বঙ্গবন্ধুর কন্ঠ শুনেছি
মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, আমি তখন মাত্র ৪ বছর বয়স অতিক্রম করেছি।আমি যুদ্ধ কি তা’ ঠিক করে বুঝে উঠতে পারিনি।তবে, মনে পড়ে, যুদ্ধ মানে মায়ের কোলে কোলে পলায়ন।সারাক্ষণ ভয় ও ত্রাসের মধ্যে নিরন্তর ছুটে চলা।আমার মনে পড়ে, কোনোএক অন্ধকার ঘরে গাদাগাদি করে শুয়ে বসে থাকা মানুষের ভিড়ের ভেতরে মা মুখে তুলে দিচ্ছে একনলা লবণ মেশানো মোটা চালের ভাত। সেই সামান্য স্মৃতির ফাঁকেও কেমন জ্বলজ্বলে তারার মতো একটি নাম শুনেছিলাম। মনে পড়ে সকলেই উদ্বিগ্ন থাকতো আর বঙ্গবন্ধুর কথা বলতো। আমি তখন তো জানতাম না কি এই বঙ্গবন্ধু, কে এই বঙ্গবন্ধু। আমি শুধু দেখেছি, আমার উঠোনে যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা, আমার উচ্চস্বরে ক্রন্দনও নিষিদ্ধ ঘোষিত। আর শুনেছি, সৈন্যরা হামলা করেছে ওঘরে সেঘরে।আবার কখনওবা, মুক্তি বলে কিছু মানুষের কথা বলতে শুনেছি। মুক্তির কথা বলতেই কেমন চোখ গুলো জ্বলজ্বল করে উঠতো সবার। বাবার কোলে পিঠে করে মায়ের বুকের ভেতর করে পালাতে পালাতে শুনি একদিন আর পালাতে হবে না। এবার সবার ঘরে ফেরার পালা। আর সেই ফেরার আনন্দে সবার হৃদয় যখন আনন্দে উদ্বেল, তখন দেখি কারও কারও মুখে এক ধরনের উৎসুক প্রতীক্ষা — সন্তানের স্বামীর বাড়ি ফেরার প্রতীক্ষা। কারও মুখে বিষাদের কালিমা। কেউ কেউ আর কোনোদিন ফিরবে না।আমাদের আশেপাশে কেউ কেউ হয়তো বলছিলো, বঙ্গবন্ধুর কি হবে? একটা আশঙ্কা একটা আশার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল সময়।চারিদিকে বিজয়ের গান। আমার রক্ত চনমন করা সেইসব গান খুব ভাল লাগতো। আমার উঠোনে খেলাধুলার দিন ফিরে এসেছে। ফিরে পেয়েছি বারান্দায় রোদ পোহানোর দিন। কিন্তু বাবা আর তাঁর বন্ধুদের চোখে মুখে উৎকন্ঠার অন্ত নেই। আলোচনার বিষয় একটাই, কবে ফিরে আসবেন প্রিয় নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
একদিন সেই প্রতীক্ষারও শেষ হয়।বাঙালি ফিরে পেল তার প্রিয় নেতাকে, জাতির পিতাকে। সারাপৃথিবী তাঁর কথা শুনতে উন্মুখ।আমিও বায়না করি বাবার কাছে, আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখব, তার কথা শুনব। মনে পড়ে, সেই সব বায়না আবদারের সময়গুলো পেরিয়ে যাবার অনেক অনেক পরে একদিন বাবা বললেন, আজ দুপুরে খেয়ে আমরা বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনতে যাবো। মনে আছে সে উত্তেজনা এখনো রক্ত চনমন করে তোলে। আমরা যখন পলোগ্রাউন্ডের কাছে সি আর বি’র পাহাড়ে গিয়ে পৌঁছালাম, তখন চারপাশে লোকে লোকারণ্য। সেই ভিড়ের ভেতরেই আমরা যতদূর পারি এগিয়ে গেলাম। একসময় বাবার হাত ধরে পাহাড়ের গায়ে বসে পড়লাম। মাইকে সেই বজ্রকন্ঠ শোনা যাচ্ছে। কিন্তু কথা স্পষ্ট নয়। আর আমার সেই আকুল আবেদন, বঙ্গবন্ধুকে দেখবো — তা’ও আর হলো না। কিছুক্ষণ শুনার পরে বাবা বললেন, দেখা তো যাচ্ছেই না, ভাল করে শুনতেও পারছি না। তারচেয়ে ঘরে ফিরে রেডিও শুনলে ভাল হবে। আমি বললাম, ওখান থেকে কি প্রথম থেকে শোনা যাবে। বাবা আমাকে সান্তনা দেবার জন্যে হ্যাঁ বুঝিয়ে বাড়ি নিয়ে গেলেন। সেই বজ্রকন্ঠ রেডিও তে শুনে সেই শৈশবেও রক্ত চনমন করে উঠেছিল। পরে পঁচাত্তরে একদিন আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানালেন পরদিন সকালে রাস্তার দুইপাশে সারি বেঁধে দাঁড়াতে হবে। জানতে পেলাম জাতির জনক চট্টগ্রাম আসবেন। তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে হবে। সে এক আনন্দের দিন গিয়েছিল। জাতির পিতাকে সরাসরি দেখতে পাবো, হাতে থাকা ছোট্ট পতাকা নেড়ে শুভেচ্ছা জানাবো এমন আনন্দে উদ্বেল হয়ে সকাল সকাল প্রস্তুত হয়ে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হলাম। সারি বেঁধে একে-অপরের কাঁধে হাত রেখে বিদ্যালয় প্রাঙ্গন থেকে দিদার মার্কেটের সামনে সিরাজউদ্দোলা রোডে এসে পাশাপাশি সারিবদ্ধ দাড়িয়ে প্রতীক্ষায় রইলাম। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা দুটো যখন ব্যথায় টনটন করছে তখন আমাদের সামনে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর গাড়িবহর ধীরে ধীরে পার হয়ে চলে গেল। এক ঝলকের একটু দেখা, সৌম্যকান্তি বিশাল মানুষটির জন্যে বুকের মধ্যে এক ধরনের অদ্ভুত ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় চাপা কান্না যেন বেজে উঠেছিল সেদিনের শিশুমনে। হায়! তখন কি জানতাম তার কয়েকদিন পরেই এই মহান মানুষটিকে কয়েকটি সামান্য সিপাহি এইভাবে সপরিবারে হত্যা করে দেবে? পচাত্তরের সেই কালো রাতের কথা অতো পরিষ্কার বুঝতে পারিনি, শুধু বাবা মায়ের ফিসফিস আলাপ থেকে বুঝতে পারলাম কোথায় যেন একটা তাল কেটে গেল, সুর হারিয়ে গেল। আমাদের দেশটি এক বিপন্ন অন্ধকারের দিকে ধাবিত হলো। কিন্তু আমরা তো জানি সেইবজ্রকন্ঠ আমাদের নিয়ত উদ্বেলিত করে আর এই ঘোষণায় বার বার উজ্জীবিত করে “দাবাইয়া রাখতে পারবা না”।
নিবাস: চট্টগ্রাম।
কবিতাই প্রধান বিচরণ।তবে নন্দনতাত্ত্বিক প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ভ্রমণগদ্য এবং অনুবাদকর্মেলিপ্ত।
কবিতার বই:
অন্যমন্ত্র(লিরিক১৯৯৫),
শাদা অন্ধকার(লিরিক২০১০),
ডায়োজিনিসের হারিকেন(ভিন্নচোখ২০১৮)
দীর্ঘ কবিতার পুস্তিকা:
শতখণ্ড(বাঙময়২০১৭)
আত্মজার প্রতি(বাঙময়২০১৭)
প্রবন্ধ/নিবন্ধ:
উত্তর আধুনিকতা: এ সবুজ করুণ ডাঙায়(লিরিক২০০১, পরিবর্ধিত২য়সংস্করণ: খড়িমাটি২০১৯)
অমৃত কথা(লিরিক২০১০)
অনুবাদ:
আধুনিকোত্তরবাদের নন্দনতত্ত্ব: কয়েকটি অনুবাদ(লিরিক২০১০)
নাজিম হিকমতের রুবাইয়াৎ(বাতিঘর২০১৮)
এমিলি ডিকিনসনের কবিতা(চৈতন্য২০১৮)