| 18 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ভাইরাস

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

(১)
রান্না শেখানোর প্রোগ্রামটাতে রেসিপি রিক্যাপ দেখানো শেষ হতেই, রোজকার মতো টিভি বন্ধ করে, সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন কাবেরীদেবী। সোফার অপর প্রান্তে বসা বীরেনবাবুর দিকে তাকিয়ে দেখলেন, উনি একমনে খবরের কাগজের সম্পাদকীয় বিভাগ পড়ছেন। কাবেরীদেবী একটু খোলা বাতাসের আশায় বসার ঘরের লাগোয়া বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। আগে বিকেল হলেই সামনের বাড়িটাতে পাড়ার বউয়েরা আড্ডা জমাতো; এখন দরজা বন্ধ, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছে সবাই। দুই বাড়ির মাঝের পিচ ঢালা রাস্তাটায় রোদ্দুর পড়তে না পড়তেই পাড়ার বাচ্চারা সাইকেল নিয়ে নেমে পড়ত; বেল বাজিয়ে বাজিয়ে ঝালাপালা করে দিতো কানের মাথা। কিন্তু লকডাউনের জন্য এখন সব শুনশান, দরকার না থাকলে কেউ পারতপক্ষে বাড়ির বাইরে বের হচ্ছে না।
সন্ধ্যে গাঢ় হতে শুরু করেছে একটু একটু করে, এখনই জানালা-দরজাগুলো বন্ধ করে না দিলে, একটু পরেই মশার উপদ্রবে আর এক জায়গায় স্থির হয়ে বসা যাবে না। শোওয়ার ঘরের জানালাগুলো দুপুরবেলাতেই বন্ধ করে দিয়েছিলেন, এখন বারান্দার দরজা আর সোফার পাশের খোলা জানালাটা বন্ধ করে কাবেরীদেবী এগিয়ে চললেন দোতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে। একতলার মতোই দোতলাতেও সুন্দর করে সাজানো বসার ঘরের দুপাশে দুটো শোওয়ার ঘর; যার একটিকে কাবেরীদেবী ঠাকুরঘর হিসাবে ব্যাবহার করেন আর একটা  গেষ্টরুম হিসাবে ব্যাবহৃত হয়। বয়স্ক দম্পতীর সংসারে আত্মীয়স্বজন বড় একটা আসে না। গরমের ছুটিতে নাতিনাতনিদের নিয়ে মেয়ে-জামাই বা ছেলে-বউমা এলে, তখন দু-চারটে দিন গেষ্টরুমটা একটু ব্যাবহার হয়। কিন্তু এ বছর আর কেউ আসবে না। করোনা ভাইরাসের ভয়ে সবাই গৃহবন্দী। ছেলে পুনাতে আর মেয়ে ব্যাঙ্গালোরে। মাঝে মাঝে খুব ভয় হয় কাবেরীদেবীর, ঘুম ভেঙ্গে যায় মাঝরাতে; অন্ধকার ঘরে চুপ করে বসে ভাবতে থাকেন, আবার দেখা হবে তো পরিবারের সবার সাথে ?
“মাসিমা, আলু-পটলের তরকারিতে গোটা জিরে ফোড়ন দেব, না জিরের গুঁড়ো?”, রান্নাঘর থেকে আসা সরু, মিহি গলার প্রশ্নটা শুনে কাবেরীদেবী থমকে দাঁড়ালেন, রান্নাঘরের দিকে ফিরে দেখলেন ; শ্রাবনী গ্যাস ওভেনের ওপর কড়াই চাপিয়েছে।
“গোটা জিরে ফোড়ন দিও, আর তার সাথে আদাবাটা”, বলে উনি আবার এগিয়ে চললেন দোতলার দিকে ।  
মাস ছ’য়েক হল শ্রাবনী কাজে ঢুকেছে। বাসন মাজা, ঘর ঝাড়ামোছা করার সাথে দু’বেলা রান্নাও করে। মোটা মোটা শাঁখা-পলা আর চওড়া করে সিঁদুর পরা, বাইশ-তেইশ বছরের রোগা, কালো শ্রাবনী একটু ভীতু প্রকৃতির, সব সময়ই কেমন যেন তটস্থ হয়ে থাকে। শ্রাবনীর আগে দীপালি এইসব কাজ করতো, ও ছিল একটু ডাকাবুকো ধরনের। গত বছর এক জায়গায় আয়ার কাজ পায় দীপালি, একটা ছোট বাচ্ছাকে, চাকুরিজীবী মায়ের অনুপস্থিতিতে বারো ঘণ্টা ধরে দেখাশোনা করার কাজ। ওই কাজে খাটুনি কম, মাইনে বেশি, সাথে সকাল-বিকেল জলখাবার, দুপুরে ভাত; তাই মাস শেষ হওয়ার অপেক্ষা না করে তিন-চার দিনের মধ্যেই দীপালি কাজ ছেড়ে দেয়। আর যাওয়ার সময় শ্রাবনীকে ঠিক করে দিয়ে যায়। শ্রাবনীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় একগাল হেসে দীপালি বলেছিল,”মাসিমা, ও এর আগে কোথাও কাজ করেনি। একটু শিখিয়ে পড়িয়ে নিও।”
ঠিকে-ঝিদের সাথে সব সময় কড়া ব্যাবহার করতেই পছন্দ করেন কাবেরীদেবী। যথোপযুক্ত শাষনে না রাখলে ওরা মাথায় চেপে বসে; নিজেদের মর্জিমাফিক না জানিয়ে ছুটি নেয়, কিছু বললেই কাজ ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেয়, আর কয়েক মাস পর থেকেই বার বার চাপ দেয় মাইনে বাড়ানোর জন্য। তবে শ্রাবনী অন্যদের মতো নয়। কাবেরীদেবী যাতে অসন্তুষ্ট না হন, সেদিকে সবসময় খেয়াল রাখে। তাই তো কাবেরীদেবীকে খুশি করার জন্য লকডাউনের মধ্যেও একবেলা করে কাজে আসছে। কাবেরীদেবীর ছোটবোন কোলকাতায় থাকে, ফ্ল্যাটবাড়িতে; সেখানে কাজের মেয়ে, ড্রাইভার এইসব বাইরের লোকের আসা-যাওয়া বারন। কিন্তু এখানে মানে এই মফস্বলে সে সব ঝামেলা নেই। তাছাড়া এ পাড়ায় বীরেনবাবুর একটা প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে, শিক্ষিত ভদ্রলোক হিসাবে সুনাম আছে; তাই ইচ্ছা থাকলেও কাবেরীদেবীর মুখের ওপর কেউ কিছু বলবে না।  
ঠাকুরঘরের জানালা বন্ধ করে, লাইট জ্বালিয়ে দিলেন কাবেরীদেবী। ধুনো-ধুপে জ্বলন্ত দেশলাই কাঠি ছোঁয়াবার সাথে সাথেই শুনতে পেলেন, বসার ঘর থেকে ভেসে আসা টিভির আওয়াজ। উনি মনে মনে হাসলেন। ওঁর এই পুজো করার সময়টাই হল বীরেনবাবুর টিভি দেখার সময়। না হলে, সারা সন্ধ্যে টিভির রিমোট কন্ট্রোল থাকে কাবেরীদেবীর দখলে, উনি চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিজের পছন্দমতো সিরিয়াল দেখেন; বেশ নিশ্চিন্তে কেটে যায় দু’তিন ঘণ্টা সময়। কাবেরীদেবী আসন পেতে ঠাকুরের সিংহাসনের সামনে বসে পড়লেন। চোখ বন্ধ করে জোড়হস্তে বার বার ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করলেন সবাইকে সুস্থ রাখার…

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
(২)
কাবেরীদেবী দোতলায় উঠে যেতেই, হাতে ধরা খবরের কাগজটা টেবিলের উপর মুড়ে রেখে, টিভি টা আবার চালিয়ে দিলেন বীরেনবাবু। এখন কিছুক্ষনের জন্য পুরোপুরি নিশ্চিন্ত। একবার পুজোয় বসলে কুড়ি-পঁচিশ মিনিটের আগে ঠাকুরঘর থেকে বের হন না কাবেরীদেবী। বীরেনবাবু রিমোট কন্ট্রোলের বোতাম টিপে, স্ত্রীর পছন্দের চ্যানেলটিকে সরিয়ে নিজের পছন্দের একখানি নিউজ চ্যানেল নিয়ে এলেন টিভির পর্দায়। যাতে ঠাকুরঘর থেকে কাবেরীদেবী আওয়াজ পান তাই টিভির ভল্যুমও বাড়িয়ে দিলেন বেশ খানিকটা।
টিভিতে করোনা ভাইরাস ও সেই সংক্রান্ত খবর ছাড়া আর অন্য কোনো খবর নেই। একই খবর বার বার শোনার ব্যাপারে বীরেনবাবুর কোনো আগ্রহ নেই। উনি টেবিলের উপর থেকে খালি হয়ে যাওয়া জলের বোতলটা হাতে নিয়ে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলেন রান্নাঘরের দিকে।

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
(৩)
বীরেনবাবুকে জলের বোতল হাতে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখেই মেজাজ গরম হয়ে গেল শ্রাবনীর। এবার জল ভরার নাম করে বীরেনবাবু ওর পাশে এসে দাঁড়াবে, তারপর সুযোগ বুঝে হাত রাখবে ওর শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর জায়গায়। ভাবতেই গা ঘিনঘিন করে উঠল শ্রাবনীর। নিজের বিরক্তি বীরেনবাবুকে বোঝাবার জন্য শ্রাবনী কড়াইয়ের মধ্যে বেশ খানিকটা তেল ঢেলে দিয়ে, ভাজা হতে থাকা আলু,পটলগুলোকে খুন্তি দিয়ে বেশ জোরে জোরে নাড়তে লাগল। বীরেনবাবু অভিজ্ঞ মানুষ; এখন আর বিশেষ সুবিধা হবে না বুঝতে পেরে, জলের বোতলটা সিঙ্কের পাশে রেখে সুড়সুড় করে বেরিয়ে পড়লেন রান্নাঘর থেকে। বীরেনবাবু বেরিয়ে গেলে কড়াইয়ের দিকে নজর পড়ল শ্রাবনীর। রাগের মাথায় তেলটা একটু বেশি পড়ে গিয়েছে, তার জন্য কাল আবার মুখনাড়া শুনতে হবে। কি কুক্ষনে যে ও এখানে কাজ ধরেছিল।
শ্রাবনীর বর বিশু রিক্সা চালিয়ে যা রোজগার করে তার বেশিরভাগটাই মদ খেয়ে উড়িয়ে দেয়। সংসার চালাতে যে কটা টাকা দেয় তাতে দুবেলা ভাত-ডাল ছাড়া আর কিছুই জোটে না। শ্রাবনী তাতেই চালিয়ে নিচ্ছিল। কিন্তু ওর ছেলেটা এখন বড় হচ্ছে, ভালোমন্দ খাওয়ার জন্য বায়না করে তাই একরকম বাধ্য হয়েই কাজের খোঁজ করতে শুরু করেছিল শ্রাবনী। কাজ পেতে খুব বেশি সময়ও লাগেনি। ওর পাশের ঘরেই থাকতো দীপালি, তিন-চার বাড়িতে ঠিকেঝিয়ের কাজ করতো। দীপালিকেই কাজ জোগাড় করে দেওয়ার কথা বলে রেখেছিল শ্রাবনী। এখান থেকে কাজ ছেড়ে যাওয়ার সময় দীপালি ওকে কাজে লাগিয়ে দিয়ে যায়।
দীপালি অবশ্য প্রথমেই বলে দিয়েছিল, কাবেরীদেবী খুব খিটখিটে, পান থেকে চুন খসলেই একঝুড়ি কথা শোনাবে, মাইনে কেটে নেওয়া, ছাঁটাই করে দেওয়ার ভয় দেখাবে, তাই শ্রাবনী যেন সবসময় কাবেরীদেবীর মন যুগিয়ে চলে। কাবেরীদেবীর সম্বন্ধে এতকিছু বলল  কিন্তু বীরেনবাবুর সম্বন্ধে একটা কথাও কেন বলল না দীপালি? তাহলে কি বীরেনবাবু দীপালির সাথে কিছুই করেনি ? একবারও ওর গা ঘেঁসে দাঁড়ায়নি? ছুতোয়-নাতায় পিঠে, কোমরে, নিতম্বে বা বুকের ওপরে হাত দেওয়ার চেষ্টা করেনি ? না কি দীপালি ইচ্ছে করেই শ্রাবনীকে কিছু বলেনি, চেয়েছিল ও যেভাবে হেনস্থা হয়েছে শ্রাবনীও ঠিক সেভাবেই হেনস্থা হোক।
মাঝে মাঝে খুব রাগ হয় শ্রাবনীর, ইচ্ছা হয় বীরেনবাবুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে, বীরেনবাবুর গা থেকে ভালো মানুষের ছদ্মবেশটা টেনে খুলে নিতে। তবে এখন ওর হাত-পা বাঁধা। লকডাউনের জন্য বিশুর রোজগার পুরোপুরি বন্ধ। সরকারি অনুদানের ভরসায় বসে থাকলে কি আর সারা মাস চলবে ? তাই বাধ্য হয়েই কাজে আসতে হচ্ছে ওকে। না হলে পরের মাসে যে না খেয়ে মরতে হবে। বীরেনবাবুও সুযোগ বুঝে অতিক্রম করছেন শালীনতার সীমা। উনি তো জানেন, শ্রাবনী এখন মুখ বুজে সবকিছু সহ্য করবে, কাজ খোয়ানোর ভয়ে কারও কাছে কোনো অভিযোগই করবে না।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্রাবনী। একদিন লকডাউন শেষ হবে, করোনা ভাইরাস নির্মূল হবে; সবকিছু আবার আগের মতো হয়ে যাবে। কিন্তু বীরেনবাবুর মতো কিছু মানুষের মনের ভেতর যে বিষাক্ত ভাইরাস দানা বেঁধে রয়েছে, তার শেষ কোথায় ?  

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত