| 18 এপ্রিল 2024
Categories
কবিতা সাহিত্য

প্রবুদ্ধসুন্দর করের গুচ্ছ কবিতা

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

ভাঁড়[br]

“জতুগৃহ থেকে যারা কখনোই পালাতে পারে না[br]
পালাতে না পেরে যারা প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে[br]
আড়মোড়া ভাঙে, হাই তোলে, দাঁত মাজে[br]
বাথরুমে গান গায়, তারিয়ে সাবান মাখে রোজ[br]
আবারও দপ্তরে ছোটে, টেবিল বাজায়[br]
বেতনবৈষম্য নিয়ে জোর তর্ক করে[br]
বিকেলে রাস্তায় হাঁটে, আড়চোখে মেয়েদের দেখে[br]
জন্মনিরোধক আর বেবিফুড কিনে বাড়ি ফেরে[br]
সেইসব সংখ্যালঘু অর্ধদগ্ধ ভাঁড়[br]
তাদের গোপন আড্ডা থেকে আমাকেও চিঠি লেখে[br]
তীব্র হাহাকার আর গোঙানি মেশানো[br]
সেইসব চিঠি পড়ে,উত্তর না লিখে আজও চুপ করে থাকি[br]
আমার মৌনতাহেতু, সম্ভবত, তাদের ধারণা[br]
জতুগৃহ থেকে তবে আমিও পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি।”[br]

 

 

 

রেডিয়ো স্টেশন[br]

জঙ্গলের ভেতর কোথাও পরিত্যক্ত এক রেডিয়ো স্টেশন[br]
কোনও একদিন খুঁজে পেলে জেনো, স্তব্ধতাই এর সিগনেচার টিউন[br]
নৈঃশব্দ্য ব্যতীত, হাহাকার, বিলাপ, অশ্রুপাতের ধারাবিবরণী[br]
২৩৬.৪ মিটারব্যান্ড তথা ১২৬৯ কিলোহার্টজে প্রচারিত হয়নি কখনও[br]
অধিবেশনের শুরুতে বা শেষে ঘোষিত হয়নি স্টেশনের নাম[br]
জঙ্গলের ভেতর কোথাও স্তব্ধতার সিগনেচার টিউন শুনতে পেলে[br]
জেনো, আত্মকণ্ডূয়নমুগ্ধ এই স্টেশনের ধ্বংসাবশেষই আকাশবাণী প্রবুদ্ধসুন্দর।[br]

 

 

 

 

 

স্যানাটোরিয়াম[br]

স্তব্ধতার প্রতিধ্বনি এসে টোকা দিলে রাতারাতি[br]
রুকস্যাক গুছিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয় হিলসের পথে।[br]
নক্ষত্র যেভাবে হাতে ধরে অন্ধ নাবিককে গন্তব্যে পৌঁছায়[br]
সাদা অ্যাপ্রনের মেঘও তেমনি তোমাকে নিয়ে যাবে[br]
স্যানাটোরিয়ামে। পথের বাঁকেই পাথর ফাটিয়ে নেমে-আসা[br]
প্লবঙ্গ ঝর্ণায় পূর্ত পাপ ধুয়ে নিয়ে ঊঠে যেয়ো[br]
সর্বোচ্চ শৃঙ্গের দিকে। সবুজ ট্রাপিজ থেকে ঝুলে-পড়া বৃষ্টি[br]
সহসা ভিজিয়ে দিলে তোমাকে আশ্রয় দেবে পাহাড়ি বাজার[br]
মাতৃতান্ত্রিক দোকানে বসে চা-র কাপে ঠোঁট রেখে আড়চোখে[br]
দেখে নিয়ো মিজো যুবতির গালে প্লামের লালিমা।[br]
অসুস্থ শহর থেকে আরোগ্যের লোভে তুমি পাহাড়ে এসেছ[br]
নিসর্গ, স্তব্ধতা, সাদা অ্যাপ্রনের মেঘ আর সান্ধ্য গির্জা থেকে[br]
ভেসে-আসা ড্রাম আর গিটারের ধ্বনি তোমাকে আরোগ্য দেবে[br]
তোমার ঔষধি আছে মিজো যুবতির পরায়ণ হাসি ও লাবণ্যে[br]
যদিও যৌনতা নিয়ে ট্যাবু নেই কোনো, তবু সম্মোহিত প্রেমিকের মতো[br]
মৌন সমর্পণ নিয়ো। পার্সের পকেটে কন্ডোম নিয়ো না।[br]

 

 

 

 

 

ঝুঁকি[br]

এতদিন যাকে দেখা গেল, সে আমার ডামি[br]
এতদিন আমার হয়ে সে আগুনের ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়েছে[br]
এক শূন্যতা থেকে ভল্ট খেয়ে ছিটকে পড়েছে আরেক শূন্যতায়[br]
ঘুমের ভেতর সমুদ্রস্বপ্ন আর বোবাধ্বনির ভার নিয়ে মধ্যরাতে সে জেগে উঠেছে[br]
যে পাতার আড়ালে কুয়াশার চেয়ে অস্পষ্ট মেয়েরা পদ্ম ফোটায়[br]
সেই পাতার ওপর অস্থির জলবিন্দু হয়ে অমাকে সে এতদিন আড়ালে রেখেছে[br]
আজ থেকে ডামি সরিয়ে সম্পূর্ণ ঝুঁকি নিতে চাই।[br]

 

 

 

 

 

নিজেকে লেখা চিঠি[br]

পরমপিতা তোমাকে রেখেছে কুশলে, আশা করি[br]
ছত্রিশ্ ছত্রাকে গেঁজে ওঠা এই অকবিজীবন[br]
আজকাল বড়ো টকটক লাগে, আরো নুন চাই।[br]
বিবাহলেবুর রসে প্রেম প্রেম হ্যাং-ওভার আমারও কেটেছে[br]
আগ্নেয়াস্ত্র ভেবে আমি এতদিন পেটে গুঁজে বেড়িয়েছি পাতি টয়গান[br]
যা দিয়ে নিদেনপক্ষে ছত্রভঙ্গ করা চলে পায়রামহল।[br]
অস্ত্রসমর্পণশেষে যে পুনর্বাসন হায় উঁকিঝুকি দিল[br]
দাম্পত্যরগড় আর বিমাপ্রিমিয়াম।[br]
মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মূলস্রোতে গুঁড়ি মেরে থাকি[br]
সমিতিসদস্যপত্র রিনিউ করেছি[br]
ধর্মজিরাফের মতো নিরামিষ খাই।[br]
মহার্ঘভাতার সঙ্গে কালেভদ্রে দেখা হয়ে গেলে[br]
চোখ টিপি, শিক্ষকের আচরণবিধি থেকে ঈষৎ দূরত্বে বসে নেশা করি[br]
বড়োজোর তিন পেগ, বেশি জলে সামান্য বারুণী।[br]
সমবায় ব্যাংকের বোলানো পালকে রোমহর্ষ হলে টের পাই[br]
একদিন আমাকেও সংবর্ধনাসহ জাতির অঙ্গুরীমাল হয়ে যেতে হবে।[br]
চকখড়ি, ব্ল্যাকবোর্ড, সাবরুটিনের ঘেরাটোপ থেকে পালাবার আগে[br]
গ্রীষ্মের ছুটিতে তাই তোমাকেই লিখি।[br]
ডাকবাক্স যদি চিঠি প্রত্যাখ্যান করে[br]
সমাসের ব্যাসবাক্য যদি মনে থাকে, তবে জেনো[br]
প্রবুদ্ধসুন্দর মরে আনালে বিনালে[br]
প্রবুদ্ধসুন্দর পোড়ে তীব্র ঋণানলে।[br]

 

 

 

 

 

ফেরা[br]

প্রতিটি ফেরার দৃশ্য স্তব্ধতাখচিত[br]
তোমার অর্ধনমিত মুখে রাষ্ট্রীয় শোকের ছায়া[br]
দিকে দিকে রাষ্ট্র হবে, এই ভয়ে, এ দৃশ্যের কথা কাউকে বলিনি[br]
অসহায় এই ফেরা, স্তব্ধতার তোলপাড়, তবু টের পেয়েছিল[br]
ঝোপজঙ্গল, পাহাড়ি বাক, মেঘ আর নেশাগোধূলির চাঁদ[br]

 

 

 

 

 

আলো[br]

সন্ধ্যা নেমে এলে সমূহ মনোবেদনা নিয়ে জ্বলে ওঠে একটি নক্ষত্র[br]
বিষাদস্পৃষ্ট তোমার মুখ[br]
কোনও একদিন যদি স্পষ্ট হয়ে ওঠে[br]
বোঝা যাবে, সেই নক্ষত্রের আলো[br]
পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছে, সামান্য আগে।[br]

 

 


আরো পড়ুন: প্রবুদ্ধসুন্দর কর-এর একগুচ্ছ


 

 

গতিপথ[br]

লামডিং-এ নদী নেই? আছে। যেন অপ্রস্তুত চোখে অতর্কিত[br]
এ প্রশ্নের দিকে সামান্য তাকিয়েছিলে।[br]
নাম জান?[br]
সাদা বালি, নুড়ি ও পাথরে বুক ঘষে ঘষে ক্রমশ যে নদী[br]
পাখিদের আত্মহত্যা, অম্বালিকা ফাংলোর প্রণয়, ব্ল্যাক উইডো, নিষিদ্ধ লাউপানি[br]
আর টানেল পেছনে রেখে মাহুর পেরিয়ে তোমার রিডের দিকে বয়ে গেছে[br]
তার শীর্ণতা, বিস্মৃতপ্রায় নজরুলগীতির মতো।[br]
তীব্র হাহাকার বুকে চেপে শুশ্রূষাবহ তোমার[br]
গায়কির কাছে সে এসেছে। তার পায়ে পায়ে আমি[br]
নিরাময়শেষে, খরস্রোত নিয়ে হয়তো সে বাঁক নেবে নাগাপাহাড়ের দিকে[br]
আমার আরোগ্য নেই। আমৃত্যু শুশ্রূষালোভী হয়ে[br]
তোমার ত্রিসন্ধ্যা আর হারমোনিয়মের আশ্রয়ে তবে থেকে যাই?[br]

 

 

 

 

 

ছায়া[br]

দু-চোখ মোমের শিখা, তাই[br]
কালি পড়ে রাত-জাগা দু-চোখের কোলে[br]
আমাকে এ আলো ভেদ করে না বলেই[br]
এই ছায়া, অনচ্ছ অবগ্রহের মৃত্যুপূর্ব অসুস্থকালিমা।[br]

 

 

 

 

 

জ্যোতিষবচন[br]

আপনার শত্রু আর কেউ নয়, আপনি নিজেই[br]
যুক্তি, তর্ক ও মন্তব্য এড়িয়ে চলুন।[br]
ঈর্ষাপরায়ণ বামনেরা মাঝে মাঝে সিটি দেবে[br]
উত্তেজিত হবেন না[br]
মুখ্যমন্ত্রীকে দেখুন, নিন্দা ও প্রশংসা দুটোতেই নির্বিকার।[br]

নির্জনতা ছাড়া কোনও কিছুই সম্ভব নয়[br]
লেখালেখি, চুম্বন, আত্মসমীক্ষা, ধ্যান, এমনকি খুনও[br]
মনে রাখবেন, কোলাহল হলাহল।[br]

যে পা-গুলো এতদিন প্রণামের যোগ্য বলে মনে হয়েছিল[br]
সেগুলো শয়তানের খুর হয়ে আরও স্পষ্ট হবে।[br]
শিবির বিপজ্জনক, নিরাপদ দূরত্বে থাকুন[br]
অত্যুত্সাহ কিংবা বিরোধিতা একদম নয়[br]
বিদ্যুৎ আগুন, জল, শস্ত্র থেকে সাবধান।[br]

বিষম রাশির জাতক আপনি, প্রতিকারহীন[br]
প্রবাল, সিংহলি মুক্তা, পোখরাজ, বার্মিজ গোমেদ[br]
কোনও কিছুই আপনার কাজে আসবে না[br]
বরং ব্রাহ্মণ গ্রহাচার্যকে দারুহরিদ্রা দান করে প্রণাম করুন।[br]

মনে রাখবেন, প্রণাম এমন এক শক্তি[br]
শয়তান তো বটেই, প্রণামের মুহূর্তে শত্রুও[br]
আপনাকে আশীর্বাদ না করে পারবে না।[br]

 

 

 

 

পরজন্ম[br]

অমৃতের মাদকতা রক্তে মিশে আছে[br]
টলমল করে ওঠে সমস্ত শরীর[br]
পথেও বিপথে ঘুরে খানাখন্দে পড়ি[br]
যেন তীব্র ক্ষুধায় আকন্দপাতা খেয়ে[br]
স্বেচ্ছা-অন্ধ হয়েছি দেবতাদের দেশে।[br]

পরজন্ম বলে যদি সত্যি কিছু হয়[br]
সমুদ্রমন্থন শেষে রাহুর কবন্ধ আমি[br]
অমরত্ব নয়, চাই, চাঁদের প্রণয়।[br]

 

 

 

 

শাশ্বতী[br]

অগ্রহায়ণের আলো সূর্যাস্তজটিল[br]
রাত্রি ও কুয়াশা তাই অতিবৈবাহিক[br]
যে-কুহক আমাকেও করেছে শরিক[br]
রোমশ জড়ুল নয়, সূচ্যগ্র সে তিল[br]

যদি বিনাযুদ্ধে চাই সন্ধিপত্র মেনে[br]
অস্থির পুরুষকার, মূঢ়, তবে বলো[br]
জটিল সূর্যাস্তশেষে অস্ত্রের ধারালো[br]
নীরবতা কীভাবে মিশেছে রক্তে, নুনে[br]

পৌত্তলিক তার দুঃসাহসের ভেতর[br]
অপরিমেয় সমুদ্র হয়ে শুয়ে থেকে[br]
প্রশস্ত বালিতে, ঢেউয়ের ব্রেলে লিখে[br]
রাখি গলনকাহিনি, তেমন কাতর[br]

ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ, সেই সূত্রে আমি[br]
নিজেকে জেনেছি দ্বিধাথরথর মমি ।[br]

 

 

 

 

 

হারমোনিয়ম[br]

The sly reeds whisper to the nights—[br]
–James Joyce[br]

এক.[br]

আমাদের বংশের প্রাণস্বরূপ এই হারমোনিয়ম[br]
ভেতরে চিরহরিৎ অরণ্যঅঞ্চল। দিনে[br]
বেলোর পাঁচটি ছিদ্র দিয়ে অনর্গল[br]
অক্সিজেন বেরোতেই থাকে। তাই পৃথিবীর যাবতীয় গাছ[br]
আমাদের কাছে ডামি।[br]
আমিও আত্মহত্যাপ্রবণ। কোনও কোনও পূর্ণিমায়[br]
হারমোনিয়মটিকে শিয়রে রাখি।[br]
বেলোর ছিদ্রগুলির দিকে মুখ রেখে নিদ্রা যাই।[br]

 

দুই.[br]

হারমোনিয়মের বেলোতে সব মিলিয়ে পাঁচটি ছিদ্র[br]
উপরে তিনটি, নিচে দুটো।[br]
উপরের ছিদ্র ক্ষিতি, অপ, তেজ[br]
নিচে মরুৎ ও ব্যোম।[br]

বাবার ধারণা, পূর্বপুরুষদের আত্মা[br]
এই হারমোনিয়মের ভেতর লীন হয়ে আছে ।[br]

 

তিন.[br]

বেলোর গায়ে যে ছিদ্রটি বাবার ভাষায় ক্ষিতি[br]
আমি সেই ছিদ্রটিকে কাম বলি।[br]
এভাবে অপকে ক্রোধ ও তেজকে লোভ[br]
মরুৎকে মদ ও ব্যোমকে মোহ[br]
যদিও রিপুপ্রবণ আমার মাৎসর্য নেই[br]
তাই, বেলোর শরীরে গোপনে আরেকটি[br]
ছিদ্র রেখে যেতে চাই।[br]

 

চার.[br]

পূর্বপুরুষদের চক্ষুদানপত্র মেনে[br]
তাদের মৃত্যুর পর, এক একটি চোখ দিয়ে তৈরি[br]
হারমোনিয়মের প্রতিটি রিড[br]
শুদ্ধ ও কোমল।[br]
ছোটোবোন রিডে আঙুল ছোঁয়ালে ত্রিসন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে[br]
আমি তো জন্মান্ধ। গান গাই[br]

যে গান অন্ধের যষ্টি —-[br]

 

 

 

 

হুমায়ুননামা[br]

মৃতের নামের আগে যে চন্দ্রবিন্দুটি বসানোর রীতি[br]
সেই চন্দ্রবিন্দু ঈশ্বরপ্রতীক[br]

আমাদের ইতিহাসে হুমায়ুনের প্রার্থনা নেই[br]
তাই তার গোটা আয়ুষ্কালই অভিশপ্ত একটি মৃত্যুশিয়র[br]
যে-শিয়রে অপত্যতাড়িত এক দিকভ্রান্ত পিতা[br]
রাত জেগে বসে থাকে, আর, ভিক্ষুকের মতো পূর্বে ও পশ্চিমে[br]
দুই করতল পেতে পুত্রের আরোগ্য চায়।[br]

আমাদের ইতিহাসে নেই হুমায়ুনের প্রর্থনা[br]
তাই, পিতার যকৃৎ চেপে বসে কর্কটের দাঁড়া[br]
অসহায় হুমায়ুনও জন্মজানুকাটা বলে প্রর্থনা-অযোগ্য।[br]

তহশিল কাছাড়িতে আমার পিতার নথিভুক্ত নাম চন্দ্রবিন্দু হরিপদ কর[br]
কুলাঙ্গার পুত্র আমি, আর, পিতা আমার ঈশ্বর জহিরউদ্দিন মহম্মদ বাবর।[br]

 

 

 

 

হেমন্তসম্ভব[br]

আর আমাকে বিষণ্ণ কোরো না হেমন্তকাল[br]
না-লেখার অভ্যাস আমাকে গিলে ফেলছে ক্রমশ[br]
একেকটা দিন ধ্বনি হয়ে পাহাড়ের দিকে গিয়ে[br]
মরা আলো ও কুয়াশা মেখে প্রতিধ্বনি[br]
গোধূলির ফাঁদ হয়ে ফিরে আসে রোজ[br]
পা দিলেই ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসে[br]
মনখারাপের বিষ মাখানো অব্যর্থ অজস্র তিরের ফলা।[br]

না-লেখার অভ্যাস, আমাকে অস্থির কোরো না আর[br]
প্রেম আর নুন-চাপা একেকটি অস্থিরতা থেকে[br]
মুখভর্তি রক্ত উঠে আসে।[br]

তোমাকে লিখতে বা মুছে ফেলতে গিয়ে হেমন্তসম্ভব[br]
নিজেরই অজান্তে একটি জোঁকের মৃত্যুদৃশ্য উপমেয় হল।[br]

 

 

 

 

 

দরজা[br]

যে তোমাকে ছেড়ে যেতে চায়[br]
তাকে যেতে দাও[br]
আটকে রেখো না।[br]
একটি কথাও না বলে তার[br]
ব্রিফকেস গোছাতে সাহায্য করো।[br]
প্রেসার বা থায়রয়েডের ওষুধ সে যেন[br]
ভুল করে ফেলে না যায়। শূন্যতা ছাড়া[br]
সে যেন ছেড়ে না যায় আর কোনো স্মৃতি।[br]
অশ্রুগ্রন্থি থেকে যেন বেরিয়ে না আসে সূচ্যগ্র তরল[br]
ঘুণাক্ষরেও তোমার মুখে যেন জলবসন্তের মতো[br]
আর্তি আর হাহাকার ফুটে না ওঠে।[br]
শুধু এগিয়ে দেওয়ার পথে নীচু স্বরে বোলো[br]
দরজা ভেজানো থাকবে[br]
টোকা দেওয়ার দরকার নেই।[br]
আলতো ঠেলে দিলেই কপাট খুলে যাবে।[br]

 

 

 

গাইড[br]

দেখুন, এই যে রাজবাড়ি। উজ্জ্বয়ন্ত প্রাসাদ। এখন বিধানসভা ভবন।[br]
এই জোড়া দিঘি, বাঁয়ে জগন্নাথ জিউর মন্দির।[br]
লক্ষীনারায়ণবাড়ি। ডানে আনন্দময়ী আশ্রম।[br]
এই যে স্পোর্টস কমপ্লেক্স দেখছেন[br]
এখানে রাজার আস্তাবল ছিল। ঘোড়া ছিল। ছিল হ্রেষা ও সহিস।[br]
এখন তো আগরতলা খচ্চরে ভরে গেছে[br]
কী বললেন? হ্রেষা? ওহো, এককথায় প্রকাশ পড়েননি?[br]
সেই যে ব্যাঙের ডাক মকমকি। ময়ূরের ডাক কেকা।[br]
কুকুরের ডাক বুক্কণ। হাতির বৃংহন।[br]
তেমনি ঘোড়ার ডাক হচ্ছে হ্রেষা।[br]
তবে খচ্চরের ডাককে এককথায় কী বলা হয়[br]
তা অবশ্য আমাদের বাংলা ব্যাকরণে নেই।[br]

 

 

 

উদাহরণ[br]

ভাদুঘর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে ভৈরববাজার[br]
শুনেছি, বাবার দৌড় এটুকুই ছিল।[br]
আমি ঢাকা অব্দি গেছি[br]
বাবাকে পেরিয়ে যাওয়ার উদাহরণ[br]
এ জীবনে আর কিছু নেই।[br]

 

 

 

নাভি[br]

অবিনশ্বর ভেবেছি এতদিন যেসব লেখাকে[br]
সেইসব লেখালেখি থেকে আজ ভেসে চাপা হরিধ্বনি।[br]
যাদের হাততালিতে প্রেক্ষাগৃহ ফেটে পড়েছিল[br]
তাদের বিদগ্ধ মুখ শ্মশানবন্ধুর মতো অভিব্যক্তিহীন।[br]
পাট্টাকোলাহল ছেড়ে উঠে আসে ডোম[br]
একমাত্র সে-ই জানে, নাভি পুড়ে ছাই হতে অনেক সময় নেয়।[br]
–আগুনে পোড়ে না নাভি, বাবু, শ্রম ও সময় বাঁচাতে[br]
এইটুকু মিথ্যে ছাই বাতাসে উড়িয়ে মাতাল ডোমেরা[br]
চিতার আলোয়, আড়চোখে মেপে নেয় বিশ্বাসযোগ্যতা।[br]
আমাদের লেখালেখি, ডোমপ্রচারিত সেই গুজবের নাভি।[br]

 

 

 

ফলক[br]

আসাম-আগরতলা রোডে পাহাড়ি রাস্তার বাঁকে[br]
পাথরের ফলকের গায়ে একটি লেখা চোখে পড়ে—[br]
বি জেন্টল অ্যাট মাই কার্ভ। বিস্ময়ে রোমাঞ্চ জাগে[br]
যেন পথ সর্পিল রমণী, গাড়িচালকের কানে[br]
মুখ এনে চাপাস্বরে অসহায় আর্তিটুকু রাখে[br]
—আমার শরীরী বাঁকে হে পুরুষ, ভদ্র হয়ে ওঠো।[br]
সঙ্গমে বন্যতা নয়, নারী চায় দিব্য কোমলতা[br]
মদ ও মাংস মিশিয়ে হে পুরুষ, হে গাড়িচালক[br]
রাগমোচনের আগে ডেকে এনো না শীঘ্রপতন।[br]
পাহাড়ি রাস্তার বাঁকে পাথরের ফলকের গায়ে[br]
স্মরণযোগ্য পঙ্ক্তির মতো ইঙ্গিতবহ এ আর্তি[br]
কে লিখেছে জানা নেই, শুধু তাঁর কবিপ্রতিভাকে[br]
ঝিঁঝিঁ-ডাকা নির্জনতায় প্রণাম করে যেতে হয়।[br]

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত