আমেরিকান ডাক্তার দল দেখলাম বাম দিকের পথে ‘ফেরিচে’ গেলো। ওখানে তাদের এ অঞ্চলের সবচাইতে বড় চিকিৎসা কেন্দ্রতে কাজ আছে। আমাকে বললেও আমার পূর্ব নির্ধারিত রুট ছেড়ে যাব কিনা কিছুক্ষণের দ্বিধায় সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিতই রাখলাম। আবার নামো নিচে তবে আশ্বাস পেলাম এই ব্রিজ পেরুনোর পর পথে চড়াই উৎরাই কম। একবার তো এক পথের ধারে দ্বিধায় পড়ে গেলাম, আর এক দিকে একটা ট্রেইল উঠে গেছে। এমনিতেই ক্লান্ত খুব, ভুল পথে গিয়ে এই জনমানব শূন্য ভয়াল অঞ্চলে দ্বিগুণ পরিশ্রমের ইচ্ছে নেই একেবারেই।
পথে একজন মানুষও নেই তবে একজন স্থানীয়র দেখা মেলায় বুঝলাম না ঠিক পথেই আছি। এবারের পথটা চমৎকার, প্রায় সমতল খাড়া চড়াই বা উৎরাই নেই। পাহাড় পেরুনোরও দরকার নেই খুব একটা। রুক্ষ পাথুরে জমিতে মরে যাওয়া ঘাস আর শেওলা, পাশ দিয়ে সেই নদীই আগে যেটা অনেক নিচে ছিলো আমার উচ্চতর উচ্চতায় চলে আসায় পাশেই রয়েছে। যতটা আরামদায়ক পথটা দেখতে, পেরুতে দুস্তরময়। বেলা পড়ে গিয়েছে, শীতও বাড়ছে। আবার ডাউন জ্যাকেট বের করে পরা বেশ ঝক্কি বটে, ভাবলাম সামনেই তো দেখা যাচ্ছে ‘ডিংবোচে’। লজ এ পৌঁছেই পরে নেব না হয়। কিন্তু অন্য গ্রামগুলোর মতন দৃশ্য নয় আর এখানে উচ্চতার মাত্রা আগের চাইতে বেশী হওয়ায় অক্সিজেনের স্বল্পতায় ক্লান্তি আরও বেশী। তাপমাত্রা শূন্যের নিচে তো বটেই। একটা উচুঁ জায়গায় পৌঁছে দেখা মেলে ‘ডিংবোচে’, নামতে হবে, নিচে মাত্র কয়েকটি লজ, রুক্ষ পাথুরে জমিতে কোন গাছপালা কিছুই নেই। কয়েকটি তাবু আছে, যদি লজ এ অভিযাত্রীদের জায়গা না মেলে তবে তাঁবুতে হবে, আমি এই ঠান্ডায় তাবু বাসের এডভেঞ্চারে যেতে মোটেও আগ্রহী নই। পেশাল এর খোঁজে চোখ এদিক ওদিক ঘোরে। ঢুকতেই একটি লজে আগের রাতের সহযোগী জার্মান গ্রুপ এর সাথে দেখা, ওরা দূর থেকে হাত নাড়ে, আমি ভাবি পেশাল নিশ্চয় আমার জন্য আরও সুন্দর লজ খুঁজে রেখেছে। ঠান্ডার প্রকোপ আরও বাড়ছে, সাথে আছে বাতাসও। ক্লান্তি নিয়েও পেশালের ঠিক করা লজ-এ এসে মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। তার উপর এখানে উচ্চতার সাথে খাপ খাওয়াতে একদিন এ্যাকলাইমাইজেসন এই বালুময় বদ্ধ খুপরীতে কাটাতে হবে ভেবে বিষন্ন বোধ করি। তার চাইতে জার্মান দলের লজ অনেক সুন্দর ছিলো, আবার অতটা পথ ফিরে যাওয়ার কষ্ট মানতে চাইছি না কিন্তু একটা যুৎসই লজ এ তো উঠতে হবে। সামনের দিকে আর না এগিয়ে পেছনে ফেলে আসাগুলোর সন্ধানে নিজেই পা বাড়াই। খুম্বু লজ এ ঠাঁই মেলে ৪০০ রূপী ভাড়া। পছন্দের মূল কারণ, রুমগুলো একটু প্রসস্ত আর ডাইনিং হলটা চমৎকার। ওয়েলেস-এর আঠাশ রমণীর দলটিও এখানে উঠেছে, বোধহয় ঐ দলের একজন পুরুষ বাদে আমি আছি। প্রথমে হোটেলের ম্যানেজারকে রূঢ় মনে হলেও পরে যথেষ্ট বন্ধুবৎসল মনে হলো। শুধু সামান্য একটু মানসিক সমস্যা যে, এ উপমহাদেশের মানুষরা বিত্তবান বা বিত্তহীন সাদা চামড়া দেখলে তাদেরকেই বেশী প্রাধান্য দেন। রুমটি পরিচ্ছন্ন বেশ, তবে শীত কমছে না আমার। দ্রুত পোশাক পাল্টে একটু ফ্রেশ হয়ে ডাউন জ্যাকেট গায়ে দিয়ে ডাইনিং হলের উষ্ণতার আহবানে দ্রুত চলে আসি। চুল্লীর চারিদিক ঘিরে নারীদল কোলাহলে মত্ত, ঠাঁই হয় না আমার। রাতের খাবারের অর্ডার করে দেই।
কেমন অসীম বিষন্নতায় সন্ধ্যা নামে ‘ডিংবোচে’ তে। ডাইনিং হলের চারদিকে কাঁচে ঘেরা রুমে কেমন যেন মনটা খারাপ হয়ে ওঠে। আরও একটি কারণ, এখানে সম্পূর্ণ যোগাযোগহীন, মোবাইল ফোন কাজ করে না। অতি উচ্চমূল্যে পাবলিক ফোন ব্যবহার করা যায় কিন্তু বাইরে বেরিয়ে তাও কষ্টকর। সন্ধ্যার অন্ধকার জেঁকে বসার আগেই আমার খাবার প্রস্তুত। কর্ণস্যুপ সাথে পিৎজা! এই বিরান ভূমিতে অতি উচ্চতায় এমন চমৎকার পিৎজা হতে পারে আমার কল্পনায়ও ছিলো না। দেশে ফিরে সব দামী পিৎজার দোকানগুলোয় খাওয়া বন্ধ করে দেব। পেশাল কে পিৎজার টুকরো একটা এগিয়ে দেয়াতে খুবই কৃতজ্ঞ অনুভব করলো। যদিও এদের উপার্জন মন্দ নয় কিন্তু এমন খাওয়া শুধু দেখে যায়, চেখে দেখার সুযোগ হয় না বোধ হয়। সাদা চামড়ার পরিব্রাজকরা ভাবতে পারে না যে ভাগাভাগি করে এক পাত্রে খাবার খাওয়া যায়। পোর্টার গাইড-এদের প্রতিদিনের খাওয়া ঐ ডাল ভাতই দুপুরে বা সকালে ভেজিটেবল স্যুপ অথবা নুডুলস। আগেই বলেছি তাদের কাছ থেকে খাবারের দাম রেয়াতী হারে নেয়া হয় এবং থাকার জন্য কোন পয়সা দিতে হয় না। যেহেতু এরা পরিব্রাজকদের লজ এ নিয়ে আসে। পরিব্রাজকরা উচ্চ মূল্যে খাদ্যদ্রব্য কেনে। নইলে এদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠতো। খাওয়া শেষে আবার নারীদের উচ্চকিত আলাপে বিরক্তই বোধ করি। চাঁদের আলো উঁকি দিচ্ছে, ক্যামেরা হাতে বাইরে গিয়ে দেখি আলোও আছে। চাঁদ পাহাড়ের আড়ালে। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বিমোহিত হয়ে পড়ি তারার মেলায়।
এমন বিপুল তারকারাজী কখনোই দেখিনি। কি তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল! যেন হাত বাড়িয়ে ধরা যাবে। পূবের আকাশে ধ্রুবতারা দেখে তো আমার মনে হলো ষ্টিমারের লাইট জ্বালানো হয়েছে। তীব্র শীত আমার বিমোহিত অনুভবে ব্যঘাত ঘটায়, ছবি উঠানো ঠিকমতো হয় না। দ্রুত রুমে ফিরে আসি। কাল যেহেতু বিশ্রাম তাই ভাবি রাত জাগলে ক্ষতি কি? মোবাইল ফোনে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনি। এখানে প্রতি ঘন্টা ফোন চার্জ করতে নুন্যতম ৫০০ টাকা লাগবে। আমার সুবিধা আর তেমন কোন গ্যাজেট নেই, ক্যামেরা ছাড়া। অন্য সব পরিব্রাজকদের কত রকমের যন্ত্রপাতি। মজা লেগেছে ব্যাগ এর গায়ে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন যন্ত্র যা দিয়ে তারা ফোন, কম্পিউটার, ক্যামেরা, আইপড র্চাজ দিচ্ছে।
সবাই পথে চমৎকার আইপডে গান শুনছে। ‘ডিংবোচে’- তে ইন্টারনেট আছে তবে ৩০ মিনিট এর খরচ ৫০০ রূপীর উপর, ওয়েলেস-এর দল দেখলাম ইন্টারনেট ছাড়া রাতে ঘুম হবে কি হবে না এই আলাপচারিতায় মগ্ন ছিল। আমার রুম পরিচ্ছন্ন হলেও কাঠের জানালার ফাঁক গলে হু হু করে হিম শীতল বাতাস ঠেকানোর কোন উপায় নেই। পর্দা দিয়ে যতটা রক্ষা। স্লিপিং ব্যাগ এর ভেতর ঢুকে তার উপর দুটো কম্বল চাপিয়ে ঘুম, মাঝ রাতে একটা দম বন্ধ করা অনুভবে ঘুম ভেঙে গেলো। ঘর বেশ গরম আমি অবাক হলাম। পানি পিপাসা লেগেছে, ফ্লাক্সেও গরম পানির সাথে ঠান্ডা পানি মেশাতে গিয়ে দেখি আমার পানির কৌটা খুলছে না। ঝাঁকি দিলে বুঝলাম পুরোটাই বরফ হয়ে আছে। আর জানালায় যতটুকু ফাঁক ফোকর ছিলো তা একেবারে সিলগালা বরফের আচ্ছাদনে। দরজা খুলে করিডোর থেকে অক্সিজেন ঢোকাই কিছুটা। বাথরুমে যাবার সময় টের পাই কি ভীষণ ঠান্ডা বাইরে। এমন দুর্বিষহ প্রতিকূল পরিবেশে অধিক ঠান্ডা যন্ত্রণার মাত্রা বাড়ায়। একটা সুন্দর সকালের প্রত্যাশায় আবার ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে ঘুম ভাঙলো দেরীতে, সূর্য অনেক উপরে উঠে গেছে। এভারেষ্ট বেইস ক্যাম্পের পথে এটাই শেষ একলাইমেজেশন পয়েন্ট আমার জন্য। এর আগ পর্যন্ত গাছপালা ছিলো, এখানে পুরোটাই ন্যাড়া পাহাড় আর বরফে মোড়া চূড়া। ‘ডিংবোচে’ চুখুং ভ্যালীতে অবস্থিত ছোট পরিসরের গ্রাম। দোকান পাট নেই বললেই চলে। এই ট্রেকিং পথে ফোনের নেটওর্য়াক শুধু এই গ্রামে এসেই যেন হোঁচট খেয়েছে।
নাস্তা খেয়ে আশেপাশে ঘুরে বেড়াবো বলে বের হলাম, গতদিনের মত রৌদ্রজ্জ্বল দিন নয়। কেমন মন খারাপ করা মেঘলা দিন আজ। প্রায় গায়ের উপর এসে পরেছে আমাদাবালাম চূড়া। সামনেই ইমজা পর্বত। এতো কাছে মনে হয় সব ডিংবোচে থেকে। গ্রামের মাঝ দিয়ে যে নালাটা কাল বিকেলে বয়ে যেতে দেখেছিলাম কলকল শব্দে। আজ শব্দ নেই পুরোটাই বরফ হয়ে গেছে। পাশেই স্রোতবিহীন ইমজা খোলা। যা পরবর্তীতে দুধ কোশীতে রূপান্তরিত। খুম্বু গ্রেসিয়ার গলে লবুচে নদীতে পড়ে, সেখান থেকে দক্ষিণ দিকে ইমজা খোলা এসে প্রবাহিত হয়ে থ্যাংবোচতে দুধ কোশীতে মিশেছে। ইমজা খোলা ডিংবোচে ভ্যালীর মাঝ দিয়ে ইমজা গ্লেসিয়ারে গলা বরফও মিশেছে ইমজা খোলায়। গ্রামের মাঝেই বিরান ক্ষেত পাথরের আড়াল করা। হয়তো বছরের কোন এক সময় ইমজা খোলার পানিতে এখানে কিছু ফলানো হয়। আমার উড়োজাহাজের সঙ্গী জেসান এই ইমজা সে বা আইল্যান্ড পিক জয় করতেই এখানে এসেছে। কয়েক পা এগুতেই গ্রাম শেষ। পুরোটাই পরিব্রাজক নির্ভর। গ্রামটির সামনেই চুখুং ভ্যালী। লোৎসে আর লুপুৎসের দক্ষিণের ঢালে এই ভ্যালী। লো আর নুপ গ্লেসিয়ার দ্বারা সৃষ্ট আর পশ্চিম ঢাল চো পলু এবং বারুন্ৎসে ইমজা গ্লেসিয়রে সৃষ্ট। উত্তরের ঢাল আমা দাবালাম-এ এবং আমা দাবালামও চুখুং গ্লেসিয়ারে সৃষ্ট। চুখুং রি একটি রিজ (১৮১৯৬ ফুট) ৫৫৪৬ মি. উচ্চতায় চুখুং ভ্যালীর উপরে লোৎসে পর্বতের উত্তর দিকে অবস্থিত। চুখুং গ্রাম ৪৭৩০ মি: উচ্চতায় অবস্থিত। ওখানে এই দূর্গম প্রান্তর পেড়িয়ে যাবার আশা চাপা দিয়ে রাখায় শ্রেয়। ডিংবোচে-তে যে পরিমাণ প্রায় সমতল জায়গা দৃশ্যমান তাতে এটি লুকলার চাইতে আরও ভালো এয়ারপোর্ট হতে পারতো কিন্তু এই দূর্গম অঞ্চলে সব পর্যটক বাণিজ্য বন্ধ করে এখানে এয়ারর্পোট নির্মাণ যৌক্তিক নয়, অথবা আমার দৃষ্টিতে যা প্রায় সমতল তা এয়ারর্পোটে রূপ দেবার সামর্থ্য নেপাল সরকারের নাই হয়তো। এখানে হেলিপ্যাড আছে। এবং আমার চাইতেও দুর্বলতম মানুষ যে বহু আছে, তাদের ইভাকুয়েট করতে অহরহ নামছে উঠছে হেলিকপ্টার। অত্যন্ত চড়া দামে গরম পানির গোসল ক্লান্তি সব মুছে দিলো। আগেই বলেছি ওয়েলেস-এর মহিলা গ্রুপ উঠেছে এই হোটেলে, আর শেয়ারড বাথরুমের সামনে লাইন আর তাদের হা হা হি হি তে একটু বেশী সময় আরাম করে গরম পানিতে নিজেকে ভেজানোর সুযোগ মিললো না। আবার কবে গোসলের সুযোগ পাবো কে জানে! দিন কোথা দিয়ে চলে গেল টেরই পেলাম না। বড্ড বিষণ্ন দিন ছিল আজ, জানা নেই এমন অধিক উচ্চতায় এটাই স্বাভাবিক কিনা? তবে ডিংবোচের পরিবেশ আর উচ্চতা আমাকে অন্য সব পর্বত থেকে ভিন্ন অভিজ্ঞতা দিলো দিনভর।
মেঘলা দিন, সব পানি বরফ হয়ে যাওয়া হীম আর নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা পুরোপুরি। দিনভর প্রচন্ড হাওয়া ছিলো। সূর্য দেখা না গেলেও আশে পাশের সব পর্বতমালা ষ্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। গতকালের সন্ধ্যার কথা মনে পড়লো কি অদ্ভূত সুন্দর আকাশ পেয়েছিলাম আমা দাবালামের কোলে। বাইরের হিম শীতল হাওয়া থেকে বাঁচতে আশ্রয় উষ্ণ ডাইনিং হল এ। ইয়াক এর গোবরে এর সুন্দর ব্যবহার কোন কালী ধোয়া নেই কিন্তু চমৎকার উষ্ণতা ছড়ায়। মাঝে মাঝেই ডাউন জ্যাকেট খুলে ফেলতে ইচ্ছে হয় উষ্ণতার দাপটে। একটু আগে ডাইনিং হলে চলে আসার সুবিধা হল সুবিধাজনক জায়গায় বসবার সুযোগ। আজও চমৎকার খাবার জুটলো গরম গরম। বাইরে তাকালেই বোঝা গেলো দিনের আলো নিভে যাবার সাথে সাথে কি প্রকান্ড হিমশীতল রাত ধরণীর বুকে নেমে আসছে। খাওয়া শেষে বাইরে এসে দেখলাম চমৎকার তারার মেলা। তারার আলোয় আমাদাবালাম মোহনীর রূপে সুউচ্চ হয়ে আছে। ঝটপট কয়েকটা ছবি তুলে, ঠান্ডার দাপট আর ঝড়ো বাতাসের ঝাপটায় দ্রুত ফিরে এলাম রুমে। সারাদিনের বিশ্রাম শরীর ক্লান্ত নয় আজ, তাই আটটায় ঘুম আসার সুযোগ নেই। গান শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে গেছি মনে পড়ছে না। খুব সকালে আমার পোর্টার পেশালের ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো। পেশাল জানালো আজ যাত্রা মোটেও কঠিন কিছু নয়, আশ্বস্ত হতে পারলাম না। তবু দ্রুততায় সকালের নাস্তা সেরে নিই বিদায় জানাই খুম্বু লজ এর ম্যানেজারকে। ডিংবোচে পার হতে একটা ছোট পাহাড়। তারপর প্রায় সমতল ভূমি কিন্তু ঐ ছোট পাহাড় এই উচ্চতায় দম বন্ধ করা অনুভব উপহার ছিলো। পাহাড়ের চূড়ায় উঠেই কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম, নেমে এলাম দ্রুত, কোন রাস্তায় চিহ্ন নেই পাথরের গায়ে পা দিয়ে দিয়ে। একটু সাবধানে নামতে হয়। বরফের গুড়ো গলে পিছল হয়ে রয়েছে। তারপর হাঁটা সহজই হলো কিন্তু দূরত্ব অতিক্রম করা সহজ নয় এমন অধিক উচ্চতা বা অলটিচিউড এ। বাঁয়ে নিচে দেখা যাচ্ছে একটা গ্রাম জানলাম ওটা ফেরিচে যেখানে এ অঞ্চলের মধ্যে সবচাইতে ভালো হাসপাতাল আছে, পর্বতারোহী ও অভিযাত্রীদের চিকিৎসায়। পথে আজ প্যাটেল বাবুর সাথে দেখা বিশ্রামের ফাঁকে আড্ডা জমে উঠলো বেশ। চারপাশে বরফে মোড়া পাহাড় ঘিরে আছে। আমি জীবনে কখনো অ্যাভালাঞ্জ দেখিনি, ফেরিচের ওপারে নাম না জানা পাহাড়ের গা থেকে বিশাল বরফের চাই বিকট শব্দে গড়িয়ে পড়ছে, স্তম্ভিত হয়ে এতটাই অবাক হয়ে দেখছিলাম যে ক্যামেরা বের করার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। তবে দৃষ্টি জুড়ালো জীবনের প্রথম অ্যাভালাঞ্জ দেখে। এপথে বিশ্রামের আর কোন জায়গা নেই পরবর্তী গন্তব্য ধুকলা যেখানে একটি খাবারের জায়গা ও থাকার লজ আছে। আমি ধুকলায় থাকবো না। দুপুরের খাবার খাবো নির্দিষ্ট করলাম। এই প্রায় সমতল প্রান্তরেও অল্প হেঁটেও বেশ ক্ষিধে পেয়ে গেছে আজ। পথের চারপাশের দৃশ্য এই পৃথিবীর কোন অংশের মনে হয় না। বিশালতার অন্য রকম মানে চারপাশে তাকিয়ে খুঁজে পাই আমি এখানে। বেশ কিছু ছবি তুলে ফেলি তারপর আবার হাঁটা ধরি সমতল অংশ শেষ এখন নিচে নামা। দূরের একটি অংশে দু-তিনটি ঘর দেখা যায় পোর্টার পেশাল জানায় ওটা ধুকলা। অনেক নিচে একটা ষ্টীলের ব্রিজ চোখে পড়ে। ব্রীজ মানেই মারাত্বক কিছু চড়াই আর উৎরাই। অনেক খানি নিচে নেমে এসে ব্রীজের উপর দাঁড়াই। বরফ গলে পানি সজোড়ে ছুটছে অদ্ভূত দৃশ্য। পরে বুঝলাম সুবিশাল খুম্বু গ্লেসিয়ার এই প্রান্তে এসে পানিতে পরিণত হয়ে বেশ কটি নদীতে তা যোগান দিচ্ছে। সামনের রেস্তোরাটি আমার পরবর্তী আস্তানা, বহু মানুষের আনাগোনা, আজ অপেক্ষাকৃত কম ক্লান্তিকর ভ্রমণ এ পর্যন্ত। কিন্তু ষ্টীলের ব্রীজ পেড়িয়ে সামান্য উঠতেই ভয়াবহ ক্লান্তি ধরে এলো। খোলা জায়গায়ই বসে পড়লাম, নুডুলস স্যুপ অর্ডার করলাম উজ্জ্বল রৌদ্দুর আর পরিশ্রম ঠান্ডা দমিয়ে রেখেছে। ডাউন জ্যাকেট খুলে পেশালকে ব্যাগে ঢোকাতে বলি। আকাশ অনেক পরিষ্কার আর শীতের তীব্রতা কম হওয়ায় চাঙ্গা বোধকরি, আর এখান থেকে বেড়িয়ে এবড়ো থেবড়ো উঁচু উঁচু বোল্ডায়ে ভরা পাহাড় পেড়িয়ে তারপর উপত্যকা ধরে যেতে হবে আজকের গন্তব্যস্থল ‘লবুচে’। খাওয়া দাওয়া করে চাঙ্গা অনুভব করি।
দূর থেকে দেখি বহু মানুষ বোল্ডায় পেড়িয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, আমি একটু এগিয়েই টের পাই বড় কষ্টকর কাজ এটা, শেরপারা একরকম দৌড়ে পেড়িয়ে যাচ্ছে। আমার বহু ক্লান্তির সময় গড়িয়েও পার হওয়া হয় না, উজ্জ্বল রৌদ্দুর হঠাৎ মিলিয়ে গিয়ে মেঘলা হয়ে পড়ে। পেশাল কে আগেই বলে দিয়েছি ও যাতে আগে পৌঁছে আমার জন্য লজে একটা রুমের ব্যবস্থা করে। এত লোকজন যাচ্ছে, লজই আছে মাত্র তিন-চারটি তারপর এই হিমশীতল প্রান্তরে তাবুতেই থাকতে হবে নইলে। ইতোমধ্যে আকাশ আরও ঘন কালো হয়ে এলো আমার চূড়ায় ওঠা হলো না ক্লান্তিকে পরাজিত করে। আশেপাশের মানুষ জন কমে গেলো। চূড়ায় উঠে বেশ সমতল আর প্রার্থনা স্তম্ভ চোখে পড়লো, কাছে গিয়ে দেখি আসলে সব কবর, এই জনবিরল স্থানে মৃতদের স্মরণে লোকগাঁথা খোদিত, মনটা কেমন জানি বিষণ্ন করে দিলো হঠাৎ। কত কত অভিযাত্রীর মৃত্যুর পর এখানে এনে পাথরের মাঝে সমাহিত করা হয়েছে, যে রকম শীতল পরিবেশ হয়তো দেহ গলে পঁচে যায়নি। এপিটাফ এ এলিজিগুলো বড্ড বিষণ্ন। পাহাড়ে অসুস্থতা সম্পর্কে দেখলাম সবাই খুব কথাবার্তা বলে। AMS-একিউট মাউন্টেন সিকনেস অথবা অলিটিচিউড সিকনেস দুর্গম পাহাড়ে ভয়াবহ বিপর্যয় যে কোন অভিযাত্রীর জন্য। এভারেষ্ট অঞ্চলে হেলিকপ্টার ইভাক্যুয়েশান যা প্রায় ৮,০০০ মার্কিন ডলার খসিয়ে দেবে। এখানে বেশীরভাগ কবরের মৃত্যুর কারণ দুর্ঘটনা ও AMS২৪০০ মিটার বা ৮০০০ ফুট উচ্চতার উপরে থেকে সাধারণত AMSএর সূচনা হয়। তবে কার হতে পারে এবং কেন হয় তা নির্ধারণ সহজ নয়। এটি একটি প্যাথলজিক্যাল প্রতিক্রিয়া মানব দেহে যা অধিক উচ্চতায় অক্সিজেনের স্বল্পতায় হয়ে থাকে। তবে কে কখন আক্রান্ত হবে এবং কোন কোন উপসর্গ দেখা যাবে তা পূর্বনিধারিত নয়। তবে ফ্লু বা জ্বর, প্রচন্ড মাথা ব্যাথা, কার্বণ মনোঅক্সাইড পয়জনিং, হ্যাংওভার জাতীয় বিষয়াদি বেশী হয়।AMS এর পরবর্তী ধাপ ভয়াবহ যেটা ‘হাই অলটিচিউড পালমোনারি এডিমা’ (HAPE) অথবা ‘হাই অলটিচিউড সেরিব্রাল এডিমা’ (HAPE) এ আক্রান্ত করে, যা মৃত্যু পর্যন্ত গড়ায়। ক্রণিক মাউন্টেন সিকনেস (CMS) দীর্ঘদিন অধিক উচ্চতায় (অলটিচিউচ) এ থাকলে ঘটে থাকে। উইকিপিডিয়াতে অলটিচিউড কে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। হাই অলটিচিউড: ৫০০০-১১৫০০ ফুট (১৫০০-৩৫০০ মিটার) এই অলটিচিউড এ অসুস্থতার মূল কারণ মানুষ খুব দ্রুততায় ৮০০০ ফুট থেকে ১১৫০০ ফুটে উঠে যায় যা অক্সিজেন স্বল্পতা আর উচ্চতায় মানবদেহে অসুস্থতা তৈরী করে। ভেরি হাই অলটিচিউড: ১১৫০০-১৮৫০০ ফুট (৩৫০০-৫৫০০ মিটার) এই উচ্চতায় এক্সট্রিম হাইপসোমিয়া হতে পারে, শারিরীক সঞ্চালনায়, ঘুমের মধ্যে এবং পালমোনারী এডিমা ও ফুসফুসের সংক্রমণ ঘটতে পারে, এই উচ্চতায় অগঝ-ভয়াবহ আকার ধারণ করে থাকে। এক্সট্রিম অলটিচিউড ১৮০০০ ফুট এর উপরে (৫,৫০০ মিটার) নানা রকম জটিল মৃত্যু আনয়নকারী উপসর্গে পড়তে হয়। ১৮০০০ ফুট উচ্চতায় উপরে কোন স্থায়ী জনবসতী নেই। আমরা যারা সমতলের মানুষ তাদের AMS বা একিউট মাউন্টেন সিকনেস এড়ানোর কতগুলো প্রক্রিয়া আছে তা যথাযথভাবে পালন করলে বেইস ক্যাম্প পর্যন্ত কোন ঝামেলা ছাড়াই ঘুরে আসা যায়। র্যাপিড একসেন্ট বা দ্রুত উচ্চতম জায়গায় যা একবারে ২৫০০ ফুট পর্যন্ত বা বেশী হলে অবশ্যই শরীরের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য বিশ্রাম প্রয়োজন। ডায়ামক্স নামক (এক্টাজোলামাইড) ঔষুধটি ৫০০ সম যা এদেশে এসিমক্স তা নিয়ম করে প্রতিদিন খেতে হবে সাথে প্রচুর পানি। দুটো কারণে প্রচুর পানি খেতে হবে: ডায়ামক্স শরীর থেকে পানি বের করে দেয় আর অধিক উচ্চতায় অক্সিজেন স্বল্পতায় ফুসফুসের স্বভাবিক কাজকর্মে পানি ক্ষরণের জন্য অধিক পানি লাগে।
[চলবে]
মারুফ কবিরের সব লেখা ও এই ধারাবাহিকের আগের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন।
কবি, অভিনয়শিল্পী।