| 19 মার্চ 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

ওজিফা খাতুন বিষয়ক কিছু কথা 

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
ওজিফা খাতুনকে গোসলের আগে উঠিয়ে বসানো হয়। পেটের সমস্ত পৃথিবীয় আবর্জনা যেন সে পৃথিবীতেই রেখে যেতে পারে। ঘাড়ের উপর উজ্জল সোনালী পাটের আঁশের মত চুল। টুকরো টুকরো জটিল প্যাচ হয়ে ঝুলছে। উর্ধাঙ্গে পুরোনো আর বহু ব্যবহৃত তেল চিটচিটে ব্লাউজ। কি রং ছিলো বোঝা যায়না এখন ধুসর হয়ে গেছে।
জীবন আর মৃত্যুর মাঝে ঠিক কতটুকু সময় গেছে তা হিসেবকারীরা ঠিকই মনে রেখেছে তবে ওজিফা খাতুনের শরীর তা মনে রাখেনি। এখনো নির্লজ্জের মত ওম ছড়িয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে যদি চোখ মেলে কিশোরী চাপল্যে খিল খিল করে হেসে উঠতেন তবে অবাক হবার কিছু ছিলনা।
ওজিফা খাতুনের টকটকে গাল মৃত্যুর মহিমায় কি না কে জানে যেন আরো বেশি জ্যোতিময়!
বাস্তবিকই ওজিফা খাতুনের মৃত্যু কারো কারো কাছে স্বস্তির বাতাস হয়েই আসবে। তবে তাঁর মারা যাবার ঘটনায় অনেকেই মন্তব্য করছিলো পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে ওজিফা খাতুনের ওপারে যাওয়া ছিলো জরুরী। এটাতো ঠিক যে দুয়েকবার হারিয়ে যাবার পর পরিবারের মানুষকে একদমই শান্তি দেয়নি ওজিফা খাতুন।
আগামী কিছুদিন ঘুমের ভেতরে কিছু মানুষ হয়ত শেকলের ঠনঠন আওয়াজ শুনবে এমনটা নিশ্চিত বলা যায় না। সারাদিন শেকল বাজানো ছিলো ওজিফা খাতুনের একমাত্র কাজ। উত্তরবঙ্গের কঠিন শীতেও তাঁকে কেউ কাপড় চেপে ঘরে রাখতে পারেনি গত কয়েক বছর। চারকোনা চকির পায়ার সাথে বেঁধে রাখা এক প্রান্ত তাকে শেষ বয়সে গভীর আগ্রহী করে তুলেছিলো শব্দ আর চাপল্য বিষয়ে।
নতুন কাউকে দেখলেই তিনি ফিক করে হেঁসে দিতেন। সারাজীবন লাজুক আর ভীষন রকম পর্দানশীল ওজিফা খাতুনের এমন পরিবর্তনের ব্যাপারটি ছিলো বিস্ময়ের। বিদ্রোহী হয়ে ওঠার যে আজন্ম বাসনা মানুষের তাতে কি কারনে তিনি পা দিয়েছিলেন আমরা তৃতীয় পক্ষ তা অনুমান করতে চাই। অথবা ঠিক কি কারণে এতদিনের স্মৃতি তাঁর সাথে বেঈমানী করলো! কেন তিনি ভুলে যেতে চাইলেন মধ্যবর্তী সময়কে। অভিজাত ঈশ্বর তার যাদুর কাঠি ঠিক কি কারনে ওজিফা খাতুনের মাথায় বুলিয়েছিলো!
এক জীবনেই সম্পূর্ণ বিপরীত আচরন সম্পন্ন দুমুখী দুই চরিত্র তিনি ধারন করলেন তাঁর জীবনে।একদিকে গভীর সারল্যময় নারীময়তা অন্যদিকে কৈশোরিক চাপল্য!
ওজিফা খাতুনের পারিবারিক জীবনের দিকে একটু চোখ বুলিয়ে আসা যাক। ছোট সন্তান ওয়াজেদ মিয়া যেদিন বিবাহ সংক্রান্ত জটিলাতায় পড়েছিলেন। ওজিফা খাতুন তার কানকে বিশ্বাস করতে পারেন নি। এই ওয়াজেদ যে কিনা সাড়ে ন বছর অব্দি তার বুকের দুধ খেয়ে গেছে। বলে রাখা ভালো ওজিফা খাতুনের স্বামী ততদিনে ঘরে এনেছে অধিক চাঞ্চল্যময় রসবর্ষীয়া এক তরুণীকে। সময়ে অসময়ে পাশের ঘর থেকে ওজিফা খাতুন লাল চুড়ির ঝনঝন শুনতে পেতেন। কখনোবা খিল খিল হাসি তরঙ্গ হয়ে ওঠানামা করছে। সবুজ ধানের পাতার উপর বাতাস যেভাবে খেলে যায়!
আট ন বছরের ওয়াজেদ যখন ননীর মত গলে গিয়ে ঘুমের ঘোরে হাতড়ে মাকে ধরতো। তারপর খপ করে ধরে বলতো,” মা দুদ দেও”
তখন নিমপাতা বেঁটে লেপ্টে রাখা দুধের বোটা ওজিফা খাতুন তার মুখে না তুলে দিয়ে পারতেন না। এসব তার মমতা সম্পর্কীয় কথা হতে পারে কোনমতেই স্মৃতিভ্রষ্ট হবার কারন হতে পারে না।
আমরা ছিলাম ওয়াজেদ আলীর বিবাহ সম্পর্কিত আলোচনায়।
সেদিন ওয়াজেদ আলীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না সকাল থেকেই। ছেলে প্রাকৃতিক সনিয়মে বড় হয়েছে বলে ওজিফা খাতুনের দুঃশ্চিন্তার তেমন কারণ ও ছিল না। ফিরবে। কিন্তু সকাল সকাল এনায়েত সর্দার ওজিফা খাতুন কে শাসিয়ে যায়।
”পোলাটার বাপ নাই, হেতে কি মাও মইরছে?গেনার মাইয়ার লগে আরেকবার দ্যাকলে শিকলি তুইলা দিমু কয়া গেলাম।”
এটা ঠিক যে পোলার বাপের মৃত্যুর উপর ওজিফা খাতুনের কোন হাত ছিল না। অথচ এই ছেলের কল্যানেই পোলার বাপের মৃত্যুর খোঁটা তাকে শুনতে হয়।
ওজিফা খাতুনের স্বামী তার দ্বিতীয় পক্ষ ত্যাগ করেছিলেন কিছুদিনের মধ্যেই। সন্তানাদি না হওয়াই তার বাহ্যিক কারণ এমনটাই হয়ত বলবেন বুজুর্গ মহল। কিংবা কে জানে রসের ভেতর অবগাহন অপাংক্তেয় মনে হয়েছিলো কিনা ওয়াজেদের বাপের তা জানা যায় না। এটা ঠিক যে তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী ত্যাগের পর ঠিক সাড়ে চার বছর বেঁচে ছিলেন। অথচ একদিনের জন্যও ওজিফা বেগমের ঘরে যান নি।
একটা সময় থাকে যখন মানুষ নিজের প্রয়োজনের কথা ভেবেই কাছাকাছি আসে। নির্ভরতা মানুষের জন্যই নির্ধারিত উপমা। তবু কেন তিনি আর ওজিফা বেগম কে সহ্য করতে পারলেন না!
একটা ব্যাপার না বললেই না। ওজিফা খাতুনের শেষ বয়সের সৌন্দর্যের কাছে দ্বিতীয় পক্ষ ছিলো নিতান্তই নস্যি। তবু ওজিফা খাতুন স্বামী বশ করতে পারেন নি। ধরে নেয়া যেতে পারে ছলা কলার অভাব ছিলো যথেষ্ট।
কিন্তু ওদিকে দিন শেষে ওয়াজেদ আলীকে গেনার মেয়ের সাথেই আবিষ্কার করে পাড়ার মুরব্বিরা। সে মুহূর্তে এই বিদ্যুৎহীন গ্রামের সকলের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলো তা বলাই বাহুল্য। এমন টাই দেখেছিলেন ওজিফা খাতুন। এই উজ্জ্বলতা অস্বাভাবিক নয়। গ্রামের মানুষের বিনোদনের একমাত্র উপায় এসব মুখরোচক ঘটনা। এসব নিয়ে পরবর্তী কিছুদিন সারা পাড়া জটলা হওয়া অবধারিত। বর্ষীয়ারা অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনার রস মিশিয়ে গালগল্প করবেন। কতকাল থেকেই তো এমন হয়ে আসছে।
আট সন্তানের ভেতর ওয়াজেদ আলীকেই ডিগ্রী পাশ করাতে পেরেছিলেন ওজিফা খাতুন। নিজে কোরান পাশ ছিলেন বলেই লেখাপড়ার প্রতি তার ছিল পাক্ষিক দূর্বলতা। অন্য সন্তানেরা পড়তে পারেনি। কারো মস্তিষ্ক পড়ালেখার মত জটিল বিষয়ের প্রতি পরিপূর্ণ উদাসীন। ওয়াজেদ মিয়াও সেই রকমই। তবে টেনে টুনে ডিগ্রী পাশ করতে ঠিকই পেরেছিলো এটা ঠিক। সেই শিক্ষিত ছেলের এরকম আচরন তাকে ভেতরে ভেতরে কতটা বিক্ষত করেছিলো হা হয়ত অনুমান করা যায়।
ওজিফা খাতুন সেবার কথা শুনেছিলেন যা হোক। অন্য ছেলে মেয়েরা এমন কি ছেলের বৌরা অব্দি গঞ্জনা দিতে ছাড়েনি। যেন ওজিফা খাতুন-ই সেই মেয়ের ঘরে ছেলেকে পাঠিয়েছেন! এনায়েত সরদারের কথা বাদ-ই না হয় দেয়া যাক।
সে যাই হোক এই ওয়াজেদ মিয়াই কিন্তু পরবর্তীতে মাকে ছোট্ট গ্রামের ছুপড়ি থেকে শহরের আলো দেখার সুযোগ করে দিয়েছিলো। ছোট একটা এনজিওতে চাকরির সুবাদে ওয়াজেদ ভাল ছিলো।
তবে?
স্বামী সন্তান সংসার তাকে আঘাত দিয়েছে ঠিক কিন্তু এর চেয়ে ভারী আঘাত আরো মানুষেও পায়। তাদের স্মৃতিভ্রষ্ট হওয়া হয় না সারা জীবনেও।
অথবা তাদের কাউকে তো শেষ বয়সে গয়নার পরিবর্তে শেকল প্রাপ্তি স্বীকার করতে হয় না।
প্রথম প্রথম ওজিফা খাতুনকে ঘরের ভেতর রাখতো বাড়ির মানুষজন। বাইরে থাকতো শেকল তোলা। দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে এর মধ্যে দু’একবার ভীষন চালাকির পরিচয় দিয়েছেন তিনি। পালিয়ে গিয়েছেন।
তার বিদ্রোহী হয়ে ওঠা ছিলো সত্যিকারের বিস্ময়। দিন দিন তার শরীরে শেকলের দৈর্ঘ্য বাড়ছিলো। আর শেকল নাড়িয়ে ঠনঠন শব্দের উৎস আকার পর্যবেক্ষন করাই যেন তার শেষ কিছুদিনের খেলা! এই যে তার অবশ্য বন্দীত্ব সত্যি বলতে কি তিনি এ ব্যাপারে কখনো অভিযোগ পর্যন্ত করেন নি।
পাগল দর্শনীয় বস্তু সে হিসেবে তার মূ্ল্য হয়ত বেড়েছিলো বলেই দর্শনার্থীর সংখ্যাও তাই বেড়েছিলো দিনদিন। নতুন বা পুরোনো সকলেই তার কাছে সমান। কাউকে দেখলেই তিনি খুব পরিচিতের মত খিলখিল করে হেসে উঠতেন। আর পরমুহূর্তেই মুখ লুকাতে যেতেন লজ্জিতা তরুনীর মত!
ওজিফা খাতুনের জাগতিক সমস্ত ক্রিয়া শেষ হয়েছে। শুধু ওয়াজেদ আলীর বাড়ি পৌছানোর অপেক্ষা। ততক্ষন স্থানে স্থানে জটলা বাড়ছিলো আর গালগল্পের ডালপালা তাদের হাত প্রসারিত করছিলো অনায়াসে।
ওজিফা খাতুনের মৃত্যু একটি বড় জমায়েতের জন্ম দিয়েছে তা স্বীকার করতেই হয়!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত