| 19 এপ্রিল 2024
Categories
ভ্রমণ

হিমালয়ের গহীনে : প্রকৃতি ও সংস্কৃতির মাঝে যাত্রা (পর্ব-২)

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

গত পর্বের পরে…

 

নর্থ এন্ড ক্যাফে আমার প্রিয় বাগান রেস্তোরাঁ, ওখানে বিকেলে গান শুনি আর ভাবি কাল এমন সময় থাকব কোথায় আমি! আমার হ্যাভারস্যাকে প্রয়োজনীয় কাপড় জামা ভরে নিই। অতিরিক্তগুলো আর একটি ব্যাগে করে হোটেলের জিম্মায় রেখে যাই, খুব ভোরে ফ্লাইট তাই আর দেরি করা চলবে না দ্রুত ঘুমাতে হবে। হোটেলের ঠিক করা ট্যাক্সিতে হাজির হই ত্রিভূবন এয়ারপোর্টের অভ্যন্তরীণ র্টামিনালে। খুবই করুণ অবস্থা দারিদ্র পীড়িত এই দেশের এয়ারপোর্টের কিন্তু পরিব্রাজকের কোনো অভাব নেই। সব বয়সী অগুনতি মানুষের আনাগোনা এখানে। প্রতিটি ফ্লাইটে নেপালীদের জন্য ভাড়া আলাদা। বেশ কম আর আমরা যারা বিদেশী তাদের জন্য ডলারে ভাড়া। তবে নেপালের সর্বত্র সার্কভুক্ত দেশের নাগরিক হিসাবে কিছু সুবিধা মেলে। হঠাৎ ভয় পেয়ে যাই লুকলা এয়ারষ্ট্রিপ সম্পর্কে এর-ওর সাথে কথোপকথনের ভিত্তিতে। অপেক্ষার প্রহর গুণি বহিঃর্গমণ লাউঞ্জে। আগে থেকেই শুনেছি যত সকালে যাত্রা তত ভাল কারণ সকাল গড়িয়ে দুপুরের দিকে যেতেই পাহাড়ের গায়ে মেঘ জমে ওঠে আর বিমান চলচল বন্ধ হয়ে যায়। আমার এই যাত্রায় সময় পরিকল্পনা খুব মাপা। একটু এদিক সেদিক হলেই বিপদ। বাসে করে রানওয়েতে যেতে হবে। বাসে উঠে যাত্রী গণনা শুরু হলে দেখা গেল মোট ১৩ জন যাত্রী। বুক এর ভেতর শুরু হয়ে গেল ধুকপুক। শুরুতেই আনলাকী থার্টিন। হঠাৎ করেই এক দীর্ঘদেহী ১৪ নম্বর যাত্রী হিসেবে বাসে প্রবেশ করায় স্বস্তি ফিরে এলো। পরবর্তিতে অত্যন্ত সজ্জন এই দীর্ঘদেহী জেসন আমার পথে বহু স্থানে বিশ্রামে আড্ডায় সঙ্গি ছিল। যুক্তরাষ্টের ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকে সে। এসেছে ইমজা (আইল্যান্ড পিক) চূড়ায় উঠতে। এর দেহের গঠন দেখে মনে হলো ও তো দু’দিনেই হেঁটে ১০ দিনের পথ পাড়ি দিতে পারবে। স্বস্তিদায়ক জেসনসহ বাস ছেড়ে এসে রানওয়েতে দাঁড়াল। একটু মেঘলা আবহাওয়া দেখে মনে শঙ্কাও জাগছে যদি কোন কারণে ফ্লাইট বাতিল হয় সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। অগ্নি এয়ার এ আমার টিকেট। ছোট ছোট ডরনিয়ের, টুইন ওটার বিমান। বুদ্ধা এয়ার, তারা এয়ার, গোর্খা এয়ার, নেপাল এয়ার, সিতা এয়ার পটাপট এসে থামছে যাত্রী নামছে দ্রুত, আবার দ্রুত যাত্রী উঠিয়েই উড়াল দিচ্ছে। আমরা বাসে বসেই রইলাম। জেসান উসখুস করছে তার বাথরুম পেয়েছে। আমি পরামর্শ দিলাম চুপ করে নেমে ঘাসের ফাঁকে গিয়ে সেরে নাও। বোধহয় পরামর্শ পছন্দ হয়নি।আমি আমার দেশাল বুদ্ধিতে তাকে পরামর্শ দিয়েছি তার মুখ করুণতর হচ্ছে আর অপেক্ষার পালাও শেষ হচ্ছে না। বিমান যে আকারের সেখানেও বাথরুম থাকার সম্ভবনা নেই। জেসান এই কথা শুনে আর থাকতে পারলো না। বাসে বসেই দেখা জেমস এ জিয়ামবর্ণের সাথে তার গলায় বাংলাদেশের গামছা দেখে যেচে গেলাম আলাপ করতে। ঢাকায় ইউএসএআইডির কর্তা ব্যাক্তি ম্যাট ফ্রাইডম্যানও একসময় নেপালে কাজ করতো যার সাথে আমার বেশ সখ্যতা ছিল। দেখা গেলো জিয়ামবর্ণও ম্যাটের ভালো বন্ধু ও ম্যাটের মতনই এক নেপালী মেয়েকে বিয়ে করেছে যিনি নেপাল ইউএসএআইডি তে কাজ করেন আর সে নিজে একটা আর্ট গ্যালারী চালান। ধামরাইতে আমার বন্ধু সুকান্ত বণিক তার কর্মী বাহিনীকে নেপালে যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল মার্কিন দূতাবাসের সহায়তায় জিয়ামবর্নই ছিল মুখ্য ব্যক্তি সে আয়োজনের। তার সাথে গল্প জমে উঠলো আমাদের ধামরাইয়ে সুনিপুন লষ্ট ওয়াক্স মেথডে সৃজন হওয়া শিল্পকর্ম দিয়ে। সে বহুবার আমাদের দেশে এসেছে এবং পাবনায় বোনা এ গামছাটি ধামরাই থেকে কেনা তার। এর মাঝে অগ্নি এয়ারের ছোট্ট বিমানটি রানওয়েতে ধীর গতিতে এগিয়ে আসতেই আমাদের ১৪ জনের চাঞ্চল্য দেখা দিলো। ড্রাইভার বাসটি একটু এগিয়ে বিমানের কাছে নিয়ে এলো। এবার আমাদের নামার পালা। এই বাসেই আগত যাত্রীরা র্টামিনালে যাবে। আমি ছবি তোলার আয়োজনে ব্যস্ত হতেই দেখলাম বাকি ১৩ জন উঠে গেছে বিমানে। দৌড়ে বিমানের ভেতর ঢুকলাম। কেমন যুদ্ধ বিমান টাইপের। দুদিকে জানালার পাশে একটি করে সিট। দরজার পাশে সিট নেই। মোট ১৩ জনের বসার ব্যবস্থা। আমি বসব কই? বিমানবালা তরুণীটি এগিয়ে এল হাসিমুখে পেছনে মালপত্রের সাথে দুটি সিট আছে বিমানবালার ও আমার। জানালার পাশেরটিতে আসন নেই। বিমান ওঠা নামায় খুব তাড়া। দ্রুত বিমান রানওয়েতে চলতে শুরু করলো। বিমানবালা তরুণীটি সামনে থেকে ট্রে ধরে পেছনে আসছে। ভাবলাম নিশ্চয় চকলেট বা অন্য কিছু হবে। দেখি কাছে আসতেই ট্রেতে তুলো যাদের কানে সমস্যা হয় তাদের সমাধানে এই উদ্যোগ বিমান কর্তৃপক্ষের। বিমানবালা শুরুতেই জানিয়ে দিল যন্ত্রের মতো এই ফ্লাইটে সিটবেল্ট কখোনই খোলা যাবে না। মোটামুটি নির্বিঘ্নে বিমান রানওয়ে ত্যাগ করলো। আমি বহুবার দেশের আভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে ছোট বিমানে চড়েছি কিন্তু এত ছোট বিমানে চড়ার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। কাঠমন্ডু ভ্যালী ছাড়তে বিমান বেশী সময় নিল না। পুরো নেপাল জুড়েই পর্বতমালা যেন। সবুজ পাহাড় আর দূরের বরফে মোড়া শ্বেত শুভ্র চূড়াগুলো অপার রহস্যময়তায় মোড়া। ২০ মিনিট যেতেই বিমান একটা গোত্তাও খেলো যেন, ধাতস্ত হতেই প্রচন্ড কম্পন। বাইরে তাকিয়ে দেখি ধবধবে সাদা মেঘে চারিদিক আচ্ছন্ন। কম্পমান বিমান ভীতিকর ভাবে এগিয়ে চলেছে মেঘেদের ফাঁক গলে। মেঘ একটু পাতলা হতেই ভয়টা আরও বাড়লো, বিমানের এত কাছে সব পাহাড় একটু এদিক সেদিক হলেই শেষ। বুকের হৃদস্পন্দন প্রথম দিনই এমন পর্যায়ে গেলে কিভাবে হবে, আর যাত্রা শুরুর জায়গায়ই যদি না পৌঁছাই আজ! এই ভাবতে ভাবতে দূরের পাহাড়ের খাঁজে বিমান বন্দরের দেখা মিললো। একি! এটাতে বিমান নামবে কোথায়? পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট একটি এয়ারষ্ট্রিপ দৈর্ঘ্য মাত্র ৪৬০ মিটার। আমাদের বিমান গোঁ গোঁ করতে করতে, আমার নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকাকে উপেক্ষা করে নিরাপদেই নামলো লুকলায়। কেন যেন খুব তাড়াহুড়ো ওঠা নামায়! আমরা বিমান থেকে নামতে না নামতেই আর এক দল চড়ে বসলো, আর আমি রানওয়ে না ছাড়তেই বিমানটি উড়াল দিয়ে দৃষ্টিতে পাহাড়ের গায়ে একটি ছোট পাখিতে পরিণত হলো। কাঠমন্ডুতে দ্বীপেন বলে দিয়েছিল এয়ারপোর্টে আমার পোর্টার থাকবে। সব পরিব্রাজকের দলের ভিড়ে আমি খুঁজি কে এলো! আমার নাম নিয়ে এখানে। লুকলা এয়ারষ্ট্রিপটা কেন যেন খুব পছন্দ হলো আমার।হয়তো ভীতিকর যাত্রার শেষে স্বস্তি এনে দেয়ায়। আগমণ টার্মিনাল নেই। আমি খুঁজে পাই একজনকে যে ‘কবির’ নাম লিখে দাঁড়িয়ে আছে। পরিচিত হই আমার পোর্টার কাম গাইড এর সাথে স্পেশাল ঢাল। আমার কাছ থেকে ব্যাগের ট্যাগ চেয়ে নিয়ে হাজির হলো আমার ব্যাগ পত্তর নিয়ে। “বললো, চলো এবার।” লুকলা সম্পর্কে বই পড়ে যেটুকু জানা বাস্তবের লুকলা অনেক ভিন্ন। আমার কাছে তো লুকলা বড় শহরই বটে। সোলোখুম্বু জেলায় ৯৩৮৩ ফুট উঁচুতে এই এয়ারপোর্টকে ঘিরেই নেপালের উত্তর পূর্বকোণে এ শহরটি। বইয়ে পড়েছিলাম রুক্ষ জমিতে একটি মাঠের উপর এই এয়ারষ্ট্রিপ, কিন্তু ছোট হলেও বেশ গোছানো এয়ারষ্ট্রিপ ‘তেনজিং হিলারি’ এয়ারপোর্ট। এভারেষ্ট জয়ের পুরোধা দু’জনের নামেই তার নামকরণ। এয়ারপোর্টের বাইরে নানান লজ রয়েছে। এভারেষ্টে যাওয়া আসার পথে অভিযাত্রীদের বিশ্রাম নেবার জায়গা। ছবির মত সুন্দর সব লজ বিমান বন্দরের চারপাশ ঘিরে। লুকলায় যদি বিমানে না এসে নামতাম তবে গাড়িতে কাঠমন্ডু থেকে সর্বশেষ পথ জিরি পর্যন্ত। জিরি থেকে লুকলা আসা যাওয়ায় জেনেছি ১২ থেকে ১৫ দিন লাগে। ৫০ মিনিটের ফ্লাইট ১৫ দিনের সময় আর পরিশ্রম বাঁচিয়ে দেয়। জিরি থেকে পোর্টাররা মালপত্র বহন করে সোলোখুম্বু জেলায় দৈনন্দিন পণ্যের চাহিদা মেটায়। আমার কাছে বেশ বড়ই মনে হলো লুকলা শহরটি।

চলবে…

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত