| 25 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

রবীন্দ্রনাথের বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

 

রবীন্দ্রনাথের ‘চারিত্রপূজা’য় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে দুটি প্রবন্ধ আছে। দুটি প্রবন্ধের নামই ‘বিদ্যাসাগরচরিত’। প্রথম প্রবন্ধের রচনাকাল ১৩০২, দ্বিতীয়টির ১৩০৫ সাল। প্রথমটি আকারে দীর্ঘ দ্বিতীয়ের তুলনায়। তবে দুটি প্রবন্ধের মূল সুর এক। বাংলাদেশে বিদ্যাসাগরের একাকীত্বের উপর আলোকপাত করতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। প্রথম প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘সেইজন্য বঙ্গদেশে বিদ্যাসাগর একক ছিলেন। এখানে যেন তাঁহার স্বজাতিসোদর কেহ ছিল না। এ-দেশে তিনি তাঁহার সমযোগ্য সহযোগীর অভাবে আমৃত্যুকাল নির্বাসন ভোগ করিয়া গিয়াছেন।’ দ্বিতীয় প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরের সঙ্গে বাঙালির ‘জাতিগত সুমহান প্রভেদে’র কথা বলেছেন। সাধারণ বাঙালির চে্যে বিদ্যাসাগরের একটা অধিক জীবন ছিল, তিনি শুধু ‘দ্বিজ’ ছিলেন না, ‘তিনি দ্বিগুণ জীবিত ছিলেন’ । এই দ্বিগুণ জীবিত থাকার রহস্যটি কি? রবীন্দ্রনাথ বলেছেন বিদ্যাসাগরের একটি সচল ‘মনোজীবন’ ছিল, যে মনোজীবন সাধারণ বাঙালির মধ্যে পরিণতি লাভ করতে পারে নি।

আদ্যোপান্ত বাঙালি বিদ্যাসাগরের সঙ্গে অন্যান্য বাঙালির ‘সুমহান’ পার্থক্য বোঝানোর জন্য রবীন্দ্রনাথ ৬টি বিশেষণে বাঙালির স্বভাববৈশিষ্ট্য সূত্রবদ্ধ করেছেন: ‘দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক’। এই বিশেষণে বিভূষিত বাঙালি গতানুগতিক, বাঁধাপথের পথিক। বিদ্যাসাগর কিন্তু গতানুগতিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র, সচেতন, পারমার্থিক। পারমার্থিক বলতে রবীন্দ্রনাথ সেই মানুষকে বুঝিয়েছেন যিনি তাঁর সচল মনের দ্বারা জীবিত থাকেন, -‘স জীবতি মনো যস্য মননেন হি জীবতি’। তাহলে কি অধিকাংশ বাঙালির মন নামক বস্তুটি ছিল না? না, তা নয় । মন একটা ছিল, কিন্তু সে মন সক্রিয় ও সজীব নয়, সে মন শাস্ত্র ও লোকাচারচালিত মন, সাময়িকভাবে কৃত্রিম গতিপ্রাপ্ত নির্জীব মন। সে মনে জগত এসে কোলাকুলি করে না, সে মনে নবনবোন্মেষশালিনী বুদ্ধির বিচ্ছুরণ ঘটে না, পর্বতপ্রমাণ প্রতিকূলতার সম্মুখে দাঁড়িয়ে সে মন বলতে পারে না-‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তো একলা চলো রে’।
বিদ্যাসাগরের জীবনে আমরা দেখি এই গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। বিদ্যাসাগর গতানুগতিক হলে ঘরের খেয়ে পরের মোষ তাড়ানোর ব্রত গ্রহণ করতেন না। যে পাণ্ডিত্য তিনি অধ্যবসায়ের দ্বারা আয়ত্ত করেছিলেন, তার সাহায্যে অধ্যাপনা করে, ইংরেজ কর্তাব্যক্তিদের তোয়াজ করে, বিদ্যালয়ের পাঠ্যগ্রন্থ রচনা ও বিক্রয় করে সম্মান-প্রতিপত্তি লাভের সঙ্গে আর্থিক দিক থেকেও সঙ্গতিসম্পন্ন হতেন এবং ‘সুখী’ জীবন যাপন করতে পারতেন। তা না করে গতানুগতিকতা বর্জন করে তিনি বরণ করে নিয়েছিলেন দুঃখকে। ঠিকই বলেছেন রবীন্দ্রনাথ, ‘তিনি সুখী ছিলেন না। তিনি নিজের মধ্যে যে এক অকৃত্রিম মনুয্যত্ব সর্বদাই অনুভব করিতেন, চারিদিকের জনমণ্ডলীর মধ্যে তাহার আভাস দেখিতে পান নাই’।

গতানুগতিক সুখের প্রত্যাশী হলে চতুর্দিকের নিঃসাড়তার পাযাণখণ্ডে আহত-প্রতিহত হয়ে নারী স্বাধীনতা ও নারী শিক্ষা বিস্তারের জন্য, বাল্যবিবাহ রোধের জন্য, বিধবাবিবাহ প্রচলনের জন্য এত ঝুঁকি তিনি নিতে পারতেন না । নিঃসাড় বঙ্গ সমাজের বিরুদ্ধে একপ্রকার যুদ্ধ ঘোযণা করেছিলেন তিনি, হয়ে উঠেছেলেন সেই যুদ্ধের বিদ্রোহী সৈনিক । অথচ সে বিদ্রোহীর কোন সহযোগী সৈন্য ছিলনা।
পরমার্থভাবুক, সজীব মনের মানুষেরাই হতে পারেন সাহসী। জীবন-মৃত্যু তাঁদের পায়ের ভৃত্য। দুরন্ত সাহসী না হলে বংশগৌরবহীন, বীরসিংহ নামক ধাবধাড়া গ্রাম থেকে আগত, দরিদ্র এক ব্রাহ্মণ সন্তানের পক্ষে আপাদমস্তক প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সম্ভব হত না। ঘরে-বাইরে সংগ্রাম করতে হয়েছে তাঁকে। একদিকে ছিল ‘অন্নপায়ী বঙ্গবাসী স্তন্যপায়ী জীবের’ অচল সমাজের প্রতিকূলতা, অন্যদিকে ছিল বিদেশি শাসকের দৃষ্টিভঙ্গিগত প্রতিকূলতা। সাহস ছিল বলেই খর্বকায় এই মানুষটি সর্বদাই অটল থাকতে পেরেছেন আপন সিদ্ধান্তে। স্ত্রীবিয়োগের পরে তাঁর বেদান্ত-অধ্যাপক বালিকাবধূকে ঘরে আনায় বিদ্যাসাগর তাঁকে বলতে দ্বিধা করেন নি, ‘এ ভিটায় আর কখনও জলস্পর্শ করিব না’। সাহস ছিল বলেই সভ্যতাভিমানী কার সাহেবকে টেবিলের উপর চটিজুতাসহ পা তুলে রেখে শিক্ষা দিয়েছিলেন। উন্মার্গগামী আপন পুত্রকেও ক্ষমা করেন নি তিনি। সমকালে যখন তাঁর স্বজাতির মানুষ প্রবল সাহেবি অথবা প্রচুর নবাবি দেখিয়ে সম্মানলাভের চেষ্টা করেছেন, তখন বিদ্যাসাগর অশনবসনে স্বকীয়তা বিসর্জন দেন নি।

আজ থেকে একশো বছর আগে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে প্রতিতুলনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বাঙালির যে স্বভাববৈশিষ্ট্যের কথা বলেছিলেন তা পড়ে এখনও শিহরিত হতে হয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‌আমরা আরম্ভ করি কিন্তু শেষ করি না; আড়ম্বর করি কিন্তু কাজ করি না; যা অনুষ্ঠান করি তা বিশ্বাস করি না; যা বিশ্বাস করি তা পালন করি না; অনেক বাক্য রচনা করতে পারি কিন্তু তিল পরিমাণ আত্মত্যাগ করতে পারি না; অহংকার দেখিয়ে পরিতৃপ্ত থাকলেও যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না; আমরা সকল কাজে পরের প্রত্যাশা করি অথচ পরের ত্রুটি নিয়ে আকাশ বিদীর্ণ করি। অননুকরণীয় ভঙ্গিতে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিকস…।’ রবীন্দ্রনাথ ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা ছিলেন কিনা একথা ভেবেই শিহরণ হয়। একশো বছর আগের কথা, অথচ এই কথার দর্পণে এখনকার আমাদেরও আমরা দেখতে পাচ্ছি। দেখছি সেই ট্রাডিশন চলে আসছে। সেই ক্ষুদ্রতা ও নীচতা, সেই বাগাড়ম্বর, চায়ের দোকানে তর্কের তুফান, সেই পূর্বপুরুষের গর্বমুখরতা, সেই পরের চক্ষে ধুলিনিক্ষেপ করে পলিটিকস, অশনবসনে সেই পরানুকরণ, নীলবর্ণ শৃগালসদৃশ আচরণ, সেই নিজের বাকচাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হয়ে ওঠা। অবশ্য এর সঙ্গে যুক্ত একটি নতুন মাত্রা। আমরা হয়ে উঠেছি প্রবলভাবে রাজনীতি সচেতন। অতীতে ধর্মীয় সংস্কারের নিগড়ে বদ্ধ ছিলাম আমরা। এখন বদ্ধ রাজনৈতিক সংস্কারে। আমরা সকলে দলবদ্ধ। কেউ সিপিএম, কেউ কংগ্রেস, কেউ তৃণমূল, কেউ বিজেপি। দল যেভাবে ভাবান, আমরা সেভাবে ভাবি। আমাদের স্বচ্ছ, স্বাধীন, নিরপেক্ষ দৃষ্টি নেই। ধর্মকে কার্ল মার্কস আফিম বলেছিলেন। এ যুগে রাজনীতি সেই আফিম। বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙলে আফিমখোর আমরা যখন ন্যাকা কান্না কাঁদি, তখন মেলোড্রামায় নতুন দৃশ্য যোজনা হয়।

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত