং এখনকার মতই দায়িত্বপ্রাপ্ত দেবতা এনলিল প্রথমে কিস্যু পাত্তা দিলেন না, তারপরে ভয় পেলেন, তারপরে প্রধান দেবতা আন অধ্যাদেশ জারী করলেন শ্রমিকদের প্রধান বিদ্রোহের উদ্গাতাকে বিনাশর্তে আনানুগ কঠোর শাস্তিভোগের জন্য দেবতাদের হাতে তুলে দিতে হবে। এবং যথারীতি শ্রমিক দেবতা ইগিগিরা সবাই এক সাথে বলো আমরা সবাই দায়ী। ক্ষমতা থাকে সবাইকে শাস্তি দিন।

সেটা সম্ভব না। তাই সমঝোতা হল। ইগিগিদের কাজ থেকে বরাবরের জন্য রেহাই দেওয়া হবে। সৃষ্টি করা হবে মানুষ নামের প্রাণী যারা এই পরিশ্রম করবে, আর তাদের অভিযোগ বা বিদ্রোহের কোন অধিকার থাকবে না।

দেবতা এনকি, ধাত্রী দেবী মামির সাহায্যে মাটি আর এক বলি দেওয়া দেবতার রক্ত মাংস দিয়ে সাতজন পুরুষ আর সাতজন নারী সৃষ্টি করলেন।

 

মানুষের সৃষ্টি হল। সাতজন নারী সাতজন পুরুষের মিলনে বংশধরেরা দ্রুত পৃথিবী ছেয়ে ফেললো। তারা কাজ করছে বটে, কিন্তু মুখ বুজে করছে না, ফলে এত লোকের মিলিত হাল্লাগোল্লায় দেবতা এনলিলের রাতের ঘুমের ব্যাঘাত হতে লাগলো। পৃথিবী আর আগের মত শান্ত নেই, দিনের তো বটেই রাতেরও নিস্তব্ধতা হারিয়ে গেছে।

এনলিল এই উৎপাতে ভীষণ বিরক্ত হলেন। কি করা যায়? কি করা যায়? অবেশেষে ঠিক করলেন, তিনি প্রতি ১২০০ বৎসর পরে পরে কোন না কোন উপায়ে পৃথিবীর সব না হলেও বেশির ভাগ মানুষকে মেরে ফেলবেন।
এই পরিকল্পনা মত তিনি প্রথম ছড়ালেন মারণ রোগ সুরুপ্পু।

কিন্তু এনকি নিজে সৃষ্টি করেছিলেন মানুষকে। তাই তাঁরা মানুষদের প্রতি একটা মমতা ছিল। পোকা মাকড়ের মত মানুষরা মরে যাক তিনি তা চাইতেন না।

তাই-

এনকি তাঁর ভক্ত আত্রা-হাসিসকে (অন্য কাহিনীতে তিনি সুরুপ্পাগ শহরের রাজা) ডেকে এই মহামারীর থেকে রেহাই পাবার সূত্র জানালেন।
বললেন তোমরা সব বয়স্ক জ্ঞানীদের একত্র করে (পাড়া পাড়ায় মিটিং করে) বোঝাও যেন সবাই ঘরে ঘরে আন্দোলন শুরু করে। তারা প্রচুর এবং প্রবল আওয়াজ শুরু করুক। আর সব দেবতার আরাধনা বন্ধ করে দিক।

শুধু যমদুত দেবতা নামাতারাকে আরাধনা করো, তাঁর মন্দিরে গরম রুটি বানিয়ে নিবেদন কর।

আত্রা-হাসিস সেই মত সব ব্যবস্থা করলেন। সব দেবতা আওজে অতিষ্ঠ আবার পেটে খাবার নেই, কারন মানব ভক্তরা কিছু নিবেদন করছে না।

এদিকে মারন-দেব নামাতারা অবাক হয়ে দেখলেন যে মানুষরা তাঁকে সব সময় এড়িয়ে চলত তারাই তাঁকে গরম গরম রুটি বানিয়ে নৈবিদ্য দিয়ে যাচ্ছে। মরন-দেব নামাতারা খুব লজ্জিত বোধ করলেন। এমন ভক্তদের তিনি কি ভাবে অকাতরে মেরে ফেলবেন। এতো খুবই বাজে কাজ হচ্ছে।

তিনি হাত ধুয়ে নিলেন।
সুরুপ্পু রোগের মহামারী থেকে মানুষ উদ্ধার পেল।

 

তথ্য সুত্রঃঃ-

Corpus of Electronic translation of Sumer Text:
Story “When Gods Were in the Ways of Men”

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত