| 19 এপ্রিল 2024
Categories
সময়ের ডায়েরি

ভক্তের অত্যুক্তি: রসজ্ঞের সমালোচনা

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট

ধর্মকে আমরা যেমন গুলিয়ে ফেলি ভগবানের সঙ্গে, তেমনি সমালোচনাকে গুলিয়ে ফেলি নিন্দা অথবা গালমন্দের সঙ্গে। কেউ আমার সমালোচনা করছে- এ কথা শুনলে আমরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি। আমাদের মনে হয় যে আমার সমালোচনা করছে, সে আমার দোষ-ত্রুটিগুলিকেই লোকচক্ষুর সামনে উন্মুক্ত করে দিতে চাইছে। সমালোচনার মধ্যে যে আমার ইতিবাচক দিক থাকতে পারে, যাকে প্রশংসা বলা যায়, সেটা আমাদের ধারনার মধ্যে থাকে না । আমরা নিন্দা ও প্রশংসা- এদুটি ভালোভাবে বুঝি, এই দুই শিখরের মধ্যবর্তী ভূমি আমাদের অজানা। যার নিন্দা করি, তার কোন গুণ দেখতে পাই না, আবার যার প্রশংসা করি তার কোন দোষ দৃষ্টিগোচর হয় না আমাদের।

কেউ বলতে পারেন আমরা যাকে ভক্তি করি, তারই প্রশংসা করি। স্বভাবতই ভক্ত অসচেতনভাবে অত্যুক্তি করে যান। ভক্তির ভিত্তি বিশ্বাস। বিশ্বাস গড়ে ওঠে পুরুষানুক্রমে। বিশ্বাস পরিণত হয় সংস্কারে। তার একটা মস্ত সুবিধা আছে। তাকে প্রশ্ন করতে হয় না, জিজ্ঞাসায় বিক্ষত হতে হয় না, আত্মদহনের কোন প্রশ্ন সেখানে নেই । চলে আসছে, মেনে নাও। শাস্ত্রে আছে, তাই শিরোধার্য । গুরু বলেছেন, তাই বিতর্ক চলে না।

সমালোচনার জন্য প্রয়োজন নির্মোহ, তটস্থ দৃষ্টি ও সাহসী মন। বিশ্বাস ও সংস্কারের স্থান সেখানে নেই। দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় সংস্কার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সমালোচনার পথে । বর্ণাশ্রমকে মেনে নিতে হয়েছে, জাতিভেদেকে মেনে নিতে হয়েছে, সতীত্বের আড়ালে নারীকে পদানত করা হয়েছে, সতীদাহকে পুণ্যকর্ম বলে গ্রহণ করা হয়েছে। যাজক-মৌলবি-পুরোহিতরা যেভাবে জগৎ ও জীবনকে ব্যাখ্যা করেছেন, তাকে নতমস্তকে মেনে নিতে হয়েছে । মোল্লাতন্ত্র-যাজকতন্ত্র-পুরোহিততন্ত্রের বিরুদ্ধে যাঁরা প্রতিবাদ করেছেন, কম নির্যাতন ভোগ করতে হয় নি তাঁদের। পোপের আদেশে বিশপ ফ্লেমিং অক্সফোর্ডের অধ্যাপক জন ওয়াইক্লেফের কবর খুঁড়ে তাঁর কঙ্কাল তুলে এনে মরা মানুষকে নতুন করে মেরে ছিলেন ; চার্চের দুর্নীতির বিরুদ্ধে বোহেমিয়ার মানুষকে সচেতন করার অপরাধে জীবন্ত পুঢ়িয়ে মারা হয়েছিল জন হাসকে ;  গ্যালিলিওকে বন্দিজীবন যাপন করতে হয়েছিল।

নানা বাইরের ও ভেতরের আঘাতে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্রমাগ্রসরমানতার ফলে ধর্মীয় সংস্কারের রঙ কালক্রমে ফিকে হয়ে আসে । ধর্মীয় সংস্কারের পরিবর্তে দেখা দেয় রাজনৈতিক সংস্কার। ফ্রান্সিস বেকন তাঁর ‘নিউ মেথডলজি’ (১৬২০) গ্রন্থে যাকে ‘দার্শনিক সংস্কার’ বলেছিলেন, সেটাই রাজনৈতিক সংস্কারে বিবর্তিত হয়েছে । বেকন কুসংস্কারগুলিকে চারভাগে বিভক্ত করেন –

১. Idols of the Tribe  বা জাত ও সম্প্রদায়গত কুসংস্কার

২. Idols of the Cave  বা মনের অন্তর্নিহত ব্যক্তিগত কুসংস্কার

৩. Idols  of the Market place  বা ভাষা ও ভাবগত কুসংস্কার

৪. Idols of the Theatre  বা দার্শনিক মতগত কুসংস্কার

ধর্মীয় গোষ্ঠীর স্থান দখল করেছে রাজনৈতিক গোষ্ঠী। যিনি বা যাঁরা  আমাদের মতের বিরুদ্ধতা করছেন তিনি বা তাঁরা আমাদের শত্রু। তাঁর কোন ইতিবাচক দিক থাকতে পারে না। সুতরাং তাঁর কণ্ঠরোধ করাই কর্তব্য। যে মার্কসবাদ পৃথিবীকে নতুন আলো দেখিয়েছিল, সে মার্কসবাদও অতিভক্তির আবর্তে সংস্কারে পরিণত হয়েছে।

বর্তমান পৃথিবীতে বেকনকথিত চতুর্থ সংস্কার ভালোভাবেই সক্রিয়। বেকন বলেছেন, ‘ আমার মতে পৃথিবীতে নানা সময়ে যেসব দার্শনিক মতামতের উদ্ভব ঘটেছে সেগুলি ঠিক রঙ্গালয়ের নাট্যাভিনয়ের মতো।’ এইসব দার্শনিক মতামত এক একসময়ে এক এক রকম গোঁড়ামি সৃষ্টি করেছে।

বিশেষ দার্শনিক বা রাজনৈতিক মত খণ্ডিত সত্য, তাই তা বিচারবুদ্ধিকে আবৃত করে। একটিমাত্র ঘটনা বা আচরণ তখন ‘প্রগতিশীল’ বা ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ তকমা এঁটে দেয় । ‘সুভাষচন্দ্র ফ্যাসিবাদী জার্মানির সাহায্য গ্রহণ করেছিলেন, তাই তিনি ঘৃণ্য’—এরকম সিদ্ধান্তে দার্শনিক বা রাজনৈতিক কুসংস্কার প্রতিভাত হয়। অনুরূপভাবে যদি সিদ্ধান্ত করা হয় ‘ কমিউনিস্টরা আন্তর্জাতিকতাবাদী বলে দেশপ্রেমিক হতে পারেন না’ – তখন তাকেও রাজনৈতিক কুসংস্কারের দৃষ্টান্ত বলা চলে।

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত