ইরানী গল্প: আমার মা, কাঁচের আড়ালে । ফারিবা ভাফি
অনুবাদ: ফজল হাসান
আমার বোন আশরাফকে বলেছি আমি বই আনতে বাড়ি যাবো। আসলে সেদিন আমি মিথ্যা বলেছিলাম। আমি যদি বলতাম অ্যালবাম থেকে মায়ের ছবি আনতে যাবো, তাহলে সে আমাকে যেতে দিত না। বরং মুখটা বিকৃত করে সে আমাকে ভর্ৎসনা করতো। আমার মা তার বাবার স্ত্রী।
মা বন্দি হওয়ার পর থেকে আশরাফ আমার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে চায় না।
মাকে যেদিন ধরে নিয়ে যায়, সেদিন আশরাফ আমাদের বাড়িতে এসেছিল। আমার হাত ধরে রীতিমত জোর করে সে আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যায় । কিন্তু সে মুখ ফুটে কোন কথা বলেনি।
আমি বললাম, ‘মায়ের খবর কী?’
আমার প্রশ্ন শুনে আশরাফের চোখ দু’টি সংকুচিত হয়ে যায়। আমার প্রতি যখন তার মনের ভেতর সমবেদনা জন্মায়, তখন সে ঠিক একই রকম ভাবে চোখ ছোট করে।
‘তুমি এখন বড় হয়েছ। মাকে তোমার দরকার নেই ।’
একসময় আশরাফের স্বামী ঘরে ঢোকে। আশরাফ একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। সত্যি বলতে কি, আমি তার স্বামীকে ঘৃণা করি। সে যেভাবে অন্যদের দিকে তাকায়, তা দেখলে সবাই অস্বস্তি এবং নিজের প্রতি লজ্জা বোধ করবে। তবে একথা সত্যি যে, আশরাফের দুষ্ট দু’ভাই মজিদ এবং মহীন না থাকলে কিছুতেই আমি সেখানে থাকতাম না। অবশ্য যাওয়ার মতো আমার অন্য কোন জায়গা নেই। আমার ভাই রেজা তেহরানে চলে গেছে। আমি বলি, ওই মহিলার জন্যই সে ঘর ছেড়েছে । আমি জানি না মহিলা কি এমন কথা বলেছে যে, রেজা এত বেশি রাগ করেছে। সেই সময় তাকে যদি কোন ধারাল ছুড়ি দিয়ে খোঁচা দেওয়া হতো, তাহলেও তার শরীর থেকে কোন রক্তপাত হতো না।
সেদিন আমার ভাই কোন কথা বলেনি। তার চোখমুখ যতটা লাল হওয়া সম্ভব ছিল, ঠিক ততটুকুই হয়েছে। তার বউয়ের ঘাড় সোজা এবং শক্ত ছিল। আমাদের দিকে যেভাবে সে তাকিয়েছিল, তা রীতিমত ন্যাক্কারজনক। মা ভয়ে ঘরের এক কোণায় জড়োসড়ো হয়ে ছিলেন এবং দৃষ্টির সীমানা ছেড়ে রেজার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আশরাফ দৌঁড়ে রেজার কাছে যায় এবং কাকুতি-মিনতি করে যেন সে চলে না যায় । কিন্তু আমার ভাই ভীষণ কড়া দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছিল এবং একসময় বললো, ‘আমার পথ থেকে সরে দাঁড়া।’
সত্যি বলতে কি, সেদিন রেজার কান্ডকাহিনী দেখে আমি ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। আমি চাইছিলাম আমাদের ছেড়ে সে অন্য কোথাও চলে যাক। আমি আদৌ ওর বউকে পছন্দ করতাম না। সবসময় সে মায়ের ভুলত্রুটি ধরতো। যখনই আমি স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে আসতাম, তখনই দেখতাম কোন কিছু নিয়ে তারা দু’জন তুমুল ঝগড়া করছে। রেজা সব সময়ই বউয়ের পক্ষে থাকতো। তার আপন মা যদি বেঁচে থাকতো, তাহলে কিছুতেই সে বউকে এত ঝগড়াটে হতে দিত না। সে চলে যাওয়ার সময় একবারও পেছন ফিরে মায়ের দিকে তাকায়নি। তারা সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে চলে গেছে। এবং তারপর আশরাফও চলে যায়। তখন আমি বুঝতে পেরেছি সবকিছু কত অসহনীয় ছিল । সারা বাড়ির পরিবেশ বদলে যায়। সেটা ছিল খুবই খারাপ অবস্থা।
মা মাথা তোলেন। একসময় তিনি বললেন, ‘গোল্লায় যাক। ওদের যেতে দে।’
বলেই তিনি উঠে দাঁড়ান। তারপর ঘরদোর গোছগাছ করে সুনসান করেন। তিনি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি ছিলেন অসুখী। আমি জানতাম। আমি উঠানে যাই। একসময় ফিরে এসে দেখি মায়ের চোখ লাল। আড়ালে-আবডালে মা কাঁদতেন। কেননা মায়ের মনে হতো পাছে কেউ তার চোখে অশ্রু দেখে ফেলে, তাহলে তিনি লজ্জা পাবেন। কিন্তু আমি তার চোখে অশ্রুকণা দেখেছি। সেই কাঁচের আড়াল থেকে। হ্যাঁ … সেখানে …। আমি যখন উপর দিকে তাকিয়েছি, তখন মায়ের টলোমলো চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু জমেছিল, এমনকি চোখের নিচের ভাঁজ এবং সরু কালো দাগ দেখেছি।
মা যখন বাইরে যেতে ইচ্ছা করতেন, তখন নিজেকে তৈরি করার জন্য তিনি এক ঘন্টা ব্যয় করেন। হ্যাঁ, পুরো এক ঘন্টা তিনি আয়নার সামনে বসে সাজসজ্জা করেন। ভাবসাব এমন যেন তিনি কোন বিয়ে বাড়িতে যাচ্ছেন। অনেক সময় তিনি সারা মুখে শশার খোসা লাগিয়ে রাখেন। তখন আমার খুব হাসি পায়। মুখের সাজগোজ শেষ করে তিনি চোখ এবং ভুরুর প্রতি ব্যস্ত হন। মায়ের চোখ দু’টি আয়ত এবং কোন বিশেষ কারণে তা আর্দ্র থাকে। তার আইলেশ দীর্ঘ। যখন তিনি দু’চোখে আইলাইনার ব্যবহার করেন, তখন তাকে দেখতে খুবই সুন্দর দেখায়। তারপর ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক লাগান এবং আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের সৌন্দর্য্য অবলোকন করে আপনমনে হাসেন। সাজসজ্জা শেষ করে তিনি পোশাক পরিধান করেন এবং সারা গায়ে সুগন্ধি ব্যবহার করেন। সেই সময় আমি প্রায় দৌঁড়ে তার কাছে যাই। তিনি আমার পড়নের জামায় খানিকটা সুগন্ধি লাগিয়ে দেন। তারপর তিনি বাইরে বেরিয়ে যান।
বাবার মৃত্যুর পর থেকে মা অনেক সময় একাকী কাটিয়েছেন। তিনি একের পর এক বিভিন্ন ধরনের পার্টিতে যেতেন। তখন মায়ের ভাবখানা এমন ছিল যেন বাবা বেঁচে থাকার দিনগুলোতে তিনি যে বাইরে যেতে পারেননি, তা কড়ায়-গন্ডায় পুষিয়ে নিচ্ছেন। বাবা বেঁচে থাকার সময় মাকে কোথাও যেতে দেননি। আমি তার কারণ জানি না। কিন্তু একদিন বাবা মুদি দোকানের মালিক ইউসুফের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে মাকে কথা বলতে দেখেছিলেন। এখনো আমার মনে আছে সেদিন বাবা মাকে কি করেছিলেন। বাবা কোমড়ের বেল্ট খুলে মাকে ভীষণ মেরেছিলেন। মা শুধু চিৎকার করে কেঁদেছিলেন।
বাবার বয়স হয়ে গেছে এবং মা যখন তাকে অভিশাপ দিতেন, তখন বাবা রাগান্বিত হয়ে আরও জোরে তাকে প্রহার করতেন। এ ভাবেই একদিন বাবা অসুস্থ হয়ে মারা যান। হায় খোদা, সে-টা আমাদের জন্য খুবই খারাপ সময় ছিল। অন্যদের মতো মা-ও বিলাপ করে কেঁদেছেন। আমি জানি, মা আসলে ততবেশি দুঃখ-শোকে কাঁদেননি। আসলে মা কোনদিনই বাবাকে পছন্দ করতেন না। তিনি নিজেকে তাই বলতেন। বরং আমার মা তাঁর বাবা-মাকে দোষারূপ করে অভিশম্পাত দিতেন। তারাই তাঁকে দুঃসহ জীবনের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। আমি জানি, মা তাদের অন্তর থেকে কখনই অভিশাপ দেননি। আমি দেখেছি, মা গোপনে ঘর থেকে অনেক জিনিস তাঁর মা-বাবার জন্য নিয়ে যেতেন। যেমন রান্নার তেল, চাউল …। এছাড়া মা প্রতি নতুন বছরে তাদের কাছে টাকা পাঠাতেন। সেই টাকা দিয়ে তারা আমার জন্য উপহার কিনতেন। কখনো মা তাদের বিভিন্ন জিনিস উপঢৌকন হিসাবে পাঠাতেন। আমি দেখে দেখে এসব কিছু শিখেছি।
একবার বাবার প্রথম স্ত্রী এমন এক অদ্ভূত কান্ড করেছিল যে, তা কেউ বিশ্বাস করবে না। ঝগড়ার মাঝে তারা একে অপরকে অভিশাপ দিয়েছিল, এমনকি চুলাচুলিও করেছিল। ভীষণ ঝগড়া হয়েছিল। বাবার সেই স্ত্রী এবং মায়ের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। ভয়ে বাবার প্রথম স্ত্রীর ক্যানসার ধরা পরে এবং একদিন তিনি মারা যান। মা ভেবেছিলেন প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর হয়তো পরিস্থিতি পাল্টে যাবে এবং মারধরও করবে না। কিন্তু বাবার ব্যবহার আরো খারাপ হয়ে যায়। তিনি সব সময়ই জানতে চাইতেন মা কোথায় গিয়েছিলেন এবং তার সঙ্গে কে ছিল। বাবার প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর রেজা এবং আশরাফও মাকে রীতিমত এড়িয়ে চলতো। তখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে, বাবা ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মাকে অযথা বেদম প্রহার করতেন। সব সময় মা বলতেন, ‘একদিন আমি নিজেকে শেষ করে দিব এবং এই অসহ্য জীবন থেকে মুক্তি লাভ করবো।’
সত্যি মা একবার অঘটন ঘটাতে চেয়েছিলেন। সেদিন মাকে অমানবিক ভাবে বাবা মেরেছিলেন। ভীষণ মার খেয়ে মা শুধু চিৎকার করেছিলেন এবং দিব্যি করে বলেছিলেন যে তিনি আত্মঘাতী হবেন। মা রাতের বেলা পেছনের ঘর থেকে দুই বোতল ঔষধের বটিকা যেইমাত্র সেবন করতে যাচ্ছিলেন, তখনই আমি আমার বিছানায় গড়াগাড়ি করার সময় ফিসফিসিয়ে ডাকি, ‘মা!’ আমার কন্ঠস্বর এমন শোনালো যেন আমি মাকে নিয়ে ঘুমাবো । মা মিনিট খানেক সময় আমার দিকে বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকেন। যদিও তখন আমার দু’চোখের পাতা বন্ধ ছিল, কিন্তু আমি জানি মা আমার দিকেই তাকিয়েছিলেন। আচমকা তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন। মায়ের বাহুবন্ধনে আমি নিজেকে আবিস্কার করি। তাঁর অশ্রুতে আমার চুল ভিজে গিয়েছিল। সেই সময় নিজের অজান্তে মনে হয়েছে আসলে বাবা তত খারাপ নন। যাহোক, আমার ইচ্ছে হয়েছিল আমি চিরদিন মায়ের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ থাকি। কেন জানি মনে হয়েছিল আমি যেন সেদিনের ছোট্ট শিশুটি থাকি। তাহলে আমাকে ঘরে একা রেখে মা কখনই বাইরে যেতে পারতেন না। ইস্, তিনি যদি এই মুহূর্তে ঘরে থাকতেন, তবে আমাকে আশরাফের ঘরে আসতে হতো না। আমি আপনমনে ভাবি, তিনি যদি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। তাহলে কী হতো?
একবার মা যখন বাইরে যাচ্ছিলেন, আমি তাকে বললাম, ‘মা, আমাকে তোমার সঙ্গে করে নিয়ে যাও।’
‘এখানে বসে থাক এবং পড়াশুনা কর। আমি তাড়াতাড়ি ফিরবো।’
প্রতিবারই মা বলেন শীঘ্রই ফিরে আসবেন, কিন্তু কখনই ঠিক সময়ে ফিরে আসেনি। আমি সরুপথ পর্যন্ত তাকে অনুসরণ করতাম। আমি দেখতাম তিনি মুখ ঢেকে তড়িৎ গতিতে রাস্তায় যেতেন এবং একটা টকটকে লাল গাড়িতে উঠে পড়তেন। ড্রাইভার ছিল যুবক এবং তার গায়ে ছিল লাল রঙের সার্ট। বিস্ফারিত চোখে সে মার দিকে তাকিয়েছিল। আমি মোটেও তাকে পছন্দ করিনি। একসময় গাড়ি চলে যায়। আমি একাকী বাড়ি ফিরে আসি। রাতে ফিরে আসার সময় মা আমার জন্য সুন্দর একটা চুলের ক্লিপ কিনে আনেন।
আমি বলেছি, ‘আমি এটা চাই না।’
আমি জেদ করেছি। মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইনি। কিন্তু মায়ের ভাবসাব ছিল ফুরফুরে, চোখেমুখে খুশির আমেজ। একসময় তিনি চুলের ক্লিপ নিয়ে নিজের তার চুলেই লাগান। সম্প্রতি তিনি তার চুলে রঙ করিয়ে ঈষৎ সোনালি করেছেন। মনে হয় রঙ করা চুলে তার বয়স কমে গেছে এবং খুবই মানিয়েছে। তাকে রীতিমত তরুণীর মতো লাগছিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি এমন ভাবে হেসে উঠেন, যেন আয়নার ভেতর থেকে কেউ একজন তাকে দেখছে। হয়তো সেই লাল সার্ট পড়া যুবকটি হবে। মাকে এমন হাসিখুশি আমি আগে কখনই দেখিনি। কিন্তু মায়ের এই উৎফুল্লতার কারণ আমি জানি না। আমি তার সঙ্গে কোন কথা বলতে চাই না। তার হাসিটা কেমন যেন অদ্ভুত, অপরিচিত। আমি বলবো সেই লাল সার্ট পড়া যুবকটির জন্য ওরা মাকে গ্রেফ্তার করেছে।
আমি আশরাফদের বাড়ির পেছনের ঘরে গিয়ে নির্জনে অনেক কেঁদেছি। প্রতিটি মুহূর্ত আমি মায়ের শূন্যতা হাঁড়ে হাঁড়ে অনুভব করেছি। একবার আশরাফ পেছনের ঘরে এসেছিল। চটজলদি আমি ভেজা চোখের অশ্রুকণা মুছে ফেলি। কিন্তু আমার মনে হয়েছে আশরাফ ঠিকই বুঝতে পেরেছিল।
‘কী হয়েছে?’
‘কিছু না।’
একসময় আশরাফ আমার পাশে বসে।
‘তুমি কী তার অভাব অনুভব করো?’
আমি কোন কথা বলিনি এবং মাথা নিচু করে নিশ্চুপ বসে থাকি। আমার দু’পাশের গাল বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়তে থাকে। আশরাফ আমার চুলে সহানুভূতির নরম আঙুল বুলিয়ে দেয়।
‘তার জন্য তোমার দুঃখ করা উচিত নয়। কেননা তোমার প্রতি তার যদি বিন্দুমাত্র স্নেহ-ভালোবাসা থাকতো, তাহলে সে কখনই তোমাকে ঘরে একা রেখে অই যুবকের সঙ্গে বাইরে যেত না। সে আমাদের সুনাম নষ্ট করেছে।’
আমি হু হু করে কাঁদতে থাকি এবং মুসলধারে বৃষ্টির মতো অনবরত আমার চোখ থেকে অশ্রু ঝরে পড়তে থাকে। কেন জানি মনে হয়েছে আমার কষ্টে আশরাফ হয়তো খানিকটা কাতর।
‘ঠিক আছে। আমি তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাব। আর কাঁদতে হবে না। এবার কান্না থামাও।’
একদিন আশরাফ আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে গিয়েছে এবং বলেছে যে, সে দরজার বাইরে থাকবে, আমার সঙ্গে ভেতরে ঢুকবে না। তার ভয় ছিল, স্বামী যদি ঘূর্ণাক্ষরে জানতে পারে, তাহলে তার পিঠের চামড়া জ্যান্ত তুলে ফেলবে। একসময় আশরাফ বললো, ‘আশা করি এখন সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে এবং পুনরায় এধরনের ভুল আর কোনদিনও করবে না।’
সেদিন আমি মাকে দেখতে গিয়েছিলাম এবং কাঁচের পেছনে বসেছিলাম। আশরাফ বাইরে অপেক্ষা করেছিল। আমার সঙ্গে ভেতরে ঢোকেনি। আমার ভয় করছিল। ভেতরে লোকজনের প্রচন্ড ভীড়। আমার হৃদকম্পন দ্রুত বেড়ে গিয়েছিল। একসময় হঠাৎ কাঁচের উল্টোদিক থেকে কন্ঠস্বর ভেসে আসে এবং একজন মহিলা কাঁচের ওপাশে আসে। আমার বললাম ‘একজন মহিলা’, কেননা প্রথমে আমি তাকে চিনতে পারিনি। কিন্তু আসলে তিনি আমার মা। হায় খোদা, তিনি এত বদলে গেছেন! তার মুখের উপর কয়েকটা দাগ স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে এবং চোখ দু’টি কোঠরে ঢুকে গেছে। আসলেই তাকে বুড়ি দেখাচ্ছিল। তার প্রতি আমার করুণা হয় । আমি আমার গলার ভেতর এক দলা থুতু অনুভব করি এবং আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ে বলি, ‘মা, মাগো!’
মার চোখও অশ্রুতে ভরে যায়। তার গায়ে একটা ছেঁড়া চাদর এবং তিনি মোটা কাঁচের ওপাশে একটা চেয়ারে বসে আছেন, যেন অপরিচিত কোন মহিলা কাঁদছেন। আমি তাকে বললাম, ‘মা, একটা কিছু করো, যাতে ওরা তোমাকে ছেড়ে দেয়। আমি আশরাফের বাড়িতে কিছুতেই ফিরে যেতে চাই না।
পুরু কাঁচের ওপাশে বসে আমার মা অঝোরে কাঁদছেন।
লেখক পরিচিতি:
ইরানের সমকালীন কথাসাহিত্যে যে ক’জন নারী লেখক বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন, তাদের মধ্য ফারিবা ভাফি অন্যতম। তার জন্ম তাবরিজ শহরের এক সম্ভ্রান্ত মধ্যবিত্ত পরিবারে, ১৯৬৩ সালের পহেলা জানুয়ারি। পড়াশুনায় তিনি বেশি দূর এগোতে পারেননি, মাত্র মাধ্যমিক পাশ করেছেন। শৈশব থেকেই তার লেখালেখিতে হাতেখড়ি। পরবর্তীতে তিনি একজন সফল কথাসাহিত্যিক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে ইরানের কারাগারে বন্দিদের দুঃসহ জীবন-কাহিনী তাঁর লেখার মূল বিষয় । ফার্সি ভাষায় ফারিবা ভাফির প্রথম ছোটগল্প সংকলন প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে, যা ১৯৯৬ সালে ইরেজিতে ‘ইন দ্য ডেপথ্ অফ দ্য স্টেজ’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় ছোটগল্প সংকলন ‘ইভেন্ হোয়েন উই আর লাফিং’। এছাড়া ‘অন দ্য ওয়ে টু ভিলা’ (২০০৮), ‘অল দ্য হরাইজন’ (২০১১) এবং ‘উইদআউট উইন্ড, উইদআউট ও্যরস্’ (২০১৬) তাঁর অন্য ছোটগল্প সংকলন। তাঁর অনেক গল্প ইংরেজি সহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায়, যেমন ইতালিয়ান, জার্মান, ফরাসী, কুর্দিশ, তুর্কী, রুশ, সুইডিশ, নরওয়েজিয়ান, আরবী এবং জাপানী, তরজমা করা হয়েছে । তবে ছোটগল্প লেখিকা হিসাবে পরিচিতি পেলেও তিনি ঔপন্যাসিক হিসাবে পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেছেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘মাই বার্ড’ ২০০২ সালে প্রকাশিত হয় । এই উপন্যাসের জন্য তিনি ২০০৩ সালে ইরানের সম্মানিত ‘হুশাং গলশিরি লিটারেরী অ্যাওয়ার্ড’ এবং ‘ইয়াল্দা’ সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। ইতিমধ্যে জনপ্রিয় এই উপন্যাসের একবিংশ সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় উপন্যাস ‘তারলান’। তিনি তৃতীয় উপন্যাস ‘দ্য ড্রিম অফ তিবেত’ (২০০৫)-এর জন্য ‘শ্রেষ্ঠ উপন্যাস’ হিসাবে পুনরায় ‘হুশাং গলশিরি লিটারেরী অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করেন। এছাড়া তিনি ‘দ্য সিক্রেট অফ দ্য অ্যালিজ’ (২০১১), ‘দ্য মুন ইজ গেটিং ওল্ড’ (২০১২) এবং ‘আফটার দ্য এন্ড’ (২০১৪) উপন্যাস রচনা করেন। বর্তমানি তিনি সপরিবারে তেহরানে বসবাস করেন।
গল্পসূত্র: ‘আমার মা, কাঁচের আড়ালে’ গল্পটি ফারিবা ভাফির ইংরেজিতে ‘মাই মাদার, বিহাইন্ড দ্য গ্লাস’ গল্পের অনুবাদ। গল্পটি মোহাম্মদ মেহদি খোররামি এবং শৌলে ভাতানাবাদি অনূদিত এবং সম্পাদিত ‘এ ফীস্ট ইন দ্য মিরর: স্টোরিজ ফ্রম কন্টেম্পোরারী ইরানিয়ান উইম্যান’ ছোটগল্প সংকলন থেকে নেওয়া হয়েছে।