মায়াতি কে ও কেন
প্রাচীন ভারতে যে সমস্ত যজ্ঞের অনুষ্ঠান হতো তার মধ্যে অন্যতম হলো অশ্বমেধ যজ্ঞ। বড় বড় ক্ষমতাশালী রাজারা এই যজ্ঞ করতেন।যেমন রামচন্দ্র, যুধিষ্ঠির(এরা দুজন ঐতিহাসিক চরিত্র কিনা সেই বিতর্ক থাকতেই পারে, সেক্ষেত্রে বলি, এখানে এদের উল্লেখ করা হচ্ছে কেবল অশ্বমেধ যজ্ঞের প্রসঙ্গে) পরবর্তীকালে সমুদ্রগুপ্ত প্রমুখ। যজ্ঞের নিয়ম ছিল একটি সক্ষম নিখুঁত পুরুষ ঘোড়ার গায়ে জল ছিটিয়ে, কানে মন্ত্রোচ্চারণ করে তাকে উত্তর-পূর্ব দিকে ছেড়ে দেওয়া হত এক বছরের জন্য। ঘোড়া প্রতিবেশীরাজ্য থেকে রাজ্যান্তরে ঘুরে বেড়াতো।তার সঙ্গে সঙ্গে যেত যজ্ঞকারী রাজার সেনাদল। যদি কোন রাজা বা অন্য যে কেউ ঘোড়ার পথ আটকাত, তবে ওই সেনা দলের সাথে তাকে যুদ্ধ করতে হত। এইভাবে ঘোড়া যে যে রাজ্যের মধ্যে দিয়ে যেত বাধাদানে বিরত বা পরাজিত সেই সেই রাজ্যের রাজাদের, যজ্ঞকারী রাজাকে রাজচক্রবর্তী হিসাবে মেনে নিতে হতো।বৎসরান্তে ঘোড়া ফিরে এলে তাকে বলি দিয়ে হোমক্রীয়ার মাধ্যমে যজ্ঞ সমাপন হতো।
এই পুরো প্রক্রিয়াটির ক্ষেত্রে ঘোড়ার বদলে একজন মানুষকে ভাবুন। সেই মানুষটিই হল মায়াতি। এই মায়াতি নিযুক্ত যজ্ঞ করা হতো দেবী দুর্গার উদ্দেশ্যে। এবং এটি অশ্বমেধ যজ্ঞের অর্ধপুণ্যফল প্রদায়ী ছিল। যজ্ঞের নিয়ম ছিল এই প্রকার— দুর্গার উদ্দেশ্যে একটি মায়াতি, একটি মহিষ, একটি ছাগ এবং একটি মেষ নিবেদন করা উচিত। মায়াতি নিবেদন করলে দূর্গা সহস্রবর্ষ প্রসন্ন থাকেন। এক তরুণ, পিতৃমাতৃহীন, এককপুত্র, স্বাস্থ্যবান,প্রসন্নস্বভাব, বিবাহিত, অজারজ সন্তান এবং সৎ-শূদ্র বংশের একমাত্র মূল– এমন ব্যক্তিকে,প্রকৃত মূল্যের অধিক মূল্য দিয়ে তার বান্ধবদের কাছ থেকে কিনে নিতে হবে। এই তরুণই হলেন মায়াতি।যজ্ঞকারী ব্যক্তি তাকে স্নান করিয়ে বস্ত্র, চন্দন, মালা ও ধুপ দিয়ে পূজা করে একজন চর সঙ্গে দিয়ে বাইরে ঘুরতে পাঠাবেন এক বছরের জন্য। বছর পূর্ণ হলে তাকে অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে রাত্রিকালে দুর্গার উদ্দেশ্যে নিবেদন করতে হবে।
সুতরাং ছাগ মেষ বা অশ্বের মতো মায়াতিও বলির পশু। সেভাবেই তাকে কেনা হয়, স্নান করানো ও সাজানো হয়। এক বছরের জন্য অশ্বের মতোই ঘোরানো হয় এবং পরিশেষে বলি দেওয়া হয়। আবার তার সঙ্গে চরও দেওয়া হয় সম্ভবত এইজন্য যে,যাতে সে পালাতে না পারে।
মায়াতি যজ্ঞের উল্লেখ যদিও অথর্ব বেদে আছে, কিন্তু এটি পালনের বিশদ বর্ণনা আমরা পাই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানে, যার রচনাকাল ষষ্ঠ সাধারণ শতকের পরে ও অষ্টম শতকের আগে (মূল অংশের জন্য)। এখন প্রশ্ন, এই সময়কালে সমাজে কি এমন কোনো পরিবর্তন ঘটেছিল যাতে করে মায়াতি যজ্ঞকে জনপ্রিয় করে তোলার প্রয়াস দেখা দিয়েছিল?
এর উত্তর আমাদের খুঁজতে হবে তৎকালীন আর্থসামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে।
বিভিন্ন পুরাণে বলা হয়েছে যে কলিযুগে শূদ্র তার অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করবে এবং সমাজের অনেক অংশের ওপর কর্তৃত্ব করবে।সবকটি পুরাণের রচনাকাল এক না হলেও পুরানগুলি রচনা শুরু হয় পঞ্চম-ষষ্ঠ সাধারণ শতক নাগাদ। আবার পুরান এক প্রকার সাহিত্যও বটে। তাই সমাজের ঘটমান চিত্র পুরানে উপস্থাপিত হবে,এটা ধরে নেওয়া যায়। বাস্তবিকই আলোচ্য সময়ে শূদ্রের বা ক্ষেত্রবিশেষে শূদ্রোদ্ভূত সংকর জাতির অবস্থার পরিবর্তন হয়েছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই কিছু বিদ্যার্জনে এবং কৃষি ও বাণিজ্য মারফত ধনার্জনে সক্ষম হয়েছিল। এদেরকে সৎশূদ্র/উত্তম সংকর বলে অভিহিত করা হয়েছে একাধিক পুরানে। এদের নীচে ছিল যথাক্রমে মধ্যম ও অধম শূদ্র/সংকর। বৃহদ্ধর্মপুরানে ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে এই তিন শ্রেণীর তালিকাই আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অমিল থাকলেও করণ,অম্বষ্ঠ/বৈদ্য,গোপ,উগ্ৰ,মাগধ,কর্মকার প্রমুখকে সৎশূদ্র বলে নির্দিষ্ট করা হয়েছে।করন দের উল্লেখ আমরা গুপ্তযুগের বহু লেখতেই পাই। সেখানে তারা রাজকীয় কর্মচারী হিসেবে বিবেচিত।বৃহদ্ধর্ম পুরাণে বলা হয়েছে ‘করণ চিরদিন শ্রীযুক্ত হোক। সে বিনয়ের সঙ্গে কথা বলে ও আচরণ করে। সে রাজকার্যে নিযুক্ত ও নীতিজ্ঞ..’
এবার মায়াতি লক্ষণগুলি বিবেচনা করুন। এর পিতা-মাতা আর সন্তানের জন্ম দিতে পারবে না বংশ রক্ষার প্রয়োজনে,কারণ তারা মৃত।এর নিজের পত্নী নিঃসন্তান অবস্থায় বিধবা থাকবেন। যেহেতু মায়াতি হবে একমাত্র পুত্রসন্তান তাই সে ঐ বংশের মূলক অর্থাৎ বংশের শেষ জীবিত পুরুষ। সুতরাং একে বধ করলেই বংশটির লোপ হবে।এদিকে,মায়াতির স্বাস্থ্য চরিত্র স্বভাব সবকিছুই যথাযথ হতে হবে এমন নির্দেশ রয়েছে।মনে করাই যায় যে এই গুণগুলি থাকায় সে কিছু শিক্ষা ও অর্থ লাভ করত এবং ফলশ্রুতিতে,কিছুটা রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষমতার অধিকারী হত।সুতরাং এই ধরনের ব্যক্তি উচ্চবর্ণের বিশেষত ব্রাহ্মণের পক্ষে বিপজ্জনক। আর ঠিক এইখানেই নিহিত আছে মায়াতিকে যজ্ঞে বলি দেবার রহস্য।
তথ্যসূত্র— ১.প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ। সুকুমারী ভট্টাচার্য।
২. প্রাচীন ভারতে শূদ্র। রামশরণ শর্মা।
৩. প্রাচীন ভারতীয় সমাজ।নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য।
পেশায় শিক্ষক। ভালোবাসেন ইতিহাসকে গল্পের ছলে লিখতে।