| 20 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

বনলতা সেন-একটা বোধ বা নিশ্চিন্ত আশ্রয়

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট

কিছুদিন আগে ইয়েটস-এর ‘ He remembers Forgotten Beauty’ এর ‘ When my arms wrap you round I press/ My heart upon the loveliness/That long has faded from the world,’’ কবিতাটা পড়তে পড়তে হঠাৎ করেই বনলতাকে মনে পড়ল।
বনলতা মানে আমাদের ভীষণ কাছের বনলতা সেন, যার বাড়ি নাটোরে। কত বছর আগে কিংবা কোথায় সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। হাজার বছর ধরে পথ হাঁটার পর আকস্মিক ভাবেই তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেছিল এক পথিকের। সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগর কিংবা বিম্বিসার অশোকের রাজ্য ছেড়ে বিদর্ভ নগর পরিক্রমা করে পথিক যখন দারুচিনি দ্বীপের সবুজে পথ হারিয়ে অন্ধকারে, তখন সন্ধ্যার নিঃস্তব্ধতায়, সেই জোনাকির আলোয়, দিশা দেখাবার জন্য সামনে এসে দাঁড়াল বনলতা। সে জিজ্ঞেস করল ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
ঠিক যেমন ভাবে নবকুমার নির্জন সমুদ্র তীরের ঘোর জঙ্গলের মধ্যে অকস্মাৎ শুনেছিল, ‘পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?’
(কপালকুন্ডলা, বঙ্কিমচন্দ্র)
পথিক দেখলেন বনলতাকে। যার চুল অন্ধকার বিদিশার নেশা। যার মুখে শ্রাবস্তীর কারুকার্য। চোখ পাখির নীড়ের মতো।
আপাত ভাবে এই বর্ননা কোনো সুন্দরী নারীর হতে পারে না। মুখের মধ্যে শ্রাবস্তীর কারুকাজকে মেয়েরা বা পুরুষেরা এড়িয়েই চলবেন। কিংবা চোখ যদি পাখির নীড়ের মতো হয়! সত্যি কী সেই চোখের প্রেমে পড়া যায়!
কিন্তু আপামর মানুষ সেই বনলতার প্রেমে মাতোয়ারা হলেন।
এমনি কিছু বর্ননা এর আগেও আমরা পেয়ে গেছি অ্যাডগার অ্যালেন পো এর ‘To Helen’ কবিতায় ‘ Thy hyacinth, Hair, Thy classic face’।( ১৮৩১ সালে রচিত) যার সঙ্গে ‘বনলতা সেন’ এর তুলনা করেছেন স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু। এই দু’ জায়গাতেই প্রকাশ্য ‘চুল’, ‘সমুদ্র’, ও ‘অন্ধকার’ প্রমুখ শব্দ আছে, এবং এই শব্দগুলো একান্তভাবেই পো-এরই।
তবু হেলেন আমাদের কাছের হলো না। বনলতা সেন নাম্নী সেই মেয়েটিই পাকাপাকি মনে জায়গা করে নিল। আর এখানেই বিদেশি একাধিক কবির দ্বারা প্রভাবিত হয়েও জীবনানন্দ অমর হয়ে গেলেন বনলতার স্রষ্টা হিসেবে।
‘বনলতা সেন’ কবিতাটি ১৯৩৫ সালে ‘কবিতা’ পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়।এবং এর প্রায় সাত বছর বাদে ১৯৪২ সালে ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থে অন্য আরো ১১ টি কবিতার সঙ্গে ১৬ পাতার পেপারব্যাক বই হিসেবে প্রকাশ পায়।প্রকাশক স্বয়ং কবি জীবনানন্দ দাশ। প্রুফ রিডার বুদ্ধদেব বসু, প্রচ্ছদ শম্ভু সাহা। মুদ্রক ব্রজেন্দ্রকিশোর সেন, মর্ডান ইন্ডিয়া প্রেস, কলকাতা।
আমাদের দেশে জীবনানন্দই প্রথম কবি যিনি বিদেশি কবিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় চিত্র শিল্প, কবিতা, গদ্যর সঙ্গে পরাবস্তবতার যে বন্ধন তৈরি হয়েছিল তিনিই প্রথম সেই ধারা অনুসরণ করলেন, কিন্তু অনুকরণ না করে স্বতন্ত্র এক মায়া বিস্তার করলেন। যে মায়া আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, সভ্যতার মধ্যে দিয়ে যার বহমানতা।
‘বনলতা’ আসলে একটা বোধ। একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয়। যার সামনে বসলে মন শান্ত হয়ে ওঠে।
দীর্ঘ সময় ধরে বয়ে চলা নদীও দিক পরিবর্তন করে, উত্তাল সমুদ্রও কখনো শান্ত হয়। এক সভ্যতা কালের স্রোতে ভাঙে, আরেক জীবন গড়ে ওঠে। কিন্তু পথিক! সে যুগ যুগ ধরে পথ হাঁটে। যতক্ষণ না তার পরিক্রমা শেষ হয়।
আমাদের প্রত্যেকের মনের মধ্যেই লুকিয়ে সেই পাল ছেঁড়া নাবিক বা পথিক, যারা হেঁটেই চলেছি দিগন্তের দিকে।দিশা জানি না।
রাতের গভীরে পাখিরা নিজেদের ঘরে ফেরে, পৃথিবী অন্ধকারে গাঢ় ঘুমে নিমগ্ন হয়। আমরা জানি একদিন এই জীবনের সব লেনা-দেনা সাঙ্গ করে আমাদেরও ফিরে যেতে হবে কোনো এক নির্দিষ্ট ঠিকানায়।
সেই পথ কতটা অন্ধকার কল্পনা করে ফেরার রাস্তায় খানিকটা জিড়িয়ে নিতে চাই বনলতার সঙ্গে। তার সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই আমাদের সুখ দুঃখ, জাগতিক যাবতীয় চাওয়া পাওয়া। আমাদের কথা একজন্মে ফুরায় না। আমরা তাই হেঁটে যাই তার খোঁজে বারবার। খুঁজে চলি শারদ নদীর উচ্ছাসে, ইতিহাস, পুরান, কড়া নাড়ে। আর দু’দন্ড দাঁড়িয়ে সেই গল্প শোনার অপেক্ষায় থাকে বনলতা। দেখা মাত্র অধীর হয়ে প্রশ্ন করে ‘এতদিন কোথায় ছিলেন ?’

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত