Categories
‘কার্মা’-র ফাঁদে
আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট
নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটানে এটা আমার পঞ্চম বছর। আমার পাড়ায় এই বসন্তেও চেরী ব্লসম ফুটেছিলো, খালি আমি ব্যস্ত ছিলাম ঈশ্বরকে ডাকতে যাতে আমার ঋতু-পরিবর্তনকালে হওয়া ইনফ্লুয়েঞ্জাটা কোভিড না হয়, যাতে ভারতে আমার পাড়ার ওপর দিয়ে ছুটে যাওয়া আম্ফানে আমার পরিবার সুস্থ থাকে, জীবিত থাকে, যাতে আমার ভারতের বাড়ী অক্ষত থাকে! লকডাউনে বাড়ির বাইরে পা রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। মুখে মাস্ক পরে আর যাই হোক সেলফি তোলা যায়না! তাই এবছরে ফোনের মেমোরি ভ’রে শুধুই ছাদ থেকে বা বাড়ির ঠিক নিচের রাস্তায় ফোটা চেরি ব্লসম আর টিউলিপের ছবি।
২০১৯-এর শেষেই পৃথিবীতে কোরোনার নাম জানা গেছিলো। শুরুর দিন থেকেই ২০২০ সালের একটা একটা করে দিন আমাদের মুখের হাসি একটু একটু করে শুকিয়ে নিয়েছে! একজন একজন করে অপরিচিত, স্বল্প পরিচিত অথবা পরিচিতের মৃত্যুর ওপরে বসে আমরা নিজেদের ভোলাতে ভোলাতে ছয়-ছয়টা মাস পার করে সেদিন পা রেখেছিলাম বিশ্ব পরিবেশ দিবসে। বছরের পর বছর ধরে বিশ্বজুড়ে পরিবেশকে নিতান্ত অজ্ঞানের মতো, অবিবেচকের মতো, অর্বাচীনের মতো আমরাই তো ক্ষতবিক্ষত করেছি। পরিবেশ আজ ফণা তুলে ছোবল দিয়ে কিছু জায়গাকে মুছে দিয়েছে, কিছু আবর্জনা সাফ করেছে, নিয়ন্ত্রণ ফেরাচ্ছে কোথাও – মানুষকেই গৃহবন্দী করে দিয়ে।
মনে পড়ে নচিকেতার সেই বিখ্যাত গান – বৃদ্ধাশ্রম? টগবগে যুবকরক্ত মাঝেমাঝে ভুলে যায় কখন কোথায় থামতে হয়! অযত্নের চূড়ান্ত সময়ে প্রকৃতি-মা মানুষকে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে মায়েরও যত্ন প্রয়োজন, বিশ্রাম প্রয়োজন। কিন্তু এসব তো কেতাবী কথা! যখন আম্ফান বা নিসর্গ আছড়ে পড়ার পূর্বাভাস আসে, আমি কি স্বার্থপরের মতো বলি না, হাওয়াটা অন্যদিকে ঘুরে যাক! যখন টের পাই আর আধ ঘন্টায় ঘূর্ণিঝড় আছড়াবে আমার পাড়ায়, আমি কি স্বার্থপরের মতো প্রার্থনা করি না, যাতে আমার বাড়ির ছাদটুকু বেঁচে যায়! মজার কথা হলো, পাহাড় ফাটিয়ে রেললাইন বানানোর সময়, জঙ্গল পুড়িয়ে সভ্যতা বানানোর সময় বা নদী বুজিয়ে হোটেল বানানোর সময় আমাদের মনেও পরে না সেসব।
অনেক তো হলো! ছয়মাস তো অনেকটা সময়! চেতনা কি হয়নি এখনো? ধ্বংস, মৃত্যু, অতিমারী, দাবানল, ঘূর্ণিঝড় – নিজেকে কি এখনো দেখে ‘উলঙ্গ রাজা’-র কথা মনে পড়ছে না! কোনো দেশের কোনো প্রশাসনকেই কোনো ব্যক্তিগত আক্রমণ এমনকি কোনো বক্রোক্তি করার কোনো ইচ্ছে, উদ্দেশ্য বা শক্তি নেই আজ, কারণ যে সুদীর্ঘকালব্যাপী স্বেচ্ছাচারে গতির পেছনে ছুটে মানুষ যত ক্ষত ডেকে এনেছে, তা কোনো একটা দেশের একটা সময়কালের একটা প্রশাসনের দায় হতেই পারে না। এ ধ্বংস হলো মানুষের ডেকে আনা সম্মিলিত ধ্বংস! কিন্তু চেতনা টা? সেটা তো আনতে হবে কাউকে না কাউকেই! কোনো একজন পথিকৃৎকে আজ বড্ড দরকার!
ঠিক যেমন রোজ একটা একটা করে দিনে আমাদের একটু একটু করে বয়স বাড়ে, কিন্তু আমরা বয়স বাড়ার উদযাপনটা করি জন্মদিনে, তেমনি করেই ফাদার্স ডে, মাদার্স ডে, ফ্রেন্ডশিপ ডে, ভ্যালেন্টাইন্স ডে বা বিশ্ব পরিবেশ দিবসের মতো কিছু মানুষের কাছে আপাত নিরর্থক “আদিখ্যেতা” পরিপূর্ণ এই দিনগুলিও ঠিক তেমন করেই আলাদা করে বাবাকে, মাকে, বন্ধুকে, ভালোবাসার মানুষটিকে বা পরিবেশকে ভালোবাসার দিন নয়, শুধুমাত্র সেই ভালোবাসাটুকু যাপন করার দিন! আসুন না, আজ আমরা একটা দিন ঠিক করি, নাম দিই ‘কার্মা দিবস’! দীপাবলিতে সবাইমিলে একটা করে প্রদীপ জ্বালানোর মতোই এই দিনে সবাইমিলে একটা করে গাছ কাটা বন্ধ করি! কারণ পরিবেশ দিবসে সবাই গাছ লাগালে কিছু না হওয়ার চেয়ে অন্ততঃ কিছু হয়! কিন্তু মুশকিল হলো একটা করে চারাগাছ লাগানোর পর যদি বন-কে-বন জ্বালানোর বন্দোবস্ত করা হয়, তাহলে কি উপায়? আর কবে চেতনা হবে?
ভেনিসের গন্ডোলার চাপে হারানো জলজ প্রাণী, গ্রিসের রাস্তায় হেঁটে বেড়ানো পাখি, সমুদ্রে খেলে বেড়ানো ডলফিনের মতো মানুষের অত্যাচারে অত্যাচারিত একজন সাধারণ ভীত ও সন্ত্রস্ত মানুষ হয়ে এই কলমটুকুই সম্বল করে নিলাম তাই। এবারে তো শান্ত হোক সব! পৃথিবীটা ‘আদিম’ হোক, ‘ব্যালান্সড’ হোক, ইকোসিস্টেমটা রক্ষা পাক, আর রক্ষা পাক সুন্দরবন ও সুখী গৃহকোণ।
একদম অন্যরকম প্রার্থনা দিয়ে হোক কার্মা দিবসের উদযাপন।
Doctoral Researcher and Adjunct Professor
Department of Physics and Astronomy
City University of New York